ইঞ্জিনিয়ার যখন ব্যাংকার

ইঞ্জিনিয়ার যখন ব্যাংকার

ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে যখন ব্যাংকে চাকরী পেলাম তখন নিজেকে নিয়ে আমি গর্ববোধ করতে শুরু করি। আমিই একমাত্র সফল ব্যক্তি যে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে ব্যাংকে জব পেয়েছে। যে করে হোক চাকরী একটা জুটিয়েছি এখন আমি গার্লফ্রেন্ডের বাবার সামনে নিজেকে একজন সুপুরুষ হিসাবে দাবি করতে পারি। এবার যদি চাকরীটা না পেতাম তাহলে আমি চাকরী পেতে পেতে আমার গার্লফ্রেন্ড অন্যের হাত ধরে ঠিকই বিয়ে করে নিতো। আর আমি ততদিনে ইঞ্জিনিয়ারিং সার্টিফিকেট গলায় ঝুলিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতাম।

বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারদের এই অবস্থা দেখলে হয়তো চীন, জাপানিজরা এতো দামি দামি মেশিন ও যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে পাঠাতো না। কারণ যে দেশের ইঞ্জিনিয়াররা বিল্ডিং বানাতে রডের পরিবর্তে বাঁশ দেয়, এতো উন্নত ও বুদ্ধিদীপ্ত দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে অযথা টাকা ও সময় নষ্ট করার কোনো প্রয়োজন মনে করি না।

স্যার সেদিন ঠিকই বলেছিলো- তোদের মতো ডিব্বা ইঞ্জিনিয়ার দেশ ও জাতির জন্য অন্ধকার ভবিষ্যৎ। তোদের স্বভাব “কাজের বেলা দুই, খাই আর শুই” আমরাও স্যারের কথা হাসি মুখে সাদরে গ্রহণ করিলাম। তাই আজ আমাদের এই অবস্থা। আসলে আমাদের কোন দোষ নেই, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটাই এমন। যাই হোক চার বছরে আর কিছু পারি আর না পারি নিজের নামের পাশে তো একটা বিশেষণ যোগ হয়েছে। আগে সবাই ডাকতো মিরাইজ্জা। আর এখন ডাকে ইঞ্জিনিয়ার মিরাজ সাহেব। আহা এমন সুমুদুর কন্ঠে কেউ আমায় ডাকে নি কোনোদিন। সাহেব যুক্ত হয়েছে ব্যাংকে চাকরী পাওয়ার পর থেকে।

এক্ষেত্রে আমার যোগ্যতাও আছে বটে। মানে আমি স্টাডি থাকা অবস্থায় একটা ইন্টারন্যাশানাল কোম্পানিতে একাউন্টারস হিসেবে জব করেছি বছর খানেক। সে সুবাদে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সহজে ব্যাংকের চাকরীটা পেয়ে যাই। My attitude, commitment, smile, toking, motivetional spiking খুব সহজে মানুষকে প্রভাবিত করতো। চারিদিকে আমার সুনাম ছড়িয়ে যেতে লাগল। পরিচিত সবাই আমার সাথে ভালো ব্যবহার করতে শুরু করলো। অপরিচিত মানুষরা আমার সাথে এসে পরিচিত হতে লাগল। রাস্তায় চলার সময় সুন্দরী মেয়েরা আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে থাকে সেটা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারি।
সেদিনের ঘটনা গাড়িতে করে অফিসে যাচ্ছিলাম।

গাড়ির বিপরীত পাশে থাকা একটি মেয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সাথে মেয়ের মা ও একইরকম ভাবে তাকিয়ে রইল। লজ্জায় আমি মরি মরি অবস্থা। মেয়ের চোখে মুখে আমি স্পষ্ট প্রেমের গ্রীন সিগন্যাল দেখতে পেলাম। কিন্তু মা কেনো তাকালো সেটা বুঝলাম না। mস্কুলকলেজ জীবনে যেসব মেয়েদের পিছে ঘুরে ঘুরে আমি কোনো পাত্তা পেতাম না সেসব মেয়েরা এখন আমাকে পটানোর ধান্দায় ঘুরে। সেদিন মেলায় গেলাম। সব ছেলে মেয়েরা জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে। আমি তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরা অবস্থায় তারা আমাকে চোখ মারে।

আজকাল নিজেকে গিয়াস উদ্দিন আল তাহেরী মনে হচ্ছে। ইদানিং ফেসবুকে মামাতো বোনের সাথে প্রেমের গল্প লিখে আমি রাতারাতি সেলিব্রেটি হয়ে গেলাম। ম্যাসেঞ্জারে মেয়েরা আমাকে নিত্যনতুন প্রেমের অফার দেয়। অথচ আমি তাদের প্রপোজাল একসেপ্ট করার সময়ই পাই না। যে গার্লফ্রেন্ড প্রতিদিন আমাকে ব্রেকআপ করার আল্টিমেটাম দিতো, এখন সে আমার সাথে কি মিষ্টি আচরণ করে। বাবু খাইছো, ঘুমাইছো। কতো কেয়ার করে, কতো ভালোবাসে। অথচ আমি তার সাথে মিট করার সময়ই পাই না।

প্রতিদিন মেয়ের বাবারা বাড়িতে আমার জন্য বিয়ের সমন্ধ নিয়ে আসে। আমি তাদের সবাই কে রিজেক্ট করে দেই। সবার সাথে দেখা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি খুব ব্যস্ত মানুষ। এদিকে বাবা মা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। গার্লফ্রেন্ড তো বিয়ের করার জন্য উতলা হয়ে আছে। যে ভাই বোন গুলার অত্যাচারে আমার ছাত্রজীবন ত্যানাত্যানা হয়ে গেছে। আজ তারা আমাকে সংবর্ধনা জানাচ্ছে। প্রথম বেতন পেলাম। ভাই আবদার করেছে তাদের শপিং করে দিতে। আমি তাদের আচরনে বিমোহিত। উৎপুল্ল মনে তাদের ২০ হাজারর টাকা দিয়ে দিলাম।

আমার ভাই বোন গুলা হচ্ছে একেকটা বজ্জাতের হাড্ডি। যখনই একটা প্রেম করতাম কিংবা মোবাইল এ কথা বলতাম তখনই তারা বাবা মাকে প্যাঁচ লাগিয়ে আমায় বাঁশ দিতো। আমার কলেজের খাতা, কলম, জ্যামিতি বক্স, ক্যালকুলেটর, ব্যাগ রুম থেকে চুরি করে নিয়ে যেতো। তাদের অত্যাচারে পকেটে টাকা রাখতে পারতাম না। এমনকি তারা আমার জিনিস ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি লেগে যেতো। আমার জিনিস চুরি করে আমাকেই বিচারক হিসাবে ডাকা হতো। কি হাস্যকর ব্যাপারটা। অতঃপর দুইটাকে কান ধরে উঠবস করানো হতো।

এলাকার এক আংকেল আমার কুকর্মের জন্য সারাজীবন আমাকে অপদার্থ বলে গালি দিতো। ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে আমি ব্যাংকার হওয়ার পর আংকেল আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। স্কুল জীবনে পাশের বাসার একটা মেয়েকে প্রেমের অফার দেওয়াই আমাকে জুতা নিয়ে দৌঁড়ায় ছিলো। তার জন্য আমার অবুঝ প্রেমটা স্কুলজীবনে জলাঞ্জলী দিতে হলো। অথচ আমি ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পর মেয়েটা আমাকে প্রতিদিন ডিস্টার্ব করে। সে কি বুঝে না তার নষ্টালজিক আচরণে আমি বিরক্তবোধ করি। অতঃপর বাসার নামটা আমার চেঞ্জ করে আমার নামে রাখা হলো।

গতকাল গার্লফ্রেন্ডের জোরাজুরিতে ডেটিং এ গেলাম। যে মেয়ে আমাকে কোনোদিন টাচ করা তো দূরে থাক হাতটা পর্যন্ত ধরতে দিতো না, আর সেই মেয়ে কিনা আমাকে সাড়ে চার ঘন্টা জড়িয়ে ধরেছিলো। তার উষ্ণ পরশে আমি ক্ষনে ক্ষনে শিহরিত হচ্ছি। মনে হচ্ছে আমি সর্গের আকাশে বাসতেছি। আমি তার চোখের সামনে আসা চুল কানে গুজে দিয়ে বললাম: বাসায় যাবে না জাহানারা। প্রত্যত্তুরে জাহানারা আমার বুকে মুখ লুকিয়ে বলল: বিয়ে করবে কবে? সহসা আমি শুধালাম: দেরী হয়ে যাচ্ছে চলো বাসায় ফিরে যায়। জাহানারা লাজুক লাজুক চেহেরায় আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল: কতোদিন পর তোমায় কাছে পেয়েছি, প্লিজ আরেকটু থাকি না মিরাজ।

১০টা না ৫টা না আমার একটামাত্র বয়ফ্রেন্ড তাও আবার ইঞ্জিনিয়ার। তাকে এত ভালোবাসি যে তার বুকে মাথা রেখে আমি মরে যেতেও রাজি। তোমার পাশে থাকলে পৃথিবীটা হাসে, দুঃখ কষ্টরা পায় ছুটি। গার্লফ্রেন্ডের মুখে এমণ কথা শুনে আমি খুশিতে আত্নহারা। মূহুর্তেই আমার মনকে প্রাণদিত করলো জাহানারা। এতোদিনে তাহলে আমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াটা স্বার্থক হয়েছে। স্যার সেদিন ঠিকই বলেছিলো- তোদের মতো ডিব্বা ইঞ্জিনিয়ার দেশে ও জাতির জন্য অন্ধকার ভবিষ্যৎ। কথাটি হাসির ছলে উড়িয়ে দিলেও আজ সেটার বাস্তবতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত