আমি বের হয়ে নিচে নামতেই নূরীর সাথে চোখাচোখি হলো। আমি তাড়াতাড়ি পা চালাতে লাগলাম। কিন্তু নূরী ডাকে থেমে গেলাম। এই মেয়েটাকে আমার একদম সহ্য হয় না। কেননা এই মেয়েটা আমাকে ভালোবাসে। তবে এখন পর্যন্ত বলেনি। কিন্তু ওর মনের কথা আমি জানি। আমি সবার মনের কথা বুঝতে পারি। মাঝেমাঝে এই অদ্ভুত শক্তিটাকে আমি উপভোগ করি। আর মাঝেমাঝে প্রচন্ড বিরক্ত হই। যেমনটা নূরী ও তার বাবা আফজাল সাহেবের ব্যাপারে হই। পাঁচ তলা ভবন বিশিষ্ট এই বাড়িটার মালিক আফজাল সাহেবের একমাত্র মেয়ে নূরী। মেয়ের বিয়ে কোনো সুপাত্রে হাতে দিয়ে তিনি এই বাড়িতে মেয়ে সহ তার স্বামীকে ঘর জামাই হিসেবে রাখতে চান। এই ব্যাপারটা আমার একদম ভালো লাগেনি।
ঘরজামাই থাকার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার। অন্যথায় নূরীকে দেখে যেকোনো পুরুষের মধ্যে ভালোলাগা কাজ করতে বাধ্য। যেমন সুশীল তেমনই গুনবতী। সকাল সকাল ছাদে বসে গানের অনুশীলন আহকরে। দুয়েকবার আমি শুনেছিলাম। খুব সুরেলা কণ্ঠ। একবার শুনলে বারবার শুনতে মন চায়। রূপেও নূরী প্রশংসনীয়। দুধে আলতা গায়ের রং। কাজল কালো চোখ। রেশমি কালো লম্বা চুল। একবার দেখলে চোখদুটো স্থির হয়ে যায়। রান্নাতেও পটু। গতবার শবেবরাত উপলক্ষে আমার বাসায় এসে গরুর মাংস ও রুটি দিয়েছিল। সেই রান্নার স্বাদ যেন এখনো মুখে লেগে আছে। সেদিন তার কাজল কালো চোখের নেশায় নেশাগ্রস্ত ছিলাম বেশ কয়েকদিন।
– কি হলো শুনতে পাচ্ছেন না?
– তাড়ায় ছিলাম তাই খেয়াল করিনি। কিছু বলবেন?
– আপনি এই মাসের ভাড়া এখনো দেননি।
নূরী মুখে এটা বললেও মনে মনে বলল, “আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছেন। তা তো হতে দিবো না।” উফ কিস অসহ্য! এরচেয়ে মনের ভাষা পড়তে না পারাই উত্তম হতো। কেন যে এই রহস্যময় শক্তি আমার মাঝে এলো! নূরীর সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। মেয়েটার ফাঁদে পড়ে ঘর জামাই থাকতে চাই না। আমি বললাম, “এই সপ্তাহেই দিয়ে দিব।” নূরী মনে মনে মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “আমার মনটা তো কেড়ে নিয়েছেন। নিজেরটা কবে দিবেন?” আমি আর দাঁড়ালাম না। তাড়াতাড়ি হাঁটা ধরলাম। একদিন বাড়ির প্রধান দরজার সামনে দুধওয়ালার অপেক্ষা করতে লাগলাম। এমন সময় নূরীও এলো।
– দুধ নিতে এসেছেন বুঝি?
– হ্যাঁ।
– আপনি নাকি নিষেধ করে দিয়েছিলেন।
– হ্যাঁ, করেছিলাম। তবে আজ থেকে আবার নিব।
– ভালো সিদ্ধান্ত। প্রতিদিন দুধ খেলে শরীরে পুষ্টি হবে।
আমি মাথা নাড়িয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলাম। আজ এত দেরি করছে যে অসহ্য লাগছে। তারওপর নূরী নানান প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। অফিসের কি অবস্থা, বাবা মায়ের কি খবর, এখানে থাকতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা ব্লা ব্লা ব্লা। নিচতলায় আসতেই আফজাল সাহেবের সাথে দেখা হলো। নূরীর বিয়ের ব্যাপারে আমার সাথে কথা বলতে এসেছেন। নূরী তার বাবাকে বলেছে সে আমাকে পছন্দ করে। তার মনের অনুভূতি পড়ার পর আমার মনের মধ্যে উথালপাথাল শুরু হয়ে গেছে। নূরী যতোই সুন্দরী হোক না কেন ঘর জামাই আমি হচ্ছি না।
– তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।
– আজ তো আমার তাড়া আছে। অন্য কোনোদিন
– বেশি না দুই মিনিট লাগবে।
– অন্য কোনোদিন।
আমি আর দাঁড়ালাম না। বেয়াদবি হলো ব্যাপারটা। তবে কিছু করার নেই। ঘর জামাই হবো না। কয়েকদিন ধরে আমি লুকোচুরি খেলছি। অফিসে যাওয়ার সময় ও বাড়িতে আসার সময় আমি বেশ সতর্কতা অবলম্বন করি। যাতে নূরী কিংবা তার বাবার সম্মুখীন না হতে হয়। এভাবে একটা সপ্তাহ পালিয়ে বেড়াতে পেরেছি। কিন্তু শুক্রবার ছাদে কাপড় শুকাতে দেওয়ার সময় নূরীর হাতে ধরা পড়ে গেলাম। তার মনে আজ ভীষণ দুঃখ। চোখ দুটোতে ছলছল ভাব। কারণটা বোধগম্য হলো না। আমাকে দেখতেই নূরী ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলল, “আপনি আনিকাকে ভালোবাসেন সেটা আগে বললেই পারতেন।” আমার টনক নড়ে উঠলো। আনিকা আমার অফিস কলিগ। সামনের বাড়িতেই থাকে। গত সপ্তাহে বেশ কয়েকবার ওর সাথে যাতায়াত করেছি। হয়তো ব্যাপারটা নূরী লক্ষ্য করেছে।
– কি হলো চুপ কেন? দিনের বেলাতেও আনিকাকে নিয়ে স্বপ্নে বিভোর বুঝি?
– কি বলছেন? এসব কে বলেছে আপনাকে?
– কেউ বলতে হবে কেন? বেশ কিছুদিন ধরে ওর সাথে অফিসে যাতায়াত করছেন। ছাদে গিয়ে ওর সাথে গল্প গুজবও করছেন। তা কি আমার চোখে পড়ে না ভাবছেন? বুঝলাম যে ব্যাপারটা অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। এবার গাল ফুলিয়ে নূরী বলল, “আপনি ইচ্ছে করেই আমার মন নিয়ে খেলছেন, তাই না?”
– মানে? কিসের মন? কিসের খেলা?
– সাধু সাজবেন না। বিশ বসন্ত পার করা একটা মেয়ে প্রতিনিয়ত আপনার খোঁজ খবর কেন রাখে তা কি আপনি বুঝেন না? আর সেদিন বাবার সাথে ওরকম ব্যবহার করেছিলেন কেন? আপনি অন্য কাউকে পছন্দ করেন সেটা আমাকে বললেই হতো। জোর করে কারও জীবনসঙ্গী হওয়া যায় না। নূরীর চোখ দুটোতে জল ছলছল করছে। ফলে কাজল লেপ্টে যাচ্ছে। ওর মুখের শব্দ গুলো কান্নার মাঝে একে অপরের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি নিশ্চুপ হয়ে শুধু শুনে যাচ্ছি। কিছু বলার মতো শব্দ আমার মস্তিষ্কে আসছে না।
– আনিকা খুব ভালো মেয়ে। শিক্ষাদীক্ষাও ভালো। আপনার সাথে মানাবে। তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেরে ফেলুন। নূরী তার চোখের জল লুকাতে দ্রুত প্রস্থান করলো। রাতে খাবার শেষে শুয়ে রইলাম। মনটা কেমন যেন অস্থির অস্থির করছে। এমন সময় নিজের মনই আমাকে বলে উঠলো, “তুমি স্বার্থপর। শুধু নিজের কথাই ভাবো।” যখন আমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি তখন আমি আমার সাথেই কথা বলি। যাকে আমি আত্মকথন নাম দিয়েছি। আমি মনকে বললাম, “স্বার্থপরের কি করলাম?”
– তুমি ঘর জামাই না হওয়ার জন্য নূরী থেকে দূরে থাকছো তাই তো?
– ঘর জামাই হওয়া মানে শ্বশুরবাড়ি দাসত্ব গ্রহণ করা। নিজের আত্মসম্মানবোধকে মাটি চাপা দেওয়া।
– কখনো কি নূরীর বাবার মনোভাব পড়ার চেষ্টা করেছো?
মা হারা একমাত্র মেয়েকে কোনো বাবাই কি চোখের আড়াল করতে চাইবে? তাছাড়া তার চলে যাওয়ার পর এই সম্পত্তি কার হবে? কারও নজরদারি না থাকলে অন্য কেউ ভোগ করবে। তার দৃষ্টিকোণ থেকে কি সে ভুল? মনের যুক্তির সামনে আমি চুপ হয়ে গেলাম। মন আরও বলল, “তাছাড়া তুমি নূরীকে ভালোবাসো। তবে কেন অস্বীকার করছো? ঘরজামাই হওয়ার ভয়ে?”
– আমি নূরীকে ভালোবাসি না।
– তুমি সবসময়ই লুকোচুরি করো। নূরীকে ভালোবাসো। নয়তো মনের মধ্যে ওর রূপের প্রসংশা করতে না, তার রান্নার স্বাদ তোমার মনে আজও থাকতো না, তার চোখের পানি তোমার মনকে কষ্ট দিতো না। তুমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে না। আমি চুপচাপ ঘুমানোর চেষ্টা শুরু করলাম।
মেয়ের চোখের পানি প্রতিটি বাবাকে ব্যথিত করে। যা আফজাল সাহেবের চেহারায় স্পষ্ট ফুটে আছে। হয়তো নূরী সারারাত কেঁদে কেঁদে কাটিয়েছে। মেয়ের কান্নার শব্দ পিতার মনকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। তাই তো আমাকে দেখতেই তিনি বেশ কর্কশ ভাষায় বললেন, “তুমি এই সপ্তাহেই বাসা ছেড়ে দিবে। নয়তো তোমার সব জিনিসপত্র আমি বাইরে ফেলে দিবো।” কথাটা বলেই তিনি হনহনিয়ে হেঁটে চলে গেলেন। আমি চুপচাপ অফিসে চলে গেলাম। তবে বিকালেই চলে এলাম। তারপর থেকে আমি ছাদেই বসে আছি। নূরীর অপেক্ষায় আছি। কাপড়চোপড় যেহেতু আছে, সে অবশ্যই আসবে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে সূর্যটা যখন পশ্চিম আকাশের বুকে ঢলে পড়েছে ঠিক তখনই নূরী ছাদে এসেছে। আমাকে দেখার সাথেসাথেই সে বিপরীত দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আমি ডাক দিয়ে বললাম, “কিছু কথা ছিল।” বেশ কর্কশ ভাষায় ধপাস করে বলল‚ “বলুন।”
– আপনার বাবা আমকে এই সপ্তাহের মধ্যেই বাসা ছাড়তে বলেছে। যাওয়ার আগে কিছু ব্যাপার পরিষ্কার করে যেতে চাই। নূরীর মনটা এক বিকট চিত্কার দিয়ে কেঁদে উঠলো। এই কান্নার কোনো শব্দ নেই। কিন্তু কান্নার ভার আমার মন নিতে পারছে না।
– কি বলতে চান, বলুন।
– আনিকা আমার অফিসের কলিগ। গত সপ্তাহে দুজনে এক প্রজেক্টে কাজ করছিলাম। তাই কিছুদিন একই সাথে যাতায়াত করছিলাম। আর ওর সাথে গল্প গুজব নয় প্রজেক্ট নিয়েই কথা বলেছিলাম। এর বেশি আমাদের মধ্যে কিছুই নেই। যাওয়ার আগে সত্যটা বলা উচিত তাই বললাম। নূরীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি ছাদ থেকে নেমে এলাম। পরেরদিন বিকালে ছাদে এলাম। নূরীও আছে। আমাকে দেখে নূরী বলল, “আপনি তো ছদে কাপড় শুকাতে দেননি। তবে এখন ছাদে এলেন কেন?”
– রূপসীর রূপ দর্শন করতে।
লজ্জায় নূরীর চেহারা লাল বর্ণ ধারণ করলো। কিছুটা দূরত্ব অবলম্বন করে আমার পাশে নূরী দাঁড়ালো। লজ্জা মুকজে নীচু স্বরে বলল, “আপনার বাবা মাকে আমার বাবার সাথে দেখা করতে বলুন। তাহলে এই দর্শন সবসময়ই করতে পারবেন।”
– সেদিনের ওমন ব্যবহারের পরেও কি আংকেল রাজি হবেন?
– এমন ভদ্র ছেলে হাতে পেয়েও কোনো বাবা ছাড়তে চাইবেন না। তাছাড়া আমার বাবা আমাকে খুব ভালোবাসেন।
“ঠিক আছে। বাবা মাকে আসতে বলব। তবে আমি কিন্তু ঘরজামাই থাকবো না।” কথাটা বলেই আমি ছাদ থেকে নামার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। নূরীর খিলখিল হাসি শুনতে পাচ্ছি। আমার মনটাও হাসছে। খুব ভালো লাগছে আজ। এতদিন মনের মধ্যে একটা পাথর জমে ছিল। আজ নিজেকে হালকা হালকা লাগছে।
কিছুদিন পর বাবা মা এসে বিয়ের কথাবার্তা পাকাপোক্ত করলেন। এক সপ্তাহ পরেই বিয়ে। এই সপ্তাহ জুড়ে নূরীকে চোখেই পড়েনি। প্রতিনিয়ত ওকে দেখার জন্য ছটফট করেছি। কিন্তু ওর সাক্ষাৎ পাইনি। এক বাড়িতে থেকেও লজ্জায় খবর নিতে পারিনি। লোকে ভাববে বিয়ের আগেই ছেলে বউ পাগল হয়ে গেছি। অবশেষে বিয়েটা হয়ে গেল। বিয়ের পরেই দুঃসংবাদটা পেলাম।
আমাকে ঘরজামাই হিসেবেই থাকতে হচ্ছে। আর এই এতে বাবা মায়ের সম্মতিও আছে। একরাশ বেদনা নিয়ে আমি বাসরঘরে ঢুকলাম। আমার গোমরামুখ দেখে নূরী খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। আর বলল, “আসুন আসুন। আমার ঘরজামাই পাখিটা।” আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না। তবে নূরীর মায়াভরা চেহারা দেখে আমি অন্য ভূবনে হারিয়ে যেতে লাগলাম। কি অপরূপ সৌন্দর্য! কি মায়াভরা চাহনি! কি রূপসী হাসি! এই মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসি।