হাস্যোজ্জ্বল তারা

হাস্যোজ্জ্বল তারা

হাশেমপুরে এক অদ্ভুত নবজাতকের জন্ম হয়েছে। যার গায়ের রঙ কুচকুচে কালো, মাথাটা প্রকাণ্ড বিরাট আকারের, চোখগুলো কুতকুতে। গায়ের চামড়া কুঁচকে রীতিমতো বুড়ো! যেখানে একটা নবজাতককে দেখলেই যে কেউ কোলে নেওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠে, সেখানে এই নবজাতককে প্রথম দেখলেই কারো বুক ধ্বক করে উঠে। কোলে তুলে নেওয়া তো দূরের কথা! গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ ছুটে আসছে এই নবজাতককে একনজর দেখার জন্য!

– এমন অদ্ভুত বাইচ্চা তো বাপের জন্মেও দেহি নাই। কইত্তে পাইছো এটারে?
– শ্যাষম্যাশ পেটে ধইরা এমন জন্তু জন্ম দিলি মালা? এটা তো অভিশাপের ফল।
– এ নিশ্চয়ই দেবতা হবে। মালার ঘরে স্বয়ং দেবতা নাইমা আসছে। পূজা দিতে হবে।
– এইগুলা সব তর পাপের ফল। বুঝছোত মালা?
– কলিযুগের লক্ষণ। নাইলে মাইনষের পেটে এমন জন্তু হয়?

মালা কাঁদতে কাঁদতে আঁচল দিয়ে তার সদ্যোজাত মেয়েকে লোকজনের কাছ থেকে আড়াল করতে চায়। তার অবুঝ মন বলে উঠে, তার এই স্নেহের আঁচলই পারে তার নিষ্পাপ শিশুটিকে এসব লোকের কুকথা থেকে রক্ষা করতে। মালা চুপ করে থাকে, কোনকিছুর জবাব দেওয়ার ক্ষমতা যেন সেও হারিয়ে ফেলেছে। সে কি ভেবেছিল তার গর্ভে এমন সন্তান জন্ম নিবে? মালার স্বামী একজন ভবঘুরে। যে মাসের একদিন সংসারের দায়িত্ব পালন করলেই হাঁপিয়ে যায়। বাকি উনত্রিশ দিন কাটায় বনে বাঁদাড়ে ঘুরে। তখন তাকে খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। মালাকে দুইমাসের অন্তঃসত্ত্বা রেখে সেই যে সে বের হলো আর ফেরার নাম করেনি। গর্ভধারণের পাঁচ মাস পরেই জন্ম নেয় মালার মেয়ে। অসময়ে সন্তানের জন্মে কেউ কথা শুনাতে বাকি রাখেনি। তার উপর সদ্যোজাত কন্যার এ অবস্থা! কোনকিছুই মালার মাথায় আসে না। গ্রামের লোকজন দুঃসময়ে কাছে এগিয়ে না এসে যেন আরও পর হয়ে যাচ্ছে। লোকজন বলতে গেলে প্রায় একঘরে করে দিচ্ছে। সবাই বাঁকা নজরে দেখে। ভয়ে সামনে আসে না।

এতো বাধা-বিপত্তি কিন্তু মালার মেয়ে মায়াকে দমিয়ে রাখতে পারে না। সে দিব্যি হেসে খেলে মায়ের কোলে কাটিয়ে দেয়। নানান অঙ্গিভঙ্গি করে তার মাকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। ছোট্ট শিশুর ছলাকলা মালাকে সকল দুঃখ ভুলিয়ে রাখে। দেখতে দেখতে মায়া ছয়মাসে পা দিয়েছে। এখনই তাকে দেখতে লাগে চল্লিশ বছরের মহিলাদের মতো। জিড়জিড়ে হাড়গুলোতে বেশি নড়াচড়া করার শক্তি তার নেই। তবুও মায়ার দুরন্তপনা সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। বাচ্চারা ভয়ে মায়ার সাথে খেলতে চায় না। মায়া একা একা আপনমনে খেলে।

একবছর বয়সে মায়া পুরোপুরি কথা বলতে শিখে। নাকানো কণ্ঠে নানারকম কথা বলে মনের কথাগুলো বুঝাতে চায়। ধীরে ধীরে মায়ার যতোই বয়স বাড়ছে, মালার মনের চিন্তাও ঠিক ততোটাই বাড়ছে। কারণ, মায়া যতো দ্রুত না বড় হচ্ছে, ততো দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যকে গাল-মন্দ করতে বাদ রাখে না মালাও। হাশেমপুর গ্রামের চেয়ারম্যানের মেয়ে রিতু ঢাকা থেকে এসেছে। সবেমাত্র ডাক্তারি পাশ করে বেরিয়েছে সে। গ্রামের অদ্ভুত শিশু মায়ার কথাগুলো পৌঁছাতে দেরি হয়নি তার কানেও। তাই পরদিন সঙ্গে কাজের মেয়ে হামিদাকে নিয়ে সে রওনা দেয় মালাদের বাড়িতে।

জীর্ণশীর্ণ একটা ঘরে মায়াকে নিয়ে থাকে মালা। রিতুকে দেখেই ব্যস্ত হয়ে উঠানে পিঁড়ি পেতে দিল। ঘরে মেহমান আসার শব্দ পেয়ে বেরিয়ে এলো মায়াও। রিতু তাকে দেখেই কাছে টেনে নিল। মালার চোখে বিষ্ময় খেলা করছে। যেই মেয়েকে সবাই দূরে সরিয়ে নেয়, সেই মেয়েকে কিনা চেয়ারম্যানের মেয়ে কাছে টেনে নিচ্ছে! রিতু কথায় কথায় জানালো, সে ঢাকা থেকে এসেছে মায়ার জন্য। সে মায়ার ব্যাপারে গ্রামবাসীদের কিছু জানাতে চায়। এজন্য সে বিকেলবেলা মাঠে সবাইকে আসতে বলেছে। মালা যেন অবশ্যই মনে করে মায়াকে নিয়ে চলে আসে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে।

বিকেলবেলা মালা তার মেয়েকে কোলে করে মাঠে আসে। দেখে, মায়ার ব্যাপারে জানতে আগ্রহী গ্রামবাসীতে মাঠ গমগম করছে। রিতু মাইক হাতে অপেক্ষা করছে। মালাকে দেখতেই তাকে টেনে পাশের চেয়ারে বসালো। জোর গলায় বলল, “প্রিয় গ্রামবাসী। আমি আপনাদের চেয়ারম্যানের মেয়ে রিতু। আল্লাহর রহমতে ও আপনাদের দোয়ায় ডাক্তারি পাশ করেছি। ঢাকায় থাকতেই আমি মায়ার কথা শুনেছি। আর তাই ছুটে এসেছি আপনাদের ভুল ভাঙাতে। মায়া কোন পাপ বা অভিশাপের ফসল নয়, কোন দেবতা বা জন্তু নয় বরং আপনার আমার মতোই একজন মানুষ। মায়া প্রোজেরিয়া নামক এক বিরল রোগে আক্রান্ত।

এটি এমন একটি রোগ, যাতে ১০ বছরের শিশুকে দেখতে ৯০ বছরের বৃদ্ধের মতো দেখায়। এই রোগীরা সাধারণত ১৭ বা ২০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। ধীর গতিতে এদের দেহের বিকাশ হয়। বয়সের অনুপাতে ওজন কম হয়। মুখের তুলনায় মাথার আকার বড় হয়। আর চামড়া কুঁচকে যাওয়ায় তাদের বৃদ্ধের মতো দেখায়।” এটুকু বলে থামল রিতু। গ্রামবাসীরা সবাই কানাঘুষা করছে। মালা অবাক হয়ে দেখছে৷ ওর চোখে পানি। রিতু আবার বলতে শুরু করলো, “এতো কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরেও কিন্তু তাদের বুদ্ধির এতোটুকু কমতি হয় না৷ অন্যান্য বাচ্চাদের মতোই তাদের মেধাশক্তি ভালো হয়। তারা পড়াশোনাও করতে পারে। কিন্তু কখনো কখনো হৃদরোগ জনিত কারণে তাদের স্বাভাবিক জীবনে সমস্যা হয়।” রিতুকে থামিয়ে মালা জিজ্ঞেস করলো, “আপা, এর কি কোন চিকিৎসা নাই?”

রিতু বলল, “না মালা, এখন পর্যন্ত প্রোজেরিয়া নিরাময়ের ঔষধ আবিষ্কার হয়নি। তবে কিছু চিকিৎসায় এ রোগীরা অনেকদিন বেঁচে থাকতে পারে। বাংলাদেশে মায়ার মতো আরও প্রোজেরিয়া রোগী আছে।” রিতু তার ল্যাপটপে প্রোজেরিয়া আক্রান্ত বায়োজিদ আর নিতুর ছবি দেখালো গ্রামবাসীদের। বলতে লাগলো, “শিশুরা ফুলের মতো পবিত্র। আর মায়া তো ঠিক তেমনি একটা শিউলি ফুল, যা হয়তো খুব দ্রুত ঝড়ে পড়ে যাবে কিন্তু তার সুবাস ছড়িয়ে যাবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। আপনারা কি চান না এই শিউলি ফুল সুন্দরভাবে ফুটে উঠুক?” এই বলে রিতু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল গ্রামবাসীদের দিকে।

রিতুর কথাগুলো দাগ কেটেছে সবার মনে। সবাই উপলব্ধি করেছে তাদের ভুল। তাই তারা সমস্বরে সায় জানালো মায়াকে তারা আর অবহেলা করবে না৷ বরং অন্য সব বাচ্চাদের মতো তাকেও সমান অধিকার দিবে।
মালার চোখ থেকে আনন্দের জল গড়িয়ে পড়ছে। আজ সবার চোখ থেকে বাঁধন খুলে গেছে। মায়া একটা হাস্যোজ্বল তারা, যা অচিরেই নিভে যাবে, তবে তার আগ পর্যন্ত আলো ছড়িয়ে যাবে বহুদূর।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত