গাঞ্জা

গাঞ্জা

৩৩ শতাংশ নম্বর পাইয়া এসএসসি পাশ করিয়া খুশিতে লাফাইতে লাফাইতে মিষ্টি লইয়া পাশের বাসার আন্টিদের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিব,এমন সময় আড়াল হইতে শুনিলাম কে যেন ভেতরে চিৎকার চেঁচামেচি করিয়া বলিতেছে,”এত পড়াশোনা করাইলাম,তাহারপরেও এই অবস্থা???ছিঃছিঃছিঃ!মরিয়া যা তুই,মরিয়া যা।” ইহার উত্তরে কে যেন মেয়ে কণ্ঠে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতেছে,”মাস্টারের খাতা দেখা ভুল হইয়াছে,আমি ভালো পরীক্ষাই দিয়াছিলাম।”

ব্যাপারটা বুঝিতে আমার কোন অসুবিধা হয় নাই।সারা বৎসর পাশের বাড়ির ইহারা মেয়ের গুণগান করিত।ইহাদের গুণগানে ঈর্ষাণ্বিত হইয়া আম্মা আমারে কম কথা শুনায় নাই।দরজার আড়াল হইতে এইমাত্র এই অবস্থা দেখিয়া তাই আমার আনন্দভরা মুখখানা মুহূর্তে আরো উজ্জ্বল হইয়া গেল।আর ভিতরে যাই নাই।যেই মিষ্টি তাহাদিগকে দিতে আনিয়াছিলাম,সেইখান হইতে একখানা মিষ্টি নিজের গালে পুরিয়া নাচিতে নাচিতে ঘরে আসিয়া আম্মারে বলিলাম,”আম্মা,”ঐ বাসার সুন্দরী মিলি পাশ করে নাই।তাহাদিগের মন খারাপ।বকাবকি চলিতেছে।এইক্ষণে আমার মিষ্টি লইয়া যাওয়া ঠিক হইবে না,তুমিই যাও।” আম্মার মুখ নরম হইয়া গেল।পাশের বাড়ির সদস্যদের কাছে নিজেরে হিরো বানাইবার তীব্র সংকল্পে আমি আবারও জোর গলায় বলিলাম,”যাও।তুৃমি একটু সান্ত্বনা দিয়া আসিও।” আব্বা মুখ গম্ভীর করিয়া বলিলেন,”কাটা ঘায়ে নুন দিবার দরকার নাই।নিজের কাজ করো।”

আমি পাশ করিয়াছি।এই খুশিতে আমাদিগের ঘরে অদ্য ভাল মন্দ রান্না হইবে।আম্মা খুশি মনে বলিল,”যা,মিলিদের বাসায় গিয়া বলিয়া আয় দুপুরে আমাদিগের সাথে খাইবে সবাই।” এই ই সুযোগ!আমি আবারও লাফাইতে লাফাইতে তাহাদিগের দরজার সম্মুখে গেলাম।আবারও ভেতর হইতে শব্দ কানে আসিল,”কিসের ভালো রান্না!অদ্য তোর ভাত নাই।কোন রান্নাই হইবে না ঘরে।কেহই খাইবে না।” অজানা কারণে খুশিতে পুনরায় লাফ মারিলাম।সে পাশ করে নাই।আমি করিয়াছি।অথচ এমন ভাবভঙ্গি লইয়া চলিত,মনে হইত সে সবজান্তা ওস্তাদ।আমার ভাবনায় ঘুরিতেছে,কীভাবে তাহাদিগের মুখে চুনকালি দেওয়া যায়।এইবারও ভিতরে না ঢুকিয়া ঘরে আসিয়া আম্মারে বলিলাম,”আম্মা,তাহাদিগের মন খুবই খারাপ।বকাবকি,চেঁচামেচি চলিতেছে জোরে।চলো,তুমি সহ গিয়া তাহাদিগকে সান্ত্বনা দিয়া আসি।” আব্বা আবার বলিলেন,”এরে শাতিল,এসএসসি পাশ করিয়াও তোর মাথায় বুদ্ধি হয় নাই?এখন তোর আম্মা তাহাদিগের বাসায় গেলে তাহারা আরো কষ্ট পাইবে।এখন যাওয়া যাইবে না।”

আমার মন আবার খারাপ হইল।আব্বার কারণে উদ্দেশ্যে সফল করিতে পারিতেছিনা।আম্মা ঘণ্টাখানেক পরে আবার বলিলেন,”আইচ্ছা শোন তো শাতিল,আমরা সকলে তো বিকালে ঘুরিতে যাইতেছি নদীর পাড়ে।মিলিরেও লইয়া যাইবি নাকি?” আব্বা রাগিয়া বলিলেন,”চোখের মাথা খাইছো নাকি?বুদ্ধি শুদ্ধি গেছে?আগে তাহাদিগের মন ভালো হউক।” আব্বার উপর রাগ হইল আবার।আমি কোথায় চাইতেছি,তাহাদিগের ব্যথা আরো বাড়াইয়া দিতে,আর আব্বা শাস্ত্রিক চিন্তায় মগ্ন।আমি আব্বার কথা না শুনিয়া আবারো তাহাদিগের দরজায় ছুটিয়া গেলাম এবং শুনিলাম ভিতরে মহাসমারোহে বকাবকি চলিতেছে,”কোন ঘুরাঘুরি নাই।অদ্য হইতে তোর বাহিরে যাওয়া বন্ধ।” আবার নাচিতে নাচিতে ঘরে আসিয়া আম্মারে বলিলাম,”মিলি মেয়েটারে সকলে মিলিয়া অনেক বকিতেছে,চলো গিয়া থামাই।” আব্বা এইবার ঠাস করিয়া আমার গালে এক চড় মারিয়া বলিলেন,”তুই বলদ যে কেমন করিয়া পাশ করিয়াছিস আল্লাহই জানেন।কুলাঙ্গার একটা।” আমি কিছু না বলিয়া অন্য রুমে গিয়া খুশিতে আবারও লাফ মারিয়া মনে মনে বলিলাম,”আহা!কী আনন্দ!আমি পাশ করিয়াছি,মিলি ফেল করিয়াছে!আহা!এই আনন্দ রাখিব কোথায়!”

ইহার পরে সন্ধ্যায়।নদীর পাড় হইতে ঘুরাঘুরি করিয়া আসিয়া মিলাদে বসিব বসিব।আমি পাশ করিয়াছি,এই উপলক্ষে মিলাদ।আম্মা আব্বারে বলিলেন,”মিলির বাপেরে ডাকিয়া লইব নাকি?” আমি এই কথা শুনিবা মাত্র আম্মার হাত ধরিয়া টান দিয়া মিলিদের দরজায় ধাক্কা দিতে যাইব,এমনসময় ভেতর হইতে শব্দ শুনিতে পাইলাম,”তোর পরীক্ষার আগে যেই মিলাদ দিছিলাম সেইটাইও কাজ হয় নাই।হইবে কেমনে?পড়ালেখা তো নাই!” শুনিয়া আমি খুশি হইলেও আম্মা কষ্ট পাইলেন।আম্মা বলিলেন,”থাক!বাদ দে।চল,ফিরিয়া যাই।”আমি রাগাণ্বিত হইয়া বলিলাম,”আরে না না!তাহাদিগকে বুঝাইতে হইবে,ফেল করা কোন প্রকার দোষ নহে।আসিতেছে বৎসর আবার পরীক্ষা দেওয়া যাইবে।” আম্মা শুনিলেন না।ঘরে ফিরিয়া গেলেন।

রাত্রিতে মিলাদ শেষে মেহমানরা চলিয়া গিয়াছেন।পরিবেশ শান্ত।আমি পাশ করিয়াও গোমড়া মুখে বসিয়া রইয়াছি।দুঃখ একটাই,এখন পর্যন্ত পাশের বাসার মানুষদের গালে চুনকালি মাখিয়া নিজেরে হিরো বানাইতে পারি নাই।কীভাবে কী করা যায় ভাবিতেছিলাম।এমন সময় শুনিতে পাইলাম আম্মা আব্বারে বলিতেছেন,”এখন কি একবার মিলিদের বাসায় গিয়া সান্ত্বনা দিয়া আসিব?নইলে বলিবে নিজের ছেলে পাশ করিবার কারণে তাহাদিগের কথা ভুলিয়া গিয়াছি।” আমি একলাফে তাহাদিগের কথার মাঝে ছুটিয়া গিয়া বলিলাম,”হুম,ঠিক বলিয়াছ।চলো,চলো।তাড়াতাড়ি।” আব্বা এবার বলিলেন,”যাইতে পারো,বেশি কথা বলিওনা।শুধু বলিও পাশ করাটা ভাগ্যেরও ব্যাপার।অনেক সময় ভালো পরীক্ষা দিয়াও পাশ আসেনা নানান ভুলের কারণে।” আমার ধৈর্য্য মানিতেছেনা।নিজেকে বড় করিবার অভিপ্রায়ে কত তাড়াতাড়ি পাশের বাসায় ছুটিয়া যাইব সেটা ভাবিয়া উত্তেজিত কণ্ঠে বলিলাম,”চলো তাড়াতাড়ি।”

আম্মা সহ পাশের বাসায় ঢুকিলাম মিষ্টির প্যাকেট লইয়া।দেখিলাম মিলির আম্মার মন খারাপ।মিলির বাপের কপালে ঘাম।সে চোখে মুখে রাগ লইয়া সোফায় বসিয়া আছে।তাহার অদূরেই মিলি চেয়ারে বসিয়া কাঁদিতেছে।মোটামুটি ভিতরে গম্ভীর পরিবেশে বিদ্যমান।আম্মাকে দেখিবামাত্র মিলির আব্বা কপালের ঘাম মুছিয়া বলিলেন,”দেখিয়াছেন ভাবী?এত্ত টাকা পয়সা খরচ করিলাম তাহারপরেও এই অবস্থা!” বলিয়া তিনি আবারও মিলির দিকে চাহিয়া বকবক শুরু করিয়া দিলেন।বুঝিতে পারিলাম,আমাদিগকে দেখিয়া তাহার শোক আরো বাড়িয়া গিয়াছে।সারাবৎসর নিজের মাইয়ার গর্ব করিত,এখন এই অবস্থা।শোক তো বাড়িবেই।তিনি মিলিকে বলিয়া যাইতেছেন একের পর এক।আম্মা হাতের মিষ্টির প্যাকেটখানা মিলির মার দিকে আগাইয়া দিয়া মিলির আব্বাকে বলিলেন,”আরে ভাই!আপনি মিলিকে এত বকিতেছেন কেন?এইবার পাশ করে নাই,তো কী হইয়াছে?সামনের বৎসর আবার দেওয়া যাইবে পরীক্ষা!” আমিতো মনে মনে আনন্দে বলিতেছি,”এইবার বুঝ ঠেলা।আমিই ভালো ছাত্র,তোরা আছিলি ঢপবাজ।”

এমনসময় ভিতরের রুম থেকে ফর্সা এক লোক আসিয়া মিলির আব্বাকে সজোরে ধমক দিয়া বলিল,”দুলাভাই,আপনি কিন্তু এইবার খুব বাড়াবাড়ি করিতেছেন।আপনি কী পাইয়াছেন?মিলি ৯৫ শতাংশ নম্বর পাইলো না বিধায় সকাল হইতে মূর্খের মতো তাহাকে অনবরত বকিয়া যাইতেছেন,অথচ আপনি একবারও ভাবিলেন না যে সে ৯০ শতাংশ নম্বর লইয়া উপজেলায় প্রথম হইয়াছে।আপনি কী গাঞ্জা সেবন করিয়াছেন?”

লোকটার কথা শুনিয়া আমি,আম্মা অবাক হইয়া তাকাইয়া রহিলাম একে অপরের দিকে।অতঃপর চোখ বড় করিয়া কাঁদো কাঁদো ভাবে আম্মার দিকে তাকাইয়া বলিলাম,”গাঞ্জা কী না পারে!চলো আম্মা,আমারেও গাঞ্জা ধরিতে হইবে!”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত