নিরুপমা

নিরুপমা

কুয়োতলায় বাসন মাজতে মাজতে বাবনা গাছের আড়ালে দোতলার বারান্দার দিকে রোজ সকালে নিরুপমা তাকিয়ে থাকে। কাকে খুঁজে সেই তা জানে। যাকে খুঁজে সে জানে না তাকে কেউ এমন করে: এঁটো থালা বাসন মাজতে মাজতে চোখের তারায় খুঁজে বেড়ায়।

গতকাল আসেনি সে। তার আগের দিনও না। দু’টো দিন বারান্দায় দেখতে না পেয়ে নিরুপমা মনে মনে কত কথা যে ভেজে গেল- মানুষটার জ্বর হয়নি তো। রোজ সকালে চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। মানুষটা কোথাও বেড়াতে যায়নি তো?

মেয়েটার নাম নিরুপমা হলেও সে দেখতে মোটেও তেমনটি নয়। এমনকি জাতেও তারা অনেক নিচুতে। বাড়ি বাড়ি ঝি এর কাজ করে পেট চালায়। তবুও সীমানার বাইরে গিয়ে একটা মানুষ কে ভালবেসে ফেলে নিরুপমা। এতো মানুষের ভিড়ে ঐ একটা মানুষকেই ওর মানুষ মনে হয়েছে।

একদিন কাঁচের বোতলে করে কেরোসিন তেল আনার সময় বেখেয়ালে মানুষটার গাড়ির সাথে ধাক্কা খায়। কাঁচের বোতল ভেংগে যায়। নিরুপমা মাটিতে খানিকটা গড়িয়ে যায়। লোকটা গাড়ি থেকে নেমে নিরুপমাকে হাত ধরে উঠায়। মাথায় হাত দিয়ে লজ্জিত কন্ঠে বলে- তোমার তেমন লাগেনি তো? নিরুপমা কিছু বলতে পারলো না। কেবল মাথাটা এপাশ ওপাশ নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো- লাগেনি। মানুষটা দোকান থেকে দুই লিটারের কেরোসিন কিনে দিলো। নিরুপমার গলায় আওয়াজ আসলো তখন- বাবু লাগপে না। কিন্তু মানুষটা শুনলে তো সে কথা। স্নেহ ভরা গলায় বললেন,

-তেল না নিয়ে গেলে মা বকবে না?
– বকবে তো।
– আমার জন্য কেন বকা খাবে?

নিরুপমা আর কিছু বলতে পারলো না। মানুষটা ওর মাথায় হাত দিয়ে বলল- যাও এবার বাড়ি যাও। লোকজন এতোক্ষন এইদিকে তাকিয়ে সব দেখছিলো। কিন্তু কিছু বলার মতো সাহস কারো নেই। ভট্টাচার্য বাড়ির ছোট ছেলে বলে কথা।

মানুষটা গাড়ি চালিয়ে ফিরতি পথে চলে গেল। নিরুপমা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে হঠাৎ বুকটা ফাঁকাফাঁকা লাগলো। ঠোঁট কাঁপছে- গলার কাছে কান্না দলা পাকাচ্ছে। ও ভেবে পাচ্ছে না এতো ভাল ব্যবহার ওর সাথে এর আগে কেউ করেছে কিনা। এভাবে স্নেহ মাখা হাত ওর মাথায় রেখেছে কিনা। মনে করতে পারলো না। কেবল গুমড়ে উঠলো ভিতরে ভিতরে।

বয়েস সতেরো হলে কি হবে দেখতে নিরুপমা ১৩ বছরের মেয়ের মতো। কিন্তু পৃথিবীতে ওর অভিজ্ঞতার বলয় ওকে আরো বড় করে দিয়েছে। বাস্তবতা কি জিনিষ সেটা জ্ঞান হবার পর থেকেই বুঝতে পেরেছে। তবুও ও এটা কিছুতেই বুঝতে পারলো না ওর বয়সের দ্বিগুণ এক মানুষ কে কি করে এতো ভালবেসে ফেলল।

মালতী মাসী কে বলে কতোবার ভট্টাচার্য বাড়িতে ঝি এর কাজ জোগার করে দিতে বলেছে। কিন্তু মাসী একান দিয়ে ঢুকিয়ে ওকান দিয়ে বের করে দিয়েছে। উল্টা নিরুপমা কে বুঝেয়েছে ও বাড়িতে কাজের কষ্ট ভীষণ। এমন সময় হঠাৎ বারান্দায় মানুষটাকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ওর পিঠ দিয়ে একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো। মিনিট দুয়েক পরেই লোকটা চলে গেল। নিরুপমা দাঁড়িয়েই আছে কুয়োতলায় কে আসছে যাচ্ছে সে হিসেব নেই। ঘন্টাখানিক বাদে মা এসে চুলের মুঠি ধরে ঘরে নিয়ে না গেলে আজ হয়তো কুয়োতলায় কাটিয়ে দিতো।

মানুষের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন জ্ঞানশূন্য হয়ে পরে। নিরুপমার ও তাই হলো একা একা ভালবাসতে বাসতে ও নিজের কাছে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেল। এক ভোরবেলায় বড় রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালো। জানে এ পথ দিয়েই নতুন বউকে নিয়ে আজ সিমলা চলে যাবে। আবার কবে দেখা হবে জানে না। ওর খুব ইচ্ছে করছে আজ মানুষটার গাড়ির নিচে পড়তে। বুকের ভিতরে হাহাকারের ঝড় তিলে তিলে বাড়ছে। গেল মাসে মানুষটা বিয়ে করে যখন নতুন বউ আনলো; সেদিন থেকে নিরুপমা এই পৃথিবীর কোন অংশ হয়ে থাকেনি। দিনতার কি যে ভাবতো কেউ জানে না। শুধু সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার পরে চোখের জলে ভিজে যাওয়া বালিশটা রোদে শুকাতে দিয়ে আসতো। কুয়োতলায় আসা বন্ধ করে দিলো এক সময়। সকালবেলায় বারান্দায় নতুন বউয়ের শাড়ি ব্লাউজ পেটিকোট ঝুলতে থাকে। ভেজা কাপড় থেকে ফোটায় ফোটায় পানি ঝড়ে। আর নিরুপমার বুকে কেউ যেন দগদগে আগুন ঢেলে দেয়।

বুকের আগুন নিয়েই বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। মালতী মাসী বলেছে ভোরেই রওনা হয়ে যাবে। কিন্তু ঘন্টা দুয়েক পেড়িয়ে গেল। এদিকে আকাশ জুড়ে কালি গোলা মেঘ জমেছে। যেন কোন মুহূর্তে গলে পড়বে পৃথিবী জুড়ে। মানুষটা কি তাহলে আজ যাবে না। ভাবতেই খুশি হয়ে উঠলো। ঠিক তাই- ওর মন বলছে আজ যায়নি। সাথে সাথে সেখান থেকে কুয়োতলার দিকে ছুট দিলো। মেঘ গুলোও আর আকাশে ঝুলে থাকতে পারলো না ঝম ঝমিয়ে পড়লো মেঠো পথে।

নিরুপমা দৌড়াচ্ছে। বৃষ্টিতে শাড়ি ভিজে একাকার। কাঁদছে মেয়েটা- সুখের কান্না। আরো একটা দিন মানুষটা অন্তত ওর আসেপাশেই থাকবে। কিন্তু কুয়োতলায় যেতেই সব হাসি সব আনন্দ চাবুকের মতো ওর বুকে আঘাত করলো। মানুষটা বউ কে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে হাত ভেজাচ্ছে। একজন আরেকজনকে বৃষ্টি ছিটা দিচ্ছে। এলোচুলে নতুন বউটা গড়িয়ে গড়িয়ে পরছে লোকটার বুকে। নিরুপমার বুকটা ভারি হয়ে গেল। নিঃশ্বাস নিতেও প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। এই একটা মানুষকেই তো ভালবেসেছিলো। জানে পাবে না কখনোই- তা যে হবার নয়। কিন্তু ভগবান এভাবে ওকে কষ্ট না দিলেও পারতো। ভাবতে ভাবতে কখন যে কুয়োর ভিতরে আনমনে পরে গেল।

গভীর কূপে ঝপাস একটা শব্দ হলো কেবল। কিন্তু অবিরত বাজের শব্দে সেই শব্দ কারো কানে গিয়ে পৌছালো না। মানুষটা হঠাৎ ই কি মনে করে কুয়োতলার দিকে চাইলো। এদিকে ঐ বাড়ির কেউ খুব একটা তাকায় না। মানুষটার কেমন যেন করে উঠলো বুকের ভিতরে। কিন্তু বউয়ের আহ্লাদী কন্ঠস্বর শুনে ভাবনাটা আর এগোল না। বউ মানুষটাকে নিয়ে বিছানায় ঝাপিয়ে পরলো। বৃষ্টি আজ উম্মাদিনী করে ফেলেছে নতুন বউ কে। বউ পাগলের মতো বলে উঠলো- আমি অথৈজলের কুয়ো আজ ডুবাবো তোমায় ভালবাসার জলে।

নিরুপমার শেষ নিঃশ্বাসটা বুদবুদ হয়ে গভীর কুয়ো থেকে উঠে এলো। পৃথিবীকে জানিয়ে দিলো- বিদায়। আকাশের বাজ থেমে গেল। বৃষ্টির তীব্রতা থেমে গেল। যেন নিরুপমার শেষ নিঃশ্বাসের বুদবুদের শব্দ মানুষটা শুনতে পায়। কিন্তু বউয়ের ঘন নিঃশ্বাসের ভিড়ে কোন শব্দই তার কানে এলো না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত