কর্মের ফল

কর্মের ফল

রাত তিনটা; এমন সময় সাধারণত মানুষ গভীর ঘুমে থাকে। তেমনই গভীর ঘুমে আছে নূরী। কিন্তু ঘুমটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। এক করুণ কান্নার সুরে তার ঘুমটা ভেঙে গেল। কেউ যেন টেনে টেনে কান্না করছে। বিগত কিছু সপ্তাহ ধরে প্রতিদিনই তার সাথে এমনটা হচ্ছে। তাই সে চমকালো না। তবে নিত্যদিনের মতো ভয় তাকে আঁকড়ে ধরলো। নূরী একনজর তার স্বামী আসাদ ও চার বছরের ফুটফুটে কন্যা তাহিয়ার দিকে তাকালো। আসাদ আরামে ঘুমাচ্ছে। আর মেয়েটা ঘুমের ঘোরেই কিছুক্ষণ পরপর মুচকি মুচকি হেসে যাচ্ছে। অজান্তেই নূরীর ঠোঁটের কোণেও হাসির রেখা ফুটে উঠলো। এদিকে কান্নার শব্দটা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। নিত্যদিনের মতো আসাদকে ডেকে তুললো নূরী।

“শুনতে পাচ্ছো কান্নাটা?” ভীত স্বরে নূরীর প্রশ্নটা শুনে আসাদ কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলল, “কেন তুমি প্রতিদিন আমার ঘুম নষ্ট করো? সারাদিন কাজ করে এসে যদি একটু শান্তি না দাও তবে কোথায় যাব? চুপচাপ ঘুমাও। আমাকেও ঘুমাতে দাও।” কর্কশ স্বরে কথাগুলো বলে আসাদ আবার শুয়ে পড়লো। কান্নার শব্দটার আরও করুণ হচ্ছে। তাহিয়াকে জড়িয়ে ধরে নূরী শুয়ে পড়লো। যেকেউই দেখলে বলতে পারবে নূরী ঘাবড়ে আছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দে শহর তার নীরবতা ভেঙে সকালের জানান দিলো। অফিসের উদ্দেশ্যে আসাদ প্রস্তুত হলো। নাস্তা নিয়ে টেবিলে বসে আছে নূরী। তাহিয়াকে খাইয়ে দিচ্ছে। আসাদ এসে তাহিয়ার কপালে চুমু দিয়ে খেতে বসলো। নূরী আমতা আমতা করে বলল, “বলছিলাম কি, কোনো হুজুরকে একবার ঘরটা দেখালে বোধহয় ভালো হতো।”

– আবার শুরু করলে তুমি?
– আমি কি করবো বলো? প্রতি রাতে কান্নার শব্দে ঘুমাতে পারি না। সারাদিন নূপুরের শব্দে ঘরে ভয়ে ভয়ে থাকি।
– বুঝেছি। তুমি বিকালে প্রস্তুত থেকো। আমি এসে ডাক্তার কাছে নিয়ে যাবো।

আসাদ চলে গেল। নূরী অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলো যে‚ ঘরে কোনো অশুভ শক্তি আছে। এখানে ডাক্তারের কাজ নেই। কিন্তু আসাদ কিছুই শুনলো না। বিকালে এসে নূরীকে এক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেল। তিনি নূরীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিছু ওষুধ ও পরামর্শ দিলেন। নূরী নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে লাগল। কিন্তু এতে কোনো উন্নতি দেখা দিলো না। প্রতিদিন সেই একই ঘটনা ঘটতে লাগল। অতঃপর ঘুমের ওষুধ দেওয়া হলো। এতে রাতের ঘুমটা তো হয় কিন্তু দিনের বেলায় নূরীর সময়টা ভয়ে ভয়েই কাটে।

চুলার ওপর পানি টগবগ করছে। বেশ কিছু পানি পাতিল বেয়ে চুলার আগুনে মিশে যাচ্ছে। আগুন-পানির সংঘর্ষে শো শো করে শব্দ হচ্ছে। সামনে থেকেও এসবে লক্ষ্য নেই নূরীর। আনমনে কোথাও হারিয়ে আছে সে। বেশ কিছুদিন ধরে হঠাৎ হঠাৎ নূরী কোথাও যেন হারিয়ে যায়। আশেপাশের খবর একদম থাকে না। গরম পানির কিছু অংশ নূরীর হাতে পড়তেই চেতনায় ফিরলো। চুলা বন্ধ করে তাহিয়ার জন্য খাবার বানিয়ে রুমে যেতেই নূপুরের শব্দ শুনতে পেল। নূরী নিজ কাজ করে যেতে লাগল। কেননা এই শব্দ তার নিত্যদিনের সঙ্গী। “নূরী, এই নূরী।” একটা চিকন কণ্ঠে নূরী নিজের নাম শুনতে পেয়ে অত্যন্ত ঘাবড়ে গেল। কান্না ও নূপুরের শব্দ শুনা গেলেও এযাবৎ কেউ কথা বলেনি। ভীত কণ্ঠে নূরী আমতা আমতা করে বলল, “কে কে?”

– আমি তোর বন্ধু। এদিকে আয়। নূরী আয়নার দিকে তাকালো। কথাগুলো যেন ওখান থেকেই ভেসে আসছে। নূরী সেদিকে তাকাতেই গায়েবী কণ্ঠ বলল, “হ্যাঁ, আমি এখানে। আয় এদিকে।” ভয়ে ভয়ে নূরী এক পা, দুই পা করে সেদিকে যেতে লাগল।

আসাদ তড়িঘড়ি করে বাসায় ফিরে এলো। তার চোখেমুখে আতংকের ছাপ। স্ত্রী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে এই খবর পেয়ে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। আসাদ লক্ষ্য করলো ঘরের আলমারির আয়নাটা ভাঙা। আসাদ ও নূরীর বাবা মায়েরাও এসেছে। নূরীর বারবার বিড়বিড় করে বলছে, “ও আমাকে আর তাহিয়াকে নিয়ে যাবে।” অতঃপর আসাদ সবাইকে বিস্তারিত খুলে বলল। নূরীর বাবা হুজুর এনে ঘর বন্ধ করালো। তবুও সমস্যার সমাধান হলো না। এতদিন নূরী শব্দ শুনতে পেতো। কিন্তু এখন কথাও শুনতে পায়। নূরীকে আবার সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নেওয়া হলো। তিনি নূরীকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরামর্শ দেন। পারিবারিকভাবে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো নূরীকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করাবে। কিন্তু তার আগেই অঘটন ঘটে গেল।

নূরী আত্মহত্যা করলো। শুধু একা নয়, তাহিয়াকে নিয়ে। স্ত্রী-সন্তান হারানোর শোকে আসাদ পাগল হয়ে উঠলো। একদিন ঘর ভর্তি লোকজনের সামনে আসাদ একটা ছুরি নিয়ে দেয়ালের দিকে উদ্দেশ্য করে চিত্‍কার দিয়ে বলল, “কে তুই? আমার সামনে আয়। আমার সবকিছুই তো কেড়ে নিলি। এবার আমাকেও নিয়ে যা।” আসাদের বিস্ফোরিত চোখদুটো দেখে তার মা কেঁদে উঠে স্বামীকে বলল, “ও গো, তুমি ওকে ধরো। বউ আর নাতনী হারিয়েছি। এবার ছেলেটা হারাতে চাই না।” সবাই মিলে আসাদকে ধরে শান্ত করলো। আসাদকে এই ঘর থেকে নিয়ে গেল তার বাবা মা। বেশ কিছুদিন আসাদ না খেয়ে নির্ঘুম ভাবেই কাটিয়েছে। নিজেকে কিছুটা সামলানোর পর আবার নিজ ঘরে ফিরে এলো। তার মতে এই ঘরে নূরী-তাহিয়ার স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। তবে আসাদের সঙ্গে তার বাবা মাও এসেছে। কিছুদিন তারাও এখানে থাকবে।

রাত প্রায় সাড়ে তিনটা। মোবাইলের শব্দে আসাদের ঘুম ভেঙে গেল। রিসিভ করার পর আসাদ যে খবর পেল তাতে তার পা থেকে মাটি সরে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি খেয়ে ফেলল। হঠাৎ তার মনে হতে লাগল তার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে আসাদ পেছনে তাকালো। কাউকে দেখতে না পেরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। ঠিক তখনই মোবাইলের আলো জ্বলে উঠলো। সেই আলোতে দেয়ালে দুটা ছাঁয়া স্পষ্ট ভেসে উঠলো। একটা ছোট আরেকটা বড়। আসাদ ভয়ে চিত্‍কার দিয়ে উঠলো। কিন্তু তার গলা থেকে কোনো শব্দই বের হলো না। “জানো আসাদ, তোমাকে তাহিয়া খুব ভালোবাসে। সারাক্ষণ বাবার জন্য কাঁদে। তাই তোমাকে নিতে এসেছি।” নূরীর কণ্ঠে কথাগুলো ভেসে আসলো। ভয়ার্ত স্বরে বাঁচার আকুতি করে আসাদ বলল, “আমাকে মাফ করে দাও। আমার ভুল হয়ে গেছে।”

– এতে কি আমরা আমাদের জীবন ফিরে পাবো? লায়লার পাপের শাস্তি তো সে পেয়েছে। এবার তোমার পালা।
ফোনে লায়লার মৃত্যুর খবরই পেয়েছে আসাদ। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে লায়লা।

সকালে ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় আসাদের দেহটা পাওয়া গেল। সবাই ভাবলো স্ত্রী-সন্তানের শোকে আসাদ আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু আসল সত্য হলো আসাদ তার কর্মের ফল পেয়েছে। আসাদ বিবাহিত জানা সত্ত্বেও তার সাথে পরকীয়ায় জড়িয়েছিল লায়লা। লায়লার প্রেমে মগ্ন হয়ে পথের কাঁটা নূরী-তাহিয়াকে সরিয়ে দিতে বিজ্ঞানের আশ্রয় নিয়েছিল আসাদ। ঘরের মধ্যে গুপ্ত ক্যামরা ও সাউন্ড বক্স লাগিয়েছিল আসাদ। কান্না ও নূপুরের শব্দ দিয়ে নূরীকে ভয়ভীতি করে তুলেছিল।

এতে ধীরে ধীরে নূরীর মস্তিষ্ক দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এরপর একদিন নূরীকে হিপ্নোটাইজ করে তাহিয়া সহ তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। সবাই ভেবেছিল মানসিক সমস্যার কারণে নূরী এমনটা করেছিল। কিন্তু সত্যটা একমাত্র আসাদ-লায়লাই জানতো। আর তাদের মৃত্যুর সত্যটা জানে প্রকৃতি। প্রকৃতি কাউকে ছাড় দেয় না। সবাইকেই তার কৃতকর্মের ফল দেয়। আজ নয়তো কাল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত