নীলাঞ্জনা

নীলাঞ্জনা

বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে; আর কিছুক্ষণ পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। শ্রাবণের দিনগুলোতে এই এক সমস্যা। আকাশ এই ভালো তো এই খারাপ। বাড়তি ঝামেলা হিসেবে একটা ছাতা সবসময়ই সাথে রাখতে হয়। সাদা আকাশে হুট করেই কখন আমাবস্যার কালো অন্ধকার নেমে মেঘ চলে আসে তা বলা সত্যিই মুশকিল। “আমার ছাতাটা দাও তো।”

মিজান সাহেব তার ছোট মেয়ে সূচিকে ছাতাটা দিতে বলে ড্রেসিং টেবিলে গেলেন এক গ্লাস পানি খেতে। বৃষ্টির দিনে বিশেষ কোনো কাজ না থাকলে তিনি বাইরে বের হন না। বৃষ্টিকে উনি ভীষণ ভয় পান। সেবার বৃষ্টিতে ভিজে যখন জ্বর এসেছিল, উনি প্রায় মরতে বসেছিলেন। কীভাবে যেন বেঁচে ফিরেছেন। তারপর থেকে উনি আর কখনও বৃষ্টিতে ভিজেন না। এমনকি বৃষ্টির পানিও মাড়ান না। ছাতা দিয়ে কী করবা আব্বা?” মিজান সাহেব আড়চোখে উনার মেয়ের দিকে তাকালেন। ফিরতি প্রশ্ন করা উনি একদমই পছন্দ করেন না। “যা বলেছি তা কর।” সূচি চুপচাপ আলমারি থেকে ছাতাটা বের করে মিজান সাহেবের হাতে দিলেন। সূচি তার বাবার রাগ সম্পর্কে বেশ ভালো করেই জানে। ছোটবেলায় একবার ভাত খেতে না চাওয়ায় যেই চড় মেরেছিলেন গালে সেই কথা মনে হলে আজও গা শিউরে উঠে সূচির। ভীষণ রাগী মানুষ উনি।

মিজান সাহেব ছাতাটা নিয়ে ধীরেধীরে দরজার সামনে গেলেন। তারপর দরজাটা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন। বৃষ্টির বেগ আরও বেড়েছে। মিজান সাহেব মনে মনে ভাবতে লাগলেন, আমি বের হব দেখে বুঝি বৃষ্টি আরও বেড়েছে। সূচি তার বাবাকে কিছু একটা বলতে চেয়েও যেন বলছে না। দ্বিধাবোধ করছে খুব। সে তার মনের ভিতরে থাকা সব ভয় ঝেড়ে ফেলে দিয়ে তার বাবার সামনে গেল । “আব্বা?” মিজান সাহেব মৃদুস্বরে উত্তর দিলেন, “হুম।” “খুব বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। না গেলে হয় না আব্বা?” মিজান সাহেব ছাতাটা বন্ধ করে সূচির দিকে তাকালেন। সূচি খানিকটা ভয় পেয়ে দু’তিন হাত পিছনে সরে গেল। মিজান সাহেব চোখ মটকে সূচির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই রুমে যাবি?”

সূচি তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। মিজান সাহেব সচরাচর তার মেয়েদের ‘তুই’ করে বলেন না। যখন তিনি খুব বেশি রেগে যান একমাত্র তখনই তুই করে বলেন। তার বাবা ভীষণ রেগে আছেন এইটা বুঝতে পেরে সূচি পাশের রুমে চলে গেল। মিজান সাহেব ছাতাটা খুলে বাইরে বের হয়ে গেলেন। বের হবার আগে খানিকটা চেঁচিয়ে বলে গেলেন, “দরজাটা লাগিয়ে দাও সূচি।”

কথাটা বলে মিজান সাহেব হাঁটতে লাগলেন। বৃষ্টির মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে। ছাতাটা যেন বৃষ্টি ভার সইতে পারছে না। বারবার নিচে নুইয়ে পরছে। ছোট ছোট শীলও পরছে আকাশ থেকে। ছাতার উপর পরতেই ঠাসঠাস আওয়াজ হচ্ছে। শীল দেখতে অনেকটা বরফের মত। বরফই বলা চলে। মিজান সাহেব ভাবতে লাগলেন, ছোটবেলায় বৃষ্টির দিনে এরকম শীল পড়লে পাড়ার ছেলেপুলেদের সাথে উনিও গিয়ে শীল টোকাতেন। তারপর সবাই মিলে সেগুলো খেতেন। ছোটবেলার দিনগুলোই বেশ ছিল। আনন্দ ছিল, ভালোবাসা ছিল। এখনকার যান্ত্রিক শহরের মত ছিল না তখন। গ্রামের কাঁচা রাস্তা, শীতের সময় ভোররাতে গাছ থেকে খেজুরের রস চুরি করা, নিশিরাতে বাগান থেকে ডাব চুরি করা; সবমিলিয়ে বেশ ভালো ছিল ছোটবেলায়।

এগুলো ভাবতে ভাবতে মিজান সাহেব কখন যে মেইন রাস্তায় উঠে গেছেন তা খেয়ালই করেননি। দু’একটা চায়ের দোকান এখনও খোলা। অনেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন বৃষ্টি থেকে উপশম পাবার জন্য। কেউবা বৃষ্টির সময়টুকু কাটাবার জন্য খাচ্ছেন চা। চায়ের দোকানে বসে থাকা কয়েকজন লোক মিজান সাহেবের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন৷ এরকম মুষলধারে বৃষ্টির সময় কেউ বাইরে বের হয়? বের হয়েছে ভালো কথা, একটা জায়গায় দাঁড়াতেও তো পারত। শুধুশুধু ভিজে ভিজে যাওয়ার কী দরকার সামনে?

মিজান সাহেব তাদের চাহুনি দেখে এসব ভাবতে লাগলেন৷ ধুর, ভাবলে ভাবুক তাতে আমার কী? আমার কাজ আছে। আচ্ছা, এক কাপ চা খাওয়া যায় এখন? হ্যাঁ, যায় তো। ঠাণ্ডাও লাগছে কিছুটা। মিজান সাহেব রাস্তার ওপাশে থাকা একটা টং দোকানে গেলেন। এক কাপ চায়ের সাথে একটা ব্যানসন সিগারেট নিলেন। তারপর চায়ের সঙ্গে বেশ আয়েশ করে সিগারেট ফুঁকতে লাগলেন।

উনি তেমন একটা সিগারেট খান না। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হলে দু’তিনটে টান দিয়েই ফেলে দেন। এছাড়া মাথায় ভীষণ টেনশন থাকলে সিগারেট খান। সবাই বলে, সিগারেট খেলে নাকি টেনশন কমে; সাথে মনের কষ্টও। কে জানে এসব কথার আসলেই কোনো ভিত্তি আছে কিনা! সিগারেট খেলে যদি মনের সব কষ্টই দূর হয়ে যেত তাহলে পৃথিবীর সব মানুষই তাদের মনের কষ্ট দূর করার জন্য সিগারেট খেত। টং দোকানের চালের উপর বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ হচ্ছে। মিজান সাহেব সেই শব্দ বেশ আয়েশ করে উপভোগ করছেন। চা, সিগারেট খাওয়া শেষে মিজান সাহেব উনার পকেটে হাত দিলেন টাকা বের করার জন্য। কিন্তু সব পকেট খুঁজেও এক টাকাও বের করতে পারলেন না৷ পরক্ষণেই উনার মনে হল, উনি তো বাসা থেকে বের হবার আগে টাকা নিয়ে বের হননি। এখন কী করা?

দোকানে মধ্যম বয়সের একটা ছেলে বসা। এই সাইডে খুব একটা আসেন না উনি। তাই ভালো করে কাউকে চিনেনও না। মিজান সাহেব একটু নতস্বরে ছেলেটাকে বললেন, “বাবা, আমি তো ভুলে টাকা আনিনি বাসা থেকে। সন্ধ্যায় দিয়ে দিই?” ছেলেটা মিজান সাহেবের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “আচ্ছা চাচা সমস্যা নেই।” মিজান সাহেব মনে মনে হিসেব মিলিয়ে নিলেন। ১৮ টাকা হয়েছে। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই দিয়ে দেব। তারপর উনি ছাতা মেলে দাঁড়ালেন। “চাচা, বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি কমলে যান।” মিজান সাহেব ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, “না বাবা, আমার কাজ আছে।” কথাটা বলেই উনি সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। চা খাওয়াতে ঠাণ্ডার উপক্রমটা একটু কম লাগছে। পুরো শরীরটা যেন গরম হয়ে গেছে।

মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর মিজান সাহেব উনার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে গেলেন। এখনও প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। থামার কোনো নামগন্ধও নেই। কাঁচা রাস্তাগুলো কাঁদায় ভরে উঠেছে। মিজান সাহেব উনার হাতে থাকা ছাতাটা বন্ধ করে পাশে রেখে দিলেন। কয়েক সেকেন্ডের ভিতরেই উনার সাদা পাঞ্জাবিটা বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে গেল। পাঞ্জাবি পাতলা হওয়ার দরুন উনার শরীরের সাথে একেবারে মিশে গেছে। পাঞ্জাবিটা শরীরে একেবারে আঠার মত লেগে গেছে; যেমনটা কোনো প্লাস্টিকে সুপার গ্লু দিলে হয়। উনি জুতোগুলো খুলে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলেন। তারপর সোজা চলে গেলেন উনার স্ত্রীর কবরের পাশে।
কবরের পাশে গিয়ে মিজান সাহেব বসে পরলেন।

“নীলাঞ্জনা, তোমার গায়ে বৃষ্টির পানি লাগছে না তো? আমি ছাতাটা পাশে রেখে এলাম যে। নিয়ে আসব? গায়ে বৃষ্টি লাগছে তোমার? শরীরে বৃষ্টি লাগলে ঠাণ্ডা লাগবে যে তোমার। বৃষ্টি লাগছে না তো নীলাঞ্জনা? চুপ করে না থেকে আমায় বল নীলাঞ্জনা। আমার চিন্তা হচ্ছে যে খুব।”

কথাগুলো বলে মিজান সাহেব আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে লাগলেন। বৃষ্টির পানির সাথে উনার কান্নাগুলো মিশে একাকার হয়ে গেছে। গত শুক্রবার দুপুরবেলায়ও নীলাঞ্জনা ছিল। আমাদের জন্য ভালোমন্দ রান্না করল সেদিন। কিন্তু সন্ধ্যায়? ব্রেণ স্ট্রোক করে চলে গেল না ফেরার দেশে। হাসপাতাল নেওয়ার সময়টুকুও পাইনি। ইশ, বিধাতার কী নিয়ম! কী ইচ্ছা!

মিজান সাহেব এক দৃষ্টিতে উনার স্ত্রী নীলাঞ্জনার কবরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আচ্ছা, সবাই বলে একটা মানুষ মারা যাওয়ার ৪০ দিন পর্যন্ত তার রুহ’টা আমাদের চারপাশে ঘুরে। আচ্ছা, তাহলে কী নীলাঞ্জনা আমায় দেখতে পাচ্ছে? আমি যে তার কবরের পাশে এসেছি সেটা কী নীলাঞ্জনা দেখতে পাচ্ছে?

মানুষের প্রিয় জিনিসগুলোই কেন সবসময় হারায়? কী হত যদি নীলাঞ্জনা আর ক’টা বছর বেঁচে থাকত? আল্লাহ কেন এমনটা করলেন? কী দোষ ছিল আমার? এত তাড়াতাড়ি কেন তিনি আমার থেকে নীলাঞ্জনাকে কেড়ে নিলেন? কেন?
প্রিয় জিনিসগুলো হারালে মানুষ স্বাভাবিক থাকতে পারে না কখনও। নিরুপায় হয়ে যায়। বুকের ভিতরের কষ্টগুলো বারবার নাড়াচাড়া দিয়ে উঠে। ক্ষত জায়গাগুলো আরও বেশি ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। মানুষটা তখন দিশেহারা হয়ে উঠে। কী থেকে কী করবে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারে না। ব্রেণ কাজ করে না তখন; ঝং ধরে যায়। কষ্টগুলো কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লেগে যায়। হতে পারে সেইটা সামান্য বছর কিংবা মহা যুগ। কারও কারও আবার সেই কষ্ট কাটিয়ে উঠতে পেরিয়ে যায় পুরোটা জীবন।

মিজান সাহেব তার স্ত্রীর কবরের পাশে বসে আছেন। যেতে ইচ্ছে করছে না উনার। মন মানছে না নীলাঞ্জনাকে এভাবে একা রেখে চলে যেতে। এখন যদি উনি চলে যান তাহলে নীলাঞ্জনা হয়তো ভাববে তিনি স্বার্থপর। মিজান সাহেব উনার স্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন, জীবনে কখনও নীলাঞ্জনাকে একা রেখে যাবেন না। সবসময় পাশে থাকবেন। তাহলে আজকের এই দিনে তিনি নীলাঞ্জনাকে একা রেখে কীভাবে যাবেন? কবরস্থানের পাশের বকুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা ভেজা কুকুর মিজান সাহেবের দিকে তাকিয়ে ভীষণ জোরে জোরে ডাকাডাকি করতে লাগল। মিজান সাহেব সেদিকে একবার তাকিয়ে আবার উনার স্ত্রীর কবরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

আচমকা মিজান সাহেব তার বুকের বাম পাশটায় ভীষণ ব্যাথা অনুভব করতে লাগলেন। প্রচণ্ড ব্যাথা করছে। মিজান সাহেবের শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তিনি তার ডান হাত দিয়ে বুকের বাম পাশটায় শক্ত করে চাপ দিয়ে ধরলেন। ব্যাথা ক্রমশ বাড়ছেই। মাটিতে লুটিয়ে পরার আগে তিনি নীলাঞ্জনার কবরের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। রহস্যময় সেই হাসি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত