পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেছেন, “গরু কচুরিপানা খেতে পারলে মানুষ খেতে পারবে না কেন?” অনেকেও নাকি আবার রিসার্চ করে দেখেছে খাবার হিসেবে কচুরিপানার বিশেষ গুন রয়েছে। এ কথা শোনার পর থেকে আমাদের বাসায় ডেইলি মেন্যুতে কচুরিপানা জায়গা করে নিয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন কচুরিপানার রেসিপি! মা খুবই মনযোগ সহকারে এবং যত্ন করে রান্না করেন যেন মনে হয় উনিশ থেকে বিশ হলেই সেটা একদম বিষ হয়ে যাবে। আজ কচুরিপানার ভর্তা তো কাল গরুর মাংস দিয়ে কচুরিপানার ঝোল, পরশু পাবদা মাছ দিয়ে কচুরিপানার তরকারি! এভাবেই চলছে কচুরিপানার রাজত্ব! আর অন্যান্য শাক সবজি বিরোধীদলের মতো ক্ষমতায় আসার আপ্রাণ চেষ্টা করেই যাচ্ছে কিন্তু ফলাফল শূন্য!
আমার ধারণা ছিল বাবা কচুরিপানার রেসিপি ছুয়েও দেখবেন না। বাবা যেমন তেমন খাবার মুখে তুলেন না। যেমন, তিনি সাধারণ ভাবে রান্না করা ভাত খান না, তার জন্য স্পেশালি রান্না করতে হয় যেমন পানি চুলায় বসিয়ে আঁচ যত টুকু পর্যন্ত বাড়ানো যায় ততটুকু পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে হবে। তারপর পানিতে চাল দিয়ে চুলার আঁচ কমিয়ে দিতে হবে। তারপর ভাত হয়ে আসলে ফেন ফেলা যাবে না। ওই ফেনযুক্ত ভাতই বাবা গরম গরম খাবেন তবে তা ধোঁয়া উঠানো হতে হবে।
কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে বাবা দিব্যি কব্জি ডুবিয়ে কচুরিপানা দিয়ে প্রতিদিন খেয়েই যাচ্ছেন! আবার প্রশংসা ও করছেন মায়ের রান্নার। আর মা তো আয়েশ করে খাচ্ছেন ই। তার ধারণা এত সুস্বাদু জিনিস তিনি জীবনে খান নি। তিনি আরও বলছিলেন শুনছিলাম যে ফ্রীজে কচুরিপানা স্টক করে দিবেন যদি বাজারে আর না পাওয়া যায়!
শুধু খেতে পারছি না আমি। মেন্যুতে কচুরিপানা দেখলেই ইচ্ছে করে তাতে বমি করে দেই। প্রথম যেদিন কচুরিপানা রান্না হয় সেদিন ঘেন্নায় ভরা বাটিতে বমি করে দিয়েছিলাম। মা রেগেমেগে ফায়ার হয়ে বললেন, আজকে সারাদিন তুই না খেয়ে থাকবি। পানিও খাবি না। আমিও তাই করলাম!
এখনও প্রায়ই না খেয়ে থাকি কারণ আর যাইহোক মরে গেলেও আমি কচুরিপানা খাবো না। আমার আরও একটি ধারণা হলো, পৃথিবীতে একমাত্র পরিবার আমারই পরিবার যেখানে কচুরিপানা প্রতিদিনের রেসিপি! রোজ একবেলা কচুরিপানা রান্না হবেই। তো সেদিন সকালে বাবা বললেন, নীরা তোমাকে আজ দেখতে আসবে। বিকালে যে টিউশনি করো সেখানে আজ যাবে না। তারা বিকালেই আসবে।
আমি মনে মনে খুশিই হলাম। কিন্তু খুশির কারণ হলো পাত্রপক্ষের পছন্দ হয়ে গেলে ই আমি বাঁচি। শশুড়বাড়িতে নিশ্চয়ই কচুরিপানা রান্না হবে না। অনেক দিন ধরে ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করছি না। চোখ গর্তে ঢুকে গেছে একেবারে। গর্তে ঢুকা চোখে গাঢ় করে কাজল দিলাম। বিকাল বেলা পাত্রপক্ষের বাড়ি থেকে লোকজন আসলো। লারার মুখে মেহমানদের জন্যে মা কত ধরনের নাস্তা যে বানিয়েছেন শুনেই রান্নাঘরে গেলাম। রান্নাঘরে গিয়েই আমার চক্ষু চড়কগাছ! প্রায় সবই কচুরিপানার আইটেম! যেমন, কচুরিপানা চাউমিন, কচুরিপানার পায়েশ, কচুরিপানা ফ্রাই, আরেকটা স্পেশাল হলো কচুরিপানা তন্দামন্দা।
দেখতে স্যুপের মতো, এটা নাকি খুব সুস্বাদু! ইটালিয়ান মশলা টশলা দিয়ে কিভাবে কিভাবে যেন বানায়৷ মা বললো পরে আমাকে রেসিপি টা শিখিয়ে দিবে। আমার মাথা ঘুরতে শুরু হলো। এমনিতেই আমি আহামরি রূপবতী না তার উপর এসব দেখে পাত্রপক্ষ জীবনেও আমাকে পছন্দ করবে না। কিন্তু পাত্রপক্ষের আমাকে পছন্দ হয়ে গেল। এক সপ্তাহের মধ্যেই নাকি বিয়ে করাতে চায় তারা। এ খবর শুনে আমি মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। যখন জ্ঞান ফিরলো দেখলাম বাসার সবাই কৌতুহলী হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বাবা বললো, কি রে শরীর খারাপ নাকি! মাথা ঘুরে পড়ে গেলি যে। আমি বললাম,
-“ওরা আমাকে পছন্দ করলো কিভাবে বাবা? ” মা বিরক্ত হয়ে বললো
-” তুই কি দেখতে খুব খারাপ নাকি যে পছন্দ করবে না? ঢং করিস না তো।” বাবা মা চলে যাওয়ার পর লারা ফিসফিস করে আমাকে বললো, আপু গো দুলাভাই তো দেখতে একদম ঝাক্কাস হিরো দের মতো! সালমান খান ও ফেইল করবে! মা তো সবাইকে বলে দিয়েছে সব তুমি রান্না করেছে। তাদের যে কি প্রশংসা! তুমি তো কিছুই শোননি!
আমার আবারও মাথা ঘুরতে শুরু করলো। পাত্রপক্ষ কচুরিপানা খেয়ে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলো! কিভাবে সম্ভব! মাথা ঘুরতে ঘুরতেই বিয়েটা হয়ে গেলো আমার। শশুড়বাড়িতে রাতে ডিনার করার পরই বাসরঘরে ঢুকিয়ে দিলো ননদ-জায়েরা। বাসরঘরে বসে ঢেকুর তুলছি আর বরের অপেক্ষা করছি। আহ! অনেক দিন পর তৃপ্তি সহকারে খেলাম। শশুড়বাড়িতে প্রথম দিন ভয়, উত্তেজনায় কি কি আইটেম ছিলো দেখিও নি চুপচাপ খেয়েই গিয়েছি শুধু। কিন্তু খুবই সুস্বাদু ছিলো খাবার গুলো। বরকে জিজ্ঞেস করতে হবে এবং শাশুড়ি থেকে রেসিপি টা নিতে হবে। এমন সময় বর ঘরে ঢুকলো। এগিয়ে গিয়ে সালাম করলাম। বেচারা এসে কিসব বকর নকর টাইপ কথা শুরু করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে আমি তার খুবই পূর্ব পরিচিত। আমি একসময় বললাম,
-“আচ্ছা ডিনারে কি কি মেন্যু ছিলো? আসলে খিদে ছিলো তো শুধু খেয়েই গিয়েছি, খেয়াল করিনি। অনেক ইয়াম্মি ছিলো সবকিছুই।” বর বলতে শুরু করলো,
-” এইতো কচুরিপানা গরুর মাংসের ঝোল, গলদা চিংড়ি দিয়ে কচুরিপানা ভুনা, কচুরিপানার সবজি, বোয়াল মাছ দিয়ে কচুরিপানার। আর কিছু শোনার আগেই আবার অজ্ঞান হয়ে গেলাম। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পরও আবছা আবছা শুনছিলাম বর বলতেছে,
-“আসলে আমাদের বাড়িতে তিনবেলাই কচুরিপানা খাওয়া হয়। কচুরিপানার অনেক আর কিছু মনে নেই।