আমার একটা পাঁচ বছরের মেয়ে আছে জেনেও রিহান আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলো।পাচঁ বছর ধরে আমি যা চেয়েছিলাম তা পূর্ণ হলো আজ। তিতিকে রিহান তার মেয়ের স্বীকৃতি দিল।বিয়ের দিন আমাকে যেভাবে বউ সাজিয়েছে তিতিকেও সেইভাবে সাজিয়ে নিয়ে আসলো আমার শশুর-শাশুড়ি।ওনারা তিতিকে পেয়ে অনেক খুশি।বিয়ের পরদিন থেকে তিতির সাথে দুষ্টুমিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি।তিতির দুষ্টুমি বেড়ে গেলে মাঝেমধ্যে আমার ডাক পড়ে।
তিতির কারণে আমার অনেক বিয়ে ভেঙেছে।আমার বাবা-মাও এজন্য মাঝেমধ্যে অনেক বিরক্তবোধ করতেন।বিয়ে না হয়েও মেয়ে কোথায় পেলাম এই নিয়ে প্রশ্ন করতো পাত্র পক্ষ।আমি সত্যিটা বললেও তারা বিশ্বাস করতেননা তিতি আমার নিজের মেয়ে নয়।যে একজন আমার কথা বিশ্বাস করেছে সে হচ্ছে রিহান।আমার শ্বশুর মশাইও কথাটা বিশ্বাস করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়াও করলেন।যেন আমাকে সৃষ্টিকর্তা আরো রহমত করে।
তিতিকে আমি রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিলাম।আজ থেকে পাঁচ বছর দুই মাস আগের ঘটনা।ফজরের নামাজের পর হাটতে বের হওয়া আমার রোজকার ঘটনা।প্রতিদিনের মতো সেদিনও হাটতে বের হলাম শহরের রাস্তাগুলোতে।তখনো সূর্যের দেখা নেই।রাস্তাগুলো আবছা অন্ধকার।একটা ময়লার স্তূপে কয়েকটা কুকুরকে ব্যাগ ধরে টানাটানি করতে দেখে আগ্রহ নিয়ে সেদিকে গেলাম।
ব্যাগের ভিতর থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনে লাঠি দিয়ে কুকুরগুলোকে তাড়িয়ে দিয়ে ব্যাগটা একটা পরিস্কার জায়গায় নিয়ে গিয়ে ব্যাগের চেইন খুলে দেখলাম একটা সদ্য জন্ম নেওয়া রক্তাত শিশু।বাচ্চাটার অবস্থা খুব কঠিন।তখন আমার বয়স ১৫ হবে,রক্তাক্ত শিশুটি এভাবে একা পড়ে থাকতে দেখে ভিতরের মাতৃত্বটা একটু হলেও জেগে উঠলো ।মাঝেমধ্যে কয়েকটা খালি সিএনজি চলছে রাস্তায়।সিএনজি নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম একাই।হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে দৌড়তে হলো অনেক।নার্স বলল ডাক্তার আসতে একটু লেট হবে।তিতি তখন কেমন জানি করছিলেন,আমার সে কি কান্না তখন।মনে হচ্ছে তিতির সাথে আমার সম্পর্কটা নাড়ির।নার্স বলল রিসিপশনে বাচ্চার ঠিকানাটা দিন,বাচ্চা আপনার কি হয়?
বাবা-মাকেউ ততক্ষণে ফোনে ঘটনাটা বলে হাসপাতালে আসতে বললাম। ওনারাও এসে হাজির।ওনারা বারবার বলেছিলেন, কুড়িয়ে পেয়েছিস বলে দেয়।তুই তোর দায়িত্ব পালন করেছিস,এবার যা করার ওনারা করবে।
আমি ততোক্ষণে এড্রেসে বাচ্চার নাম আমার নামের সাথে মিল রেখে মায়সা জান্নাত তিতি আর মায়ের নামের জায়গায় নিজের নামটা লিখে দিলাম।
মাকে বললাম, মা তুমি যেমন আমাকে পেয়ে সাত রাজার ধন পাওয়ার খুশি হয়েছিলে,আমার মধ্যেও আজ সেই অনুভূতি হচ্ছে।প্লিজ মা তোমরা না করোনা।তিতি কার নাড়ি ছেড়া ধন আমি জানিনা কিন্তু তিতিকে আমি আমার মেয়ের মতোই ভালোবাসবো। তিতির কারণে আমাকে কেউ বিয়ে না করলে আমি সিঙ্গেল মাদার হয়ে থাকব আজীবন।তাও আমি তিতিকে চাই মা।
মা আর না করেননি।তিতি সুস্থ হয়ে ওঠলে তিনদিন পর হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসলাম। আত্মীয়-স্বজনরা কম কথা বলেনি বিয়ে দিতে সমস্যা হবে বলে।তারা অনেকে আমার তিতিকে দত্তক চাইতো,কিন্তু তিতিকে ছাড়া আমি যেমন এক মিনিটও থাকতে পারতাম না তিতিও তেমন আমাকে ছাড়া থাকতে পারতনা।সবসময় তিতির মা ডাক শুনতে মুখিয়ে থাকতাম।আত্মীয়-স্বজনরা অনেক কথা বলতো,মেয়েটা বড় হয়ে বাবা কে জানতে চাইলে কি বলবি?তোকেতো মেয়েসহ কোন যোয়ান ছেলে বিয়ে করবেনা।আমি মনে মনে তখন বলতাম, আমি আর আমার পরিবার যেভাবে তিতিকে মা ডাকার অধিকার দিয়েছি,তিতির জন্য সেরকম কোন বাবার পরিবারও অপেক্ষা করছে। সবার কথা মিথ্যা হয়ে গেলো,আর আমার মনের বিশ্বাসটা সত্যি হলো।রিহানের পরিবার তিতিকে তাদের নাতনি পরিচয় দিয়ে দিলো।
শ্বশুর আব্বা আর রিহান আমার তিতিকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে নিয়ে যাচ্ছে আজ।বাবার নামের খালি জায়গায় রিহান তার নাম দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তিতির জন্ম সনদ করে নিয়ে আসলো। আজ আমার প্রথম মনে হলো আমি তিতিকে আমি একটা পরিপূর্ণ পরিবার দিতে পারলাম।যেখানে সে সবার ভালোবাসা পেয়ে বেড়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট।তিতি আজ প্রথম আমার হাত ছেড়ে তার বাবা আর দাদার হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছে।আমার মেয়েটা অনেক দুষ্ট।যাওয়ার সময় আমার গালে চুমু দিয়ে বলে গেলো,দেখিস কিন্তু আমি বাসার বাইরে যাচ্ছি বলে সারা বাড়ি মাথায় করে ঘুরবি।নিজের খেয়াল রাখবি কিন্তু,খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করবি।
পাশে আমার শাশুড়ী হাসতে হাসতে গড়াগড়ি শুরু করে দিলো।ওনাকেও দুচারটা জ্ঞান দিয়ে তারপর মহাশয়া বিদায় নিলেন।আমিও শাশুড়ির সাথে হাসছি আর চোখেরজল মুছছি। আসলে আমি যখন ওকে বাসায় রেখে ভার্সিটিতে যেতাম তখন ওকে এই কথাগুলো বলতাম।জন্মটা আমি না দিয়েও শাসন আর ভালোবাসায় তাঁকে যে নিজের মেয়ের স্বীকৃতি দিয়ে দিলাম সে কথাতো আর তিতি জানেনা।মনেপ্রাণে চাই তিতি সেইকথা কোনদিন না জানুক।