গোলাপ

গোলাপ

-গোলাপের দাম কত ?? গোলাপ বিক্রেতা একটা বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল
-এই বুইড়া বয়সে কার লাইগা গোলাপ নিবেন চাচা? আহসান মিয়া রেগে গিয়ে বলল

-ওইটা তোমার না জানলেও চলবে। দাম বলো।
-লাল গোলাপ ৪০ টাকা। হলুদ আর সাদা ৩০।।
-কি বলো! এত দাম!
-হু নিলে নেন। না নিলে নাই।
-ঠিক আছে। তিনটা দাও। একটা লাল একটা সাদা আর একটা হলুদ দাও। তিনটা গোলাপ কিনে বাসার দিকে রওনা দিলেন আহসান মিয়া। গোলাপ বিক্রেতা পেছন থেকে বলল

-বুইড়া বয়সে ভীমরতি হইছে।

নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে আহসান আর রেহেনার। বিয়ের আগে নাকি বর কনের মুখ দেখতে নেই। ওদের দুইজনের দেখা হয়েছিলো বিয়ের পরের প্রথম রাতে। খাটের উপর গুটিশুটি হয়ে একটা মেয়ে বসা। বিশাল ঘোমটা দেয়া। আহসান গিয়ে পাশে বসে নতুন বউয়ের ঘোমটা উঠালো। চেহারা দেখে বেশ বুঝা যাচ্ছে মেয়ের বয়স খুব বেশি হলে ষোলো হবে। অপরদিকে তার বয়স ছাব্বিশ চলছে। বয়সের পার্থক্য পুরো দশ বছর।

-আমি আমার মায়ের গায়ের গন্ধ না পেলে ঘুমাতে পারি না। আহসান কে বলা রেহেনার প্রথম কথা ছিলো এটা।
-তাহলে কি তুমি কি সারা রাত জেগে কাটাবে?

রেহেনা আর কোনো কথা বলে নি। সেদিন রেহেনা ঘুমিয়েছিলো। মাকে ছাড়া এই প্রথমবারের মত। পরেরদিন সকালে রেহেনার বলা একটা কথা আহসানের আজো মনে পরে। ‘জানেন, আপনার গায়ের গন্ধ টাও কেমন যেন মাতাল করা।’ জীবনে কোনোদিন মিথ্যা না বলা মানুষটা সেদিন মিথ্যে বলেছিলো। শুধুমাত্র রেহেনাকে নিয়ে বাইরে সময় কাটানোর জন্য। পুরো এক বছর তাদের বিয়ের বয়স। তবুও কখনো দুইজন ঘুরতে বের হয়নি। রেহেনার জীবন যেন এই চার দেয়ালে আটকে গিয়েছিলো।

-মা, তোমার বউমার শরীর টা বেশি একটা ভালো না। ওকে একবার বদ্যি দেখিয়ে আনলে ভালো হয়।
-বদ্যি কে খবর দে। বাসায় এসে দেখুক। বউ এর বাইরে যাওয়ার কি দরকার?
-না মা। আসলে সামনের গ্রামে নাকি ভালো একটা বদ্যি থাকে। উনি নাকি দূরের কোথাও রোগী দেখিতে যান না। তাই আর কি?
-ঠিক আছে বাপু। যাও। টাকা কড়ি সাথে আছে তো?
-হ্যা মা। রেহেনাও সেদিন অসুস্থ না হয়েও অসুস্থ হওয়ার ভান ধরেছিলো। টানা রিকশায় বসে রেহেনা কে হাসতে হাসতে বলল

-তুমি যা অভিনয় করলে না রেহেনা!! মঞ্চ নাটক করেছো নাকি কখনো? রেহেনা লজ্জায় লাল হয়ে বলল
-নাহ। জানেন, আজকে আমি খুব খুশি।
-বাসায় গিয়ে কি বলবে সব মনে আছে তো?
-হ্যা। কিন্তু আমার না এরকম লুকিয়ে কোথাও যেতে…
-আরে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করারও তো একটা মজা আছে।
-ধ্যাত আপনি যে কি বলেন না!!
-এই তুমি আমাকে আপনি করে বলবে না তো।
-স্বামীদের তুমি করে বলতে হয় না। মা শিখিয়েছে।
-তা আর কি শিখিয়েছে তোমার মা?
-বলেছে সবসময় স্বামীর মন জুগিয়ে চলতে।

আহসান হাসলো। রেহেনার এই লোকটার হাসি ভীষণ ভালো লাগে। কেমন যেন ছেলে মানুষী হাসি। হঠাৎ করেই রেহেনা তার চাইতেও ১০ বছরের বড় স্বামীর প্রেমে পড়ে গেলো।

-ওইই দেখেন কি সুন্দর ফুল। আমাকে একটা ফুল কিনে দিবেন?
-আচ্ছা দাঁড়াও। আহসান তখন তিনটা ফুল কিনে এনে রেহেনার হাতে দিলো। ও বলল

-তিনটা তিন রঙের আনলেন কেন শুনি? আমার তো লাল রঙটাই পছন্দ।
-তুমি জানো, লাল হচ্ছে ভালোবাসার রঙ। সাদা পবিত্রতার আর হলুদ হচ্ছে বন্ধুত্বের রঙ। আমি চাই তোমার আর আমার মধ্যে শুধু ভালোবাসা না, বন্ধুত্বের আর পবিত্রতার সম্পর্ক গড়ে উঠুক। রেহেনা কথাগুলি শুনে মাথা নিচু করে ফেলল। তার চোখে যে পানি এসে গেছিলো সেটা এই মানুষটাকে দেখাতে চাইলো না। নিজেকে তার বড্ড সুখী মনে হচ্ছে। সারা রাস্তায় আর আহসানের দিকে তাকায় ই নি। আহসানের দিকে তাকাতেই তার লজ্জা লাগছে।

-বদ্যিমশাই কি ওষুধ দেয়ার বদলে গোলাপ ফুল ধরিয়ে দিলো? পানের পিক ফেলতে ফেলতে আহসানের মা এই প্রশ্ন টা ছুড়ে দিলো রেহেনার দিকে। রেহেনা ভয়ে পিছনে গোলাপ গুলা লুকিয়ে ফেলল।

-আসলে মা আসার পথে পুরো কথা টা শেষ করতে পারলো না আহসান।
-যেই ছেলে জীবনে আমাকে একদিনও মিথ্যে কথা বললো না আজ সেই ছেলেই বউয়ের পাল্লায় পড়ে আমাকে মিথ্যা বলল!!

তুই আর আমাকে মা বলে ডাকবি না। তোকে যে কেন পেটে ধরেছিলাম কে জানে? এরকম আরো অনেক কথা শুনিয়ে দিলেন রেহেনার শাশুড়ি। রেহেনা রাগে ক্ষোভে পরে সেই তিনটে গোলাপ ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছিলো। পানের ডিব্বা টা খুলতে গিয়ে রেহেনা খেয়াল করলো সেখানে পানের বদলে আছে তিনটে গোলাপ। আজকাল পান খাওয়ার বড্ড নেশা তার। একটা লাল, একটা সাদা, একটা হলুদ রাখা।

-এই ফুল গুলি কি আপনি এনেছেন??
-কই না তো। রেহেনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল
-সেদিনের মত আজকেও মিথ্যে বলছেন?
-তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা টা আজও ঠিক মত প্রকাশ করতে পারলাম না রেহেনা।

আমাদের যুগটা শিখিয়েছিল নিজের বিয়ে করা বউকেও ভালোবাসা টা বড্ড খারাপ একটা জিনিশ। তাকে নিয়ে আলাদা একটু ঘুরতে যাওয়া, ফুল নিয়ে আসা, কিংবা লুকিয়ে কিছু নিয়ে আসা খুব অন্যায় কোনো কাজ। তাই কখনো তোমার জন্য কোনো কিছু হাতে করে নিয়ে আসতে পারিনি। বাসার বাকি সবার যা পছন্দ ছিলো তাই এনেছি। কিন্তু তোমার পছন্দের কোনো কিছু আনা হয় নি।

-আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা আমি সবসময় বুঝতে পারি।
-আচ্ছা রেহেনা তোমার কি সত্যি ই মনে হয় আমি তোমাকে ভালোবাসি? আমি তো তোমাকে কোনোদিন ভালোবাসি বলিনি।

রেহেনা চুপ করে রইলো। -দাদি..দাদি চেঁচামিচি করতে করতে তার ৭ বছরের নাতনি মিনু টা ঘরে ঢুকলো। তার পেছনে পেছনে মিনুর মা ও খাবারের থালা হাতে ঘরে ঢুকলো। এসেই অভিযোগের সুরে বলল

-দেখুন তো মা একদম খেতে চাচ্ছে না। মিনু রেহেনা কে জড়িয়ে ধরে বলল
-দাদি, আমি আর খাবো না। রেহেনা আদুরে গলায় বলল
-না খেলে যে তোমাকে আজকে আর গল্প শুনানো হবে না দাদুভাই। ও তখন মুখ টা গম্ভীর করে বলল
-তুমি সবসময়ই আমাকে ব্লাকমেইল করো। পানের ডিব্বার দিকে তাকাতেই সামিয়া খেয়াল করলো সেখানে তিনটা গোলাপ। সামিয়া তখন দুষ্টামির হাসি হেসে বলল

-মা,গোলাপ কি বাবা এনে দিয়েছে?? তোমাদের মধ্যে কত্ত ভালোবাসা!! এর এক ভাগ ও যদি তোমার ছেলের থাকতো কত্ত ভালো হতো। ও তো আমাকে ফুলকপি ছাড়া জীবনে আর কোনো ফুল ই কিনে দিলো না। রেহেনা আর আহসান হেসে ফেলল। আহসানের মনে হচ্ছে তার ছেলেটাও তার মতই আনরোমান্টিক হয়েছে হয়ত। অপরদিকে রেহেনার মনে হচ্ছে সেদিন ময়লার ঝুড়িতে ফেলা ফুলগুলি ই যেন তার স্বামী ফিরিয়ে এনেছে দীর্ঘ ৩০ বছর পর।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত