আমি ও আমার মেয়ে

আমি ও আমার মেয়ে

আমার বড় মেয়ে কাল রাত থেকে চুপ। মন খারাপ করে রুমে বসে আছে। রাতেও খেতে আসেনি। সকালেও না। রাতে একবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছিলো, “ বাবা, তুমি কীভাবে এতো হাসো? কীভাবে এতো খুশি থাকো? ”

আমি তাঁকে জবাব দিয়েছিলাম এর উত্তরটা তোমায় সকালে দিবো। বাড়ির সামনের দোকান থেকে একশো টাকার একটা নোট সব পাঁচ টাকার নোটে রূপান্তরিত করলাম। টাকাগুলো নিয়ে মেয়েটার হাতে দিতেই সে বললো, “ বাবা আমার টাকার দরকার নাই তো! আমার কাছে আছে। আমি তোমাকে টাকাগুলো দেইনি। তুমি আপাতত রাখো, এবং আমার সাথে চলো। ” তাঁর চোখমুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে সে সারারাত কান্না করেছে। কারণটা আমি জানি না। কারণটা মনে হয় সে নিজেও জানে না! তাঁর মনে অশান্তি জমে গেছে। এটা বুঝতে পারছি। সে হাতমুখ ধুয়ে বললো, “ কোথায় যাবো? ” “ আমি যেদিকে যাই, যেখানে যাই। ”

হাঁটতে বললাম আমার সাথে। বাড়ির গেটে আসতেই একজন লোক হাত বাড়ালো। “ স্যার, একটা ট্যাকা দেন। সকাল থাইকা কিচ্ছু খাই নাই! ” আমি মেয়েকে বললাম, “ তাঁকে পাঁচ টাকা দিয়ে দাও। ” সে পাঁচ টাকার নোটগুলো থেকে একটা নোট লোকটাকে দিলো। লোকটার পা নেই দুটো। দুহাতে ভর দিয়ে চলে। তাঁকে আমি রোজ দুই টাকা দেই। আজকে পাঁচ টাকা পেয়ে সে বললো, “ স্যার, আজকে পাঁচ ট্যাকা দিলেন যে? আপনি তো কখনো দুই ট্যাকার বেশি দেন না! ” তাঁকে জবাব দিলাম, “ দুই টাকা আমার আর তিন টাকা আমার মেয়ের। তাঁর জন্য দোয়া করো, সে কাল থেকে কথা বলছে না বেশি! ”

লোকটার চোখে আমি পানি দেখতে পেলাম। সে কাঁদতে শুরু করলো। আমি মেয়েকে নিয়ে সামনে এগিয়ে একটা রিকশা নিলাম। সে জিজ্ঞেস করলো, “ বাবা, লোকটা ওভাবে কাঁদছিলো কেনো? ” “ তাঁর একটা মেয়ে আছে৷ সে বোবা। কথা বলতে পারে না। একটাই মেয়ে। কোনোদিন সে মেয়ের মুখে বাবা ডাক শুনতে পারেননি। ” মেয়েটা আর কিছু বললো না। রিকশা থেকে নামার পরে বললাম, “ তাঁকে ভাড়া দাও পনেরো টাকা। ” রিকশাওয়ালা বললো, “ স্যার ভাড়া তো বিশ ট্যাকা! ” “ আজকে আমার কাছে আর টাকা নাই! ” রিকশাওয়ালা মুচকি হেসে বললো, “ স্যার, ট্যাকা দেওন লাগবো না। এক ট্যাকাও না। ” আমি ঠিকাছে বলে চলে এলাম। আরেকটু এগুতেই মেয়ে বললো, “ তুমি লোকটার সাথে মিথ্যে বললে কেনো? তারপর টাকা নাই বলার পর খুশিতে আর এক টাকাও লাগবে না বললো কেনো? ”

আমি মেয়েকে বললাম, “ তাঁর ছোট ছেলেকে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করে দিয়েছিলাম আমি। সে ছেলে কালকে ক্লাসে সবচেয়ে বেশি নাম্বার পেয়েছে! ” সামনেই বাস স্টেশন। দুটো টিকিট কিনলাম। বাসে উঠে বসার পর মেয়ে বললো, “ তুমি কী আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছো? ” “ না, অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তুমি কী অসুস্থ? ” সে মাথা নাড়ালো। অসুস্থ না। আমার চেম্বারের একটু দূরে নামলাম। আমার চেম্বারে যেতে হলে দুটি এতিমখানা ও একটি বৃদ্ধাশ্রম পার হয়ে যেতে হয়।

এতিমখানার সামনে দিয়ে আসার সময় কিছু ছেলে সালাম দিচ্ছিলো। চার পাঁচবার যে কেউই সালামের সম্মুখীন হবে, এই এতিমখানার সামনে দিয়ে আসলে। আজকে তাঁরা সালাম দিচ্ছিলো আর আমার মেয়ে যেন অবাক হয়ে দেখছিলো। সে আরো অবাক হয়েছিলো যখন একটা ছেলেকে টাকা দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু ছেলেটা টাকা না নিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করে চলে যাওয়ার আগে বলেছিলো, “ দোয়া করবেন, আমার মা বাবাকে যেন আল্লাহ্ জান্নাত দান করেন। ” বৃদ্ধাশ্রমের সামনে দিয়ে গেলে দেখবেন। জানালা দিয়ে শেষ বয়সের বৃদ্ধরা কেমন করে তাকিয়ে আছে। চোখের দিকে তাকালে বুঝবেন। চোখের মাঝে যেন তাঁদের সন্তানদের অবহেলা ভেসে উঠছে।

ভেসে উঠছে কতো যত্ন করে খুকুদের বড় করেছিলো। সে খুকু বড় হয়ে যাওয়ার পরে আর তাঁদের প্রয়োজন মনে করেনি। তখন যদি আপনি তাঁদের সামনে যান। তাঁরা কিছুই বলবে না। চোখের কোণে অশ্রু দেখতে পারবেন। আরো একটু কাছে গেলে হয়তো আপনার মাথায় হাত রাখবে। আমার মেয়ে সাথে ছিলো। এক বৃদ্ধ মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে বললো, “ চোখে তো দেখিই না মা। দূর থেকে মনে হলো আমার মেয়েটা বুঝি নিতে এসেছে৷ তাই মাথায় হাত দিয়ে দেখছিলাম তাঁর চুলগুলো কী আগের মতোই আছে কিনা। কিছু মনে করবে না মা! ”

লোকটার সামনের দিকে একটা দাঁতও নেই৷ আমার মেয়ে মাথা নাড়ালো। সে কিছু মনে করেনি। আরো একটু সামনে যেতেই মেয়েটা বললো, “ বাবা তোমার তো প্রতিদিন মন খারাপ থাকার কথা এগুলো দেখে! তুমি তো হাসো! ” আমি তাঁর কথা শুনে হেসে বললাম, “ আমার কী একটা পা নেই? হাত নেই? নাকি আমার ছেলে মেয়েরা আমাকে ভালোবাসে না? নাকি আমি বৃদ্ধাশ্রমে? নাকি আমার কারো কাছে হাত পাততে হচ্ছে? ” মেয়েটা জবাব দিলো না। বললো, “ তোমার চেম্বারেই তো এসে গেলাম। ” “ হুম, কিন্তু একজনের বাড়িতে যাবো। ”

আরো পাঁচ মিনিট হাঁটার পর একটা বাসার কলিং বেল চাপলাম। একটা মেয়ে দরজা খুলেই আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো হাসলো। বসতে দিয়ে চা বানাতে চলে গেলো। আমার মেয়ে বললো, “ মেয়েটা কে? এটা কার বাসা? ” “ মেয়েটার নাম সাদিয়া। তাঁর বাবা আরেকটা বিয়ে করে এখন আলাদা আছে। প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেছে সে বাবার মুখ দেখেনি! মেয়েটা এবার নবম শ্রেণীতে পড়ে। এই বয়সেই সে পুরো বাড়িটা সামলায়। ছোট ভাই পড়ে পঞ্চম শ্রেণীতে। দুজনের সংসার। মা তো কবেই আকাশের তারা হয়ে গেছে।

স্কুলে গেলে সে একবার না একবার আমার কাছে আসবেই। কোনোদিন এক কাপ চা খাওয়ার জন্য হলেও যেন এখানে আসি। ” আমার মেয়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো, “ তোমাকেই বলে কেনো? ” “ কারণ তাঁর বাবা দেখতে আমার মতোই ছিলো। এবং আমার পাশের চেম্বারটিই তাঁর বাবার ছিলো। যা বহুদিন হলো বন্ধ আছে! ” সাদিয়া দু কাপ চা নিয়ে আসলো। সাদিয়া নামের অর্থ ভাগ্যবতী। কিন্তু কিছু সাদিয়া আছে যাদের ভাগ্য এতোই খারাপ হয় যে অভাগিনী বললেও কম বলা হয়। অবশ্য এই নামটাও তাঁর বাবাই রেখেছিলো।

আমার মেয়ে চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে বললো, “ তুমি খুব ভালো চা বানাও তো। কদিন পর পর চা খেতে চলে আসলে অসুবিধে হবে না তো? ” মেয়েটা যেন লজ্জা পেলো। বললো, একদম নাহ। পারলে আংকেলকে সাথে নিয়ে আসবেন। ” “ তুমি করে বলো না আমাকে। আমি কী খুব বেশি বড়? ” মেয়েটা মাথা নাড়িয়ে বললো, “ আচ্ছা। ” আমার মেয়ে উঠে বললো, “ চল তোর রান্নাঘরটা দেখি। ” সাদিয়া চমকে গেলো। কী এক অদ্ভুত চাহনি ওর। “ আচ্ছা, আজ না৷ কালকে আসবো। আমি একাই আসবো। ”

সাদিয়া আবার মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। কিছুক্ষণ পর সাদিয়াদের বাসা থেকে বের হওয়ার পর একটা রিকশা নিলাম। আমার মেয়ে আমার কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো! আমি তাঁকে বুঝানোর চেষ্টা করছি। মানছে না। আমি জানি এই কান্নার কারণ। সে যে দুনিয়াতে কতো সুখে আছে। আল্লাহ্ এর কতো রহমতের ছায়ায় আছে। তা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারার কান্না!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত