সুখের প্রদীপ

সুখের প্রদীপ

—নষ্টার ভাই যাচ্ছে রে, শালারে ধর; একটু জব্দ করি ৷ ওর বোনটার বিয়ে না দিয়ে ঘরে বসিয়ে রেখেছিলো ৷ শেষ পর্যন্ত ওর বোন যৌবনের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ভেগে গেছে ৷ এদের মত বাজে লোক গ্রামে অবস্থান করলে গ্রামের অন্য সবার মানসম্মান নষ্ট তো হবেই সেইসাথে গ্রামেরও বদনাম হবে ৷ এই গ্রামের ঐতিহ্য আছে, সেটা তো এদের জন্য মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া যায়না ৷ এদের গ্রাম থেকে অতি তাড়াতাড়ি তাড়ানো দরকার! মাতব্বরের নিকট বিচার দেওয়া লাগবে ৷ তার আগে চল, ব্যাটারে একটু শিক্ষা দিই!

স্পষ্টভাবেই শুনতে পেলাম কথাগুলো ৷ টং দোকানের বেঞ্চে বসে ছিল তিন তিনজন বখাটে ৷ তাদের একজন এমন নোংরা শব্দচয়ন করে যাচ্ছিল ৷ তাদেরকে উপেক্ষা করে হাঁটতে লাগলাম ৷ বাজারে যেতে হবে ৷ আব্বুই সচরাচর বাজার করে ৷ কিন্তু গতকাল আপু বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ায় সে লজ্জা ও অপমানের ভয়ে ঘর থেকেই বের হচ্ছেনা!

অপমানের ভয় আমার মধ্যেও রয়েছে ৷ লোকজনের কথা যে শুনতে হবে এটা ভাল করেই জানতাম ৷ কিন্তু অন্যের কথাকে কানে নিলে সমাজে টিকে থাকা সম্ভব না ৷ মাথা নিচু করে বিষন্ন মন নিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে চলছিলাম ৷ আচমকা আমাকে থামিয়ে দিলো প্রতিবেশী সেই তিনজন বখাটে যুবক ৷ আমাকে থামিয়ে দিয়ে মতিন নামের একজন মুখ বাকা করে তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বলল,

—-কিরে, তোর বোনের বিয়ে দিয়ে দিলি, অথচ দাওয়াত পেলাম না! এটা কিছু হলো? তোর বোনকে ছোট থেকে নজরে নজরে রেখেছি যাতে অন্যকারো কুনজরে না পড়ে ৷ এমন কাজের জন্য হলেও তো আমরা দাওয়াতটা ডিজার্ভ করি ৷ কিন্তু তোরা কি করলি ভাই? আমাদের দাওয়াত থেকে বঞ্চিত করলি? কাজটা ঠিক করিস নাই, হুহ! মতিনের কথাগুলো মুখ বুজে সহ্য করলাম ৷ সে থেমে গেলে খালেদ নামের একজন বাজে দেহভঙ্গিমায় নির্লজ্জের মত বলে উঠলো,

—-ভাই তোর দুলাভাইকে কেমন দেখতে রে? মালটা দারুণ তাইনা? দারুণ না হলে তো তোর সুন্দরী বোনটা ভাগতো না ৷ তবে যাই বলিস, আমরা কিন্তু কম ছিলাম না ৷ আমাদের কেন যে তোর বোনের চোখে পড়লোনা ৷ এবার ধৈর্য্য ধারণ করা সম্ভব হলোনা ৷ রাগের চরম সীমায় পৌঁছলাম ৷ চোখ মুখ রক্তিম হয়ে গেল ৷ মাথা শুরু থেকেই গরম ছিল ৷ মাথা আরো গরম হলো খালেদের কথা শুনে ৷ রক্তও যেন গরম হয়ে গেল ৷ চোখ দিয়ে অগ্নি ঝরার মত অবস্থা ৷ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে হাতের মুঠো পাকিয়ে খালেদের কপালে মারলাম সজোরে ঘুষি ৷ ব্যথায় ককিয়ে উঠে “ও মারে ও মারে” বলতে বলতে সে দৌঁড়ে পালালো!

বাকি দুজনও আমার ভয়াবহ রকমের রাগের অভিব্যক্তি দেখে আড়চোখে তাকাতে তাকাতে আমার সামনে থেকে প্রস্থান গ্রহণ করলো ৷ রাগকে সংবরণ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল ৷ বাধ্য হয়ে টং দোকানের বেঞ্চে বসলাম ৷ টং দোকানের মালিক শাহিন ভাই এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো ৷ গ্লাসটা নিয়ে ধীরস্থির ভাবে পানি খেয়ে নিলাম ৷ তবুও রাগের ভাবটা দূর হচ্ছিল না ৷ তীব্র রাগ আমার মাথায় এসে জরো হয়েছিল যা এখনো বিরাজ করছে ৷ আমার রাগের মাত্রা এতবেশি যে নীরব মুড থেকে হঠাৎ করে যদি ভায়োলেন্ট হয়ে যাই, তাহলে অবস্থা খুব কাহিল হয়ে যায় ৷ দোকানদার শাহিন ভাই আমার চোখে, মুখে প্রচন্ড রকমের রাগের ছাঁপ দেখে গলা ঝেরে মৃদ্যুস্বরে বলল,

—-ভাই, এই সমাজের মানুষ এমনই ৷ অন্যের ভাল দেখলে সহ্য হয়না, হিংসা করে ৷ আবার যখন খারাপ ও অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে যায় তখন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, অপমানে পিষিয়ে মারতে পছন্দ করে ৷ যারা তোমাকে জব্দ করলো তাদের পরিবারের বাজে চিত্র তুমি ভাল করেই জানো ৷ অথচ তারা কিন্তু নিজেদের খারাপ অবস্থার কথা নিয়ে ভাবছেনা ৷ ভাবছে অন্যের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে ৷ শোনো ভাই, এদের জন্য কষ্ট পেওনা ৷ এরা বলবেই, এরা তো রাস্তার কুকুরের মত ৷ ঘেউঘেউ করা স্বভাব! তুমি এখানে কিছুক্ষণ বসো ৷ মাথাটা ঠান্ডা হলে যেখানে যেতে চাইছো, সেখানে যেও!

শাহিন ভাইয়ের কথায় মনটা হালকা হলো ৷ ক্রমেই রাগটা কমে যাচ্ছিল ৷ ভাইয়ের কথাগুলো খুবই বাস্তবিক ও সত্য! সমাজের কিছু মানুষের কাজই অন্যের ব্যক্তিগত দোষ ত্রুটি নিয়ে নাক ছিটকানো অথচ নিজেদের দোষ ত্রুটি নিয়ে মোটেও ভাবেনা, ভাবার সময়ই যেন পায়না!

টং দোকানে আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে, রাগের ভাবটা পুরোপুরি কমে গেলে; চললাম বাজারের দিকে ৷ প্রায় ১ মাস পর বাজারে আসলাম ৷ কিছুটা হলেও ভাল লাগছিল ৷ একটা শপিং কম্প্লেক্সে ঢুকলাম আম্মুর জন্য নারিকেল তেলের বোতল কেনার জন্য ৷ আম্মু অনেকদিন ধরে আব্বুকে তেল আনতে বলছিল ৷ কিন্তু আব্বুর তেল আনার কথা মনেই থাকেনা ৷ এজন্য ভাবলাম আমিই কিনে নিয়ে যাই ৷ কসমেটিকসের দোকানে পৌঁছলাম ৷ দোকানের সামনে দাঁড়াতেই চোখ পড়লো একটা ক্রিমের দিকে ৷ ক্রিমের দিকে নজর দিতেই মনে কষ্ট এসে আঘাত হানলো ৷ চাপা কষ্টে বুকটা চিনচিন করে উঠলো ৷ আপু আমাকে প্রতি মাসের শেষদিকে ৫০০ টাকা ধরিয়ে দিতো এবং বলতো, “এই টাকা দিয়ে প্রথমে ক্রিমটা কিনবি এরপর যে টাকা বেচে যাবে, সেটা তোর ৷”

আপু আমাদের থেকে অচেনা কোথাও চলে গেছে ৷ সে আর আমাকে কখনো ক্রিম কেনার টাকা দিবেনা ৷ তাকে ক্রিম কিনে দেওয়াও হবেনা ৷ আপুর কথা এখন খুব করে মনে পরছে ৷ ভোঁতা এক কষ্ট বুকের ভেতরে অসহ্যকর যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছিল ৷ আপু কোথায় গেছে সেই ঠিকানাটা যদি পেতাম তবে এখনই তাকে খুঁজে আনতাম ৷ দরকার পড়লে আপুর পা ধরে বাসায় নিয়ে আসতাম ৷ কিন্তু হায় দূর্ভাগ্য! আপু কোথায় গেছে সেই ঠিকানাটাও অজানা!

নারিকল তেলের বোতল কেনা শেষে অন্যান্য পন্য-দ্রব্য কিনতে লাগলাম ৷ মাছের বাজারে ঢুকতেই আবারো আপুকে স্মরণ হলো ৷ আপু তেলাপেয়া মাছ খুব পছন্দ করতো ৷ তার জন্য এই মাছ প্রতিদিনই কিনতে হতো ৷ অন্যথায় যদি সে মাছ না পেতো সেদিন সে খাবারই খেতোনা ৷ আজকে আপু কি মাছ দিয়ে যে খাবার খাচ্ছে বা খাবে, কে জানে? তার ভালবাসার মানুষটি কি তেলাপেয়া মাছ কিনে এনেছে?

কিন্তু আপু তো মাছ কাটা শিখেনি ৷ সে কখনোই মাছ কাটতো না ৷ মাছের আঁইশের গন্ধ তার সহ্য হতোনা ৷ একারণে কখনো সে কাঁচা মাছের আশেপাশেও থাকতোনা ৷ কিন্তু রান্না পর ঠিকই সেই মাছ আয়েশ করে খেতো ৷ আপু তো মাছ কাটতে জানেনা, তাহলে কি আপু বাধ্য হয়ে মাছ কাটছে? নাকি সে এসব ঝামেলা থেকে মুক্ত? যেমনই হোক, আমি চাই আমার বোনটা যেন সবসময় ভাল থাকে, সব রকমের বিপদ আপদ ও ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকে! বাজার করা শেষ করে সন্ধ্যা পরপরই বাড়ির দিকে পৌঁছলাম ৷ বাড়িতে পৌঁছে দেখি আপু আম্মুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে ৷ আপুকে দেখামাত্র আমার বুকটা ভাললাগার আবেশে অস্বাভাবিকভাবে কেঁপে উঠলো ৷ অন্যরকম সুখের পরশে ভাললাগার আতিসাহ্যে অন্তরটা জুরিয়ে গেল ৷ প্রশান্ত মনটা আমাকে হাসতে বাধ্য করছিলো ৷ কিন্তু হাসি আটকে সুখের চরমে পৌঁছে গিয়ে আনন্দ অশ্রু ঝরতে লাগলো চোখের কোণ ঘেঁষে!

আপু আমাকে দেখে কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দিলো ৷ আব্বু বারান্দায় বসে ছিল আমি যখন বাজারে গেলাম তারও আগে থেকে; এখনো আব্বু সেখানেই বসে আছে ৷ তার চোখে, মুখে গাঢ় কষ্টের ছাঁপ স্পষ্ট ৷ মাথা নিচু করে বসে আছে সে ৷ চোখ দুটো চকচক করছে ৷ আপু ভয়ে তার দিকে তাকাচ্ছে না ৷ আমাকে দেখেই আপু আম্মুর শরীর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো ৷ এবং আমাকে জড়িয়ে ধরে ক্রন্দণরত অবস্থায় ভাঙ্গা গলায় বলল,

—-বিশ্বাস কর ভাই, আমি পালিয়ে যাইনি! আপুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবেগ তাড়িত কন্ঠে বললাম,

—-এসব কথা থাক আপু ৷ যা হবার হয়েছে! আপু আমার বুক থেকে সরে গিয়ে ভাঙ্গা গলাতে ফের বলল,

—-আসলেই ভাই, আমি পালাই নি ৷ গতকালই অর্ধেক রাস্তা যাবার পর ফিরে আসছি ৷ কিন্তু কাল বাড়িতে ফিরে আসার সাহস পাইনি ৷ এজন্য বান্ধবীর বাসায় উঠেছিলাম ৷ কিন্তু আজ বিকেলে যখন বান্ধবীর বাবা, মা জেনে গেল আমি বাসা থেকে পালিয়ে আসছি ৷ তখন তারা জোর করে তাদের বাসা থেকে বের করে দিলো এবং বললো, “বাসায় ফিরে যাও, যদি তোমার বাবা, মা জায়গা না দেয় তখন আমাদের এখানে চলে এসো ৷” এরপরই ভয়ার্ত মন নিয়ে বাসায় চলে এলাম ৷ আমি তো ভেবেছিলাম বাসায় ফিরলে বাবা আমাকে বাসাতে ঢুকতেই দিবেনা ৷ কিন্তু এমনটা ঘটেনি! আপুকে থামিয়ে দিয়ে আমার ছলছল চোখ দুটো তার চোখ বরাবর রেখে থেমে থেমে বললাম,

—-তো, তুমি ফিরে এলে কেন? সে কি ফিরিয়ে দিয়েছে তোমাকে? আপু হাতের তালু দিয়ে চোখ থেকে ঝরতে থাকা অনুশোচনার বারিধারা মুছে চাপাকন্ঠে বলল,

—-না, সেরকম কিছু না ৷ আমাদের কাজী অফিসে গিয়ে অপেক্ষা করার কথা ছিল ৷ কিন্তু আমি অর্ধেক রাস্তায় পৌঁছে ফিরে আসছি ৷ ফিরে আসছি নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে ৷ বাসে আমার পাশে বসেছিল মধ্যবয়সী একজন মহিলা ৷ তিনি হয়তো আমার অভিব্যক্তি দেখে আন্দাজ করেছিলেন আমি কি ভুল করতে যাচ্ছি! বেশকিছু কথা জিজ্ঞেসা করার পর তিনি তার মেয়ের জীবনে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনা আমার নিকট প্রকাশ করছিলেন ৷ মহিলার একমাত্র মেয়ের নাম অনিতা ৷৷

সে অনার্স প্রথমবর্ষের ছাত্রী ৷ কলেজ লাইফে সে একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক করে ৷ ছেলেটা অনেক আগেই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে একটা জব করছিল ৷ একদিন ছেলেটা অনিতাকে জোর দিয়ে বলে যে সে বিয়ে করবে ৷ এবং অনিতাকে বাসা থেকে পালানোর কথা বলে ৷ কিন্তু অনিতা প্রথমে রাজি ছিলোনা ৷ পরবর্তিতে যখন তার বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কচ্ছেদের কথা বললো তখন সে পালানোর জন্য রাজি হয়ে গেল ৷ অনিতাকে তার বয়ফ্রেন্ড কিছু টাকা নিয়ে বাসা ছাড়ার কথা বলেছিল ৷ সেই মোতাবেক অনিতা তার বাবার থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়েছিল সেমিস্টার ফি ও প্রাইভেটের টাকার ফি দেবার কথা বলে ৷ আর তার মায়ের সামান্য কিছু স্বর্ণের গহনা চুরি করে বাসা থেকে বের হয়েছিল ৷ অনিতা তার বাবার থেকে যে ২০ হাজার টাকা চেয়ে নিয়েছিল, ঐ টাকাটা ছিল তার বাবার চিকিৎসা করার জন্য জমানো টাকা ৷৷ তার বাবার বেশকিছু টেস্টের জন্য ২৫ হাজার টাকা লাগতো ৷ ২০ হাজার টাকা জমিয়েছিল কিন্তু সেটাও খরচ হলো মেয়ের জন্য ৷

একারণে অনিতার বাবা দেরিতে টেস্টগুলো করার সিদ্ধান্ত নেয় ৷ ওদিকে অনিতা বাসা থেকে পালিয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের ভাড়ায় চালিত বাসায় ওঠে ৷ ফ্ল্যাটের মালিক ও অন্যান্য লোকদের নিকট অনিতাকে স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেয় তার বয়ফ্রেন্ড ৷ অথচ তারা বিয়েই করেনি ৷ অনিতা তার বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ের জন্য জোরাজুরি করে কিন্তু তার বয়ফ্রেন্ড আজ নয় কাল বলতে বলতে ২ সপ্তাহ কাটিয়ে দেয় ৷ বিয়ের আশা দেখিয়ে অনিতার সাথে শারীরিক সম্পর্কও করে ফেলে ৷ একপর্যায়ে মেয়েটিকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেয় ৷ অনিতা তার বয়ফ্রেন্ডের এমন আচরণে অবাক হয়ে যায় ৷ তার যেন মাটির নিচ থেকে মাটি সরে যায় ৷ তার বয়ফ্রেন্ডকে অনেক অনুরোধ করেও সে বাসায় অবস্থান করার সুযোগ পায়নি ৷ বাধ্য হয়ে অনিতাকে আপন নীড়ে ফেরার সিদ্ধান্ত নিতে হয় ৷ এতদিন সে বাবা, মা আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ বন্ধ ছিল ৷ তাই তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেনি ৷

যখন সে গ্রামে ফিরলো তখন সে সত্যটা জেনে বড়সর আঘাত পেলো ৷ বিনা মেঘে বজ্রপাতের আঘাতে প্রাণ হারাতে যাচ্ছে এমন অবস্থা হলো তার ৷ অনিতার বাবা হার্টঅ্যাটাকে সেদিনই মারা যায় যেদিন সে বাসা থেকে পালিয়েছিল ৷ বাবা, মায়ের অকৃত্তিম ভালবাসাকে ভুলে অর্বাচিন কারো থেকে সুখের পরশ নিতে স্বর্গসুখকে পা পিষে চলে গিয়েছিল ৷ কিন্তু আজকে তাকে সেই সুখের নীড়ে ফিরতে হচ্ছে ৷ কিন্তু এখন ফিরে সে কেবল অনুতাপ করতে থাকবে ৷ যে ভুল করেছে, সেই ভুলের মাশুল স্বরুপ তাকে অনুশোচনায় প্রতিনিয়ত বিষাদের অনলে জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হতে হবে এবং চোখের অজস্র অশ্রুধারা বিয়োগ করতে হবে! অনিতা তার বাবাকে হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে যায় ৷ তার বাবার মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী করে ৷ সে ভেবেছিল তার মা তাকে বাসায় স্থান দিবেনা কিন্তু না, তার ধারণা ভুল ছিল ৷ অনিতা তার মায়ের পায়ে পরে গিয়ে মাফ চাইলে তার মা তাকে বুকে টেনে নেয়!

অনিতার জীবনকাহিনী শুনে আমার উপলদ্ধি হলো আমি যেটা করতে যাচ্ছি সেটা অবশ্যই অনিতার মত আরেকটি ভুল, মারাক্তক ভুল ৷ যে ভুলের ক্ষমা হয়না ৷ আমিও অনিতার মত বাবার থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়েছি ল্যাপটপ কেনার কথা বলে ৷ আম্মুর সমস্ত স্বর্ণের গহনা ও টাকা চুরি করেছি ৷ অনিতার বাবা হার্টঅ্যাটাকে মারা গেছে, কথাটি শুনে আমার বুকটা কেঁপে উঠেছিল ৷ ততক্ষণাত বাবার কথা মনে পরে গিয়েছিল ৷ আব্বু ব্লাড পেশারের রোগী, পাশাপাশি হার্টেরও সমস্যা আছে কিছুটা, আব্বু আমার চিন্তায় কেমন করছে এটা ভেবে আমার যেন আত্মা ছটফট করছিল বাড়ি ফেরার জন্য ৷ নিজেকে শামলাতে না পেরে বাসের ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলেছিলাম ৷ কাজী অফিসের দিকে না গিয়ে বাস থেকে নেমে পড়ি অন্য একটি বাসে করে নীড়ে ফেরার জন্য! সায়মা আপু আর কিছু না বলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আব্বুর পায়ের উপর পড়ে গেল ৷ এবং কান্নামিশ্রিত গলায় মিনোতির স্বরে বলল,

—-আমি জানি এই ভুলের কখনোই ক্ষমা হয়না বাবা ৷ তবুও আমি তোমার নিকট ক্ষমা ভিক্ষা চাইছি ৷ তুমি ক্ষমা না করলে যে আমি ধ্বংস হয়ে যাবো ৷ কখনোই সুখী হতে পারবোনা ৷ আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম বাবা, এজন্য ভাল-মন্দ বুঝে উঠতে পারিনি ৷ এবারের মত মাফ করে দাও আমাকে ৷ তোমরা যা বলবে সেটাই করবো ৷ তোমাদের বাধ্যনুগত সন্তান হয়ে থাকবো! আব্বুর চোখ দিয়ে শীতল অশ্রুসজল টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছিল চোখের দু-ধার দিয়ে ৷ চোখের পানিতে আব্বুর শুভ্রবর্ণের দাঁড়ি ভিজে গেল ৷ চোখের পানি না মুছে কাঁপা ঠোঁটে আবেগপ্রবণ কন্ঠে আব্বু বলল,

—-আমি তোকে তখনই ক্ষমা করে দিয়েছি যখন তুই বাড়ি ফিরলি ৷ এখন কান্না থামা ৷ তোর মা কালও কিছু খায়নি, আজও না ৷ তাকে কিছু খেতে বল! আপু আম্মুর হাত ধরে কাতরকন্ঠে বলল,

—-মেয়ে অন্যায় করেছে, সেজন্য কি না খেয়ে থাকবে তুমি? চলো খাবে চলো! আম্মু শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ থেকে গড়িয়ে পরা নোনাজল গাল থেকে মুছে তীক্ষ্ণকন্ঠে বলল,

—-শুধু কি আমিই না খেয়ে আছি? তোর আব্বু, তোর ভাই, তারাও না খেয়ে আছে ৷৷ তাদেরকে কে খেতে বলবে? রাফাত আজ বাজার করতে যাবার সময় বলেছিল, “যদি আপু আমাদের এতটুকু ভালবেসে থাকে তাহলে সে ফিরে আসবে ৷ তার ফেরার আশাতে আমি বাজার করতে যাচ্ছি ৷ যদি না ফেরে তাহলে আজকের পর কোনোদিনই আমি বাজার করবোনা ৷ যে বাড়িতে আমার বোনের অস্তিত্ব নেই, সেই বাড়িতে আমি সুখে কাটিয়ে দিতে পারবোনা ৷ তবে, আমার মন বলছে আপু ফিরবে, বাবা মায়ের ভালবাসা ও একমাত্র ভাইয়ের সোহাগের আশায় সে ফিরবে!” সত্যিই তুই ফিরলি মা ৷ এবং প্রমাণ করলি তুই আমাদের ভালবাসিস!

আজ প্রথমবার আপু নিজ হাতে তেলাপেয়া মাছ কাটছে ৷ তার নাকে দুর্গন্ধ আসছেনা ৷ সে মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে মাছ কেটে যাচ্ছে ৷ আমি আপুর পাশে বসা ৷ আপু মাছ কেটে টুকরো টুকরো করছিল ৷ মাছের যে টুকরো একটু বড় হচ্ছিল সেটাকে আমি ছোট করে কাটতে বলছি আপুকে ৷ আপু এতে রাগ দেখিয়ে বলছিল, “কুত্তা, এত ছোট করে কেটে কি বিড়ালকে খাওয়াবি? দুষ্টুমির হাসি হেসে বললাম, “হুম, বিড়ালকেই তো খাওয়াবো ৷ আমাদের বাসায় শুভ্রবর্ণের একটা বিড়াল রয়েছে ৷ যে তেলাপেয়া মাছ ভাগে ঠিকমত না পেলে চুরি করে খায়! আপু কপট রেগে গিয়ে মাছের আঁইশ আমার গালে মাখিয়ে দিয়ে শক্তকন্ঠে বলল,

—-কুত্তা, সামনে থেকে সরে যা ৷ নইলে তোকে আঁইশের শরবত বানিয়ে খাওয়াবো!

পাশ থেকে আম্মু ও আব্বু মিটমিট করে হাসছিল ৷ আজকে যেন আমাদের বাড়িটা সুখস্বর্গে রুপ নিয়েছে ৷ আপুকে ফিরে পেয়ে সত্যি সত্যি আমরা সুখের সাগরে ভাসছি! আসলে আমাদের ছোট্ট নীড়ে সুখের প্রদীপ বলতে আমার বড় বোনটা ৷ সে ছাড়া আমাদের ঘরটা একেবারে অন্ধকারে ছেয়ে যায় ৷ আশা করি আপু আমাদের ঘরটা আলোকিত রাখবে সারাটাজীবন ধরে ৷ স্বামীর ঘরে গিয়েও যেন সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের ঘরে এসে পড়ে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত