যেদিন প্রথম আমার স্বামীর ২য় বিয়ের খবর পেলাম প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো মিথ্যা কথা।আমি পাগলের মত ভেবে বসেছিলাম আমাকে বাপের বাড়ি থেকে ফিরিয়ে আনতেই এমন নাটক করছে সে।কিন্তু যখন জানলাম ঘটনা পুরো সত্যি আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছিল। মাস তিনেক আগেও আমাদের সংসারটা ছিল ভালবাসায় ভরা।এমন নয় যে আমার স্বামী আমার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন বা সংসারে কিছু নিয়ে অশান্তি ছিল।আমাদের ৬ বছরের একটা ছোট্ট রাজকুমারী আছে,মেঘা।আমি,আমার স্বামী, মেয়ে আর শাশুড়িসহ ৪ সদস্যের সুখী পরিবার।আমার শাশুড়ি যদিও আমাকে পছন্দ করতেন না তেমন তবুও আমি অসুখী ছিলাম।
কেনই বা অসুখী থাকবো। আমার তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসার।কতকিছু করেছি সংসারের জন্য।পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাল সাবজেক্টে পড়াশোনা করেও চাকরি করিনি সংসার আর সন্তানের জন্য। মাস তিনেক আগে আমার শাশুড়ি তার বোনের ডিভোর্সি মেয়েকে এনে তুললেন আমার সংসারে।এতে আমার কোন আপত্তি ছিল না।কিন্তু যখন দেখলাম মেয়েটা আমার সংসারের কর্তী হয়ে উঠতে চাইছে,শুধু তাই নয় আমার স্বামীর একটু বেশিই খেয়াল রাখছে মেনে নিতে পারিনি।প্রতিবাদ করেছিলাম।
হ্যা সেই প্রতিবাদই আমার কাল হয়েছিল।শাশুড়ি আর তার বোনের মেয়ে এমন কান ভারি করেছিল সেদিন আমার স্বামী জীবনে প্রথম আমার গায়ে হাত তোলে।মেনে নিতে পারিনি।এক কাপড়ে মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে এসেছিলাম।যদিও আমার স্বামী সেদিন আমাদের আটকায়নি তবুও ভেবেছিলাম রাগ ভাঙলে সে আমাদের নিতে আসবে।প্রথম প্রথম সে কল দিত আমি ধরতাম না।ভাবতাম এসে নিয়ে যাক।এভাবেই মান অভিমানে কেটে গেছে ৩ টা মাস। এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন পাশের বাড়ির ভাবী আমাকে কল করে।
-হ্যালো কেমন আছেন ভাবী?
-আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
-জ্বি ভাল।তা নিজের সংসারের খোজ খবর রাখেন?বাপের বাড়ি গিয়ে বসে তো আছেন।এ দিকে নিজের কি সর্বনাশ হচ্ছে খবর নিলেন না যে।
-কি হয়েছে ভাবী? আপনার ভাই ঠিক আছে?
-বহাল তবিয়তে আছে।ওই যে আপনার একটা ডিভোর্সী ননদ ছিল না ওর সাথে আপনার শাশুড়ি তো ভাইয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।
-কি যে বলেন ভাবী। আমাদের সাময়িক ঝগড়া হয়েছে ঠিকই ডিভোর্স তো হয়নি।তাছাড়া মেয়ে বড় হচ্ছে আপনার ভাই এমনটা করতেই পারেন না।
-ঠিক আছে খোজ নিয়ে দেখুন।রাখি।
খবর নিয়ে জানতে পারলাম ঘটনা সত্যি।আমি নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে।আমার বাবার আমার বড়লোক শ্বশুর বাড়ির সাথে লড়াই করার ক্ষমতা ছিল না।মা আমাকে বুঝালেন পুরুষ মানুষ এমন করতেই পারে।আমাকে নারী হিসেবে মেনে নিতে হবে যেহেতু আমার না আছে অর্থের জোর,না বাপের বাড়ির জোর।তাছাড়া মেয়ের একটা ভবিষ্যৎ আছে।সেটা মেনেই আমাকে আমার কপাল মেনে নিয়ে সতীনের ঘর করতে হবে। ও বাড়িতে যাওয়ার পর খুব যে ভাল ব্যাবহার পাব না জানতাম।তবুও মেনে নিয়ে সংসার করতে লাগলাম।আমার স্বামী যে আমাকে ভালবাসতেন না তা না কিন্তু মা আর ২য় স্ত্রীর জন্য অনেক কিছু পারতেন না করতে। সারাদিন আমার শাশুড়ি আর সতীন মিলে আমাকে খাটিয়ে মারতো আর রাত হলে ওনি আসলে আমার নামে বিচার দিত।
সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যেতাম।এতকিছু মেনে নিয়েও মেয়ের ভবিষ্যৎ আর স্বামীকে দেখার লোভে পড়ে ছিলাম কিন্তু আমার ধৈর্যের বাধ সেদিন ভেঙে গেল যেদিন জানলাম আমার সতীন প্রেগন্যান্ট। চোখের সামনে অনেক কিছু দেখার পর ও কেন জানি খবরটা মেনে নিতে বুক ফেটে যাচ্ছিল।মনে হচ্ছিল কলিজাটা কেউ ছুড়ি দিয়ে ফালা ফালা করে দিয়েছে।
সেদিন রাতেই এক বান্ধবীর সাথে যোগাযোগ করে বের হয়ে আসি ওই বাড়ি থেকে।বান্ধবীর সাহায্য নিয়ে একটা বেসরকারি অফিসে ছোট পোস্টে জয়েন্ট করি।ওভাবেই মা মেয়ে ঠায় করে নিয়েছিলাম একটা নতুন শহরে।মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে, ওর স্কুলের খরচ আর সংসারের খরচ মিলে খুব কষ্ট করে চলতাম।এর মাঝে বই খাতা কিনে বিসিএসের প্রিপারেশন শুরু করি।আল্লাহর অশেষ রহমতে এক বছরের কঠিন পরিশ্রমের পর আজ আমি একজন পুলিশ কর্মকর্তা।আজ কি নেই আমার।দামি কোয়ার্টার,গাড়ি, কাজের লোক,নাম,যশ সব আছে আমার।যে বাবা মা একদিন বোঝা হওয়ার ভয়ে সতীনের ঘর করতে বলেছিল আজ তাদের নয়নমণি আমি।পরিবারের সব সিদ্ধান্ত এখন আমিই নিই। এর মাঝে একদিন সকাল বেলা একজন কনস্টেবল এসে জানালো এক বৃদ্ধা দেখা করতে চায় আমার সাথে।তাকে বসাতে বলে আমি ড্রয়িংরুম এ গিয়ে আমি চমকে উঠলাম।মহিলাটি আর কেউ নন আমার শাশুড়ি। তার সেই জৌলুস আর নেই।পরনে ছেড়া ময়লা কাপড়।
-একি আপনি এখানে?
-হ্যা মা তোমার সাথে যে অন্যায় আমি করেছি তার ক্ষমা চাইতে আসলাম।আমাকে মাফ করে দাও।
-হঠাৎ এত বোধদয়?
-সেদিন তুমি বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার পর আমি আর আমার বোনের মেয়ে মিলে খোকাকে বাধ্য করেছিলাম আমার বোনের মেয়েকে বিয়ে করতে।
ও এ বিয়ে করতে চায়নি।আমি ওকে কসম দিয়েছিলাম।শুধু তাই নয় তোমার নামে বিষিয়েছিলাম।ভেবেছিলাম আমার নিজের ভাগ্নি আমাকে ভাল রাখবে কিন্তু না সে তার রুপ দেখাতে শুরু করে দিয়েছে বাচ্চাটা হবার পর।আমাকে কুকুর -বিড়ালের মত দুরছাই করে আর খোকাকে রাতদিন পুলিশের ভয় দেখায়।এক ফোটাও শান্তি দেয় না।জানো মা খোকা রোজ তোমার আর তোমার মেয়ের জন্য চোখের পানি ফেলে।
-এসব কথা আমাকে বলছেন কেন?আমি কি করতে পারি?
-আমার নাতনিকে নিয়ে ফিরে চলো মা।তোমাদের তো তালাক হয়নি।আর তাছাড়া তুমি এখন পুলিশের বড় অফিসার।ও তোমাকে তাড়ানোর সাহস পাবে না।
-আপনি ভাবলেন কি করে আমি ফিরে যাব?এসেছেন ভাল কথা।চা নাস্তা করে চলে যান
-বলছি কি দাদুভাই?
-ও পড়তে গেছে।দেখা হবে না।আপনি দয়া করে আসতে পারেন।
আমার শাশুড়ি চলে যাচ্ছে।বুঝতেই পারছি ওনার চোখ জলে ভরে উঠেছে।কিন্তু ওনার সাথে ঠিক এমনটাই হওয়া উচিৎ ছিল মানুষ হয়তো নিজের পাপ ভুলে যায় কিন্তু প্রকৃতি ঠিক তার বন্য প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়ে।প্রকৃতির প্রতিশোধ থেকে কারও মুক্তি নাই।