‘তোর বেস্টফ্রেন্ডকে পাত্র পক্ষ দেখতে এসেছে জানিস? শুনলাম পাত্র নাকি গুলিস্তানের হকার।’ বিছানায় শুয়ে ফেসবুকিং করছিলাম হুট করে রুমে আম্মা এসে এসব বলল। আম্মার কথা শুনে বড় ধরণের একটা টাস্কি খেলাম। বললাম…..
–দেখো তুমি আমাকে যাই বলো আমার বেস্টুর নামে উল্টাপাল্টা বলবানা, ও মেয়ে হিসেবে অনেক ভালো৷
-তোর কি মনে হয় আমি মিথ্যে বলেছি?
–অবশ্যই! চারুর নিজস্ব একটা ব্যক্তিত্য আছে। ও কখনো হকার ছেলেকে বিয়েতো দূরের কথা পছন্দও করেনা।
-বিশ্বাস না হলে তুই নিজে গিয়ে দেখে আয়।
–সিরিয়াসলি আম্মা? এটা আসলেও সত্যি?
-তো আমি মিথ্যে বলব কেন?
আম্মার কথাও ঠিক। হুদাই মিথ্যে কেন বলবে!? চারুকে কি আসলেই হকার দেখতে এসেছে? কেমন যেন কনফিউজড হয়ে গেলাম। আমাকে একটিবারও বললনা। শ্লা খাচ্চুন্নি। অমনি চারুর ফোন। আমি রিসিভ করতেই চারু বলল…..
–দোস্ত এখনি আমাদের বাসায় আয়।
-কেন কিচ্চে?
–তুই আয় আগে৷
-কাহিনী কি দোস্ত? আর শুনলাম তোকে নাকি পাত্র পক্ষ দেখতে এসেছে, তাও আবার হকার পাত্র?
–সব পরে বলব আগে তুই বাসায় আয়।
বলেই চারু ফোন কেঁটে দিলো। আমি আহাম্মক হয়ে বসে রইলাম। ঘটনা কি আসলেই সত্য। নাহ এটা হতে পারেনা। একটা হকারকে আমি দুলাভাই ডাকব? ইয়াম পসিবল। কোনরকম দৌঁড়ে চলে গেলাম চারুদের বাসায়। বসার রুমে দেখলাম কয়েকজন লোক বসা। আংকেলও উনাদের সাথে। আমি সালাম দিয়ে বিনিয়ম করলাম। আংকেল ইশারা দিয়ে বোঝালো উনার বাম পাশের ছেলেটা পাত্র। পাত্রের গলায় গামছা। সরিষার তেল জুবুথুবু করে মাথায় দেওয়া। মেয়েদের মতন মাঝখানে সিথি করেছে। দেখতে একদম তেইল্লাচোরার মতন লাগছে। মনচাচ্ছে দৌঁড়ে গিয়ে তেইল্লা চোরাকে কাতুকুতু দিয়ে এখানেই অজ্ঞান করে ফেলি। মনের বাসনা মনে রেখে চলে গেলাম চারুর রুমে। আমাকে দেখেই চারু উৎসাহিত হয়ে বলল…..
–উফফফ! তুই এসেছিস?
-না এসে উপায় আছে? এবার বল কাহিনী কি?
–কাহিনী আবার কি আমাকে দেখতে এসেছে।
-তাই বলে হকারকে বিয়ে করবি?
–কেন হকাররা কি মানুষ না?
-আমি সেটা বলিনি, কিন্তু কি মনে করে এমন হকারের সাথে বিয়ে করতে রাজি হলি?
–আরে গাধা, এই লোক হকার হলেও কত কিউট করে কথা বলে জানিস! সমানে দ্রুত গতিতে স্পষ্টভাবে কথা বলে, মিলিয়ে মিলিয়ে বলে৷ আমারতো হেব্বি লাগে।
-তোর মাথা গেছেরে!
–তুই চুপ কর, শোন। ও যখন ‘ইঁদুর মারেন তেলাপোকা মারেন’ এসব বলে আমার খুব ভালো লাগে। তাইতো বাবাকে বলেছি বিয়ে করলে হকারকেই করব।
চারুর কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। আল্লাহ ইমান দাও৷ তাহলে চারু একেই বিয়ে করবে। ওর পাত্র দেখে নিজেই ডিপ্রেশনে চলে গেলাম। অথচ বেস্টুর বিয়ে হিসেবে খুশিতে আমার লুঙ্গি ডান্স দেওয়া উচিৎ ছিল। বালের ডান্স দিমু। সঠিক দিনক্ষণ দেখে চারুর বিয়ে ঠিক হলো সেই হকারের সাথে। চারু ফেসবুকে রিলেশনশিপ স্টাটাস দিলো৷ নিকনেম তাসনিমা থেকে ‘হকারু লতা’ দিলো। ভিওতে লিখলো ‘আই অ্যাম চারু, মাই হাজবেন্ড ইজ হকারু।’ দিনশেষে যেই চারু আমার সাথে কথা বলতো সে এখন ‘ইদুর মারেন তেলাপোকা মারেন’ এসব শোনে। মোবাইলের রিংটোন পর্যন্ত এটা দিয়েছে। ভাবা যায় এগ্লা? ভং ধরে বিছানায় শুয়ে আছি, চারু কল দিলো। রিসিভ করতেই বলল….
–এ শোননা?
-হুম বল।
–তোর দুলাভাইকে নিয়ে একটা কবিতা লিখছি, তুইতো টুকটাক লিখিস দেখতো কেমন হয়েছে।
-তুইওতো লিখিস?
–তুই দেখ আগে, পোস্ট করেছি।
আমি ফেসবুকে ঢুকলাম। চারুর আইডিতে গিয়ে কবিতা দেখে টাস্কি খেয়ে পরে রইলাম। হোয়াট এ কবিতা৷ ও লিখছে ‘আমি পাগল হয়েছি তোমার প্রেমে, পাগল হয়েছি তোমার ঐ পাগলা জমবাগ মলমের! যেই মলমের গুনাগুন লেখার সাহস নেই কোন কলমের।’ নিচের টুকু পড়তে পারলাম না। আমি আবেগে আপ্লুত হলাম। দরজার চিপায় আঙ্গুল রেখে চাপ দিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করলাম। নাহ আর পারছিনা। কি কবিতা লিখলাম জীবনে! আজ চারুর বিয়ে। বর এসেছে। খাওয়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমাকে। অনেক লোকজন এসেছে। সবাই গপাগপ করে খাচ্ছে। মন চাচ্ছে বিরিয়ানির প্লেটে মাথা ঠেসে ধরি। কিন্তু নাহ তা করা যাবেনা। মানইজ্জত সব শেষ হবে৷ এক মুরুব্বি কে মাংস দিব তখন-ই সে বলল….
-বাবা আমি গরুর মাংস খাইনা, আমার এলার্জি। এই কথা বলার সাথেসাথে চারুর বর এক লাফে উঠে আসলো, বলল….
–সমস্যা মাই চাচা, কিচ্ছু হবেনা। খাওয়া শুরু করেন এলার্জির ঔষধের বাপ আমি।
চাচা মুচকি হেসে খাওয়া শুরু করলো৷ খাওয়া শেষ হতেই চাচার শুরু হলো খাউজানি। চাচা সমানে পিঠ, পেট চুলকাচ্ছে। তখন চারুর বাবা বিষয়টি বুঝতে পেরে বলল, ‘জামাই বাবা তোমার কেলমা শুরু করো।’ সবার মাথা কি গেলো নাকি এই বিয়ে বাড়িতে হকারু গিরি করবে? খেয়াল করে দেখলাম চারুর বর মাথার টুপি খুললো। তারপর হাতে মলম নিয়ে বলা শুরু করলো ‘ইঁদুর মারেন, তেলাপোকা মারেন, ছাড়পোকা মারেন। জাগায় খায় জাগায় মরে, চিত অইয়া খায় কাইত অইয়া মরে। খাউজানি, চুলকানি, বাত ব্যথা, কোমড় ব্যাথা, হাটু ব্যথা, পা ব্যথা আর নয় দুশ্চিন্তা। আপনাদের জন্য সুদূর ভারত থেকে নিয়ে এসেছি আমি আজমল হকার পাগলা জামবাগ মলম। একবার লাগালেই ব্যথার চৌদ্দ গুষ্টি মরে যাবে। ঐ রাখখখখরে মূল্য, শুনে যান ভাই আমি কোন গল্প করছিনা আপনাদের জন্য রইলো মাত্র ২০ টাকা, ২০ টাকা ২০ টা।’
চারুর বরকে আর পায় কে। বিয়ের আসরের যত মানুষের অসুখ ছিলো সবাই গণহারে মলম নেওয়া শুরু করলো৷ মলমও আনছিলো, ওরে চিটার। আমি অবাক হয়ে কাণ্ড দেখছি। আবার হকারু ভাই শুরু করলো ‘ছোট ছেলে-মেয়েদের জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা, পয়েন্টে পয়েন্টে ব্যথা। আঙ্গুলের চিপায় চাপায় খাইজানি, দাউদ একজিমা। বগলের তলে খাউজানি, দুই রানের চিপায় চুলকায়, আর নয় রংপুর ঢাকা, এইইইইই চলে আসেন আমার কাছে এলেই পাবেন আলিবাবা মলম, মূল্য মাত্র ১০ টাকা ১০ টাকা ১০ টাকা।’ সবাই আগ্রহের সাথে ঔষধ কিনছে। চিন্তা করা যায়? বিয়ে বাড়িটাকে গরু হাট বানিয়ে ফেলছে। এদিকে চারুর বরের বাম্পার ব্যবসা হচ্ছে। ঔষধ প্রায় শেষের দিকে। আমি সবকিছু ছেড়ে চারুর রুমে গেলাম। কিছু বলতে যাব আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল….
–চুপ করে বোস, এখন কিছু বলিসনা।
-কেন?
–দেখছিস না তোর দুলাভাই হকারুসংগীত গাইছে। আমি শুনছি কত কিউট করে গাইছে ইসসস…!
আমি তব্দা খেয়ে বসে রইলাম। হকারু আবার সঙ্গীত হয় কেমনে? এ জীবন রাখবনা। বিরিয়ানি খেয়ে মরে যাব। মন খারাপ করে খানা পিনা যে ঘরে রেডি করা হয় সেই রুমে গেলাম। কেউ নেই, সবাই হকারু সংগীত শুনতে গেছে। বড় গামলা ভরে শুধু রোস্ট নিলাম। কানে হেডফোন লাগিয়ে রোস্ট খেতে শুরু করলাম। এই ডিপ্রেশন কমাতে আজ প্রচুর রোস্ট খেতে হবে। আলবিদা!