ছাব্বিশ বছরে যখন আমার বিয়ে হয় তখন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম এই ভেবে- যাক অবশেষে বিয়েটা হলো আমার। কত্ত কত্ত কথা যে শুনতে হয়েছিলো বিয়ে হচ্ছে না বলে তার ইয়াত্তা নেই। পাশের বাড়িব চাচি গল্প করতো; যেই ঘরে বিয়ে না হওয়া মেয়ে থাকে সেই ঘরে নাকি অভাব অনটন লেগে থাকে। সুখ শান্তি থাকে না। আবার তার নিজের মেয়ের উদাহরণ টেনে বলতো-
–তুমি আর আমার হেলেন তো একি বয়সের। হেলেনের আল্লাহর রহমতে ৩ জন ছেলে মেয়ে। বড় মেয়ে ফাইভে পড়ে বিয়ের সমন্ধও আসে। আরও যে কত কথার তীরে বিদ্ধ হতাম তার শেষ নেই। এইসব কথা শুনতে শুনতে এক সময় মনে হতো- আমার তো বিয়ের বয়স শেষ হয়েই গেছে আর বিয়ে হবেনা কোনোদিন। নানীর কতো আদরের ছিলাম সেও দেখে যেতে পারলো না বিয়েটা। বাবা রোজ রোজ অসুস্থ হচ্ছে কিছু যদি হয়ে যায় তাহলে তো আর কোনদিনই বিয়ে হবে না।
পাড়ার চাচী, ফুফু টাইপের নারীরা মাঝেমধ্যে সমন্ধ নিয়ে আসে। ছেলে আইএ পাশ কম্পানিতে চাকুরী করে ভালো টাকা বেতন পায়। আবার ছেলে ব্যবসা করে দেখতে সুন্দর, শহরে বাড়ি আছে, বাপের অনেক নাম ডাক আছে। মায়ের কাছে বলে কিন্তু মা সায় তো দেয়ই না বরং না করে দেয়। বাবার কাছে বলার আর সাহসই পায় না।
আশেপাশে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। সেখানে পরিচিতরা আলোচনা করে কেউ কেউ সমবেদনাও জানায়। আহা! মেয়েটা তো খারাপ না, কেনো এখনো বিয়ে হয়না, চেহারায় বয়স এখনো বোঝা যায় না, বাপ মায়ের বিয়ে দেয়ার কোনো গরজই নেই। বিভিন্ন কিছিমের কথা।
যখন কানে আসে মনে হয় যেনো লেখাপড়া করে মস্ত পাপ করেছি। সারাক্ষণ চিন্তা করে হতাশায় ভূগতাম। অথচ এই এলাকায় আমিই প্রথম সদ্য মাস্টার্স কম্পিলিট করা মেয়ে। আমার সহপাঠিরা প্রায় ৯৫% অবিবাহিত। তারপরও দুচিন্তা যেন হাঁটুগেড়ে বসে থাকে আমার মাথায় উপর। কেনো বিয়ে হচ্ছে না, কেনো? আর কতদিন প্রতিবেশীরা আমাকে পঁচিয়ে কথা বলবে? আর কতদিন শুনতে হবে? বিয়ে হওয়া এতো জরুরি, বিয়ে হতেই হবে? কই অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া মেয়েগুলোর বেশিরভাগইতো ভালো নেই। তাহলে এতো কথা ওরাই আবার বলে কেনো? এখন চাকরীর চিন্তা বাদ দিয়ে যেনো বিয়ে না হওয়ার চিন্তাই মূল হয়ে গেলো। মন আর যেনো বড় কিছুর চিন্তাই আর করতে পারছে না।
হুম, আমাদের গ্রাম্য সমাজ। ১৫/১৬ বছরের মধ্যে বিয়ে হলে মেয়েকে এক কথায় ভাগ্যবতী মনে করা হয়। মায়েরা গর্বে গর্বে গর্ভবতী হয়ে যায়। At a time মা মেয়ের বাচ্চা হয়। দুই চার বছর পরে আর চেনা যায় না কে মা আর কে মেয়ে? কয়েক মাস যেতে না যেতেই শশুর বাড়িব বিরুদ্ধে ঝাঁপি ঝাঁপি অভিযোগের পসরা নিয়ে বসে।বিশ বছরের মেয়েকে দেখলে মনে হয় যেনো চল্লিশ শেষ হয়েছে। তারপরও কম বয়সের বিয়েকে তারা সৌভাগ্যের নজিরা মনে করেন। শিক্ষার আলো যখন প্রবেশ করবে এ সমাজের পরতে পরতে তখন ঘুঁচে যাবে এ অন্ধ আনন্দ হাসি সে অপেক্ষা শুধু। এক অপরাহ্নে ছোট বোন এসে বললো।
–মহুয়া, তোর জন্য এক বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। ছেলে গভমেন্ট জব করে প্রথম শ্রেণির। দেখতেও নাকি দারুণ। শহরেই সবকিছু বাবা দেখে এসেছে। পছন্দ হয়েছে তার। এখন তোদের দেখাদেখি হবে আর পছন্দ হলেই বিয়ে।
শুনেই আনন্দে যেনো চুপসে যাওয়া মনটা প্রসারিত হতে থাকলো। সময়টা যেনো ঝলমল করে কাটছে। হাজার বার আয়নার সামনে যাই। নিজেকে দেখি খুঁটে খুঁটে বারবার। কোন্ ড্রেসটা পরে সামনে যাবো, কিভাবে সাজবো, কীভাবে কথা বলবো?
ইত্যাদি ইত্যাদি মোটকথা এক খুশির পরিকল্পনার হাট বসেছে যেনো আমার সমস্ত জুড়ে। সারারাত স্বপ্নের সাগরে ভেসেছি। পরের দিন এসে গেলো সেই দেখাদেখির মুহূর্ত। যেনো এক রাজপুত্র সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি দেখেই কুপোকাত। কী জানতে চেয়েছিলো আর কী জানতে চায়নি সেও মাথায় নেই। অস্থির সুখের কাঁপনে ঠকঠক করে কাঁপছিলাম। আর হ্যাঁ রাজপুত্রও আমাকে পছন্দ করে মনের অন্দরমহলে ঠাঁই দিয়ে ফেলেছিলো। শেষতক যা হবার তা ই হলো। আমাদের বিয়ে হলো এবং আমার বিয়ে হলো।
প্রতিবেশীর মুখ বন্ধ হলো এবার তাহলে। যাক বাঁচা গেলো আর কথা শুনতে হবে না। ঝড়টা যে বড় গাছেই বেশি লাগে আর বড় মাছ কেনার ক্রেতা বাজারে কমই থাকে এই কথা গুলোর মর্ম অনুধাবন করছিলাম তখন।
ওমা, সে কি আবার কথা! এবার বেবি হচ্ছে না কেনো? বয়স অনেক হয়েছে। তাড়াতাড়ি বেবি নিয়ে নাও। পরে কিন্তু বেবি আর হবে না। নানান প্রশ্নের বাণ আবারো। নাহ্ এবার আর আল্লাহ বেশিদিন কথা শোনালেন না। বিয়ের দের বছরের মধ্যেই আল্লাহর রহমতে বেবি হলো। এবার সুন্দর করে যখন বেবিকে লালন পালন করছিলাম তখনও বাঁকা কথার বিষ বন্ধ হয়নি।
— বয়স হয়ে বাচ্চা হইছে লালন পালন তো করবেই ভালোভাবে। আমাগো বয়সে কি মা হইছে যে পারবেনা। এবার আর পারলাম না সইতে। নিজেকে নিজেই শুনাইলাম। ওরে বাছা! তুই তোর মত চল, নিন্দুকেরা ছুঁড়বেই ছুঁড়বে তাদের নোংরা কথার জল। কেউ শিক্ষার অভাবে, কেউ বা স্বভাবে, তুই করিসনা তাতে তোর সিদ্ধান্ত বদল। তুই তোর মতো চল, বিবেকের পাল উড়িয়ে গড়িস মনোবল।