পরপর দুটি কন্যাসন্তান হওয়ায় পর ডাক্তার জানায় জেনির আর কখনো বাচ্চা হবে না তাই রাফিদ আরেকটা বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গেছে। অথচ রাফিদ জেনিকে ভালবেসে বিয়ে করেছে। জেনি রাফিদকে খুব ভালোবাসে কিন্তু এ কদিনে রাফিদ যেন কেমন হয়ে গেছে। প্রতিদিন বাসায় এসে খারাপ ব্যবহার করে জেনির সাথে। ছোট্ট ছোট্ট নিষ্পাপ শিশুগুলোকেও একটু আদর করে না, কোলে নেয় না। অথচ এই রাফিদই বিয়ের আগে বলেছিল, ‘আমি আমার সন্তানের নিয়ে সারাক্ষণ মেতে থাকবো।’ তখন যদি বোঝতাম, মাঝে মাঝে সন্তান বলতে শুধু ছেলে সন্তান বোঝায়, তাহলে রাফিদের সাথে বিয়েতে কখনো রাজি হতাম না।
-রাফিদ.! একটু আমার দিকে তাকাও তুমি.!
-তুমি কি এমন গুণবতী, ভাগ্যবতী যে তোমার দিকে তাকাতে হবে.?
-আমি গুণবতী, ভাগ্যবতী কিছু না হলেও আমি তোমার বউ। তাকাও একটু.! তোমার সেই আগের চোখটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। যেই চোখ আমার ভালবাসার পূর্ণ।
প্রচন্ড রাগ নিয়ে লাল চোখে জেনির দিকে তাকালো রাফিদ। তবু জেনি ভয় না পেয়ে ওই লাল চোখেও ভালবাসা খোঁজতে লাগলো। হঠাৎ রাফিদ একটা কষিয়ে থাপ্পর মারলো জেনির গালে। জেনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি, কান্না করে যাচ্ছে। কদিন পর রাফিদ একটা মেয়েকে বাসায় নিয়ে আসছে। দেখতে বেশ সুন্দরী কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে খুব গরীব। জেনি রাফিদকে জিজ্ঞেস করলো,
-রাফিদ, তুমি কি উনাকে বিয়ে করেছ.?
-নাহ।
-তাহলে এসব কি? এত রাতে উনাকে বাসায় আনছো কেন.?
-আমার বাসা আমার ইচ্ছে হয়েছে আনছি।
-এটা কোনো উত্তর হতে পারে না। তুমি মেয়েটাকে ওর বাসায় দিয়ে আসো।
-তোমার সাহস বেড়ে গেছে। এত কথা কেন বলো.? মার খাওয়ার সখ জেগেছে.?
-তুমি আমাকে মারো কাটো আর যাই করো। তবুও মেয়েটিকে ওর বাসায় দিয়ে আসো। এভাবে মেয়েটির জীবন নষ্ট করো না, প্লিজ।
রাফিদ জেনির কথা শুনে চুপি চুপি রুম থেকে বের হয়ে বাইরে থেকে দরজা নক করে চলে যায়। জেনি বারবার চেষ্টা করছে দরজা খোলার কিন্তু কিছুতেই খোলছে না। অঝর দ্বারার কাঁদছে মেয়েটি। জীবনের সবচেয়ে বিশ্বাসী মানুষটা যদি অবিশ্বাসী কাজ করে তখন হৃদয়টা ভেঙে টুকরোটুকরো হয়ে যায়। জেনি আত্মহত্যা করবেভাবছে। এ জীবন রেখে কি লাভ.! অনেক্ষণ এভাবেই দরজার কাছে নিষ্চুপ বসে কাঁদছিল জেনি আর মনে মনে ভাবছে কিভাবে আত্মহত্যা করা যায়। হঠাৎ ওর ৮মাস বয়সের মেয়েটি কেঁদে উঠলো। জেনি দরজা থেকে উঠে দৌড়ে মেয়ের কাছে গেল। মেয়েকে জনমের মত আদর দিয়ে, খাইয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়ার প্লান করছে। এমন সময় জেনির চোখের দুফোটা জল বড় মেয়েটার ঠিক চোখে পরার বড়মেয়েও কান্না করে জেগে উঠে। বড় মেয়েটি কান্না থামিয়ে আদর, জড়তামাথা পিচ্ছি কন্ঠে বলে,
-আম্মু, কাঁচছ(কাঁদছো) কেন.?
জেনি কোনো কথা বলতে পারছে না। অবুঝ শিশু না মেয়েশিশু দুটির দিকে চেয়ে আছে। ওদের কান্না থামানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছে। সেদিন রাতটাও চলে গেছে। আসলেই, খারাপ সময়ের ভালো দিক হলো এটা একটা সময় চলে যায়। রাফিদের সাথে জেনির ১সপ্তাহ থেকে কোনো কথা নেই। পুরো বাসা চুপচাপ। মেয়ে দুটোও কয়েকদিন থেকে চুপচাপ হয়ে গেছে। ওরাও হয়তো অনেক কিছু বোঝে! এর কিছুদিন পর রাফিদ আরেকটা বিয়ে করে। মেয়েটা কেমন যেনো ও রাফিদকে স্বামী হিসেবে যতটা না দেখতে পারে তার থেকে টাকাওয়ালা হিসেবে দেখে। জেনি একমাসের মত রাফিদের সাথে থেকে মেয়ে দুটোকে নিয়ে চলে আসে। জেনি খুব আশ্চর্য হয় যে, জেনি বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মেয়ে দুটোকেও আটকায় নি রাফিদ।
বছর দুয়েক পর শুনছিলাম রাফিদের একটা ছেলে হয়েছে। এর পরের বছর আরেকটা ছেলে হয়েছিল। আর শুনলাম, কদিন আগে নাকি দুই ছেলে আর ওদের মা মিলে মেরে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। জেনি আপসুস করে বলছে- ইশ, কখন কখন ছেলে সন্তান কুলাঙ্গার হয় রাফিদটা যদি বোঝতো আজ অনেক বছর পর মেয়েদেরকে জীবনের গল্প শুনাচ্ছিল জেনি। বড় মেয়েকে আর্মি বানিয়েছে আর ছোটটা মেডিকেলে পড়ছে। মেয়েদের চোখের কোণে জল জমেছে। বাবার প্রতি অভিমানও জমেছে।
-আম্মু.! আব্বুকে কি তালাক দিয়েছো তুমি.!
-নাহ দেই নি। এই ধৃষ্টতা আমি দেখাতে পারি নি। আমি রাফিদকে ভালোবেসেছিলাম আর ভালোবাসিও। আর রাফিদও আমাকে তালাক দেয় নি।
কদিন পর কলিং ব্যাল বাজছে। দরজা খুলেই জেনি চমকে উঠলো। জীর্ণ শরীর, লম্বাচুল, ময়লা কাপড় পরে একজন ভিক্ষা চাচ্ছেন। উনি হয়তো জেনিকে চিনতে পারছেন না, হয়তো চোখে পাওয়ার নেই। কিন্তু জেনি ঠিকই চিনেছে। অনেক অভিমান থাকলেও বড্ড মায়া হলো, লোকটাকে বাসার ভিতরে বসতে দিয়ে জীবনের উত্থান পতনের গল্প বলতে লাগলো।গল্পের একপর্যায়ে বলল, তুমি ছেলে হয়ে ছেলেদের মানুষ করতে পারো নি কিন্তু আমি মেয়ে হয়ে অনেক কষ্ট হলেও মেয়েদের মানুষ করেছি।
-আমি চলে যাই। মেয়েদের এই মুখ দেখাতে পারব না। আর মেয়েরা যদি রাগ করে তাড়িয়ে দেয়।
-আরে না না। মেয়েরা তোমাকে কখন তাড়িয়ে দিবে না। বাবাদের জন্য মেয়েদের একটা মায়া থেকেই যায়। আর আমার মেয়েরা তোমার মত হয়নি, আমার মত করে গড়ে তুলেছি।
কথা বলতে বলতে লোকটি কান্না শুরু করলো। জেনি চোখ মুছে দিয়ে লোকটাকে জড়িয়ে ধরলো। মৃদু স্বরে বলল, খাচার পাখি বহুবছর পর ফিরে এসেছে আর যেন ছুটে না যায়। এমন সময় ছোটো মেয়েটাও এসে বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরলো।