বাস

বাস

ভাই টাকা হবে কিছু? আমি আপনাকে পরে বিকাশ করে দিবো! অচেনা মানুষটার দিকে আমি তাকিয়ে আছি। দিক ভুলে যাওয়া পথিকের মতো কেমন ছন্নছাড়া দেখাচ্ছে, চোখে অন্ধকার বিষাদের ছোঁয়া। খুব বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম কতো টাকা? ভাই অনেক টাকা লাগবে। আপনি যতো দিতে পারেন! আমি বিকাশ নাম্বারটা দিয়ে যা ছিলো তা দিয়ে দিলাম। লোকটা চোখের সামনে দৌড়ে চলে গেলো।

টাকা কেন দিয়ে দিলাম তা বুঝতে পারছিনা। তাছাড়া এ টাকা আমার নিজের ও না। কাকা ব্যাংকে চেক দিয়ে পাঠিয়েছিলো সেই টাকাই তোলে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। বাসায় গিয়ে কি বলবো ভেবে পাচ্ছিনা। তাই ভাবলাম বাসায় যাবোনা। পরক্ষণে মনে হলো আমার যাওয়ার মতো তেমন কোন জায়গাও নেই। মাঝে মাঝে এ শহরে আমি অকারনে লোকাল বাসে চড়ি। শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। জ্যামে বাসে বসে থাকতে ভালো লাগতো না একটা সময়। কিন্তু এখন তা সয়ে গেছে। জ্যাম অপেক্ষা শিখায়। ধৈর্য্যহীনতার শহরে অপেক্ষার প্রয়োজনটা ভাইরাস আতঙ্কে মাস্ক পড়ার মতো। মাস্ক থাকলে নিরাপদ না থাকলে বিপদ।

অপেক্ষায় সম্পর্ক নিরাপদ তা না হয় বিপদ! অপেক্ষার অভাবে যে সম্পর্ক গুলো ছিন্ন হয়ে যায় চোখের পলকে, তাদের লোকাল বাসে চড়তে দিলে হয়তো বুঝে যেত ২০ মিনিটের রাস্তা কিভাবে ২ ঘন্টায় পাড়ি দিতে হয়। এক জীবনের সম্পর্ক বয়ে নিয়ে যেতে ঠিক কতদিন সম্পর্কের জন্য সময় দিতে হয়। জ্যাম আবার মিথ্যাও শিখায়। কাকা ফোন দেওয়ার পর বললাম জ্যামে আছি, বাসায় আসতেছি। অথচ আমি বাসায় যাচ্ছিনা। কোথায় যাচ্ছি তাও জানিনা। লোকাল বাসে চড়ে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি খুব। বাসে উঠে ৫-১০ টাকা ভাড়ার জন্য যে মানুষটার সাথে ঝগড়া বেধে যায় ইভেন চড় থাপ্পড় ও আমরা দিয়ে ফেলি সে মানুষটাই কিন্তু আপনার আমার বোন, মা কিংবা প্রেমিকা বাস থেকে নামার সময় চিল্লাইয়া বলে উঠে ‘উস্তাদ ব্রেকে মহিলা নামবার আছে’! পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের মধ্যেই শ্রদ্ধা করার মতো ভালো গুন আছে।

শুধু পরখ করে নিতে হয়। ভাবলাম তাহলে আমার কি গুন আছে? কনট্রাক্টর বললো ভাড়া দিন। আমি এত গুলো মানুষের মধ্যে গলার স্বর নিচু করে বললাম, ভাড়া নেই মামা! ভাড়া নাই তো বাসে উঠছেন কেন? আমি আমার গুন দিয়ে বিচার করলাম এই মানুষটার কড়া কথার মাঝে তার একটা সরল মন আছে। কিছুক্ষণ পর হয়তো সে ভুলেই যাবে আমি ভাড়া ছাড়া বাসে উঠেছি কিংবা মনে থাকলেও আমায় কিছু বলবেনা আর। কিন্তু সে আমায় আরো চার পাচ বার ধমক দিলো। আমি চুপ করেই থাকলাম। উত্তর দিলাম না। বাস থামলো নিউমার্কেট পেরিয়ে ইডেন কলেজের সামনে। লাস্ট স্টপেজ। আমি নামিনা। কি মিয়া ভাই নামবেন না?

কনট্রাকটরের দিকে তাকিয়ে মনে হলো আমার বলা উচিৎ, না আমি নামবোনা। একিই বাসে করে উত্তরা যাবো আবার। কিন্তু মাথা নাড়িয়ে বুঝালাম হ্যা নামবো। নামতে যাবো ঠিক সে সময় উনি আমার কাধে হাত দিয়ে বললো কিছু খাইছেন মিয়া ভাই? না সূচক মাথা নাড়ালাম। চলেন আমরা খামু এহন। আমাগো লগে দুই চাইর মোঠ খাইবেন। খাওয়ার ফাকে জানতে পারলাম তার নাম আক্তার। ‘মামা আপনি মানুষ বুঝেন?’ আক্তার মিয়া আমার দিকে আড় চোখে তাকালো। ‘কি কন ভাই। কাইত অইয়া হুইলে ছাড়পোকা কামড় দিয়া কোন দিকে গেলো হেইডাই বুঝিনা আর মানুষ বুঝমো কেমনে? খান মিয়া ভাই। খাওয়ার সময় অত কওয়া ঠিক না!’

আমি খাচ্ছি আর আক্তার মিয়াকে বুঝার চেষ্টা করছি। ছিমছাম গড়নের সরল মানুষ। কনট্রাক্টর আক্তার আর এই আক্তারের মধ্যে রাত দিন পার্থক্য। ভাড়া চাওয়ার সময় আক্তার যেভাবে কথা বলে তখন মনে হয় তাকে একটা চড় না দিলেও পাপ হবে। আর এই আক্তারের দিকে এক নজর তাকালেও বুঝি পূন্য হবে! স্থান কাল ভেদে মানুষের চরিত্রের হরক রকমের রঙটাই মাঝেমাঝে আমাকে মনোবিজ্ঞানের দিকে টানে। কি অদ্ভুত! কত নিখুঁত কিন্তু কতো রহস্য মানব চরিত্র। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, এই যে বাসে আর বাহিরে দুই রকম আচরন করেন এটা কিভাবে করেন?
‘দুনিয়াডা গোঁজামিলে ভরপুর মিয়া ভাই। এই যে আফনে আমারে মামা কইতাছেন আর আমি আফনেরে ভাই কইতাছি কোন সমস্যা অইতাছে? বিষয়ডা গোঁজামিল কিন্তু তাল আছে। যার যার তালে আমরা ঠিক আছি। যেই কাজের যেই তাল মিয়া ভাই। তাল ঠিক না থাকলে বেতালা অইয়া যাইবেন।

বেতালা মানে ফাগল, আর ফাগল মানে পাবনা। বুঝলেন কিছু?’ আমি কিছুই না বুঝে মাথা নাড়ালাম। মানে বুঝেছি! ‘কইলেন না আমি মানুষ বুঝি কিনা? আমি মানুষ বুঝি না মিয়া ভাই। কথা বুঝি। এল্লেইগা কথা একটু বেশী কই!’ অতটুকু বলেই আক্তার মিয়া তরমুজের দানার মতো দাত গুলো বের করে হেসে গেলো কিছুক্ষণ। আজ অনেকদিন পর একটা মানুষকে আমি ঠিকঠাক ভাবে বুঝতে পারছিনা। খুব ছোটবেলা থেকেই কিভাবে যেন আমি মানুষ বুঝতে পারতাম। কেউ একজন কথা বললে বলে দিতাম সে সত্য বলছে নাকি মিথ্যা। তবে সেটা মনে মনে। প্রকাশ করতাম না। আমার আশেপাশের মানুষ সব প্রেডিক্টেবল ছিলো। যা প্রেডিক্ট করতাম সব মিলে যেত। শুনেছি জন্মের আগে আব্বা মারা গিয়েছিলো।

আম্মা যখন মারা যায় তখন আমার বয়স ৯। শুধু আম্মাকেই কখনো প্রেডিক্ট করতে পারিনি। কখনোই বুঝতে পারিনি এই মানুষটা আমাকে রেখে চলে যাবে। যদি বুঝতে পারতাম তাহলে আম্মার সাথে সাথে আমিও চলে যেতাম। প্রতিরাতে তাঁরা গুনে গুনে আমার আম্মা ঠিক কোন তাঁরা-টা সেটা খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টায় আমাকে নিমগ্ন থাকতে হতোনা। আম্মা হতো বড় তাঁরা আর আমি ছোট্ট তাঁরা। থাকতাম পাশাপাশি!
কিন্তু তা হলোনা। সারাজীবন আমার দায়িত্ব নিবে বলে সব সম্পত্তি আমার কাকা লিখে নিয়েছিলো নিজের নামে। কিন্তু ২ মাসের দায়িত্ব পালন শেষে সব সম্পত্তি বিক্রি করে আমার আপন কাকা পরিবার সহো বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে! আমি কেনো জানি এই ব্যাপারটাও প্রেডিক্ট করতে পেরেছিলাম। তবুও নির্দ্বিধায় সব দিয়ে দিয়েছিলাম।

এ বাড়ি, ও বাড়ি এক বেলা দুই বেলা খেয়ে এতিম আশ্রয়ে আমার দিন কেটে যাচ্ছিলো কোন রকম। শুধু একদিন একটা লোক কে সরাসরি বলেছিলাম আপনার মেয়ের নাম কি ‘তানহা’ রাখবেন? লোকটা আমার দিকে অবাক তাকিয়ে ছিলো অনেকক্ষন। তারপর আমায় নিয়ে ঢাকায় আসে। তার আশ্রয়ে জীবনে এ পর্যন্ত এতদূর এসেছি। তার নাম হাফিজুর রহমান। সেদিন কোন এক বিশেষ কাজে হাফিজ কাকা গ্রামে গিয়েছিলো। তার দুইদিন আগে তার মেয়ে হয়। গ্রামের দিকে যেতে যেতে উনি ভেবেছিলো নাকি তার মেয়ের নাম তানহা রাখবে। অদ্ভুত ভাবে মিলে যায়, আর আমার ভাগ্যে জুটে একটা স্থায়ী ভাবে অস্থায়ী আশ্রয়! আক্তার ভাইকে প্রেডিক্ট করতে না পেরে বললাম ভাই কাউকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে দিলে সেটা কি ফেরৎ পাওয়া যায়?

‘৫০ হাজার টেহা দিলে মানে? কি কন মিয়া ভাই?’ হ্যা ৫০ হাজার টাকা। ব্যাংক থেকে ফিরার পথে এক লোক বললো খুব বিপদ। সে বিকাশ নাম্বার নিয়ে গেলো আর বললো দিয়ে দিবে। ‘আরে মিয়া ভাই কয় কি? এই শহরে ধান্দার অভাব আছে নাকি? আফনে তো মিয়া বলদ। মাথায় গেলু নাই? চাইলো আর ৫০ হাজার দিয়া দিলেন? মনে করছিলাম আফনেরে উত্তরা নিয়া যামু আবার। এই আক্তার অসহায় লোক গো সাহায্য করে, কোন বলদরে না। হাটা দেন। আফনেরে খাওয়ানডাই ভুল অইছে!’ আমি হাটা দিলাম না। চুপ করে আক্তার মিয়ার বাসে উঠলাম। বাসের ভাড়া উঠাতে উঠাতে উত্তরা গেলাম।

বাসায় ঢুকতেই কাকা বললো কই ছিলি সারাদিন? মোবাইল বন্ধ কেনো? আমি উত্তর দেইনা।কাকী দৌড়ে এসে বললো এই ছেলেটাকে বাসায় আনাই ছিলো তোমার সবচেয়ে বড় ভুল। টাকা তুইলা জুয়া খেইলা উড়াইয়া দিয়া আসছে। এর অনেক আগেও তো অনেকবার এই কাজ হইছে। তুমি ওরে টাকা আনতে পাঠাও কেনো? দারোয়ানকে পাঠাইতে পারোনা? অসভ্য ছেলে কোথাকার। অবশ্য এসব কথা নতুন কিছুনা। দীর্ঘ ১৩ বছরে অনেক শুনেছি আমি। তবুও কাকা আমায় আগলে রেখেছে সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে। পৃথিবীতে এই একটা মানুষের চোখের দিকে তাকালে মনে হয় সে আমাকে বুঝতে পারে। আমাকে ভালোবাসতে পারে সকল অবিশ্বাস আর অনিয়মকে দূরে সরিয়ে রেখে। কাকা কখনোই কাকীর এসব কথা কানে নেয়না। আজও নিলোনা। শুধু বললো ফ্রেশ হয়ে আয়। খাবি।

আমি সেদিন খুব খেয়েছিলাম। তারপর যে বাসা থেকে বের হয়েছি রাতে আর কখনো বাসায় যাওয়া হয়নি। আক্তার ভাইয়ের খোঁজ করছিলাম। আমি জানতাম না সে কোথায় থাকে কিংবা তার নাম্বার ও রাখিনি। শুধু মাথায় ছিলো বাসের নাম আর সেই বাস নাম্বার। খুজেঁ একদিন পেয়ে গেলাম তাকে। কখনো বাসে করে ভাড়া তুলি আবার কখনো স্ট্যান্ডে বসে বসে মানুষ দেখি। মানুষ দেখে দেখে প্রেডিক্ট করা যখন আমার একটা নেশা হয়ে দাঁড়ায় ঠিক তখনকার কোন এক সন্ধ্যায় এক অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন করে বলে আপনি কি ‘হাসান’ বলছেন?
জ্বী বলছি। আমি শাফায়েত। একদিন রাস্তায় আপনার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলাম। মনে পড়েছে?জ্বী পড়েছে।

ওইদিন আমার মেয়েটার অপারেশন ছিলো। ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম। ডাক্তার বললো জরুরী অপারেশন করানো লাগবে। আমি বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। হুট করে এতটাকা কোথায় পাবো? রাস্তায় আপনাকে পেলাম ফেরেস্তার মতো। জানেন ভাই এত দোয়া আমার ভেতর থেকে কখনোই কারো জন্য আসেনি এর আগে। টাকা গুলো উপকারে এসেছিলো খুব। ভেবেছিলাম টাকা টা বিকাশেই দিবো। কিন্তু যদি আপনি দেখা করতেন, মেয়েটার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতেন আমি খুব খুশী হতাম। টাকাটা সরাসরি দিতাম আপনার হাতে।’ আমি বললাম টাকা দিতে হবেনা। রেখে দেন। আর যদি দিতেই চান তাহলে একটা একাউন্ট নাম্বার দেই, ব্যাংকে গিয়ে পাঠিয়ে দিয়েন। কাকার একাউন্ট নাম্বারটা সেন্ড করে সিমটা ফেলে দিলাম। এতদিন এই মানুষটার ফোনের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। পরে মনে হলো আমার ফোন কিংবা সিম আর কোন কিছুরই দরকার নেই।

এখন আর মানুষ দেখে তেমন কিছু বুঝিনা। বরং কিছুই বুঝিনা। শুধু কারো মা, প্রেমিকা কিংবা বোন বাস থেকে নামার সময় জোর গলায় বলি ওস্তাদ ব্রেকে, মহিলা নামবার আছে!ভাড়া তোলার সময় মাঝে মাঝে খুব উত্তেজিত হয়ে যাই, যাত্রীর চড় থাপ্পড় খাই। যে বাসের কনট্রাক্টর আমি সেই বাসের ড্রাইভার এখন আক্তার ভাই। বাসের ঠিকানা উত্তরা টু নিউমার্কেট, বাস নাম্বার ‘ঢাকা মেট্রো ব ৩৪৫৫৬’!আর আমার ঠিকানা? ওই একিই! উত্তরা টু নিউমার্কেট!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত