টান

টান

নুরিতার মন খারাপ। তার অনেক গুলো কারণ আছে। প্রধান কারণ হল তার স্বামী আসিফ সাত দিনের জন্য আমেরিকা গেছে একটা কনফারেন্সে। আসিফ পেশায় একজন ডাক্তার হওয়ায় তাকে প্রায়শই বিদেশ যেতে হয়। সাত দিনের দুই দিন গেছে। বিদেশে গেলে প্রতিদিন রাত নয়টায় সে স্কাইপেতে নুরিতার সাথে কথা বলে। আজ শুধু একটা মেসেজ দিয়েছে – Can’t talk. আসিফের একটা সমস্যা হল সে কোন কথা বিস্তারিত বলে না। তিন বছরের সংসার জীবনে সে কোন বাক্য পুরোপুরি বলে নি। কেন কথা বলতে পারবে না? এটা মেসেজে লিখতে এক মিনিট সময় লাগত। তারপরও বলবে না। এটা যে কম ভালবাসার কারণ তা নয়। আসিফ নুরিতাকে অনেক ভালবাসে এবং তার প্রমাণও রেখেছে। গত বিবাহ বার্ষিকীটা তার জীবনে সবচেয়ে আনন্দদায়ক ঘটনা, তা আসিফের নির্বাক ভালবাসার কারণ।

নুরিতার জীবনে আসিফ দ্বিতীয় অধ্যায়। প্রথম ছিল সোহেল। সোহেল একটা পাগল টাইপের ছেলে ছিল। তার সাথে নুরিতার বিয়ে ঠিক, গায়ে হলুদের আগেরদিন হঠাত সোহেল উধাও। এরপর তাকে অনেক খোজা হয়েছে, সোহেলের ফ্যামিলি থেকে অনেক যায়গায়, অনেক পীর ফকিরের কাছে গিয়েছে। কিন্তু তাকে কোথাও পাওয়া যায় নি। কোন মেয়ের বিয়ের বর উধাও – এর থেকে কষ্টের আর কি হতে পারে। নুরিতা শক্ত মনের মেয়ে তাই সমস্যা হয় নি। অন্য কোন মেয়ে হলে হয়তো সুইসাইড করত। এখনো নুরিতার নিঃসঙ্গতায় সোহেলের আগমন ঘটে।

একদিন সোহেল তাকে একটা কৌটায় এক হাজার জোনাকি গিফট দিয়েছিল। এত জোনাকি সে কিভাবে ধরেছে কে জানে। বিস্ময়ে নুরিতা তাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিল। আজ যদি সোহেলের সাথে তার বিয়ে হত তাহলে কি সে আরও সুখী থাকত? সুখ আপেক্ষিক। নুরিতা যদি ভাবে যে সে সুখী নয় তাহলে সে কোনদিন সুখী হতে পারবে না। নুরিতা আসলেই সুখী। সোহেলের বিষয়টা আসিফ সহজভাবে নিয়েছে। এবং সে তাকে সান্ত্বনাও দিয়েছে। এটা নিয়ে আসিফ কোন দিন কোন কথা তুলে নি আর তুলবেও না।

রাত এগারোটা। বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে। সম্ভবত বৃষ্টি হবে। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। নুরিতার ভয় লাগছে না কিন্তু অস্বস্তি লাগছে। হঠাত বাথরুমে ট্যাপ ছাড়ার শব্দ পেল। কে ট্যাপ ছাড়বে? হয়তো তার মনের ভুল। সে ফ্লাস্ক থেকে এক মগ কফি নিয়ে বারান্দায় বসল। শব্দ করে চা কফি খেতে নুরিতার ভাল লাগে। সোহেল চা বা কফির সাথে দুইটা সিগারেট শেষ করত। ছেলেটা চেইন স্মোকার ছিল। সিগারেটের গন্ধে নুরিতার বমি আসত তবুও সে সহ্য করত। আসিফ অবশ্য সিগারেট খাই না। কি মনে করে নুরিতার সিগারেট টানতে ইচ্ছে করছে। সে দারোয়ানকে ডেকে এক প্যাকেট সিগারেট আনতে বলল। দারোয়ান চোখ বড় করে তাকালেও কিছু বলল না।

সিগারেটে টান দিয়েই নুরিতা কাশতে লাগল। এই বিশ্রী জিনিসটা ছেলেরা খায় কিভাবে? তখনই বাথরুমের পাশ থেকে শিস দেওয়ার শব্দ শুনল। এতো সেই সুর। সোহেল প্রায় “Come September” গানের সুরে শিস দিত। নুরিতার ভয় করতে লাগল। এটা কি করে সম্ভব? ভয়ে ভয়ে নুরিতা এগিয়ে গেল। নুরিতা আবছা আলোয় দেখল বাথরুমের বাইরে কেউ বসে আছে। মুখটা দেখা যাচ্ছে না। নুরিতার মনে হল তার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। সে কি উল্টাপাল্টা কিছু খেয়েছে? নাতো, শুধু কফি আর সিগারেট এক টান দিয়ে ফেলে দিয়েছে।

-কেমন আছ? নুরিতার ভয়ে বুক কাঁপছে। সে বুকে হাত দিয়ে কম্পন রোধ করার চেষ্টা করছে।
-অনেক সুখে আছ, না? নুরিতা তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করল, কে?
-এখনো চিনতে পারছ না? যাকে সবসময় ভাব, তাকে চিনতে পারছ না?

-তুমি? তুমি এখানে কিভাবে এলে?
-এটা বাদ দাও। তার থেকে বরং বলি, কোথায় কিভাবে ছিলাম। নুরিতা চুপ। সে মেঝেতে বসে পড়ল।

-সেদিন ভাবলাম আমি শুদ্ধ না। তোমাকে বিয়ে করলে শুদ্ধ হওয়ার সুযোগ পাব না। তাই অজানার উদ্দেশ্যে বের হলাম।
-কোথায়?
-ভারতে। সেখানে এক বাবার সান্নিধ্য পেলাম। নাম ঘুম বাবা। সবসময় ঘুমিয়ে থাকে। সেখানে বেশিদিন থাকলাম না।ভাবলাম আমি যদি শুদ্ধ হয়ে যায় তাহলে আমার ভিতর থেকে ‘মানুষ’ হারিয়ে যাবে। আমি মানুষ থাকব না। তাই অশুদ্ধতাকে আপন করে নিলাম। এরপর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কাজ করেছি। এক সময় ভিক্ষাও করেছিলাম। হঠাৎ তোমার প্রতি, বাড়ির প্রতি মায়া লাগতে শুরু করল। তাই ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।

-আমার ঠিকানা কোথায় পেলে?
-আমি সব জানি। সব বলতে পারি। তোমার হাজবেন্ড আসিফ এবার একদিন আগে ফিরবে।আজ ফোন দেয় নি, সকালে ফোন দিবে।
-মানে কী?
-কোন মানে নাই।
-তুমি ভ্রম, আমার কল্পনা। যখন কেউ কোন বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে তার দৃষ্টিবিভ্রম হয়, হ্যালুসিনেশন হয়।
-বাহ! ভালই তো জানো। আর কি কি জানো?

-প্লিজ, তুমি চলে যাও।
-আমি কিভাবে যাব? আমি তো হ্যালুসিনেশন, তোমার কল্পনা।
-স্টপ ইট। গেট আউট।
-চিৎকার কর না। পাশের ফ্লাটের মতিন সাহেব চলে আসবে। আর আমি বেশিক্ষণ থাকবও না। তোমাকে একটা কথা বলার জন্য এসেছি।

-বল। বলে বিদায় হও।
-সরি। আমার সেদিন চলে যাওয়া ঠিক হয় নি। তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছ, আমাকে ক্ষমা করে দাও, প্লিজ।
-তো?
-আমি এক্সিডেন্ট করেছি। পা ভেঙে গেছে। তাই দাঁড়াতে পারছি না। আমার লাশ এতক্ষণে বাড়ি পৌছে গেছে। আমি মারা গেছি।
একথা শুনে নুরিতা অজ্ঞান হয়ে গেল।
কতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরল জানা নেই। সে সাথে সাথে সোহেলের বাড়ি ফোন করল। সোহেলের মা ফোন রিসিভ করে কেঁদে কেঁদে বলল, মা নুরিতা, সোহেল ফিরে এসেছে। কিন্তু সে আর কোনদিন আমাকে মা বলে ডাকবে না।…..
নুরিতার হাত থেকে ফোনটা মেঝেতে পড়ে গেল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত