সাবানে লেগে থাকা ফেনা আর বেসিনে পরে থাকা চুলের মতোই বিরক্তিকর লোকটা। সেই কখন থেকে আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করছে; কিভাবে আমি আমার অবসর সময়টা কাজে লাগাতে পারি। কি এক হার্বাল প্রোডাক্ট আছে। চীন থেকে আসে। উনাদের কোম্পানিতে অনেক রকম পণ্য আছে। তবে বর্তমানে হট আইটেম হচ্ছে সেই হার্বাল প্রোডাক্টটা। এটা বিক্রি করতে পারলে ভালো কমিশন পাওয়া যায়। বিক্রি করতে না পারলেও জনা কয়েক মানুষকে ডান হাতে বাম হাতে নিতে পারলেও ইনকাম শুরু হবে। আমাকে বোঝাচ্ছেন আমি চাইলে তার বাম হাতে যোগ দিতে পারি। তার ডান হাত আপাতত ভরে গেছে।
বাসে করে শ্যামলী থেকে উত্তরা যাচ্ছিলাম। কোন কপাল দোষে যে এই তেতুলিয়া বাসে উঠেছিলাম। মিরপুর দিয়ে ঘুরে ঘুরে সাপের পাছপা দেখাতে দেখাতে নিয়ে যাবে। সব সময় ভুঁইয়া বাসে করেই যাই। আজ তাড়াহুড়োয় খেয়াল করিনি কোন বাসে উঠছি। এই লোকও যাবে উত্তরা হাউজবিল্ডিং। সেখানে তাদের ডান হাত বাম হাতের অফিস আছে। আমাকে একটা ফ্রি সেমিনার করতে বলছেন। সেমিনার ফি মাত্র ৫০ টাকা। আমার আপত্তি না থাকলে টাকাটা উনিই দিয়ে দিবেন। তাও যেন সেমিনারটা করি। উনি কিছুতেই চান না আমি এমন বেকার হয়ে সময় নষ্ট করে হতাশায় ডুবে যাই।
শ্যামলী ওভারব্রিজ থেকে রোকেয়া সরণি পর্যন্ত অনেক ধৈর্য নিয়ে বসে ছিলাম; ভদ্রতা নামক বিষাদ জিনিসটার সাথে ঢোক গিলে গিলে ঐ লোকের কথাও গিলছিলাম। আর তো সম্ভব নয়। বললাম, ‘ভাই আপনাদের এই ডাইন হাত, বাম হাতের কারসাজি এখন সারা দেশের মানুষ বুঝে। আপনিও বুঝেন এইসব ভাঁওতাবাজি। কেন শুধু শুধু আমাকে বিরক্ত করছেন?’
উনি মুচকি হেসে খুব শান্ত গলায় বললেন, ‘ইয়ং ম্যান! আমি জানি আপনাদের এই বয়সে রক্ত একটু গরম থাকে। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাদের কোম্পানির একটা প্রোডাক্ট আছে। সেটা নিয়মিত খেলে আপনার মেজাজ ঠাণ্ডা থাকবে। ঠাণ্ডা মাথায় সব কিছু চিন্তা করতে পারবেন। সেই প্রোডাক্টটা কিনলেই আপনার একাউন্টে ৫০ পয়েন্ট যোগ হবে।
মিনিমাম ১০০ পয়েন্ট হলেই আপনি ২৫০ টাকার যেকোনো প্রোডাক্ট নিতে পারবেন। চিন্তা করে দেখেন আপনার প্রয়োজনীয় একটা জিনিস কিনেই আপনার পয়েন্ট যোগ হচ্ছে। সেই পয়েন্ট দিয়ে আরো কিছু কিনতে পারছেন। এমন সুযোগ আপনি কোথায় পাবেন। সামনের মাস থেকে আমাদের কোম্পানি ইলেক্ট্রনিক জিনিসও আনবে।’ ‘আপনাদের কোম্পানিতে ছেলেমেয়েদের আন্ডারওয়্যার পাওয়া যায় না?’ ‘হ্যাঁ যায় তো! কিনবেন আপনি?’ ‘ভাই তাহলে আপনি আপনার বউয়ের জন্য আন্ডার গার্মেন্টস কিনে নিয়ে যান। কিনার পরে যেই পয়েন্ট পাবেন সেই পয়েন্ট দিয়ে আপনার জন্যও একটা কিনেন। আন্ডারওয়্যার আরামদায়ক হওয়া দরকার। না হলে কি যে হয় সেটা আপনাকে দেখেই বোঝা যায়।’
লোকটার শান্তভাব আমাকে অবাক করলো। দেখলাম তাও বেশ শান্ত আছে। কি ট্রেনিং নেয়রে বাবা এরা। নির্লজ্জতার কাণ্ডারি এই ডান হাত বাম হাত কোম্পানির লোকগুলো। আমাকে বললেন, ‘ফানি ম্যান। আই লাইক ফানি ফ্যান। জানেন তো যারা হাস্যরস করতে পারে তারাই জীবনে অনেক চ্যালেঞ্জ নিতে পারে। এই যোগ্যতা সবার থাকে না। আমার খুব ভালো লাগছে যে এই যোগ্যতা আপনার আছে। শুধু একটু সঠিক গাইডলাইন পেলেই আপনার সাফল্য হাতের মুঠোয় ধরা দেওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই যে দেখেন লিস্টটা। এখানে ডিটেইলস দেওয়া আছে কোন পণ্য কিনলে কত পয়েন্ট পাবেন। আমার তো এখন কিছুই করতে হয় না জানেন। আমার ডান হাত বাম হাত কাজ করে যায় আর আমি শুধু ইনকাম তুলি। এমন আরামের কাজ আপনি আর কোথাও পাবেন না…’
‘ভাই একটা কথা বলি?’ ‘জ্বি বলুন!’ ‘ভালো হয়ে যান। সময় আছে অন্য লাইনে যান। এসব ফাতরামি কাজ বাদ দেন।’ ‘মানে? আপনি আমার কথা বিশ্বাস ‘ভাই থামেন। অনেকক্ষণ আপনার অনেক বকবকানি শুনছি। এইবার আপনি শুনেন। এই সব ডান হাত বাম হাত করে অনেক কোম্পানি চান্দের দ্যাশে গ্যাছে এটা আপনিও জানেন। শুরুতে যারা থাকে তারাই কিছুটা লাভবান হয়। আপনি শুরু নাকি মাঝের দিকের মানুষ তা জানি না।’ ‘আমি এক বছর হয় আছি।’
‘যাই হোক। এইসব প্রতিষ্ঠান হলো গ্রামের কিছু কৃষকের মতোন। যেই কৃষকরা ইঁদুরের জ্বালায় অতিষ্ঠ থাকে। কৃষকরা তখন করে কি জানেন। একটা ইঁদুর ধরে ইঁদুরের পাছার ফুটা সেলাই করে দেয়। এরপরে ছেড়ে দেয়। সেই ইঁদুর নিজেদের এলাকায় গিয়া সব ইঁদুররে জ্বালানো শুরু করে। সেই ইঁদুর হাগতে না পেরে পাগলা কুত্তা হয়ে যায়। সেই ইঁদুরের জ্বালায় তখন সব ইঁদুর সেই এলাকা থেকে ভাগে। আপনারাও সেই পাছার ফুটা সেলাই করা ইঁদুরের মতোন। ডান হাত বাম হাতের ট্রেনিং দিয়ে আসলে আপনাদের পাছার ফুটা সেলাই করে দিছে। এখন আপনারা পাগলা কুত্তার মতো সাধারণ মানুষদের অতিষ্ঠ করতেছেন। আর একটা কথা যদি বলেন। আর একবার যদি আমারে এইসব ফাতরামি বুঝাইতে আসেন আপনার গালের উপরে কষায়া থাপ্পড় মারবো। আপনি আমার যতো বড়ই হন না কেন। আপনার কোনো অধিকার নাই আমারে এইভাবে বিরক্ত করার। একদম চুপচাপ বইস্যা থাকেন।’
কথা গুলো বলতে গিয়ে আমি যে নিজেই এতো রেগে যাবো বুঝতে পারিনি। কিন্তু রেগে যখন গিয়েছি সেটা তো ধরে রাখতে হবে। নাহলে কথার দাম জুয়ার আসর শেয়ার বাজারের মতো পরে যেতে পারে। লোকটার জন্য একটু পরে মায়া লাগলো। এতোটা না ঝাড়লেও পারতাম। কিন্তু রেগে যেহেতু গিয়েছি সেটা আর নামাতে ইচ্ছা করছে না। যত যাই বলেন; এরা আসলেই একটা সমস্যা। জায়গা বেজায়গা বুঝে না। বাস ট্রেন বুঝে না। মানুষ পেলেই ডান হাত বাম হাত বুঝায়। কালশী এসে আমার লেকচার শেষ হয়েছিলো। বাকি রাস্তা বেশ আরামেই গেলাম। এয়ারপোর্ট আসার পরেই লোকটার ফোনে কল এলো। লোকটার ফোনের স্পিকারের ভলিউম এতো বাড়ানো যে আমিও শুনতে পাচ্ছিলাম ফোনের ওপাশের কথা গুলো। বাচ্চা মেয়ের গলা।
‘বাবা তুমি কই?’ ‘আমি বাসে মা। তুমি কি করো।’ ‘বাবা আম্মুর জ্বর। তুমি তাড়াতাড়ি আসো।’ ‘আসবো মা। সন্ধ্যার আগেই আসবো।’ ‘বাবা আসার সময় আমার জন্য বার্গার আনবা। প্রতিদিন বলো। কই আনো না তো।’ ‘আনবো মা আনবো। তোমার আম্মুকে ফোন দাও তো।’ ‘না আম্মু কথা বলবে না। তুমি আম্মুর গলার চেইন বিক্রি করে দিছো কেন। আম্মু তোমার সাথে আর কথা বলবে না…’
লাইনটা কেটে গেলো নাকি রেখে দিলো ঐপাশ থেকে জানি না। বাস জসিম উদ্দিন পার হয়ে যাচ্ছে। এই মানুষ গুলো কেন যে এমন ফাঁদে পরে জানি না। নিজেরা ফাঁদে পরে অন্যদেরও সেই ফাঁদে ফেলে ফাসায়। এই লোক আমাকে সেমিনারে জয়েন করতে বলছে। সেমিনারের ফি ৫০ টাকা দিবেও বলেছে। আসলে সে ভদ্রতার সুযোগ কাজে লাগাতে চেয়েছে। এভাবে কেউ অফার করলে যে ভদ্রতার কারণে কেউ অফারটা নেয় না এরা তা ভালো করেই জানে।
আমার কেবল মন পরে আছে সেই বাচ্চা মেয়েটার কথায়। নিষ্পাপ বাচ্চাটা জানেও না তার বাবাকে একটু আগে আমার কাছে অনেক অপমানিত হতে হয়েছে। জানবেও না কোনদিন। বাবাদের কত ভাবেই না সংসার চালাতে হয়। আমি আজমপুর নামবো। রাজলক্ষ্মী পার হতেই উঠে দাঁড়ালাম। মানিব্যাগ থেকে একটা ৫০ টাকার নোট বের করে লোকটাকে দিয়ে বললাম, ‘কিছু মনে করবেন না আমার কথায়। কিন্তু যা বলছি একটু মাথা ঠাণ্ডা করে ভাববেন। অন্য লাইনে কিছু করার চেষ্টা করেন। এই টাকা দিয়ে আপনার মেয়ের জন্য একটা বার্গার নিয়া যাবেন। মেয়েটা খুশি হবে। সে জানবে তার বাবা তাকে অনেক ভালবাসে।’
বলেই বাসের দরজায় দিয়ে দাঁড়ালাম। বাস থেকে নেমে জানালায় তাকাতেই দেখি লোকটা সেভাবেই টাকাটা হাতে নিয়ে বসে আছেন। লোকটার চোখ কি ছলছল করছে নাকি আমার দেখার ভুল। কিন্তু বাসের জানালায় তখন আমি দেখছিলাম এক অসহায় মানুষের মুখ। পৃথিবীতে সবচেয়ে অসহায় মুখ হলো- একজন অসহায় বাবার মুখ।