আজ শুক্রবার। গার্লফ্রেন্ডের বিয়ের দাওয়াতে যাচ্ছি। শুনতে অবাক লাগলেও ঘটনা সত্যি। গার্লফ্রেন্ডের বিয়ের দাওয়াত খেতে এর আগে কেউ গিয়েছেন কিনা আমার জানা নেই। হয়তোবা আমিই প্রথম। এক্ষেত্রে আমি একটা ইতিহাসের অংশ হতে যাচ্ছি। ওর নাম মীরা। মীরার বিয়েটা হুট করেই হচ্ছে। গত সপ্তাহে সে আমাকে বলল, চলো আমরা পালিয়ে যাই। তারপর কোন এক অজানা জায়গায় গিয়ে বিয়ে করে ঘর বাঁধি।
আমি উচ্চশিক্ষিত বেকার ছেলে। পড়াশোনা শেষ করেছি গতবছর। বেশ কয়েকটা চাকরির ইন্টার্ভিউ দিয়ে কিছু হচ্ছে না দেখে আপাতত ক্ষ্যন্ত দিয়েছি। তবে খুব শিঘ্রই ভালো কিছু করতে পারবো বলে আশা রাখি। আমি মীরাকে বললাম, কি বলো এসব? পালিয়ে যাবো মানে কি! পালিয়ে কোথায় যাবো? তাছাড়া জীবনটা কোন নাটক সিনেমা নয় মীরা। মীরা চোখ বড় বড় করে বলল, সেটা আমার জানার বিষয় নয় নিশ্চয়ই। আমি তোমার সাথে যাবো। তুমি আমাকে গাছতলাতেও নিতে পারো আবার দশতলা কোন বিল্ডিঙেও নিতে পারো। ওতে আমার কোন সমস্যা নেই। আমি সব জায়গায় মানিয়ে নিতে প্রস্তুত।
আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। মীরা বলে কি এসব! সে তো আমার অবস্থা জানে। গতকালও তো ওর সাথে মিট হল। কই ও তো এসব বিষয়ে কিছুই বলল না। আমি ওর হাতটা ধরে বললাম, মীরা তুমি কি বলছো আমি আগামাথা কিছুই বুঝছি না! আমি নিজেকে নিয়েই মহা মসিবতে আছি। তার উপর তোমাকে কাঁধে চাপালে আমার আর উপায় থাকবে না! মীরা এবার মাথা ঝাকিয়ে বলল, ও বুঝেছি তোমরা ছেলেরাই এমন। প্রেমের বেলায় মিষ্টি মিষ্টি কথা। আর বিয়ের কথা শুনলেই পালাই পালাই! এই তোমাদের মতো ছ্যাচড়া প্রেমিকদের আমার ভালোই চেনা আছে। মীরার কথাবার্তার ছিরি দেখে আমি আবারও অবাক হলাম। ও তো এরকম শ্রীহীন ভাষায় কথা বলে না! গত তিন বছর ধরে ওকে দেখছি; এমন কাম এন্ড কোয়াইট মেয়ে বর্তমানে পাওয়াই মুশকিল। অথচ আজ! আমি বললাম, দেখো মীরা, তুমি জানো আমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব নয়। তারপরও তুমি আমাকে ডেকে এনে অপমান করছো!
এবার ওর পরিপাটি মুখের ভাষা আরও নিচে নেমে গেলো, ও আচ্ছা ঠিক আছে। থাক তুই। তোর সাথে কথা বলে কোন লাভ নাই। তোর মতো ফকিন্নির সাথে কেন যে প্রেম করেছিলাম! বলেই ও ঝট করে উঠে রিক্সা ধরে চলে গেল। আমি বোকার মতো চেয়ে চেয়ে দেখলাম। তখন একটা গানের কলি খুব মনে পড়ছিল, আমার বলার কিছু ছিল না! না গো! আমার বলার কিছু ছিল না! চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে! আমি জীবনে প্রথম ছ্যাকা খাওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছুলাম। পরদিন পাশের বাসার বাবুর হাতে মীরা ওর বিয়ের কার্ড পাঠালো। সাথে একটি আলাদা চিরকুট। বাবু আমার এলাকার খুব কাছের ছোট ভাই। এবার অনার্স ২য় বর্ষে পা দিয়েছে। ছেলেটা বড্ড ভালো। মা’য়ের সাথেও ভীষণ খাতির। মীরাকে ও ভাবী বলে ডাকে। চিরকুটে লেখা, ওই ছ্যাচড়া শোন, যদি আমার বিয়ের দাওয়াতে না আসিস তাহলে দেখিস আমি কি করি। একেবারে সুইসাইড করে ফেলবো! আর সুইসাইড নোটে লিখে যাবো তোর নাম!
আমি আঁতকে উঠলাম। এই মেয়ের খুব জেদ। এর আগে একবার আমার সাথে রাগ করে দশটা ঘুমের বড়ি খেয়েও বেঁচে গিয়েছিল। আমি পড়লাম মহা যন্ত্রনায়। কই প্রেমিকার বিয়ে উপলক্ষে একটু মদ, টদ খাবো। বুকের ভেতর যে ভয়ানক কষ্ট অনুভব করছি তা প্রশমনের চেষ্টা চালাবো। এই মেয়ে তা আর হতে দিলো কই! আমি সেজেগুজে বের হলাম। পাঞ্জাবি পড়লাম কালো রঙের। প্যান্ট কালো রঙের। জুতা ঘড়ি সব কালো। আজ আমার মহান শোক দিবস। আমাকে দেখে মা বললেন, কই যাও? এমন কালা মানিক সেজে! বললাম, মা আজ মীরার বিয়ে। ও দাওয়াত দিয়েছে। না গেলে বিপদ হতে পারে।
মা আমার কথা গুলো শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, কি বললি? কোন মীরা? মীরা আমাদের বাসায় এসেছে অনেকবার। আমাদের রিলেশনটা মা আগাগোড়া জানতেন। আমি মা’কে জড়িয়ে ধরে বললাম, হ্যা মা। তোমার অতি প্রিয় মীরা। যাকে তুমি ছেলের বৌ হিসেবে কল্পনা করতে। দেখো মেয়েটা কত খারাপ। আর কয়টা দিন অপেক্ষা করতে পারলো না। আচ্ছা ভাই, তুই বিয়ে করছিস কর! আমাকে দাওয়াত কেন দিতে হবে! আবার না গেলে সুইসাইডের হুমকিই বা কেন দেবে!
মা আমাকে বুক থেকে ছাড়িয়ে বললেন, মেয়েটা তো আসলেই খারাপ। এত এত দিন আমাদের বাসায় এলো। আমাকে মা বলে ডাকলো। সব সব অভিনয়! শুধু তোকেই দাওয়াত দিলো! আমি কি দোষ করলাম! কত দিন বিয়েশাদি খাই না! ছেলের এমন কষ্ট দেখে সম্ভবত মায়ের মাথাটা ইষৎ খারাপ হয়েছে। দুঃখে কষ্টে আবোল তাবোল বকছেন। আমি মা’কে বললাম দুঃখ পেও না মা। ওরা বড়লোকের বখাটে মেয়ে। প্রেম করবে একজনের সাথে আর বিয়ে করবে আরেকজনকে!
মা রেগে গিয়ে বললেন, খবরদার ওকে বখাটে বলবি না। তোর ভাগ্য ভালো এতদিন ও তোর সাথে ছিল! মেয়েটা সুখি হোক। দোয়া করি। নাহ আর মায়ের সামনে থাকতে পারলাম না। মা রীতিমতো পাগলের মতো আচরণ শুরু করেছেন। আর কিছুক্ষণ থাকলে কি অনিষ্ট ঘটে কে জানে! বাসার সামনে থেকে সিএনজি নিলাম। মিরপুর টু ধানমন্ডি। এই সিএনজি মামার সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয়। মীরাকেও উনি চেনেন! মীরা ও আমি অনেক দিন এই মামার সিএনজি ভাড়া করেছি। মামা বললেন, কই যাইবেন মামা!
ধানমণ্ডি আচ্ছা। শুক্রবার দিন কোন দাওয়াত টাওয়াত আছে নাকি মামা? হ। বিয়ের দাওয়াত। মীরার বিয়ে। মীরাকে চেনেনতো! ওই যে লম্বা মতো, ছিপছিপে সুন্দর, সোনালী চুলের মেয়েটা! চিনবো না কেন মামা! আপনার লগে কতদিন দেখছি। তয় মামা ওই মাইয়া তো আপনের প্রেমিকা আছিল। আপনারা আমার সিএনজির পেছনে অনেক চাকুম চুকুম করেছেন তা আমি ফ্রন্ট গ্লাসে দেখছি! হে হে হে!
রাগে আমার মাথা ফেটে যাচ্ছিলো। এই মামা তো খুব খারাপ। চুল দাড়ি পাক ধরছে কিন্তু মনমানসিকতা এখনও পাড়ার বখাটে ছেলেটার মতোই আছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, মামা আমার মেজাজ ভীষণ খারাপ। কথা বইলেন না। হ বা’জান বুঝছি। কি জমানা আইলো প্রেমিকার বিয়া খাইতে যায় প্রেমিক! আহা! মামা আপনার কি সুখ! আমিও যুবক বয়সে প্রেম করতাম মামা। একেবারে উরাধুরা প্রেম। অথচ দেখেন বিয়া করলো অন্য এক পোলারে। আমারে দাওয়াতটা পর্যন্ত দেয় নাই। সেদিক দিয়ে আপনি ভাগ্যবান। হে হে হে। মেজাজটা খুব বিগড়ে যাচ্ছিলো। ভেবেছিলাম সিএনজির পেছনে বসে নীরবে কিছুটা চোখের জল ঝরাবো। এই মামার অত্যাচারে তা আর হল না!
বিয়ের আয়োজন বিশাল। বড় বড় গরু মারা হয়েছে। হাজার খানেক মানুষের খাওয়ার এন্তেজাম হয়েছে। ভেতরে গিয়ে দেখি মীরা রাজকন্যার মতো অতি দামি শাড়ি পরে সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। আমার গা জ্বলে গেল। এই মেয়েটাই একদিন আকাশ বাতাস সাক্ষি রেখে আমাকে বলেছিল, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। কতো ভালোবাসলাম এই মেয়েটাকে। রক্ত বিক্রি করে ওর জন্মদিনের গিফট কিনেছিলাম(অবশ্য একথা কেউ জানে না)। আমাকে দেখে বলল, তুমি এসেছো। গুড। তারপর একজনকে ডেকে বলল, এই বাবুকে নাস্তা দাও। কি বেহায়া মেয়ে! আমাকে বাবু ছাড়া কথা বলতো না। তাই বলে এই বেয়াড়ার সামনেও বাবু বলতে হবে! আমি জায়গা ত্যাগ করলাম। বাথরুমে গিয়ে খুব কান্না করলাম। ওর বৌ সাজ দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না। আহারে মীরা তুমি আমার সাথে এমন করলা! আমার স্বপ্নগুলোর কোন গতিই হতে দিলে না।
আমি বসে আছি প্যান্ডেলের এক কোনায়। হঠাত দেখি বাবু আমার দিকে এগিয়ে আসছে। বাবু এসে বলল, ভাই ছেলে তো আমেরিকায় থাকে। মীরা ভাবীও বিয়ের পর আমেরিকা চলে যাবে। চোখ গরম করে বললাম, এই তুই কাকে ভাবী বলিস? হ্যা! ওই প্রতারক মেয়েকে? ভাই, আমি মীরা ভাবীকে ভাবীই ডাকবো। আপনে আমার বড় ভাই। আপনিই একদিন পরিচয় করায় দিছিলেন, ও মীরা। তোর ভাবী। মনে নাই ভাই? আরে বাবা সে তো অনেক আগের কথা! ওর বিয়ে হচ্ছে অন্য জায়গায়। ওকে কি আর ভাবী বলা সাজে? আচ্ছা যাই হোক তুই এখানে কীভাবে?
গতরাতে মীরা ভাবী ফোনে বললেন, সকালে যেন এসে পড়ি। যাই হোক শোনেন ভাই পোলার বাসা চিটাগাং। আসতে আসতে সন্ধ্যা। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে এশার নামাযের পর। এর মধ্যেই আমাদের কাজ কম্পপ্লিট করতে হবে। কাজ কম্পলিট মানে? ও কিছু না। বলে বাবু দ্রুত কোথায় জানি চলে গেল। তখনো এশার আযান হয় নি। বাবু আমাকে ফোন করে মীরাদের বাসার পেছনে ডাকলো। চোখ মুছতে মুছতে আমি যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পরেই মীরা অন্যের হয়ে যাবে। ভাবলাম বাবুকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবো। আর পারছি না! ওর বৌ সাজটা আমার বুকের ভেতর ফলার মতো বিঁধছিল।
ওদের বাড়ির পেছনে একটা কালো কারের সামনে বাবু দাঁড়িয়ে আছে। আশপাশে কোন লোকজন নেই। আমাকে দেখে বলল, কোন কথা কইয়েন না ভাই। গাড়িতে উঠে বসেন। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। গাড়িতে উঠবো মানে! গাড়ির গেট খুলে দেখি ভেতরে লাল বানারসি পড়ে মীরা বসে আছে। একটা বিষয় দেখে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মীরার পাশে আমার মা বসে আছেন। আমার মুখ থেকে খুব ধীরে একটা আওয়াজ বের হল, মা!
গাড়ি চলছে মিরপুরের দিকে। এই মুহুর্তে আমার খুশি হওয়া উচিত নাকি বেজার কিছুই বুঝছি না। বাবু খুব খুশি। সে অতি আনন্দে গাড়ি চালাচ্ছে। একটা গানও বাজিয়ে দিয়েছে। ঝাকা নাকা ঝাকা নাকা দেহ দোলা না ও মীরা বাইই হেইলা দুইলা হেইলা দরবার নাচাই মীরা পেছন থেকে বলল, বাবু সাউন্ডটা বাড়িয়ে দাও তো। বাসায় গিয়ে আমি আরো অবাক হলাম। বাবা বসে আছেন। সাথে আছেন আমার আপন মামা। মোজাম্মেল হক। ধানমন্ডি থানার ওসি। আরো বেশ কয়েকজন। কাজী সাহেবও আছেন দেখছি। স্বপ্নের মতো লাগছিল সবকিছু। আমাদের বিয়ে হয়ে গেল রাত নয়টা বাজার আগেই। আমার ওসি মামা সবকিছু হ্যান্ডেল করছেন। এই মীরা কবে যে মামার সাথেও খাতির জমিয়েছে আল্লাহ্ মালুম। খুব মামা মামা বলা হচ্ছে।
গভীর রাতে যখন বাসর ঘরে ঢুকলাম, তখন মীরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কি মায়াবী দেখাচ্ছে ওকে। বৌ সাজে ঘুম। একদম রুপকথার পরিদের মতো লাগছে। ওকে জাগালাম না। অনেক হ্যাপা গিয়েছে মেয়েটার উপর দিয়ে। ঘুমাক। আলতো করে ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লাম। তখনও আমার মাথার ভেতর সেই গানটা বাজছিল,
ঝাকা নাকা ঝাকা নাকা দেহ দোলা না ও মীরা বাইই হেইলা দুইলা হেইলা দরবার নাচাই…