২৯ শে ফেব্রুয়ারি

২৯ শে ফেব্রুয়ারি

সকাল সকাল ফোনের মিষ্টি সুরের রিংটোনে নূরীর ঘুমটা ভেঙে গেল। মিষ্টি সুর এজন্যই যে, এই রিংটোন কেবলমাত্র তখনই বাজে তখন আসাদ কল দেয়।

– হুম। বলো।
– আমি তোমাকে বিয়ে করবো।
– সকাল সকাল দুষ্টামি করো?
– সত্যি বলছি। আমি তোমার বাসার নিচে। তোমার বাবার সাথে এখনই কথা বলব।

নূরী ঝটপট বিছানা ছেড়ে উঠে জানালা দিয়ে নিচে তাকালো। হ্যাঁ, আসাদ চায়ের দোকানের সামনে একেবারে সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এটা নূরীর বিশ্বাসই হচ্ছে না। যে ছেলেটাকে গত তিন বছর ধরে বিয়ের ব্যাপারে অজস্র পদ্ধতিতে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করেও লাভ হয়নি। আজ সেই ছেলে নিজ ইচ্ছায় বিয়ের কথা বলতে এসেছে! নূরী ফোনটা হাতে নিয়ে বলল, “তুমি কি সত্যিই বিয়ের কথা বলতে এসেছ?”

– বুঝেছি। তুমি এভাবে বিশ্বাস করবে না।

আসাদ ফোন কেটে দিলো। নূরী দেখলো আসাদ বাড়ির ভেতরে ঢুকছে। নূরী তাড়াতাড়ি তার মায়ের কাছে গেল। “মা, মা ও এসে গেছে।” মেয়ের ধড়ফড়ানি দেখে সাহেলা অবাক হয়ে বললেন, “কে এসেছে?” নূরী হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আসাদ।” নূরীর সম্পর্কের ব্যাপারে সাহেলা জানেন। মায়ের সাহায্যের কারণেই নূরী এখন পর্যন্ত পড়ালেখার নামে বিয়ের ভাগা-দৌড় থেকে মুক্ত আছে। নূরী ও সাহেলা নিচে নেমে এলো। দো’তলা বিশিষ্ট ঘরের নিচতলায় সকালের নাস্তা পানি করেন নূরীর বাবা জামশেদ ইকবাল। বর্তমানে নাস্তার টেবিলে নূরীর বাবার সাথে আসাদ বসে আছে। নূরী আড়ালে লুকিয়ে গেল। সাহেলা এগিয়ে এলেন। “কে উনি?” সাহেলার প্রশ্নের জবাবে জামশেদ বেশ কর্কশ ভাষায় বললেন, “এটা আমার ঘর। কোনো নাট্যমঞ্চ নয়। যাও ভেতরে যাও।” ভয়ে সাহেলা তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে এলেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর আসাদ চলে গেল। জামশেদ ঘরে ঢুকে নূরীকে ডাকলেন। ধীরু পায়ে নূরী এসে উপস্থিত হলো। তার অন্তরটা ধুরুধুরু কাঁপছে।

– ভেবেছিলাম আমার মেয়েটার মাঝে লোভ লালসা নেই। কিন্তু এ তো দেখছি ভীষণ লোভী। ধনী দেখেই ভালোবাসলি, মানুষটা কেমন তা দেখলি না? অন্যকেউ হলে ছেলের ব্যাংক ব্যালেন্স দেখে রাজি হয়ে যেতো। কিন্তু আমি এসবের তোয়াক্কা করি না। আমার কাছে মানুষের মনটাই প্রধান। এমন অহংকারী ছেলের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিবো না। যেহেতু এত বছর ধরে লুকিয়ে প্রেম করতে পেরেছিস। সেহেতু পালাতেও পারবি। আমি বাধা দিবো না। ভেবে নিবো আমার কোনো সন্তানই ছিল না। কথাগুলো বলে জামশেদ তার রুমে চলে গেলেন। নূরী তার রুমে এসে আসাদকে ফোন করলো।

– তুমি কই ছিলে? দেখলামই না তোমাকে।
– বিয়ে করবে না এটা সরাসরি বললেই পারতে।
– কি বলছো এসব? বিয়ে করবো বলেই তো এসেছি।
– যদি বিয়ের উদ্দেশ্যেই আসতে তবে বাবার সাথে নম্রতার সাথে কথা বলতে। টাকার অহংকার দেখাতে না।
– কি যাতা বলছ? আমি কখন টাকার অহংকার দেখালাম?

নূরী তার বাবার কথাগুলো সব খুলে বলল। আসাদও সব খুলে বলল। কি কি নিয়ে আলাপ আলোচনা করেছে। সব শুনে নূরী রেগেমেগে বলল, “তোমাকে কে বলেছে নিজের ঢোল নিজে পেটাতে? একে তো তিন বছর ধরে বিয়ে নিয়ে তালবাহানা করেছ। আর আজ বিয়ের কথা বলতে এসেও বোমা ফাটিয়েছ। একটা কথা সরাসরি বলে দিচ্ছি। আমার বিয়ে যদি তোমার সাথে না হয়। তবে আমি বিষ খাব। আর চিঠিতে তোমাকে দায়ী করে যাব।” আসাদ কিছু বলার আগেই নূরী ফোন কেটে দিলো।

নূরীর বাবার সাথে দেখা করার পর প্রথমে আসাদ তার ও নূরীর সম্পর্কের ব্যাপারটা জানিয়েছে। তারপর বিয়ের কথা উল্লেখ করে নিজের অর্জিত অর্থ সম্পদ ও ব্যাংক-ব্যালেন্সের কথা ইশারা ইঙ্গিতে উল্লেখ করেছে। বিগত কিছু বছর ধরে নিজের সাফল্যের গল্পগুলো বেশ গর্বের সাথে বর্ণনা করেছে। যা জামশেদের মোটেই পছন্দ হয়নি।
বেশ গম্ভীর হয়ে বসে আছেন জামশেদ। সাহেলা তার কাঁধে হাত রাখলেন। এতে যেন জামশেদের কষ্ট মন থেকে নিংড়ে বেরিয়ে এলো।

– জানো সাহেলা, আমি লোভী ও অহংকারীদের একদম পছন্দ করি না। অথচ আমার মেয়েটা লোভী।অর্থ সম্পদ দেখে এক অপদার্থকে ভালোবেসেছে। যার হৃদয়ের কোণা টকার অহংকারে ভরপুর।

– তুমি বুঝতে ভুল করছো। আসলে নূরী-আসাদ কেউই তেমন নয়। নূরী তো আসাদকে তখন থেকেই ভালোবাসতো যখন ওর কিছুই ছিল না। আর আসাদ তার মনের ভাবটা তোমার নিকট ভালোভাবে তুলে ধরতে পারেনি। ও কিন্তু ছেলে হিসেবে একদম খাঁটি। জামশেদ বিস্মিত হয়ে সাহেলার দিকে তাকালেন। মাথা নেড়ে সাহেলা আরও বললেন, “আমি ওদের ব্যাপারটা শুরু থেকেই জানি। ওরা একে অপরকে খুব ভালোবাসে। প্রতিষ্ঠিত হয়েও গত তিন-চার বছর ধরে আসাদ বিয়ের জন্য রাজি হয়নি। আজ হঠাৎই নিজ থেকে এসেছে। ছেলেমানুষ তো তাই কিভাবে কি করত্ব হয় তা বুঝেনি। সাহেলার কথা শুনে জামশেদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইললেন। তারপর বললেন, “ঠিক আছে। আমি রাজি। নূরীকে বলে দাও ছেলেটা যেন তার বাবা মাকে নিয়ে আসে।”

বিকালেই আসাদ তার বাবা মাকে নিয়ে হাজির। এতে নূরী সহ তার বাবা মা সবাই বেশ অবাক হয়েছেন। মাত্র সকালেই তাকে জানানো হলো। এরমধ্যেই ওমনি হাজির হয়ে গেল! দুই পরিবারের অভিভাবকেরা আলাপ আলোচনায় বসলেন। আর আসাদ নূরী ছাদে বসে আছে। আসাদ বাবা বললেন, “সত্যি বলতে কি আমরা আজই জানলাম যে, আসাদ কাউকে পছন্দ করে। ওর বিয়ে তো আরও আগেই করাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও কিছুতেই রাজি ছিল না। আজ কারণটা বুঝতে পারলাম। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এখন দিন তারিখ দেখে সবকিছু ঠিক করলেই হয়।” একটা গম্ভীর নিঃশ্বাস ফেলে জামশেদ বললেন, “নূরী আমার একমাত্র মেয়ে। আমি ওর বিয়েটা ধুমধাম করেই দিতে চাই।” দুই পরিবার মিলে আলাপ আলোচনা করতে লাগল।

ছাদে বসে নূরীকে মোবাইলে বিয়ের কার্ডের ছবি দেখাচ্ছে আসাদ। কিন্তু নূরীর দৃষ্টি আসাদের দিকে। যেই ছেলেটা গত তিনটা বছর ধরে বিয়ের ব্যাপারটা নানানভাবে এড়িয়ে এসেছে। আজ সে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। সকাল সকাল চলে এসেছে। বাবা মাকেও তাতক্ষণিক নিয়ে এসেছে। বিয়ের কার্ডও বাছাই শুরু করে দিয়েছে। নূরীর দিকে নজর পড়তেই আসাদ হেসে বলল, “ওভাবে কি দেখছ? কার্ড বাছাই করো।” আসাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নূরী বলল, “আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, তুমি বিয়ের জন্য এমন পাগল হয়ে আছ। মনে হচ্ছে এটা আমার স্বপ্ন। এখনই আম্মু ডাক দিবে আর ওমনি স্বপ্নটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।” নূরীর কণ্ঠ স্বর কেঁপে উঠলো।

– আহা পাগলী! কাঁদছো কেন? এটা স্বপ্ন নয়। তবে আমাদের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। তুমি শুধু আমার পাশে থেকো।” নিচ থেকে ডাক এলো। আসাদ নূরী নেমে এলো।
– তো আংকেল বিয়ের অনুষ্ঠান কোন ক্লাবে করবেন? বেশ কর্কশ ভাষায় জামশেদ বললেন, “ওসব আমরা বড়রা দেখবো। তোমাকে ভাবতে হবে না।”
– সময় তো বেশি নেই। আর মাত্র এক সপ্তাহ।
– মানে?
– ২৯ শে ফেব্রুয়ারিই তো বিয়ে।
– আমরা এখনো কোনো তারিখ নির্ধারণ করিনি।

নূরীর দিকে ইঙ্গিত করে আসাদ বলল, “তারিখ আমরা নির্ধারণ করেছি। আপনাদের কষ্ট কিছুটা কমিয়ে দিলাম। আপনাদের কোনো কষ্টই নেই। ক্লাবও আমরা বুকিং করে রেখেছি।” জামশেদ তার মেয়ের দিকে তাকালেন। নূরী মাথা নিচু করে ফেলল। আসাদের বাবা মাকে লক্ষ্য করে জামশেদ বললেন, “আচ্ছা আপনারা এখন আসতে পারেন। বাকিটা পরে আলোচনা করবো।” জামশেদ তার আত্মীয় স্বজনদের সাথে আলাপ আলোচনা করলো। তারপর বিয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হলো। কিন্তু বিপত্তি বাধলো তারিখ নিয়ে। জামশেদ তার মেয়েকে তারিখ পরিবর্তনের ব্যাপারটা জানালেন। নূরী জানালো আসাদকে। কিন্তু আসাদ তারিখ পরিবর্তনে রাজি হলো না। নূরী অনেক বুঝাতে লাগল।

– বাবা তো সবই মেনে নিয়েছে। তুমি অন্তত বাবার এই কথাটা মানো।
– আমি এতো কিছু শুনতে চাই না। বিয়ে ২৯ তারিখেই হবে।
– তুমি এমন একরোখা ভাব দেখাচ্ছো কেন?
– আমি কি তোমার বাবার থেকে যৌতুক চেয়েছি?

আমি শুধু তোমাকে চেয়েছি। আমার ফাইনাল কথা, বিয়ে ২৯ তারিখেই হবে। নয়তো না। পরে আবার বলো না আসাদ ধোকা দিয়েছে। আসাদ ফোন কেটে দিলো। নূরী বাধ্য হয়ে বাবাকেই বুঝাতে এলো।

– বাবা, ও তো বিয়ের কার্ডও ছাপিয়ে ফেলেছে। এখন তারিখ পরিবর্তন করতে অনেক ঝামেলা হবে।
– যতো ঝামেলাই হোক। তারিখ পরিবর্তন করতে হবে।
– তারিখে কি আসে যায়?
– তোমাদের সব কথাই মেনেছি। কমপক্ষে আমার এই কথাটা তো মানো।
স্বামীর সাথে সুর মিলিয়ে সাহেলা বললেন, “কার্ড তো নতুনও বানানো যাবে। জামাই বাবাকে বুঝিয়ে বল।”

– আমি অনেক বুঝিয়েছি। ও তারিখ পরিবর্তনে রাজি না। ও বলছে এই তারিখে বিয়ে না হলে নাকি বিয়েই করবে না।
– ছেলেটার মধ্যে এতো অহংকার কেন? নিজেকে কি ভাবে? ও যা বলবে সেটাই শেষ নাকি?
– বাবা, তুমি ওকে একটু পজিটিভ ভাবে দেখো।
– ২৯ তারিখ শনিবার। একমাত্র মেয়ের বিয়ে আমি এমন দিনে দিতে চাই না।
– বাবা! তুমি এখনো সেই আদিকালের নিয়ম বিশ্বাস করো?
– ওসব আমি শুনতে চাই না। ২৯ তারিখে বিয়ে হবে না।

জামশেদ হনহনিয়ে হেঁটে গেলেন। অবশেষে ২৯ তারিখেই বিয়ে হলো। মেয়ের সুখের চিন্তা করে একজন বাবা কম্প্রোমাইজ করলেন। বাসরঘরে ঢুকে নূরীর গোমরা মুখ দেখে আসাদ বলল, “কি ব্যাপার? মধুচন্দ্রিমার রাতে তোমার মুখে চন্দ্রগ্রহণ লেগে আছে কেন? তুমি কি এই বিয়েতে খুশি নও?”

– আগে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। তুমি ২৯ তারিখেই বিয়ে করার জন্য জেদ ধরে বসে ছিলে কেন? আসাদ মুচকি হাসি দিলো। তারপর সব বলল। কিছুদিন আগে আসাদের এক বন্ধুর বিবাহবার্ষিকী ছিল। কিন্তু তার বন্ধু এটা ভুলে গিয়েছিল। এই নিয়ে সেই দম্পতির মধ্যে অনেক ঝগড়াবিবাদও হয়েছিল। পুরো সপ্তাহজুড়ে ঘরে অশান্তি চলেছিল। বিবাহবার্ষিকী ভুলার কারণে আসাদের অনেক বন্ধুর জীবনেই এমন হয়েছে। দিনটা নিয়ে মেয়েরা খুবই সিরিয়াস থাকে। দিনটা ভুলে যাওয়া মানে বাঁশ খাওয়া। এমন ভুল যাতে আসাদের না হয় তাই ২৯ তারিখে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেননা ফেব্রুয়ারি মাসে ২৯ তারিখ চার বছরে একবার আসে। তাই প্রতি বছর বিবাহবার্ষিকী ভুলার সুযোগ নাই। সব শুনে নূরী রেগেমেগে আগুন। আসাদের বুকে অজস্র কিল ঘুষির বন্যা চালালো। আসাদ সাদরে সব গ্রহণ করলো।

– তোমার এই ২৯ তারিখের জন্য আব্বু খুব রাগ করেছেন। শুধুমাত্র আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়েটা দিয়েছেন।
– তুমিই তো বিয়ের জন্য পাগল ছিলে। তাড়াতাড়ি হওয়াতে তো তোমার খুশি হওয়ার কথা।
– তাই বলে বাবার মনে কষ্ট দিয়ে নয়।
– ওটা শিগগিরই দূর হয়ে যাবে।

পরেরদিন সকালে নূরীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে এলো আসাদ। নূরী তার মাকে বিস্তারিত বলল। যা শুনে তিনি হেসে উঠলেন। বাগানে বসে আসাদও তার শ্বশুরকে বিয়ের কারণটা জানালো। এতে জামশেদও হেসে ফেলেন। ছেলেটা উদ্ভট তবে খারাপ নয়। মেয়েটা সুখেই থাকবে। এটা ভেবেই তার মনে প্রশান্তির বাতাস বইছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত