এক যুবক বিপুল আয়োজনে বিয়ে করে নদী-পথে বাড়ি ফিরছিল। সঙ্গে অনেক বরযাত্রী ছিল। প্রতিটি নৌকা ছিল বরযাত্রিতে ঠাঁসা। যাত্রা-পথ ছিল অনেক লম্বা। নদীটিও ছিল প্রশস্ত। বিকেলের আকাশটা মেঘে কালো হয়ে উঠলো। দেখতে দেখতে ঝড় উঠে আসলো। নদী ফুঁসে উঠলো। উত্তাল তরঙ্গ নৌকাগুলিকে মাথার উপর তুলে নিয়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে খান-খান করে দিল। যাত্রীরা কে কোথায় ডুবলো কেউ বলতে পারলো না। নদীর আশে পাশে কোন বসতি ছিল না। বিপদের সময় কেউ এগিয়ে আসেনি। কিছুক্ষণ আহাজারি শোনা গেল তারপর সব নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো।
পরদিন যুবকটি নিজেকে দেখলো সে নদীর চরে একটি পতিত বৃক্ষের মত পড়ে আছে। সে নড়ে-চড়ে উঠে বসলো। দেখলো তার চারদিকে লাশ ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে রয়েছে। নব-বধূর কথা মনে পড়ে গেল। সে সারাদিন বধূর লাশ খুঁজে বেড়ালো। সন্ধ্যায় পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিল। সেখান থেকে প্রতিদিন এসে নদীতে স্ত্রীকে খুঁজতে লাগলো। কয়েকদিন এভাবে খোঁজার পর সে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, শহর থেকে শহরান্তারে খুঁজতে লাগলো। এভাবে বিশটি বছর কেটে গেলো।
অতঃপর সে নিরাশ হয়ে ভাবলো, জীবনে আর বিয়ে করবো না। বাকি জীবন ‘আল্লাহ-আল্লাহ’ করে কাটাবো। সুতরাং সে দীনদারী গ্রহণ করলো। কিছুদিন দ্বীনের পথে চলার পর দেখলো একা একা দ্বীনের পথে চলা বড় কঠিন। একজন ওস্তাদ দরকার। সে একজন হাক্কানী বু্যুর্গের সন্ধান পেলো। তাঁর কাছে গিয়ে আরজ করলো, “হুজুর আমি অতীত জীবন থেকে তওবা করে আপনার হাতে মুরীদ হতে চাই।” বুযুর্গ বললেন, “মুরিদ হওয়ার শর্ত আছে। আমার কথা মানতে হবে। এই শহরের অমুক পতিতালযয়ে এক নতুন বেশ্যা এসেছে। তার ঘরে আজ রাত্রি যাপন করার পর সকালে এসো, তখন মুরীদ করা হবে।”
লোকটি বুযুর্গের কথা শুনে অবাক হলো। এত বড় গুনাহ করা কীভাবে সম্ভব? কিন্তু বুজুর্গের নির্দেশ মানতে হবে। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে সে প্রতিতালয়ের দিকে রওয়ানা হলো। নতুন বেশ্যাটির খোঁজ নিয়ে তার মালিককে যথা নিয়মে ফি দিয়ে তার ঘরে প্রবেশ করলো। দেখলো একটি মেয়ে ঘোমটা দিয়ে ঘরের এক কোণায় বসে আছে। সে তার কাছে না গিয়ে ঘরের অপর এক কোণায় নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। সারা রাত নামাজ পড়ে এবং জিকির-আজকার করে কাটালো। রাত্রি যখন সকাল হলো তখন সে তার সে ঘর থেকে বাহির হতে উদ্যত হলো। তাকে বাহির হতে দেখে মেয়েটি হাউ-মাউ করে কাঁদতে লাগলো। লোকটি বললো, কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে?
মেয়েটি বললো, জনাব, আপনি একজন ভালো মানুষ। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। আপনি আমাকে সাহায্য করুন। আমি একজন সতী নারী। এরা আমাকে অপহরণ করে নিয়ে এসেছে। আজই প্রথম রাত, এরা আমাকে গ্রাহকের হাতে তুলে দিয়েছে। আজ যদিও আপনি গ্রাহক হয়ে আমার সতীত্ব রক্ষা করেছেন। কিন্তু পরবর্তী রাতে আমার সতীত্ব কে রক্ষা করবে? সুতরাং আপনি আমাকে উদ্ধার করুন।
লোকটি বললো, কেন, আপনার কেউ নাই? কোত্থেকে থেকে এরা আপনাকে অপহরণ করেছে? মেয়েটি বললো, সে অনেক লম্বা ইতিহাস। আমি বংশীয় ঘরের মেয়ে। ছোট বেলায় বাপ-মাকে হারিয়েছি। ভাই আমাকে এক বংশীয় ঘরের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে নৌকাযোগে স্বামীর বাড়ি যাচ্ছিলাম। একমাত্র ভাইটিও আমার সঙ্গে ছিল। হঠাৎ নদীতে ঝড় উঠলো। নৌকা তলিয়ে গেল। আমি ভাসতে ভাসতে এক গ্রামের ঘাটে গিয়ে ভিড়লাম। গ্রামের মেয়েরা সকাল বেলায় ঘাটে পানি নিতে এসে আমাকে দেখতে পেয়ে তাদের বাড়ি নিয়ে গেল। তাদের আশ্রয়েই ছিলাম। সেখান থেকে এরা আমাকে অপহরণ করে। জানিনা আজ আমার স্বামী বেঁচে আছেন কি না।
লোকটি অবাক হয়ে সব-কিছু শোনার পর তার নাম ও ঠিকানা জেনে নিয়ে বললো, তুমি আর চিন্তা করিও না। তোমার দুঃখের দিন শেষ হয়েছে। তোমার স্বামী বেঁচে আছে। আমি তোমার সেই হতভাগা স্বামী। আজ বিশটি বছর ধরে আমি তোমাকে খুঁজছি। অবশেষে নিরাশ হয়ে দুনিয়া ছেড়ে দিয়ে পডরকাল ধরেছি। তার পুরস্কার আজ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। আমার হারানো স্ত্রীকে তিনি আমার হাতে তুলে দিয়েছেন। চলো যাই, বুজুর্গের কাছে যাই। তাঁর হাতে দুইজন একসাথে মুরীদ হই। আল্লাহকে ধরি।
সুতরাং বুযুর্গের জ্ঞানের পরিধি কোথায় গিয়ে পৌঁচেছে সাধারণ মানুষ কি সেখানে পৌঁছাতে পারবে? লোকটির স্ত্রী যে পতিতালয়ে ছিল তিনি তা কিভাবে জানতে পারলেন? লোকটিকে গুনাহয় লিপ্ত করাই কি বুযুর্গের উদ্দেশ্য ছিল? নাকি তার স্ত্রীকে উদ্ধার করা?