মাঘের কুয়াসাচ্ছন্ন ঝলমলে চাঁদটা রাতের আকাশকে আলোয় ভরে দিলেও আমার মনের আকাশে তখন কালো মেঘের ঘনঘটা। চাকরি খোয়ানোর পর বেকারত্বের অভিশাপ মাথায় নিয়ে একটা চাকরির জন্য পুরো ঢাকার শহর চষে বেড়াচ্ছিলাম। দুই-একজন বন্ধু যারা মোটামুটি ভালোবাসতো তাদের বাসায় থেকে সোনার হরিণের পেছনে ঘুরে মরছিলাম। ব্যস্ত রাস্তায় গোধূলি লগ্নে একদিন পুরনো বন্ধু কামালের সঙ্গে দেখা হতেই আমাকে অতি আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরলো। বুকে যতোই কষ্ট থাকুক, এই মহা বিপদের সময় একজন বন্ধুর আগ্রহের আলিঙ্গন বড়ই সুখের লাগলো। আমার কথা শুনে মোস্তফা তার নিজের ভিজিটিং কার্ডটি আমার হাতে দিয়ে হাসি মুখে বললো, কাব্য আয় অফিসে একদিন, দেখি তোর জন্য কিছু করতে পারি কি না। শুনে মনটা আমার খুশিতে দুলে উঠলো।
সেই দুপুরে মিরপুরে বন্ধু নওশেরের বাসা থেকে আলু ভর্তা আর পাতলা ডাল দিয়ে কয়টা ভাত খেয়ে এসেছিলাম। পেট একটা মোচড় দিতেই বুঝলাম দারুণ ক্ষিধে লেগেছে। কিছু একটা খেতে হবে।গিজগিজ করা মানুষের ভিড় ঠেলে ফুটপাথ দিয়ে হেটে চলছিলাম একটা সস্তা হোটেলের খোজে। কাকরাইলের মোড় পার হয়ে রাস্তার বাম পাশে একটি হোটেল দেখতে পেয়ে কাছে এগিয়ে গিয়ে পরখ করতে লাগলাম, এখানে এক বেকারের জন্য কি খাবার পাওয়া যাবে? ইতিমধ্যে যারা বসে খাওয়া-দাওয়া করছিল তাদের প্লেটের দিকে বাঁকা চোখে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম। ভেতরে একটু সাহস সঞ্চারিত হলো। হাত ধুতে ধুতে বয় ছেলেটিকে বললাম, সবজি দিয়ে এক প্লেট ভাত দাও|
– সবজি নেই, ছেলেটি কর্কশ কণ্ঠে কথাটি বললো।
– কেন? ওই যে ওনারা সবজি দিয়ে খাচ্ছেন।
– এতোক্ষণ ছিল, এই মাত্র শেষ। কাতলা, বোয়াল, রুই, মাংস ছাড়া আর কিছু নেই।
এমনিতেই মুখটা শুকিয়ে ছিল, তার কথা শুনে নিজের দাম যেন একেবারেই শূন্যের কোঠায় নেমে গেল। পকেটে মাত্র ছয়শ টাকা অবশিষ্ট আছে। মনের অজান্তেই হাতটা পকেটে ভেতর চলে গেল। কিন্তু এ কি! টাকা গেল কোথায়? বুকের ভেতর ততোক্ষণে ধড়ফড় শুরু হয়ে গিয়েছে। এদিক-ওদিক তাকালাম বিষন্ন দৃষ্টিতে। বুকের ভেতর থেকে কান্না উপচে উঠলো। মনে হলো যেন আমি কোনো এতিম বালক হয়ে গিয়েছি। সামনের ভাতটা রেখে উঠে দাড়ালাম। বয়টাকে নম্র ও বিষন্ন কণ্ঠে বললাম, দুঃখিত ভাই, আমার সব টাকা হারিয়ে গিয়েছে। আশপাশে যারা বসে খাচ্ছিল তারা আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো। এক যুবক গম্ভীর কণ্ঠে বললো, কত টাকা ছিল আপনার কাছে?
– ছয়শ টাকা।
সে সহানুভূতির সুরে বললো, ভাই সামনের ভাতটা এভাবে না রেখে খেয়ে যান। ভেতর থেকে যেন কান্না উপচে পড়তে চাইলো। খুব কষ্ট করে বললাম, দেখুন আমার কাছে কোনো টাকা নেই। বয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি কিছু মনে করো না ভাই, আমি খুবই দুঃখিত। যুবক ছেলেটি আমার খুব কাছে এসে বললো, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বিলের টাকাটা আমি দিয়ে দিচ্ছি, আপনি ভাত খেয়ে যান।
– আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই। এখন আমার পেটে কোনো ভাত ঢুকবে না। কথাটি বলেই হোটেল থেকে ব্যস্ত হয়ে বের হয়ে গেলাম।
শান্তিনগরের মোড় পার হয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দিকে যাচ্ছিলাম। রিস্টওয়াচে দেখলাম রাত সাড়ে দশটা বাজে। ফকিরেরপুলে বন্ধু কবির থাকে। ভাবলাম, তার বাসায় আজ রাতটা কাটাবো। পুলিশ লাইনের এক নম্বর গেইট পার হয়ে রাস্তার ডান পাশের ফুটপাথ দিয়ে হাটছিলাম। রাস্তার বাতির আলোয় নিজের হাত দুটোকে দেখলাম ফ্যাকাশে রঙ ধারণ করেছে। পেটের ভেতর ক্ষিধে যন্ত্রণার স্টিমরোলার চালাচ্ছে। সহসা একটি দৃশ্য দেখে চমকে উঠলাম। উলঙ্গ এক পুরুষ ফুটপাথের বাম পাশে বসে আছে। তার মুখে লম্বা-কালো দাড়ি। মাথার লম্বা চুলগুলো পেছনে বেণী করে বাধা। শরীরে কোথাও কাপড়ের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। থমকে দাড়ালাম। কয়েকজন ইতিমধ্যে লোকটিকে ঘিরে ধরে রেখেছিল। তারা লোকটিকে বাবা বলে সম্বোধন করছিল। লোকটি তাদের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করছিল।
একজন এগিয়ে এসে লোকটির হাতে কয়েকটি টাকা গুজে দিতেই লোকটি বাঘের মতো গর্জে উঠলো। এই খচ্ছর! যা, তোর টাকা নিয়ে। ভক্ত বেকুব হয়ে থতমত খেয়ে গেল। আমার পাশে দাড়ানো একজন কানের পাশে ফিশফিশ করে বললো, বাবা ওকে পছন্দ করেনি। তাই ওর টাকা গ্রহণ করেনি। যাকে কিছু দেয়ার ইচ্ছা হয় তার দেয়া জিনিসই শুধু গ্রহণ করে। আমার ভেতরে একটা প্রশ্নের জন্ম নিল। লোকটা আসলে ভন্ড, নাকি ভালো? আগেই জানা ছিল, ঢাকার শহরে এ রকম অনেকেই ভন্ডামি করে। তাই ভেতরে একটা আশংকা জেগে উঠলো।
গন্তব্যের দিকে দুই পা বাড়াতেই ন্যাংটা বাবা মিহি সুরে ডাক দিয়ে বললো, এই, তুই চলে যাস কেন? আমাকে একটা টাকা দিয়ে যা। ফিরে লোকটির দিকে এগিয়ে বললাম, আমার কাছে কোনো টাকা নেই। সব টাকা পথে খোয়া গিয়েছে। ন্যাংটা বাবা একটু মুচকি হেসে বললো, আরে পাগল, তোর টাকা হারিয়েছে তা কি আমি জানি না? পকেটে হাত দিয়ে দ্যাখ, একটি টাকা আছে। প্যান্টের সব পকেট খুজে কিছুই পেলাম না। শার্টের পকেট হাতড়িয়েও কোনো টাকা না পেয়ে ন্যাংটা বাবার দিকে নিরাশ হয়ে তাকালাম। তিনি মুচকি হেসে বললেন, শার্ট খুলে ঝাড়া দে, দ্যাখ, একটা টাকা পড়বে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গায়ের শার্টটি খুলে ঝাড়তে লাগলাম। কিন্তু কই, একটা টাকাও তো পড়লো না। হঠাৎ করে পাশের একটি লোক নিচু হয়ে হেসে বললো, এই যে একটা টাকা পড়েছে।
ন্যাংটা লোকটি টাকার কয়েনটি হাতে নিয়ে মুখের কাছে বিড়বিড় করে কয়েকবার কি যেন বললো। তারপর টাকাটি আমার হাতে দিয়ে বললো, ধর, এটা যত্ন করে কাছে রেখে দিবি, কখনো হাতছাড়া করবি না। আমি তার কথায় সায় দিলাম। ন্যাংটা বাবা ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলো। আমি তার নিম্নাঙ্গের দিকে দৃষ্টি রাখলাম। শরীরটা উলঙ্গ। কিন্তু তার লজ্জাস্থানটি দুই রানের চাপায় আড়াল হয়ে আছে। মোটা-কালো শরীর থেকে একটা সুগন্ধ বের হয়ে আসছে। আমি তার মুখের দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালাম। আমার দিকে গম্ভীর চোখে তাকালো লোকটি। আমার ভেতরে অনেক ভাবনার ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। সন্দেহের সতর্ক বাতাস মন বার বার দোলা দিচ্ছিল। লোকটি সহসা নরম সুরে বললো, তুই আমাকে সন্দেহ করছিস? সন্দেহ করলে চলে যা। তবে আমি তোকে কিছু দিতে চাই। তুই এখন বড়ই কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিস, তাই না?
– হ্যা, আমি আড়ষ্ট মাখা কণ্ঠে বললাম।
– তোর মা-বাবা বেচে আছে?
– বাবা নেই, মা আছে।
– মাকে যত্ন করিস?
– জি করি।
– মায়ের মনে কখনো কষ্ট দিবি না। ধর, হা কর।
লোকটি তার মুখের ভেতর থেকে কি যেন বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। একটা খটকার মধ্যে পড়ে গেলাম। শূচিবাই আছে আমার। কখনো খাদ্যের ভেতর একটা পিপড়ে পড়লেও খাবার রেখে উঠে এসেছি আর এখন লোকটির মুখের থুথু মেশানো কিছু নিজের পেটে ঢোকাবো? হঠাৎ একটা ঘৃণা ভেতরে জেগে উঠলো। এ কোন বিপদে পড়লাম আমি?
লোকটি আমার অনীহা দেখে নিরাশ হয়ে বললো, তুই আমাকে ঘৃণা করলে চলে যা। তবে আমি তোকে কিছু দিতে চাই। যারা আল্লাহর মনোনীত বান্দা তাদের শরীরে কোথাও কোনো ঘৃণার কিছু নেই। আমি তোর চোখে এখন উলঙ্গ মানুষ রূপেই বসে আছি। কিন্তু তুই আমার লজ্জাস্থানটি দেখতে পাচ্ছিস না। তুই পোশাক পরে আছিস। অথচ আমি তোর লজ্জাস্থানটি পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি। কি, আমার কথা তোর বিশ্বাস হচ্ছে না? ধর, একটু খেয়ে দ্যাখ। খা, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। কি আর করা! চোখ-কান বুঝে মুখের ভেতর ঢোকালাম। কিন্তু এ কি! এতো সুবাসিত ঘ্রাণ। আমি অবাক হয়ে গেলাম! ন্যাংটা বাবা হেসে বললো, কি, কিছু পেয়েছিস?
– হ্যা পেয়েছি। একটা সুমিষ্ট ঘ্রাণ পেয়েছি।
– আর কিছু পাসনি?
– না তো!
– বোকা কোথাকার।
পেয়েছিস, আজ রাতে এর প্রমাণ পাবি। রাতে শোয়ার সময় পয়সাটি বালিশের নিচে রাখবি। গভীর রাতে প্রমাণ পাবি তোকে কি দিলাম। পাশে দাড়ানো সেই লোকটি অস্পষ্ট স্বরে বললো, আপনার কপাল খুলে গিয়েছে। আমরা অনেক সাধনা করেও বাবার মন ভরাতে পারিনি, বাবা আপনার মন পরীক্ষা করার জন্য হয়তো কিছু চাইতে পারে। বাবাকে বিমুখ করবেন না। এমন সুযোগ সব সময় আসে না।
আমি ন্যাংটা বাবার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালাম। দেখলাম, সে আকাশের দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর আমার দিকে চোখ রেখে বললো, তোর একটা প্রিয় জিনিস দিয়ে যা আমাকে, দিবি? আমি ঘাবড়ে গেলাম। প্রিয় জিনিস বলতে গলায় সোনার চেইনটা এবং হাতে সিকো ফাইভ ঘড়িটা শুধু আছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলাম। এই দুটো জিনিসের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। কল্প নিজের হাতে চেইনটি আমার গলায় পরিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় যখন তার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটলো তখন এই ঘড়ি আর চেইনটাই আমার সান্তনার শেষ সম্বল ছিল। আজ কি করে যে তার স্মৃতি মাখা মূল্যবান জিনিস দুটোকে হাতছাড়া করবো সেই ভাবনাটাই আমাকে দারুণ যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছিল!
– কি রে! কি এতো ভাবছিস? মনে না চাইলে চলে যা।
– নদীর ভেতরে পড়ে কেউ যদি হারিয়ে যাওয়া কলমটি খুজতে গিয়ে নিজের জীবন বিলায় তার মতো দুর্ভাগা আর কে আছে?
পাশের সেই লোকটি আমাকে তিরস্কার করে বললো, আপনি এতো বোকা কেন? বাবার কথার ইঙ্গিত বোঝেন না? লক্ষ্মী কখনো পায়ে দলতে নেই। কি আর করা! হাতের ঘড়িটা খুলে বাবার হাতে দিলাম। ঘড়িটা হাতে নিয়ে বাবা রাগত স্বরে বললো, এটাই শুধু তোর প্রিয় জিনিস, গলার চেইনটা তোর প্রিয় নয়? তুই আমাকে বার বার অপমান করছিস কেন? আমাকে তোর বিশ্বাস হচ্ছে না? আমার আশীর্বাদ যেমন জোরালো, অভিশাপও তেমন জোরালো। দেখলাম, বাবার চোখ দিয়ে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। পাশের সেই লোকটি আমাকে আবার ভর্ৎসনা দিয়ে বললো, কি রে ভাই, আপনি কিছু বোঝেন না? এই সামান্য জিনিস আপনার কাছে বড়, নাকি জীবন ও ভবিষ্যৎ বড়?
সত্যিই আমি নদীতে পড়ে গিয়েছিলাম। কলম খুজে আর কাজ নেই। নিজের জীবনটা অনেক মূল্যবান। গলার চেইনটা খুলতে গিয়ে বুকের ভেতর একটা মোচড় দিয়ে উঠলো। কল্পর সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ার সময় বুকের ভেতর এ মোচড়টা দিয়েছিল। বাবা চেইনটা পেয়ে খুশিতে ডগমগ হয়ে গেল। একটু হেসে বললো, যা, চুপ করে চলে যা। পথে কারো সঙ্গে কোনো কথা বলবি না। খবরদার ওই পয়সাটা কখনো হারাবি না। রাতে যা পাবি এর একশ ভাগের এক ভাগ ফকির-মিসকিন আর মসজিদে দান করে দিবি। যা, পেছন দিকে একটুও তাকাবি না।
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল। বালিশের নিচে খুব ব্যস্ত হয়ে হাতড়াতে লাগলাম। একটা টাকার কয়েন শুধু হাতে ঠেকলো। কয়েকবারই রাতে ঘুম ভাঙলো। বালিশের নিচে হাত রেখে বার বার নিরাশ হলাম। বিষণ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে রাতটি কেটে গেল। আশা-নিরাশার দোলায় পুনরায় বালিশটা সরিয়ে দেখলাম, এক টাকার কয়েনের সঙ্গে আর কিছুই যোগ হয়নি। সোনালি কয়েনটির দিকে গভীর ভাবে দৃষ্টি রাখলাম। দেখলাম, কয়েনটি হেরোইনের দগ্ধ ধোয়াই কালো বর্ণের রূপ পেয়েছে। রাগ-ক্ষোভে কয়েনটি জানালা দিয়ে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেললাম। মোহের ভেতর বিশ্বাসের ভিত যতোই শক্ত হোক, মোহ কেটে গেলে বিশ্বাসের ভিত সহজেই ভেঙে যেতে পারে। প্রতারণার মাধ্যমে ন্যাংটা বাবা সেটাই আমাকে বুঝিয়ে দিল।