আমাকে এখনি বাসায় যেতে হবে। খালি বাসা পড়ে আছে। কেউ নেই।’ তুসি কথাটা বলেই উঠে হাঁটা শুরু করলো। পেছন পেছন হেঁটে আমিও বললাম, ‘এভাবে ভালোবাসা হয়না তুসি।’ ও দাঁড়ালো। তিক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, ‘এভাবে হয়না তাহলে কোন ভাবে ভালোবাসতে হয় আমার জানা নেই। আমি চললাম।’
তুসি হেঁটে চলেছে। ক্যাফেতে বসে দু’জনের কথার ছলে একটু কথা-কাটাকাটি হতেই পারে। তাই বলে যেতে হবে? দাঁড়াতে বললাম। কোনো রেসপন্স পেলাম না। রাস্তায় সিনক্রেট করা উচিৎ হবে না। লম্বা লম্বা পায়ের কদম ফেলে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম, ‘এভাবে না ভালোবাসলে, চলো তোমাকে বাসায় পৌঁছিয়ে দেই।’ তুসি কিছু বললো না। বুঝতে পারি ও বিরক্ত অনুভব করছে। আমি রিকশা ডাক দিয়ে দাঁড় করালাম। ও রিকশায় উঠতে চাইছে না। মনে মনে খুব রাগ হচ্ছিল। খুব কষ্টও হচ্ছিল আমার। তুসি ছিল খুব রাগি আর বদমেজাজি। রাগ ভাঙানোর মতো কোনো উপায় নেই। কিছু মানুষের রাগ ভাঙানোর মতো প্রিয় জিনিস থাকে। কিন্তু ও যখন রাগায় তখন প্রিয় জিনিস গুলোও বিষ রূপ ধারণ করে।
রিকশা সামনে দাঁড়ানো। বারেবারে রিকশাওয়ালা বলছে, আমরা যাবো কিনা? আমি তুসির দিকে তাকিয়ে বলি,
‘রিকশায় উঠো, মাথা ঠাণ্ডা করো। বাসায় গিয়ে ফোন দিও।’ ও ক্ষেপে হেসে বলে, ‘বাসায় গিয়ে আমি বিয়ের কথা বলবো। তোমার সাথে এভাবে সম্পর্ক রাখতে পারবো না।’ তুসি এই বলেই রিকশায় ওঠে। মন মেজাজ আমারও তখন বিগড়ে যাচ্ছিল। আমিও ওর পাশে বসবো, ও হাত দিয়ে বাঁধা দিল। আমাকে ওর পাশে বসতে বারণ করছে। ‘রাস্তায় তুমি সিনক্রেট করতে চাইছো? যা বলার বাসায় গিয়ে ফোনে বইলো।’ আমি জোর করেই রিকশায় বসলাম। আমি ওর বাম পাশে বসলাম। রিকশা চলছে। পুরো রাস্তা জুড়ে একা একা কথা বললাম। তুসি বোবার মতো চুপচাপ বসেই ছিল।
তুসির সাথে দীর্ঘ তিন বছরের সম্পর্ক আমার। এনিয়ে অনেকবার ঝগড়া ফেসাদ হয়েছে। ছোট ছোট বিষয় গুলো নিয়ে বেশ মাতিয়ে তুলে বড় করে দেখে। প্রায় পনেরো দিন যাবৎ বাড়িতে আব্বা অসুস্থ থাকায় তেমন সময় দিতে পারি নাই।একবার হাসপাতালে নয়তো ঔষুধের ফার্মেসিতে। ব্যাপার গুলো ক্যাফেতে বসে বললেও ও এগুলো নিছক ভেবে উড়িয়ে দেয়। তুসিকে নামিয়ে দিয়ে বাসায় এসে পড়লাম। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজালাম। মা এসে দরজা খুললো। মা বিষন্নমনে বলে, ‘সারাদিন কোথায় থাকিস বাবা। তোর আব্বা যে অসুস্থ পরিবারের টুকিটাকি কাজ করতে হবে সেগুলো কি মাথায় রাখিস?’ উত্তরে কি বলতে হবে ভেবে পাচ্ছিলাম না। কিই বা বলবো, বলবো আমি একটি মেয়ের সাথে প্রেম করি ও আমাকে এভোয়েড করছে। সম্পর্ক রাখতে চাইছে না। এগুলো বললে মা ও আব্বা আরও কষ্ট পাবে। আব্বার অসুস্থতা যেন আরও বেড়ে যাবে। চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ি।
আমার প্রতি ওর একটা দুর্বলতা ছিল। রাগ হলে আমি ভিডিও কলে ফোন দিয়ে কানে ধরে ক্ষমা চাইতাম। ও সাথে সাথে মুচকি হেসে ওগুলো স্ক্রিনশট দিয়ে রাখতো। নেট চালু করে দেখি ও লাইনে নাই। নাম্বারে ফোন দিলাম। ওপাশ থেকে বারেবারে বলছে, সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। একটু পড় আবার ডায়েল করুন। হয়তো কারো সাথে কথা বলছে। প্রচুর মাথা ব্যথা, ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে আবার রুমে আসলাম। পরক্ষণেই আব্বার ঘুঙ্গানোর শব্দে আঁতকে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে আব্বার রুমে যাই।
দেখি মা আব্বার মাথার কাছে বসে কপালে জলপট্টি দিয়েছে। আব্বা আমাকে দেখেই চোখের পানি ছেড়ে বললো, ‘অনেক বড় হয়েছিস বাবা, আমার শরীরটা ভালো না। আমার ব্যবসাটা তুই দেখাশোনা করিস।’ আব্বার কথা শোনে ভাবছি, তুসিকে সময় দিতে পারি না বলে ও সম্পর্ক রাখবে না। এদিকে আব্বার অনুরোধ! ভাবতে ভাবতে মাথা’টা ধরে যাচ্ছে। আব্বার পায়ের পাশে বসে পা টিপে টিপে বললাম, ‘জ্বী আব্বা, তুমি কোনো চিন্তা করো না। তুমি রেষ্ট নাও। আমিই ব্যবসা দেখাশোনা করবো।’ আব্বা ঘুমাবে, আমি এসে পড়ি। সময় যেতে চাইছে না, বই খুলে টেবিলে বসলাম। তুসিকে ফোন দিবো বলে মোবাইল হাতে নিলাম। দেখি তুসির পাঁচটা মিসডকল ভেসে আছে। সাথে সাথে কল দিলাম। ফোন ধরেই ওপাশ থেকে তুসি চেঁচিয়ে বললো, ‘আমাকে ফোন দিয়েছিলে কিসের জন্য?’ ‘আসার পথে বললাম বাসায় গিয়ে ফোন দিও। দাওনি তাই আমিই দিয়েছিলাম।’
‘ধরা বাঁধা কোনো নিয়ম নেই যে বাসায় এসে ফোন দিতেই হবে। তাঁছাড়া তুমি আমাকে এভোয়েড করছো। আমি চাইনা তুমি আর আমার মাঝে থাকো।’ আমি হেসে হেসে বললাম, ‘সত্যিই আমি পরিবারের পিছনে সময় দিতে গিয়ে মনের অজানতেই তোমাকে এভোয়েড করেছি।’ তুসিও হাসি মুখে বলে, ‘বাড়িতে আমার আর শাওনের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলেছি। উনারা রাজিও হয়েছে।’ চোখটা ভিজে গেল আমার। খুব কষ্ট হচ্ছিল। পরিবারের কাছে আমার হাত পা, মন বাঁধা। চাইলেও তুসিকে সময় দিতে পারবো না। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করিনি শাওন কে? কি বা লাভ জিজ্ঞেস করে! যে চাইনা, তার জন্য উৎপেতে বসে থাকার কোনো মানেই হয়না। আমি বললাম, ‘বিয়ে করে সুখি হোও।’ এই বলেই ফোন কেটে দিলাম।
প্রায় মাস পাঁচেক পর- আব্বার অসুস্থতার জন্য ব্যবসার হাল, পুরো পরিবারের হাল ধরতে হয়েছিল আমাকেই। ব্যবসাও বেশ ভালোই যাচ্ছে। কিছু টাকা সঞ্চয় করেছি আব্বা ও মায়ের নামে। সবাই মিলে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য জীবন কাটাচ্ছি। পনেরোদিন পর পর আব্বাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যেতে হয়। আজও তাই যেতে হবে। আব্বাকে নিয়ে শহরে গেলাম ডাক্তার দেখাতে। হঠাৎ তুসির সাথে দেখা। প্রথমে চিনতে পারিনাই মেয়েটি যে তুসি। তবু গভীর প্রেমের জন্য হয়তো চিনে ফেললাম। পাঁচ মাস আগে যেমন ছিল দেখতে এখন পুরোটাই তার বিপরীত। মুখ শুকনো, কালো হয়েছে অনেক। দেখি হাতে বাজারের ব্যাগ। ব্যাগ ভর্তি কাঁচা সবজি। ওকে এই অবস্থাতে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল। মুখে হাসি দিয়ে তুসিকে বললাম,
‘ধন্যবাদ তুসি।’
আমাকে দেখা মাত্রই হকচকিয়ে উঠে বলে, ‘ধন্যবাদ?’ ‘হ্যাঁ, তুমি যদি আমাকে ছেড়ে চলে না যেতে তাহলে পরিবার নিয়ে সুখে থাকতে পারতাম না। পরিবারকে সময় দিতে পারতাম না।’ ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আসার পথে আবার তুসিকে বললাম, ‘তোমার স্বামী অনেক সময় দেয় তোমাকে তাইনা? শোনেছি ভালো চাকুরি করে, তোমাকে কিছুর অভাব বুঝতে দেয়না।’ তুসির চোখে পানি। বলে, ‘সময়, আমি চাইনা। আমি ভালোবাসা চাই। যে সময়ে কোনো সুখ শান্তি নাই, সে সময়ে মাধুর্য নাই।, এক চিলতে হাসি দিয়ে বললাম, ‘আমি আসি, স্বামী নিয়ে সুখে থাকো।’
আব্বাকে নিয়ে আবার হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আব্বা এতক্ষণ সময় আমার আর তুসির কথা শুনছিল। আব্বা বললো, ‘মেয়েটি কে?’ আব্বার হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছি আর বলছি, ‘ঐ মেয়েটিই আমার জীবন পরিবর্তনের মূল কারণ। ও না থাকলে হয়তো তোমাদেরকে আগলে রেখে ভালোবাসতে পারতাম না।’ আব্বা খকখক করে কাশি দিয়ে বলে, ‘মেয়েটিকে ভালোবাসতি?’ ‘হ্যাঁ আব্বা, এতো জেনে কি লাভ। শুধু অতিত অনুশরন করে জীবনের পথ অতিক্রম করতে হয়।’