জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী

জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী

আমার ছোট ছেলেটা সবে হাঁটতে শিখেছে। এক পা দু পা করে হাঁটে আবার ধপাস ধপাস করে বসে পড়ে। কখনো যদি উপুড় হয়ে পড়ে; আগে দেখে আশেপাশে কেউ আছে কিনা। কেউ ওর দিকে একটু মায়া মায়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কিনা। যদি ওর মা একটু আহ্লাদ করে বলে, “ইস আমার বাবাইটা পড়ে গেছে।” তাহলে কাজ শেষ। প্রথমে ঠোঁটটা উলটে ফুল ভলিউমে গলা ছেড়ে কান্না শুরু করে দেয়। পুরাই ভাঁওতাবাজি কান্না। চোখে এক ফোঁটা পানিও থাকে না। আমি বেশ কয়েকবার খেয়াল করেছি। ও উপুড় হয়ে ধপাস করে পড়লেও যদি কেউ ওকে খেয়াল না করে তাহলে নিজে নিজেই উঠে আবার হাঁটতে চেষ্টা করে।

কিছুদিন থেকেই লক্ষ করছি ছেলের মতিগতি কেমন যেন। বারান্দার গ্রিল ধরে উদাস হয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। আর বৈষয়িক সবকিছুর উপরে কেমন যেন ক্ষেপে আছে। দুই দিন আগে ওর মায়ের মোবাইলটা বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ফেলে দিলো। আমার হাত ঘড়ি, আলমারির চাবি, ওর দুইটা প্যান্টও ফেলে দিয়েছে। ও বারান্দার কাছে গেলেই এখন ভয় লাগে। কি না কি আবার ফেলে দিচ্ছে। ছেলের মতিগতি বুঝি না কিছুই।

সকালে আমার ঘুম একটু দেরিতেই ভাংগে। ওরা মা ছেলে কি করে যে সেই ভোর বেলাতে উঠে যায় জানিনা। একদিন সকালে বউয়ের চিৎকার শুনে ঘুম ভেংগে যায়। বউ ছেলেকে ডাকছে। ডাকতে ডাকতে ছুটে এলো বেডরুমে। এসেই “ইয়াল্লা” বলেই মুখে হাত দিয়ে সেই কি হাসি। আমি কিছুই বুঝতেছিলাম না। ঘুমের রেশ তখনো তুঙ্গে। হঠাৎ পিছন থেকে চুল ধরে কে যেন টান দিলো মনে হয়। ফিরে দেখি আমার বাপধন হাসতেছে। তবে ভয়ে চমকে গেলাম। এই ভূতের বাচ্চা কোত্থেকে এলো। সারা গায়ে পাউডার মেখে সাদা হয়ে গেছে।

বউকে বললাম, “আরে কি হলো এতো হাসি কিসের। বাবাইকে নাও। কি অবস্থা করেছে দেখতো। নাও ওকে ফ্রেস করে দাও।” বউ এই মুহূর্তে পেটে হাত দিয়ে হাসছে। হাসতে হাসতে কাহিল হয়ে গেছে। বুঝলাম বাচ্চা মানুষ না হয় সারা গায়ে পাউডার মেখে ভূতের বাচ্চা হয়ে গেছে তাই বলে এভাবে হাসতে হয়।

বউ কাছে এসে একটা ছোট আয়নাটা আমার মুখের সামনে ধরলো। দেখেই চমকে উঠলাম। নিজেকে দেখে এভাবে আগে ভয় পাই নাই। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালাম। দেখি আমার মুখে চুলের একপাশ পুরো সাদা। বউয়ের হাসি আরো বেড়ে গেলো। মায়ের হাসি দেখে ছেলেও এখন ফর্মে আছে। ও হাততালি দিয়ে হাসছে। বউ বলল, “তোমার ছেলে রান্নাঘর থেকে ময়দায় প্যাকেট নিয়ে এসে তোমাকে আর নিজেকে মেকাপ করে দিয়েছে। তোমরা বাপ ব্যাটা তো ময়দা সুন্দরী হয়ে গেছো।” বউয়ের হাসি আরো বাড়ছে। সেই সাথে আমার গা জ্বালাও বাড়ছে। এটা আর সহ্য করা যায় না। ছেলেকে বগলদাবা করে ওয়াশরুমে ঢুকলাম।

ছেলেকে নিয়ে বেশি জ্বালায় থাকি রাতে ঘুমানোর সময়। যতোক্ষণ ও ঘুমায় না ততোক্ষণ ওর মায়ের পেটে মাথা রেখে পা দিয়ে আমাকে ধাক্কাতে থাকে। বউ ই শিখাই এইসব বুঝি আমি। ছেলেরে তো কিছু বলে না উলটা মুচকি মুচকি হাসে। আমি ছেলের পায়ে আস্তে করে চর দিলে ক্ষেপে উঠে। মা ছেলে ঐক্য জোট নিয়ে মেলা ঝামেলায় আছি।
সবচেয়ে বড় জ্বালা হলো, হঠাৎ ঘুম ভেংগে গেলে দেখি ছেলে আমার আর বউয়ের মাঝখানে নাই। বিশ্বভ্রমণে বের হয়েছে। হয় পায়ের কাছে। না হলে মাথার উপরে। কখনোবা খাটের কিনারায় মশারিতে ঝুলতে থাকে। সারা রাত কতোবার আর এভাবে ধরে আনা যায়। আমার ধারনা আমার বাবাইকে যদি ঘুমের মধ্যে বিশ্বরোডে শুইয়ে দেওয়া হয়। ও এক রাতেই এক ঘুমে গড়াতে গড়াতে পুরো পৃথিবী ঘুরে আসতে পারবে।

সেদিন ছেলেকে দেখি একটু পর পর বান্দায় যাচ্ছে আর আসছে। মিটিমিটি হাসছে। সন্দেহ হলো কাহিনী কি। বারান্দায় উকি দিয়ে দেখি সামনের বিল্ডিং এ পুতুলের মতো এক মেয়ে বাবু গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমার ছেলেও গ্রিল ধরে সেই মেয়েকে দেখে হাত নাড়ছে। মেয়ে বাবু দেখি আমার ছেলেরে পাত্তাই দিচ্ছে না। আবার সরেও যাচ্ছেনা।

বউকে ডাক দিয়ে বললাম, “দেখো তোমার পুত্রধনের কাজ। সামনের বিল্ডিংয়ের মেয়ের সাথে ফিল্ডিং মারছে।” বউও এসে বারান্দায় উকি দিলো। সাথে সাথে বাবাইকে কোলে করে নিয়ে এলো বারান্দা থেকে। আর আমাকে গটমট করে বলছে, “একেবারে বাপের মতোই হইছে। মেয়ে দেখলে হুশ থাকেনা।”

এদিকে ছেলে আহ্লাদী কান্না শুরু করছে, “বাবু যাবো, বাবু যাবো।” মানে বারান্দায় মেয়ে বাবুটার কাছে যাবে, মানে আসলে দেখবে। ওর মা তো আরো রেগে গেল, “বাপে সারাদিন মেয়ে দেখলেই বেইবী বেইবী করে। আর ছেলেটা বাবু বাবু। পুরুষ মানুষ জাতটাই খারাপ। সে দুধের বাচ্চাই হোক আর তোমার মতো বুড়া হাবড়াই হোক।” কবি এখানে নিরব। ঘরে শান্তির জন্য আমি কম কথা বলি।

এক সন্ধ্যায় বাসায় আসার সময় কি মনে হলো বউয়ের জন্য একটা লাল টুকটুকে গোলাপ নিয়ে গেলাম। এর আগে কখনোই গোলাপ নেইনি। আমাদের দুজনের পছন্দই বেলী ফুল। আজ গোলাপ ফুল নিয়ে নিজেকে কেমন যেন প্রেমিক প্রেমিক মনে হচ্ছিলো। যাক অবশেষে বউকে গোলাপ ও দেয়া হবে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি, বউ দরজা খুলতেই ফুলটা দিবো নাকি পরে দিবো। কলিংবেল বাজাতেই বউ দরজা খুলে দিয়েই বলল, “বাবাইকে দেখে রাখো। আমার রান্না চুলায়।”

যাক বাবা। কি ভাবলাম আর কি হলো। ছেলেকে বেডরুমে নিয়ে খাটে বসালাম। এতোক্ষণ এখানে বসেই খেলছিল। পুরা বিছানা পলাশীর রণক্ষেত্র হয়ে গেছে। ওর মা ওকে বিছানাতেই খেলনা দিয়ে টিভি অন করে রান্না করতে যায়। আর একটু পর পর এসে দেখে যায়। কলিং বেলের আওয়াজ পেলে ছেলেই আগে দরজার কাছে গিয়ে পৌছায়। গোলাপটা ড্রেসিং টেবিলের সামনে রেখে রান্না ঘরে গেলাম। বউ শাক ভাজি করছিলো। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে একটা চুমু খেলাম।

“আহ কি হচ্ছে ছাড়ো। খুনতি লাগাই দিবো কিন্তু।” মুখেই বলছে ছাড়ো। কিন্তু ওর ছাড়া পাওয়ার তো কোন লক্ষণ দেখিনা। আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই আমার হাতের উপরে একটা হাত রাখলো।

“কি ব্যাপার স্যার। আজ বউকে এতো সোহাগ করা হচ্ছে ঘটনা কি হু!”

“আরে সোহাগ তো সব সময়ই করতে ইচ্ছে করে। তোমার ছাওয়াল ই তো জ্বালায়।”

“খবরদার বাবাইকে নিয়ে কিছু বললে খুন করে ফেলবো। যাও তো গিয়ে দেখে আসো বাবাই কি করছে?”

“কি আর করছে, খেলছে। তোমার জন্য একটা জিনিস আছে চলো দেখবে। ভালবাসার জিনিস।”

“এখনই যেতে হবে। শাকটা নামাই। হয়েই গেছে। এক মিনিট প্লীজ। ” বউ শাক নামাতেই বউয়ের চোখ পিছন থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছি। বউ বলল, “কি ছেলেমানুষি করছো। এভাবে চোখ বন্ধ করেই যেতে হবে কেন।”

চুপচাপ বউকে নিয়ে বেডরুমে ঢুকতেই আমার কলিজা আর কলিজায় নাই। হাপিস হয়ে গেছে। বউ বললো, “এই এবার চোখ ছাড়ো।” আমি বিনা বাক্য বেয়ে চোখ ছেড়ে দিলাম। বউ আমার দিকে ফিরে বলল, “কই আমার ভালবাসার জিনিস কই? দাও।” বউকে ছেলের দিকে ফিরিয়ে বললাম, “ঐ যে তোমার তোমার ছাওয়ালের মুখে। চাবাইতাছে।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত