পার্থিব শোধ

পার্থিব শোধ

ব্যাটা ছেলের মতোন শাড়িটা হাঁটুর ওপরে তুলে; হাত-পা ইতস্তত ছুঁড়ে শাশুড়ির সঙ্গে তুমুল ঝগড়ায় মত্ত বড়বউ মুক্তা। নাম তার ‘মুক্তা’ হলেও তার ভেতরটা কষ্টিপাথরের মতো মিশমিশে কালো। যদিচ কষ্টিপাথরের মতোন মূল্যবান সে নয়। অন্য সবার সঙ্গে মিছরির ছুরির মতো আচরণ করলেও, কারণে-অকারণে থুড়থুড়ে বুড়ি শাশুড়ির সঙ্গে তর্কাতর্কি লেগে যায় তার। আজকের ঝগড়ার বিষয় নিতান্তই তুচ্ছ। তার আগে শাশুড়ি-বউ এর ঝগড়ার কিয়দংশ আলোকপাত করা যাক। বড়বউ মুক্তা বেপরোয়া ঢংয়ে হাত নেড়ে বলল,

— হ্যাঁ হ্যাঁ, বহুত দেখছি তোর মতো দজ্জাল শাশুড়ির কাজ কারবার। যত কিছুই বল্ আমার কিচ্ছু হবে না।
বলে আরেকদফা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সুমুখে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের ছেলেকে অকারণে পিঠের ওপর চটচট দু’টো চপেটাঘাত করে ঘরে ঢুকিয়ে নিজেও প্রস্থান করল সেখান থেকে। শাশুড়ি কিছুক্ষণ থতমত খেয়ে তাকিয়ে গর্জন করে বললেন,

— কী! কীসের এতো দাপট তোর? আমি কি তোরে খারাপ কথা বলছি? মেঝোবউ এর ঘরে খাওয়ার সময় শেষ হয়ে গেছে আইজকা দশ দিন। তোর কোন খবর নাই শাশুড়িকে খাওয়ানোর। এখন মনে করাই দেয়াটা কি দোষের হইয়া গেছে? বড়বউ মুক্তা আবার বেগে ছুটে এলো ঘর থেকে। গলা চড়িয়ে বলল,

— না, দোষের কেন্ হইব? আমার ঘরে যহন মাস পেরোয়ে আরো অর্ধেক মাস পর্যন্ত গিলতে থাকো তখন তো ছোটবউকে মনে করাই দাও না তুমি৷ আমার বেলাতেই পারো সব। আল্লায় করবো এর বিচার। শাশুড়ি মরিয়মের বয়োবৃদ্ধ শুষ্ক চোখের গণ্ডি বেয়ে দুইফোঁটা অশ্রু নেমে আসে, গলা আসে ভেঙে।

— আল্লায় বিচার করব না? দেখা যাইবো কে কার বিচার করে। তোর ঘরে খামুই না আর। এত অপমান আর সহ্য হয় না। বড়বউ এবার তিরস্কারের সুরে গলা টেনে শরীর বাঁকিয়ে বলল,
— আহারে কত শুনলাম তোমার মুখে ঐ কথা৷ পরে তো আবার ঠিকই পিলপিল করে আমার ঘরে খেতে চলে আসো। মরিয়ম এবার চোখের পানিতে জোরপূর্বক বাঁধ দিয়ে ভাঙা গলায় বললেন,
— ছেলে তো পেটে ধরছি। না? তোর হইয়া যহন হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চায় তখন তো আর না এসে পারি না।
— আসিও না। তুমি আসলেই ঘরে অশান্তি হয়। আমরা একটু শান্তিতে দু-চারটা ভাত খাই।

ঠিক সে সময় মরিয়মের বড় ছেলে ঘরে প্রবেশ করল। ঘরে ঢুকেই এই গোলযোগ তার কানে এলো ক্ষুরধার সূঁচের মতো। একে তো সারাদিনের কাজেকর্মে মেজাজ ছিল খিটমিটে, সেই খিটমিটে মেজাজে তুষের আগুন ধপ করে জ্বলে ওঠল আপন মা’য়ের সঙ্গে স্ত্রীর এরূপ ধৃষ্টতায়। তৎক্ষনাৎ সে বউকে টেনে হিঁচড়ে অন্দরে নিয়ে গেল। পরক্ষণেই মুহুর্মুহু দুমদাম শব্দের সঙ্গে ভেসে এলো মুক্তার গলা ফাটানো আর্তনাদ। মরিয়ম বুঝলেন ছেলে বৌমাকে উত্তম মাধ্যম দিচ্ছে। শুরুতে কিছুক্ষণ ঠায় বসে থেকে ভাবলেন, এমন বউকে মারাই উচিত। মেরে একদম কুঁচি কুঁচি করে কেটে খালে ভাসিয়ে দেওয়া উচিত। বৌমার পিঠের ওপর একেকটা মুষ্টিঘাতে মরিয়ম আতঙ্কিত হয়ে সব অনুরাগ যেন ঘুণে ধরা কাঠের ন্যায় ঝুরঝুর করে ধরাশায়ী হল। ক্রমাগত প্রহারের তরক্কিতে তিনি আর বসে থাকতে পারলেন না। শেষমেশ আবদ্ধ কক্ষের দরজার সুমুখে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বললেন,

— ওরে ও আব্বাস, বউডারে কি শেষ করে দিবি আইজকে? ছোডো মানুষ, মাথা গরম হয়ে বইলা ফেলছে, এবার ছেড়ে দে বাপ। ছেলের কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। বেড়ার ফাঁক গলে ফোঁস ফোঁস শ্রান্তির নিঃশ্বাস ভেসে আসছিল আব্বাসের। কিন্তু ছেলের বউ যেন হার মানার পাত্রী নয়। অশ্রবিকৃত কণ্ঠে মুক্তা তীব্র গর্জন করে বলল,

— তুই আর ফোঁপর দালালি করবি না বুড়ি মাগি। তোর জন্য আজকে আমার এই দশা। মরে যা তুই। তোর মরণকালে একফোঁটা চোখের পানি আসবে কথা শেষ হল না। ঠাস করে চড়ের শব্দ হলো। হতেই থাকল। থামার নামগন্ধ নেই। এরমধ্যেও মুক্তা শাশুড়ির প্রতিকূলে নানান অশ্রাব্য গালিগালাজের ফুলঝুরি থেমে নেই। কিন্তু কান্না আর এলোপাতাড়ি মারের শব্দে সেসব কথা অতল গহ্বরে নিলীন হতে লাগল।

‌‌‍‌‌‌‌‌‌ ঝগড়ুটে মুক্তার শাশুড়ি মরিয়মের চার ছেলে। এক মেয়ে জন্মের নবম বছরের মাথায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পটল তুলে। স্বামী সরকারি চাকরি করতো বন্দরে। মাসের নির্দিষ্ট সময় পরপর এসে একবারের জন্য দেখে যেতো স্ত্রী ছেলের একটুকরো সংসারটাকে। সচ্ছল জীবনযাত্রায় ভালোই চলছিল তাদের দিনকাল। কিন্তু একদিন খবর আসে মরিয়মের স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করেন সেই বন্দরের আশেপাশের কোনো এলাকায়৷ মরিয়ম মোটেও মুষড়ে পড়েননি সেসময়। কারণ, সেইকালে এসব বিষয় নিতান্তই স্বাভাবিক ছিল। তদুপরি মরিয়ম ছিল একেবারেই নিরীহ গোবেচারা প্রকৃতির মহিলা। ছেলেমেয়েরা যখন ডাগর হয়ে গেল তখন আর এসব বিষয়ে মাথা ঘামানো চলে না। তবুও স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা, ভক্তি, শ্রদ্ধা ছিল আজীবন অমলিন। অবশেষে শেষ বয়সে এসে মরিয়মের কাছেই মৃত্যুশয্যা বেছে নেয় তার স্বামী। সেসব দিন এখন গত। মরিয়মও বিধবা হয়েছে সেই কবে। বর্তমানে চার ছেলের মধ্যে তিন ছেলেই বিয়ে করে মোটামুটি সংগতিপন্ন।

তিন ছেলের কাছে একমাস করে থেকে খাবার খায় সে। ছোট ছেলে একাই মা’কে খাওয়ানোর ইচ্ছে পোষণ করলেও বড় ছেলে আর মেঝো ছেলে এতে আপত্তি তুলে। কথা ছুঁড়ে, “মা টা তো সবার! কাজেই যৌথ পরিবার যেহেতু আর নেই, তাই প্রত্যেকের ঘরে এক মাস করে খাবে মা।” বাড়ির বউয়েরা এই প্রস্তাবে কোনরূপ নেতিবাচক উক্তি প্রয়োগ না করলেও বিশেষকরে বড়বউ মুক্তা শাশুড়িকে দু-চোখে দেখতে পারে না তা কাজেকর্মে,বোলচালে, কথার ভঙ্গিমায় সুস্পষ্ট। মনে মনে সে খানিক অপ্রসন্ন হয়েছিল বটে কিন্তু তা প্রকাশ করা অনুচিত ভেবে ভেতরে ভেতরে অসংলগ্ন ক্রোধানলে জ্বলতে লাগল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মরিয়ম নিজের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে। মনে মনে গর্ব করে, এত কষ্ট করে ছেলেদের মানুষ করেছি এবার জীবনের শেষ লগ্নে এসে একটু শান্তিতে কাটাব,স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলব।

বাস্তবিক ক্বচিৎ তার আশা পূরণ হয়, আবার কখনো ছেলের বউয়েরা সেই আশায় গুড়েবালি দেয়। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ স্বভাবতই একটু নিজেকে বড় প্রমাণ করতে চায় ছোটদের খুটিনাটি ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে ধরে দিয়ে। মরিয়মের স্বভাবেও এর তরতম নেই। তবু এই স্বভাব মেঝো বউ এবং ছোটবউ অনেকটাই মেনে নিলেও বড়বউ রায়বাঘিনীর ন্যায় তেড়েফুঁড়ে এসে প্রতুত্ত্যরে কথার বাণ ছোঁড়ে শাশুড়ির গাত্রে। শাশুড়িও নিজ শক্তিবলে যা পারে বাণবিদ্ধ বচনতীর উল্টো ছোঁড়ে প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার যারপরনাই চেষ্টা করে। বউ শাশুড়ির এই বিবাদ জগ্বিখ্যাত না হলেও এই গ্রামবিখ্যাত৷ মুক্তার গলা যখন চড়ে তখন আশেপাশের দশবাড়ি পর্যন্ত মানুষ তা শুনে এবং নানান কথা বলে হাসি-তামাশায় লিপ্ত হয়। বড়ছেলে আব্বাস রাতে ফেরার পর সব শুনে কখনো বউকে বকাঝকা, কখনো উত্তম মাধ্যম আর কখনো নীরবে মাথা নত করে সয়ে যায়। একছেলে আর একমেয়ের সামনে নিত্যনৈমত্তিক এমন কলহে আব্বাসের ভেতরটা যেন একপ্রকার ঘোরকালো হয়ে উঠেছে। তলিয়ে দেখলে অতলান্ত তমসা ছাড়া কিছুরই দেখা মেলে না।

রাত তখন গভীর। বালিশে মুখ গুঁজে গুনগুন সুর ছেড়ে কেঁদে চলেছে মুক্তা। পাশেই আধশোয়া হয়ে বসে লক্ষ্যহীন স্থাবর তাকিয়ে আছে আব্বাস। মাঝে মাঝে চরম বীতশ্রদ্ধ হয়ে আবার কখনো সহানুভূতি ভরে তাকাচ্ছে স্ত্রীর দিকে। দশ বছরের সংসারে এই দৃশ্য নতুন নয়। পূর্বেও এই ঘর, এই রাত, এই অনবরত ফ্যাঁচফ্যাঁচ কান্নার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাক্ষী ছিল আব্বাস। মায়ের বিরুদ্ধে কোনো ধরণের কটুকথাই সহ্য করে না সে। প্রতিপক্ষের মুখ দিয়ে কথা বের হতে দেরি কিন্তু আব্বাসের হাত চলতে দেরি হয় না।

শুরুতে স্ত্রীকে ইনিয়েবিনিয়ে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু কথায় আছে, মুখে যখন হয় না তখন হাত চালাতে হয়। তাতেও ক্ষান্ত হল না মুক্তা। শাশুড়ির সাধারণ অল্প কথাতেই খোঁচাযুক্ত কথা তার মুখ দিয়ে আপনাআপনি নিঃসৃত হয়। বয়োজ্যেষ্ঠ শাশুড়ি বৌমার ছোটমুখে ওমন উদ্ধত কথার ঝাঁজ সহ্য করতে না পেরে স্বভাবতই খ্যাঁক করে ওঠে। লেগে যায় তুমুল বিগ্রহ। গোটা পাড়া মাথায় তুলে বিবিধ অশ্রাব্য গালমন্দ বর্ষণ হয় অনর্গল। বলা বাহুল্য, মেঝোবউ এবং ছোটবউ এর সঙ্গেও মুক্তার তেমন বনিবনা নেই। এই ভালো, এই খারাপ। বাকি জা’দের তুলনায় অধিক রূপবতী হওয়ায় তার দর্পটা চালচলনে স্পষ্ট ফুটে ওঠে।
আব্বাস আধশোয়া থেকে উঠে বসে শব্দ করে বালিশটা রেখে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে স্বাভাবিক গলায় বলল,

— অনেক হইছে, চুপ করো এখন। ঘুমাব। মুক্তা থামল না। কান্নার বেগ দ্বিগুণ করে দিয়ে ঝাঁজালো গলায় বলল,
— তা ঘুমাও না। না করল কে?
— যেমন সুর তুইলা কান্না করতেছ ঘুমাব কেমনে? এতো রাতে তোমার বেশুরা গলার গান শুনার ইচ্ছা নাই। দোহায় লাগে ঘুমাতে দাও। বলে খানিক প্রকাশ্যে গজগজ করতে করতে শুয়ে পড়ল আব্বাস। মুক্তা একাই বিড়বিড় করে বলতে শুরু করল,

— যত দোষ এখন আমার! শাশুড়ি নামে শয়তান। আমার ঘরে ঠিকই এক্সটেরা আট দশ দিন খাইতে পারে। অথচ ওদের ঘরে কয়েকটাদিন বেশি খাইলেই আমাকে মনে করাই দিতে হবে। বুড়ো শয়তান! আব্বাস সব শুনেও না শোনার ভড়ং ধরে অসাড় হয়ে শুয়ে রইল। একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে সন্তর্পণে ধীরে ধীরে তা উন্মুক্ত করল সে। পাছে নিজের ক্লান্তি এবং প্রশ্রয়টা স্ত্রীর কাছে ধরা পড়ে যায়! পরেরদিন ভোরে যখন মরিয়ম নামাজ পড়তে উঠলেন তখন হঠাৎ আবছা আলোয় একটা ছায়ামূর্তি দেখে চমকিত,আতঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

— কে, কে ওইহানে?
— ভয় পাইয়োনা আম্মা, আমি। বলতে বলতে দেয়ালের আড়াল থেকে দৃশ্যমান হল আব্বাস।

মরিয়ম ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ির পেছনের পুকুর ঘাটে বসে ছিলেন একাগ্রচিত্তে। তখনো আবছা অন্ধকার আর ঘিঞ্জি গাছপালা ভেদ করে সূর্যের কিরণ প্রবেশ করেনি৷ বড়ছেলের উপস্থিতিতে তিনি একাধারে স্বস্তি ফিরে পেলেন এবং গতরাতের সমস্ত ঘটনা মনে হয়ে ভেতরটা অস্বস্তিতে পূর্ণ হয়ে গেল। তিনি একপ্রকার জোর করে মুখ খুললেন,

— ওহহ, তুই? আয়।

পুকুরের সঙ্গে লাগোয়া ঘরটা মরিয়মের। আব্বাস মায়ের ঘরে প্রবেশ করে একটা পিঁড়ি নিয়ে এসে বসল মায়ের মুখোমুখি। বসন্তের শুরুতে শীতের বিদায়বেলায় ‘শীত’ নিজের আধিপত্যটা বেশ জাহির করছে ঘন কুয়াশার শামিয়ানা টাঙিয়ে। পুকুরের ধোঁয়া ওঠা পানির দিকে তাকিয়ে মা ছেলে অনেক্ষণ নিরুচ্চারে বসপ রইল৷ একপর্যায়ে আব্বসা বলল,

— মা, আমার ছেলেমেয়ে দুইডারে তুমি বদদোয়া দিও না। মরিয়ম স্নেহার্দ্র মলিন হেসে বলল,

— কী বলস। ওদের কেন্ বদদোয়া দিমু? ওরা আমার নাতি-নাতনি,ওরা তো কোনো দুষ করে নাই। আব্বাসের মূল কথাটা বলা হল না। সে এসেছিল স্ত্রীর হয়ে ক্ষমা চাইতে। কিন্তু মুখে উঠল না ঐ একি কথা৷ “ছোট মানুষ। আর করবে না। ” হঠাৎই অনুষঙ্গ পাল্টাল আব্বাস। অসংলগ্নভাবে বলল,

— রাতে খাইছিলা আম্মা? মরিয়ম এই প্রসঙ্গের ধারে কাছেও পা দিলেন না। একইদিকে তাকিয়ে থেকে উদাস কণ্ঠে বললেন,
— সেই সতের বছর বয়সে আনছিলাম বউরে। এখন সাতাশ হইতে চলল। পরিবর্তন আর হলো কই। আমার অবদান সব তো সে ভুলে গেল! যে আদরটা সে পাইছে বাকি বউরা তার সিকিভাগও পায়নাই। কপাল!

আব্বাসের মুখে এই কথার যথোচিত জবাব নেই। গতরাত্রির দীর্ঘশ্বাসটা পুষে রেখে স্নিগ্ধ ভোরে পুকুরপাড়ে এসে মায়ের সম্মুখে উৎসারিত করল সেটি। এরপর কয়েকবছর গত হয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুর। চারভাইয়ের বেড়ার ঘরের জায়গায় গড়ে উঠেছে দ্বিতল ভবন। ভূধরসম কষ্ট আর দুরাশা নিয়ে খাটিয়ায় চড়ে ভূগর্ভের বাসিন্দা হয়েছেন মরিয়ম৷ মরণকালে মরিয়ম কয়েকমাস যাবৎ শয্যাশায়ী হয়ে পড়ার পর শুধুমাত্র লোকদেখানোর নিমিত্তে, কয়েকবার নিতান্তই অতর্কিতভাবে শাশুড়ির পাশে উপস্থিত হয়েছে মুক্তা। বাদবাকি সেবাশুশ্রূষা মেঝোবউ এবং ছোটবউ দ্বারা সমাপন হয়েছে।

দীর্ঘদিনের শত্রুর মৃত্যুতেও প্রতিপক্ষের দুই চোখের কোণে দুইফোঁটা অশ্রু বাষ্পীভূত হয়ে ওঠে,কিন্তু শাশুড়ি মরিয়মের মৃত্যুতে মরিয়মের মুখে ছিল না কোনো বিকার। জমেনি একরত্তি পরিমাণ অশ্রুকণা। ভাঙেনি বুক। অকারণ কলহ-বিবাদের ক্লেদ স্মৃতিগুলো রোমন্থন করে হৃদয়ের তলদেশ হতে ফেনিয়ে উঠেনি কোনো ক্ষুদ্র অনুভূতি। সে ছিল সম্পূর্ণ নির্বিকার। লোকমুখে শোনা যায়, সবাই যখন মরিয়মের মৃত্যুশয্যায় আহাজারিতে,দোয়াদরুদ পড়ায় ব্যস্ত ছিল মুক্তা তখন নির্বিঘ্নে ঘুমোচ্ছিল ঘরের দ্বার রুদ্ধ করে। তবে এই কথার সত্যতা কতটুকু তা জানা নেই। পাড়ার লোকচোখে মুক্তার রগচটা স্বভাবের একটা বদনাম রটে যাওয়ায় যে কেউ নিঃসংশয়ে নানান অবান্তর কুৎসা রটিয়ে দেওয়ার সুযোগ লুফে নেয় প্রায়শই ৷

একবছর দুইবছর নয় হাতেগোনা পনেরোটি বছর পরের কথা বলছি। এই কয় বছরে মুক্তা মুক্ত বিহঙ্গের মতো কাটিয়েছে। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে যাওয়া কথায় কথায় ফোঁড়ন কাটার অভ্যাসটা কিছুটা কমেছে সময়ের বিবর্তনে৷ মনটাও কিছুটা বিগলিত হয়েছে। মাঝে মধ্যে হা হতাস্মি করে শাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়ার দিনগুলো মনের তটে ভাসিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলতো সে। কিন্তু সেই জলের দাম এখন শূন্যের ঘরে। কেঁদে কেটে মাথা খুঁড়ে মরলেও শাশুড়ি একবারের জন্য এসে তার অনুতপ্ত মুখের পানে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকাবে না। সেই লোকে যে যায় সে আর ফেরে না। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝা যায় না কথাটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মুক্তা। যে যৌবনের দর্পে তার মাটিতে পা পড়ত না সেই রসঘন উছলে পড়া যৌবন এখন ভাঁটার টানে শুষ্ক । প্রকৃতির নীতিমতো সে এখন পৌঢ়ত্বের দরজার চৌকাঠে বসে প্রমাদ গুনছে।

ছোটমেয়ে রিধির বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামেই। সুখেই আছে সে। বড় ছেলে নাঈমকে ব্যাবসার হাল ধরিয়ে মোটামুটি একটা গতিক করে দিয়ে এখন একটু স্বস্তিতে কাটাচ্ছে আব্বাস। অতটা স্বস্তি অবশ্য নেই। বড়ছেলের জন্য পাত্রী অনুসন্ধানে নেমেছে সে। এখন এইটেই কেবল বাকি৷ মুক্তাও ছেলের বিয়ে নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত। বাজার থেকে দাগহীন, অমলিন তরকারি বাছাইয়ের মতো করে ছেলের জন্য বউ বাছাই করতে লাগল। অবশেষে মনমতো একজন মেয়ে মিলে গেল এবং ভালো দিনক্ষণ দেখে ছেলেকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করল। খাওয়ানো হল চেনা অচেনা সমস্ত আত্মীয়-স্বজন,পাড়াপড়শি,দীনদুঃখীকে।

নতুন বউয়ের নাম জেসিকা। এযুগের মেয়ে তারউপর বাবা মায়ের আদরের সন্তান। সারাবছর পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলে রান্নাঘরের দ্বারপ্রান্তেও ঘেঁষতে দেয়নি বাবা মা। কাজেই সম্পূর্ণ তালকানা বলা চলে। শ্বশুরবাড়ি এসে তাই পূর্ণ রন্ধন প্রশিক্ষণে লাগিয়ে দিয়েছে মুক্তা। কিন্তু রন্ধনশালায় প্রবেশ করাই যেন জেসিকার জন্য অভিশাপ সরূপ। একে তো বাড়ির নতুন বউ তারউপর মুক্তার সরলমূর্তির আবডলে লুকিয়ে থাকা রুদ্রমুর্তির খবর সে এসেই পেয়েছিল। অনেক সাবধানতার বাণীও শুনেছিল লোকমুখে। কারণে,স্বামীর কাছে নিজের অপারগতার আদুরে নালিশ করা ছাড়া শোবার ঘরের বাইরে মুখ খোলার সাহস তার ছিল না। ছেলের বউকে নিয়ে কয়েকটা মাস বিনা উপদ্রবে কাটল মুক্তার। মুক্তা ধরেই নিয়েছিল তার শেষ বয়সে সুখের জোয়ার এসে গেছে। এখন আর কোনো বাঁধা বিপত্তি নেই। কিন্তু কপালের লিখন কে বদলাবে? সুখ সায়ের ভাসাতে স্পষ্ট প্রতীয়মান সুখের সুবিশাল স্রোত যেন আচমকা ভাঁটার টানে সুখকণাগুলো কোথায় তলিয়ে গেল তার আর সন্ধান মিলল না।

একদিন দুপুরে শাশুড়িকে রন্ধনকাজে সাহায্য করছিল জেসিকা। এমন সময় মুক্তা কি একটা কাজে হেলাফেলা করায় ছেলেবৌকে মৃদু ভর্ৎসনা করল। আর ওমনিই জেসিকা মুখ ঘুরিয়ে, গা নাচিয়ে, তপতপ করে সদম্ভে পা ফেলে নিজঘরে অবস্থান নিল শাশুড়িকে অগ্রাহ্য করে। মুক্তার মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল। বারকয়েক চড়া গলায় হেঁকেও যখন বৌমাকে রান্নাঘরে ফেরাতে সক্ষম হল না তখন তার ক্রোধানালে তৈলাক্ত বস্তু পড়ার মতো করে ফুলে ফেঁপে দ্বিগুণ-ত্রিগুণ হল। এরপর অনর্গল তার কটুকথা ছুঁড়তে লাগল। নবোঢ়া বউ বাদানুবাদ না করে মুখ ভার করে বসে রইল। এই তো কেবল শুরু! এই একপাক্ষিক বচসার পর আরো কয়েকদফা তিরস্কার মুখ বুজে সহ্য করল জেসিকা। কিন্তু একদিন সব ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে খানখান হয়ে গেল। মনের অজান্তেই ঠোঁট ফসকে একটা মন্দকথা বেরিয়ে এলো জেসিকার। সেইদিন মুক্তার প্রথম মনে হলো, “এককালে আমিও জেসিকার অবস্থানে ছিলাম এবং শাশুড়ির সব কথা মাথা পেতে না নিয়ে পটাপট তির্যক কথা ছুঁড়তাম প্রয়াত শাশুড়ির বিপরীতে।” ভাবনাটা শুধু ভাবনাতেই রয়ে গেল৷ মুক্তার শাশুড়িসুলভ কঠিন আচরণে এর কোনো প্রভাব পড়ল না।

ক্রমে যেন বউ-শাশুড়ির সম্মন্ধটা নুইয়ে পড়তে লাগল সূর্যরশ্মি অভাবে হরিদ্রাভ চারাগাছটির মতো। আব্বাসও মনে মনে ঝড়ের পূর্বসংকেত পাচ্ছে। তবু ঝড় মোকাবিলার কোনো ব্যবস্থা তার মাথায় এলো না। এমন করে ভালো-মন্দ মিলে একে একে তিনটা বছর কেটে গেল, জেসিকার কোলজুড়ে কোনো সন্তানসন্ততি এলো না। এই নিয়ে প্রায়সময় গঞ্জনা সইতে হয় তাকে। মূলত জেসিকার কোনো সমস্যা নেই। সকল প্রকার ডাক্তারি পরীক্ষার পর জানা গেছে সমস্যাটা নাঈমের,তবে উন্নত চিকিৎসায় তা এড়ানো সম্ভব। অথচ অক্ষর-জ্ঞানহীন মুক্তা এতসব বুঝতে চায় না। নিজে যা বুঝে তা-ই উর্ধ্বে রাখতে চায়। তেমনি আজও এই বিষয়ে বিরক্তিভরে ছেলেবৌকে উদ্দ্যেশ্য করে বিড়বিড় করে শ্লেষোক্তি আওড়াচ্ছিল মুক্তা। অকস্মাৎ আতর্কিতে জেসিকা কোত্থেকে তেড়ে এসে বলল,

— সবসময় আমার দোষ কেন মা? সমস্যা তো আমার না। সমস্যা আপনার ছেলের। সারাদিন আমারে কেন্ এটা নিয়ে খোঁটা দেন? মুক্তা তাচ্ছিল্যভরে বলল,

— আমাকে শিখাতে আইসো না। ছেলেদের সমস্যা থাহে না। থাহে মাইয়্যাদের। মূর্খু মনে হয় আমারে?
জেসিকা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

— হ্যাঁ শুধু মূর্খু না আপনি। গণ্ডমূর্খ। একে তো নিজের ছেলের সমস্যা। আবার আমারে দোষ দেন সবসময়। গুল্লি মারি এই সংসারের। বলে ঝনাৎ করে হাতে থাকা স্টিলের গ্লাস পাকা মেঝেতে ছুঁড়ে গুমগুম পা ফেলে প্রস্থান করল সে স্থান হতে। অর্ধেক না যেতেই মুক্তা চেঁচিয়ে বলল,

— দূর হয়ে যা আমার ঘর থিকা। এমন তেজওয়ালা বউয়ের দরকার নাই আমার। সবজায়গায় তার তেজ। রান্না করতেও তার গা জ্বলে যায়! জেসিকা পূর্বের জায়গায় ফিরে এলো আবার। তারস্বরে বলল,

— আমি কেন দূর হব ঘর থেকে হু? তোমার মন চাইলে তুমি দূর হও। আর হ্যাঁ,রান্না করতে আমার গা জ্বলে ঠিক। আমি ঘরের কাজের লোক না। সারাদিন আমি কাজ করতে পারব না। নিজের রান্না নিজে করে খাইয়ো। নাঈম নিজের ঘরে হিসাব-নিকাশের কাজে ব্যস্ত ছিল। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে এলো মায়ের ঘরে। এরপর কথঞ্চিৎ উগ্র স্ত্রীকে দু’হাতে আগলে ধরে টেনে নিয়ে গেল সেখান থেকে। তবু জেসিকার মুখ থেমে নেই। সে অগ্নিশর্মা হয়ে বাড়িসুদ্ধ মাথায় তুলে বলেই চলেছে,

— এই ঘরে আমি আর থাকব না, এখনই চলে যাব। হয় ঐ মূর্খ বুড়ি থাকবে এই ঘরে নয়তো আমি৷ এক ছাদের তলায় আমি আর পারব না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নাঈম স্ত্রীকে একটা কষে চড় বসিয়ে থামিয়ে দিয়ে দ্রুতপদে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। স্বামীর হাতে প্রথম আঘাত পেয়ে জেসিকা দিকবিদিকশুন্য হয়ে কাঁদতে কাঁদতে তল্পিতল্পা গোঁছাতে শুরু করল। এখানে আর একমুহূর্তও নয়! মুক্তা স্তব্ধ, পলকহীন চোখে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ বন্ধ করে সে ফিরে গেল আঠারো বছর পূর্বে। যখন তার শরীরে বাঁধভাঙা যৌবনের হিল্লোল ছিল।

তেজদীপ্ত কণ্ঠ ছিল। হ্যাঁ, ছিল শাশুড়ির ছোট কথাতেও তেড়ে কোমর বেঁধে ঝগড়া করার মনন। মুক্তার মনে পড়ে গেল সেও তো এভাবে শাশুড়ির কোনো আদুরে তিরস্কারও সহ্য করত না! জেসিকার চেয়ে দ্বিগুণ গোঁয়ার ছিল সে। এমনকি শাশুড়িকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করতেও তার মুখে একটুও আটকাতো না! শাশুড়ির মুখনিঃসৃত আরো একটি কথা তার হৃদয়তটে পুনঃপুনঃ আঘাত হানতে লাগল। ” দেখা যাইব আল্লায় কে কার বিচার করে” কথাটা আজো শুনতে পাচ্ছে মুক্তা। সুদীর্ঘ আঠারো বছর পর ছোট্ট ভারী কথাটা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠল। বুক কেঁপে উঠল তার। আল্লাহ বিচার করেছে! মুক্তা মনে মনে বদ্ধমূল হল, নাহ এই ঘরে আর নয়। ছেলেটা সুখে থাকুক। এটাই তার পাওনা ছিল। বরং পাওনাটা পেতে বড্ড দেরি হয়ে গেল।

ধীরে ধীরে ঘোরগ্রস্তের মতো বাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়ে অপরাধী-চিত্তে রাস্তায় নেমে এলো মুক্তা। তখন ঘোর অমানিশা। গভীর নিশিতে পৃথিবীর কোথাও যেন আলোরেখার চিহ্নমাত্র নেই। কদাচিত বিশাল ডালা মেলে পতপত করে উড়ে যায় বাদুড়। স্বাভাবিক অথচ ভয়ংকর একটা শব্দ করে বিশাল ডালা মেলে পতপত করে উড়ে যায় বাদুড়। রাস্তার ধারের খর্বাকৃতির অর্জুন গাছের মাথায় লক্ষ্মীপ্যাঁচার চোখ জুলজুল করছে।

রাস্তায় নেমে পূর্বদিকের শুনশান জনশূন্য রাস্তায় মিনিট দুই হাঁটলেই মেলে গোরস্থান। সেদিকেই এগুচ্ছে মুক্তা। কিন্তু কেন? তার উত্তর অন্তর্যামী ভিন্ন সবারই অবিদিত। সে শুধু জানে ঐ বাড়িতে আর থাকা নয়! গোরস্থান পেরোতেই হঠাৎ আঠারো বছর আগের মৃত শাশুড়ি মরিয়মকে দেখে চোখ বিস্ফারিত করে তাকাল সে। মৃত মরিয়ম স্বয়ং দাঁড়িয়ে আছে মুক্তার সামনে। তার পরনে কাফনের কাপড় নেই;আছে মুক্তার বিয়ের পরপর নিজ হাতে শাশুড়ির জন্য পছন্দ করা শাড়িটি। এক নিমিষে চিন ফেলল মুক্তা। ভয় পেলো না। শাশুড়ির নিষ্ক্রিয়ের ন্যায় দাঁড়িয়ে ভাসাভাসা সম্মোহনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। হিম জড়ানো বাতাসে অশরীরী মরিয়মের গা থেকে ছুটে আসা তীব্র আতরের গন্ধে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে মুক্তার। সে কোনমতে মুখে অস্ফুটে ঠোঁট নেড়ে বলল,

— মা? এমন সময় দেখা গেল জেসিকা গাঁটরি হাতে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে বাপেরবাড়ির উদ্দেশ্যে। মুক্তা আটকাতে চাইল। কিন্তু তার বাকশক্তি রহিত। চলনশক্তি থিতু হয়ে এসেছে। প্রয়াত শাশুড়ি ‘মরিয়ম’ নাতবউয়ের সদর্প প্রস্থানের দিকে একবার কটাক্ষপাত করে বলল,

— মুক্তা, তোরে আমি কম আদর করিনাই। নিজের মেয়ে আছিল না বলে শুরুতে পোলা বিয়া দিয়া তোরে নিজের মেয়ে মনে করছি। প্রথ্থম পাঁচ বছর নিজের হাতে রাইন্ধা খাওয়াইছি। পরে আর ক্ষমতা হয়নাই। প্রতিদান কিছুই পাইনাই। প্রকৃতি তার শোধ ঠিকি লয় বুঝলি? মুক্তার চোখের কার্নিশ বেয়ে ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ছে অনুশোচনার জল। কিছু বলতে চেয়েও বারবার ঠোঁটদ্বয় তিরতির করে কাঁপছে তার৷ মরিয়ম কঠিন গলায় বলল,

— চল্ আমি তোরে নিয়ে যাইতে আসছি। পরেরদিন পুরো গ্রাম তল্লাশি চালিয়েও মুক্তার আর কোনো খোঁজখবর মিলল না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত