আহিরিটোলার বাড়ি
আহিরিটোলা কোথায় জান তো? সেখানে গঙ্গার ধারে আমার পূর্বপুরুষদের একটা মস্ত বাড়ি আছে। সেখানে কেউ থাকে না। দরজা-জানলা ঝুলে রয়েছে, ছাদ দিয়ে জল পড়ে, দেয়ালে সব ইট বেরিয়ে পড়েছে। শুধুইঁদুর বাদুড়ের বাস, আর সব জায়গায় একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ। বাড়িটা বাবার ঠাকুরদার ঠাকুরদা কোম্পানির আমলে তৈরি করেছিলেন, কাতা শহরই তখন সবে তৈরি হচ্ছে। দিব্যি চক-মেলানো দোমহলা বাড়ি, দেয়ালে সব জং ধরে-যাওয়া চিত্র টিত্র করা, বিরাট পাথরের সিঁড়ি। টাকারও আর তাদের অভাব ছিল না, কীসব চোরাকারবার চলত; তখনকার দিনে অত আইন-আদালতেরও হাঙ্গামা ছিল না। মোট কথা, বাবার ঠাকুরদার ঠাকুরদা ভয়ংকর ধনী লোক ছিলেন। প্রকাণ্ড জুড়ি-গাড়ি ছিল, তাতে চারটে কালো কুচকুচে ঘোড়া জোড়া হত, বাড়ির পিছন দিকে বিশাল আস্তাবল ছিল। সেসব কবে বিক্রি হয়ে গেছে, তার জায়গায় তিনতলা সব বাড়ি হয়ে, সেগুলো পর্যন্ত ভেঙেচুরে যাচ্ছে। সেবার প্রি-টেস্টে অঙ্কে পনেরো পেলাম। তাই নিয়ে বাড়িময় সে যে কীরকম হইচই লেগে গেল সে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। বাবা পর্যন্ত এমন কাণ্ড আরম্ভ করলেন যে, শেষ অবধি বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলাম। কাউকে কিছু না বলে, সন্ধ্যে বেলায় কয়েকটা কাপড় জামার পুঁটলি কাঁধে নিয়ে, ঘড়ি কিনবার জমানো টাকাগুলো পকেটে পুরে, একেবারে আহিরিটোলার বাড়িতে গিয়ে উঠলাম।
সেখানে আলোটালো নেই, রাস্তার আলো এসে যা একটু ভাঙা দরজা জানলা দিয়ে ঢুকছে, অদ্ভুত সব ছায়া পড়ছে। সামনের দরজায় তালা মারা। কিন্তু জানলায় শিক নোনা ধরে ভেঙে গেছে, ঢুকতে কোনো অসুবিধা হল না। একটু যে ভয় করছিল না তাও নয়, আর কতরকম শেডের যে অন্ধকার হয়, তাই দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। খিদেও পেয়েছে প্রচুর, আবার রাগও হয়েছে। নীচের তলাটা কেমন যেন ঘুপসিপানা, পুঁটলি বগলে ধুলোমাখা সিঁড়ি দিয়ে দুমদুম করে উপরতলায় উঠে যাচ্ছি। এমন সময় সিঁড়ির ঠিক উপর থেকে কে বলল, আহা। তোদের জ্বালায় কি সন্ধ্যে বেলাতেও হাত-মুখ ধুয়ে আলবোলাটা নিয়ে একটু চুপ করে বসা যাবে না? সারাদিন শুধু দাও, দাও, দাও, দাও, এটা নেই, ওটা নেই, এটা চাই, ওটা চাই, এবার একটু ক্ষান্তি দে। ভুরভুর করে নাকে একটা ধূপধুনোর সঙ্গে গোলাপজল আর ভালো তামাকের গন্ধ এল। চেয়ে দেখি তারার আলোকে সিঁড়ির উপর একজন বুড়ো লোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ভুসকো রঙের লম্বা জোব্বা পরনে, পায়ে সাদা নাগরাই জুতো, মাথায় ভুসকো একটা ছোট্ট সাদা টুপি, আর ডান হাতের বকবার আঙুলে একটা মস্ত সবুজ পাথরের আংটি।
যেমন সিঁড়ির উপরের ধাপে এসে উঠেছি; আশ্চর্য হয়ে বললেন, আঁ, তোকে তো আগে দেখিনি। তুই এখানে কেন এসেছিস? কী চাস তাই বল দেখি বাবা? খিদেয় পেটটা খালি খালি লাগছিল, বললাম, কেন আসব না, এটা আমার বাবার ঠাকুরদাদার ঠাকুরদাদার বাড়ি। ভীষণ চমকিয়ে গিয়ে লোকটি কাছে এসে আমার কাঁধে একটা হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বাবার নাম কী? তোমার ঠাকুরদাদার নাম কী? নাম শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
কোথাও জনমানুষ নেই, চারদিকে অন্ধকার, রেলিঙের কাছে গিয়ে বুড়ো হাঁক দিলেন, পরদেশি! আমিন! বলি, কাজের সময় গেলি কোথায়, আলো দিবি না? নীচের তলার অন্ধকার থেকে অস্পষ্ট একটা সাড়া এল, তারপর লম্বা একটা কাচের ঢাকনি-পরানো সেজ হাতে কুচকুচে কালো, ডিগডিগে লম্বা, গোলাপি গেঞ্জি, মিহি ধুতি আর গলায় সোনার মাদুলি পরা একটা লোক সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল।
ছিলি কোথায় হতভাগা? বাড়িতে লোক এলে দেখতে পাস না? এজ্ঞে, বারোয়ারিতলায় হাফ-আখড়াইটা একবার দেখে এলাম।
আমার দিকে ফিরে বলল, যাবে-না, খোকাবাবু, হাফ-আখড়াইতে? কেমন সব সং বেনিয়েছে, গান-বাজনা হতেছে। বুড়ো বললে, চো, ওসব ছেলেমানুষের জায়গা নয়। এসো, দাদা, তুমি আমার সঙ্গে এসো।
সামনের ঘরে গেলাম। মেঝেতে লাল গাচে পাতা, মস্ত নীচু তক্তপোশে হলদে মখমলের চাদর বিছানো। তার কোনায় গোঁফঝোলা চুড়িদার পাঞ্জাবি গায়, কানে মাকড়ি একজন লোক। দাঁড়িয়ে। তাকে বললেন, যাও এখন, বলেছি তো দশ টাকা চাঁদা আর পাঁচ ভরি আতর দেব তোমাদের বারোয়ারি পুজোর জন্য, এখন কেটে পড়ো।
লোকটি চলে গেলে, আমাকে তক্তপোশে বসিয়ে পুঁটলির দিকে চেয়ে বললেন, ওতে কী? পালিয়ে এসেছ নাকি? কেন? বলতে হল সব কথা। খানিকটা ভেবে হঠাৎ বিরক্ত হয়ে বললেন, পনেরো পেইছিস্? হতভাগা, তোর লজ্জা করে না? আঁক হয় না কেন? শুভংকরি পড়িস না? মুখ অমন পাংশুপানা কেন? খেইছিস্? আঁ, খাসনি এখনও? পরদেশি, যা দিকিনি, পছুকে বলগে যা। পরদেশি চলে গেলে বললেন, ই, আমার কক্ষনো একটা আঁক কষতে ভুল হত, আর তুই ব্যাটা একেবারে পনেরো পেলি! জানিস নবাবের কাছ থেকে সার্টিফিকেট পেইছিলাম, হৌসের সব হিসেবের ভুল শুধরে দিয়েছিলাম বলে। দাঁড়া, কুট্টিকে ডেকে পাঠাই, সে তোকে আঁক শিখিয়ে দেবে।
পরদেশি একটা রুপোর থালায় করে লুচি, সন্দেশ, ছানামাখা, আর এক গেলাস বাদামের শরবত এনে দিল।
তারপর বারান্দার কোণে শ্বেতপাথর দিয়ে বাঁধানো স্নানের ঘরে আরাম করে হাত পা ধুয়ে, পাশের ঘরে কারিকুরি-করা খাটে সাদা বিছানায় শুয়ে সারারাত ঘুমোলাম।
সকালে পরদেশি এসে ডেকে দিল, কুট্টিবাবু আঁক শেখাতে এসেছেন। কুটিবাবুও এসে, চিত্র-করা পাটিতে বসে সারাটা সকাল আমাকে অঙ্ক কষালেন। পরদেশি কোনো কথা না বলে দু-জনকে দুই গেলাস দুধ দিয়ে গেল। বই নেই, কিছু নেই, পুঁটলিতে খাতা-পেনসিল ছিল, তাই দেখে কুট্টিবাবু মহাখুশি। কী বলব, যে সব অঙ্ক সারা বছর ধরে বুঝতে পারছিলাম না, সব যেন জলের মতো সোজা হয়ে গেল। কুট্টিবাবুর বই দরকার হয় না, সব মাথার মধ্যে ঠাসা।
উনি চলে গেলে, বারান্দায় বেরিয়ে দিনের আলোতে ভালো করে চেয়ে দেখি এরা সব বাড়িঘর ঝকঝকে পরিষ্কার করে ফেলেছে। উঠোনের ধারে ধারে বড়ো বড়ো টবে করে কতরকম পাতাবাহারের গাছ, আর উঠোনে দাঁড়ের উপর লাল-নীল-হলদে-সবুজ মস্ত মস্ত তোতা পাখি রোদে বসে ছোলা খাচ্ছে।
দেয়াল ঠেস দিয়ে পরদেশি মুচকি মুচকি হাসছে। কাকে খুঁজছ, খোকাবাবু? বুড়ো লোকটির খোঁজ করলাম। কী তার নাম পরদেশি? বড্ড ভালো লোক। পিছন থেকে তিনি নিজে বললেন, আমার নাম শিবেন্দ্রনারায়ণ, লোকে শিবুবাবু বলে ডাকে। তুমি নাকি ভালো করে অঙ্ক কষেছ, কুট্টি বলছিল। এই নাও তার পুরস্কার। আমার হাতে একটা মস্ত সোনার মোহর গুঁজে দিলেন। ও কী পরদেশি? বাইরের দরজায় কারা যেন মহা ধাক্কাধাক্কি চেঁচামেচি করছে। সঙেরা নয় পরদেশি? পরদেশি আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল, আমি বললাম, এই রে, তবে নিশ্চয় বাবা এসেছেন আমাকে খুঁজতে। ছুটে নীচে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। মা, বাবা, বড়োকাকা আর পিসেমশাই এসেছেন। ইশ, কী সাংঘাতিক ছেলে বাপু তুমি। এই খালি বাড়িতে অন্ধকারে, কালিঝুলের মধ্যে, খাওয়া নেই দাওয়া নেই দিব্যি রাত কাটিয়ে দিলে? বলিহারি তোমাকে। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি এক মুহূর্তের মধ্যে পরিষ্কার তকতকে উঠোন, তোতা পাখির সারি, পাতাবাহারের গাছ, সব উড়ে গেছে। পাগলের মতো দৌড়ে উপরে উঠলাম, খালি ঘর খাঁ খাঁ করছে, ভাঙা স্নানের ঘরে শ্বেত পাথরের সব টালি খুলে পড়ে আছে। পরদেশি, ও পরদেশি, শিবুবাবু, কোথায় তোমরা?
বাবা আমাকে খপ করে ধরে ফেললেন, জানিস না, শিবুবাবু আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা, পরদেশি তার খাস খানসামা।
আস্তে আস্তে আমার হাতের মুঠোর মধ্যে মোহরটাকে পকেটে পুরে বললাম, চলো, টেস্টে আমি অঙ্কে ভালো নম্বর পাব, দেখো। কাউকে কিছু বলতে পারলাম না।
আমি ঠিক করেছি বড়ো হয়ে টাকাপয়সা রোজগার করে আহিরিটোলার বাড়িটা সারিয়ে-সুরিয়ে সেখানেই থাকব। গঙ্গাটাও বেশ সামনে আছে।