পিপলী বেগম

পিপলী বেগম

পিপলী বেগম – হুমায়ূন আহমেদ

১. তারা তিন বোন — তিলু, বিলু, নীলু

তারা তিন বোন –তিলু, বিলু, নীলু। সবচে বড় হল তিলু, সে ভিকারুননেসা স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ে। খুব শান্ত মেয়ে।

তারপর বিলু, সেও ভিকারুননেসা স্কুলে পড়ে। ক্লাস থ্রী। সে মোটেও শান্ত না। দারুণ হৈ চৈ করে। কদিন আগে সিঁড়ি থেকে পড়ে হাত ভেঙেছে। ভাঙ্গা হাত প্লাস্টার করে এখন তার গলায় ঝোলানো। বিলু খুব খুশি। হাতের প্লাস্টারে ছবি আঁকতে পারছে।

সবচে ছোট নীলু। এবার তার স্কুলে ভর্তি হবার কথা ছিল। অনেক কটা স্কুলে টেস্ট দিয়েও এলাউ হয় নি। নীলু খুব কেঁদেছিল। নীলুর বাবা মতিন সাহেব বলেছেন –মা পচা স্কুলগুলিতে তোমাকে পড়তে হবে না। আমিই তোমাকে পড়াব। নীলু অবাক হয়ে বলেছে, তুমি কি করে পড়াবে? তুমি তো মাস্টার না। তুমি ডাক্তার।

ডাক্তাররাও পড়াতে পারে মা।

না পারে না।

নীলুর কথাই ঠিক হয়েছে। মতিন সাহেব পড়াতে পারছেন না। সময় পাচ্ছেন না। তিনি সেই সকালে যান, ফিরতে রাত এগারোটা বাজে। তিলু বিলু ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ঘুম চোখে জেগে থাকে নীলু। মতিন সাহেব ঘরে ঢুকতেই সে বলে, বাবা আমাকে পড়াবে না?

অবশ্যই পড়াব মা।

বই নিয়ে আসব?

আজতো অনেক রাত হয়ে গেছে। কাল থেকে আমরা শুরু করব।

আচ্ছা।

কালও শুরু করা যায় না, আরো দেরি হয়। তিলু বিলুর মা শাহানা একদিন বললেন, তুমি কয়েকদিন হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় থাকোতো। বাচ্চারা তোমার চেহারা ভুলে যাচ্ছে। একদিন দেখা যাবে রাস্তার কাউকে দেখে চেঁচিয়ে উঠবে –বাবা! বাবা!

মতিন সাহেব সত্যি সত্যি ছুটি নিয়েছেন। দুদিনের ছুটি। বাচ্চাদের সঙ্গে তিনি গত দুদিন ধরে আছেন। ওদের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলেছেন। মনোপালি খেলেছেন, নাম-দেশ-ফুল-ফল খেলেছেন। এখন সন্ধ্যা। মেয়েরা বাবাকে ঘিরে বসেছে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। ঘরে মোম জ্বালানো হয়েছে। গল্প শোনার রাত। মেয়েরা গল্প শুনতে চায়। মতিন সাহেব পড়েছেন বিপদে। কোন গল্পই তাঁর মনে আসছে না। পাঁচ মিনিট ধরে তিনি মাথা চুলকাচ্ছেন। মাথা চুলকালে ছেলেবেলায় শোনা কোন গল্প মনে পড়তে পারে –এই তাঁর ক্ষীণ আশা। মাথা চুলকানোয় কোন লাভ হচ্ছে না। তিলু বলল, কি হল বাবা, শুরু কর। তুমি না বলেছিলে আমাদের সব কথা শুনবে।

কি শুরু করব?

কি আবার, গল্প।

কিসের গল্প শুনতে চাও? ভূতের?

বিলু বলল, ভূতের গল্প আমি মরলেও শুনব না। একটা বাঘের গল্প বল, বাবা।

মতিন সাহেব ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যদি ছাদের দিকে তাকালে কিছু মনে পড়ে!

কি হল বাবা?

মনে করার চেষ্টা করছি।

মনে আসছে না?

উঁহু।

একবার শুরু করে দাও। শুরু করলেই দেখবে মনে পড়বে।

কিভাবে শুরু করব?

বল –এক দেশে ছিল এক বাঘ।

মতিন সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। বৃষ্টি আরো চেপে আসছে। কে জানে ঝড় শুরু হবে কি-না। তিনি অসহায় গলায় বললেন, তোর মা ফেরার পর গল্প শুরু করলে কেমন হয়? সেও শুনতে পেত।

নীলু বলল, মা আজ রাতে ফিরবে না, বাবা। মা ছোটমামার বাসা থেকে টেলিফোন করেছে। সে মামার বাসায় আটকা পড়েছে। বাড়ির সামনে এক-কোমর পানি। মা কাল ভোরে আসবে। মা বলেছে তুমি যেন আমাদের দেখেশুনে রাখ।

বলিস কি? এ তো আরেক যন্ত্রণা হল।

কোন যন্ত্রণা হয়নি, বাবা। তোমাকে কিছু দেখতে হবে না। তুমি গল্প বললেই হবে। তিন জনের জন্যে তিনটা গল্প। শুরু কর —

রাতের খাবারের কি ব্যবস্থা হবে।

মা রান্না করে রেখে গেছে। খিদে লাগলে আমরা খেয়ে নেব।

কি রান্না?

খিচুড়ি আর ডিমের তরকারী।

হাসের ডিম না মুরগীর ডিম?

বাবা তুমি ইচ্ছা করে –অন্য কথা বলছ। গল্প শুরু কর।

রাতের খাওয়ার পর শুরু করলে কেমন হয়?

খুব খারাপ হয়। শুরু কর বাবা।

মতিন সাহেব বললেন –এক দেশে ছিল এক পিপড়া …

তিলু চেঁচিয়ে বলল, বাবা তুমি কি বললে? কি ছিল?

পিপড়া।

পিপড়া? তুমি পিপড়ার গল্প বলবে?

হু।

পিপড়ার কি কোন গল্প হয়, বাবা?

বাঘের গল্প যদি হয়, হাতির গল্প যদি হয় তাহলে পিপড়ারও গল্প হয়।

বিলু বলল, এত ছোট একটা জিনিস চোখেই দেখা যায় না।

মতিন সাহেব বললেন, ভূতও তো চোখে দেখা যায় না। পিপড়া ছোট হলেও দেখা যায়।

তিলু বিলু বলল, আমরা পিপড়ার গল্প শুনব না। শুধু নীলু বলল, সে শুনবে। নীলু বলল, বাবা, তুমি আবার বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলবে না তো?

অসম্ভব। বানিয়ে বলব না।

সত্যি গল্প?

গল্প সব সময় সত্যি হয়। গল্প কখনো মিথ্যা হয় না।

তিলু বিলু বলল, সব গল্পই কি সত্যি?

অবশ্যই সত্যি।

একটা গল্পে যখন বাঘ কথা বলে সেটাও কি সত্যি?

সেটাও সত্যি। এমনি পৃথিবী আর গল্পের পৃথিবী –দুটি আলাদা পৃথিবী। দুটি পৃথিবীই সত্যি। আমাদের পৃথিবীতে বাঘ কথা বলে না, কিন্তু গল্পের পৃথিবীতে বলে। বুঝতে পারলে?

তিলু বিলু মাথা নাড়ল না, তবে নীলু মাথা নাড়ল অর্থাৎ সে বুঝেছে। বিলু বলল, বাবা দেখ নীলু কিছু না বুঝেই মাথা নাড়ছে। মতিন সাহেব বললেন, আমার ধারণা নীলু ঠিকই বুঝেছে ছোট বলেই যে সে কিছু বুঝবে না তা তো না। বরং ছোটরাই অনেক বেশি বোঝে।

মতিন সাহেব গল্প শুরু করলেন।

.

এক দেশে ছিল এক পিপড়া। মেয়ে পিপড়া। তার নাম পিপলী বেগম। বয়স খুব বেশি না, মানুষের হিসেবে তার বয়স তের বছর। দেখতে সে খুব সুন্দর। সবচে সুন্দর তার চোখ। ঝকঝকে নীল। চোখ দেখলেই বোঝা যায় পিপলী বেগমের খুব বুদ্ধি। স্কুলের পরীক্ষায় সে সব সময় ফার্স্ট হয়। শুধু সেবার পরীক্ষায় খুব খারাপ করল। অঙ্কে পেল মাত্র ১৯। ভূগোলে তেইশ। তাদের আপা পিপলীকে অফিসঘুরে ডেকে নিয়ে গেলেন।

নীলু বলল, বাবা, ওদের স্কুল আছে?

অবশ্যই আছে। স্কুল থাকবে না কেন? স্কুল আছে, কলেজ আছে। সেখানে সবাইকে পড়াশোনা করতে হয়।

ওদের স্কুলগুলি কেমন বাবা?

ওদের স্কুলগুলি বেশির ভাগই রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের মত। খোলা ময়দানে ক্লাস হয়। কখনো গাছের নিচে। কখনো গাছে। তবে ঝড়-বাদলার দিনে স্কুলঘরে।

ওদের স্কুলঘর আছে?

আছে। দুতলা-তিনতলা স্কুলঘর। পিপড়ারা যে খুব সুন্দর বাড়ি বানাতে পারে তা তুমি জান না?

না।

ওরা মাটির নিচে বাড়ি বানায়। সুন্দর সুন্দর বাড়ি। বাড়িতে পানি আছে –ইলেকট্রিসিটি আছে।

তিলু রাগী গলায় বলল, বাবা, তুমি বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলা শুরু করেছ। ওরা ইলেকট্রিসিটি কোথায় পাবে?

মতিন সাহেব হাসিমুখে বললেন, ওদের ইলেকট্রিসিটি মানুষের ইলেকট্রিসিটির মত না। এক ধরনের পচা কাঠ আছে, অন্ধকারে জ্বলে। ওরা করে কি –ঐসব কাঠের ছোট ছোট টুকরা নিজেদের বাড়ির হলরুমে রাখে। ওদের মিটিং-টিটিং তো সব হলঘরে হয় –এই জন্যেই শুধু হলঘরে আলোর ব্যবস্থা।

বিলু বলল, বাবার কথা আমার মোটেই বিশ্বাস হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে বাবা বানিয়ে বানিয়ে বলছে। তিলু বলল, আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে।

নীলু বলল, বাহ্, বাবার সব কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছে। বাবা তুমি বল। পিপড়াদের কি মজা তাই না বাবা।

মজা তো বটেই। আমরা মানুষ ছাড়া অন্য সবাইকে খুব ছোট করে দেখি। ছোট করে দেখা ঠিক নয়। বুঝলে মা? প্রাণীদেরও বুদ্ধি আছে। অনেক বুদ্ধি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষদের বুদ্ধির চেয়েও বেশি। বাবুই পাখি কি করে জান?

না। কি করে?

ওরা ওদের বাড়িতে জোনাকি পোকা ধরে রাখে। প্রথমে খানিকটা গোবর নিয়ে যায়, সেই গোবরে জোনাকি পোকা পুঁতে দেয়। এতে ঘর আলো হয়।

বাবুই পাখিদেরও কি স্কুল আছে?

সবারই স্কুল আছে। সবাইকে শিখতে হয়। তবে পিপড়াদের স্কুল হল খুব ভাল স্কুল। এরা অনেক কিছু শেখায়।

বিলু বলল, কি কি শেখায়?

অঙ্ক তো শিখতেই হয়। হিসেব-নিকেশ না শিখলে চলবে কেন? তারপর শিখতে হয় মাটিবিদ্যা। ওরা মাটিতে থাকে, মাটি দিয়ে ঘর বানায় –মাটিবিদ্যা শিখলে চলবে কেন? ওদের ভূগোল খুব বেশি বেশি পড়তে হয়। কোন জায়গাটা কি রকম তা না জানলে ওদের চলে না। আবহাওয়া জানতে হয় –কখন বৃষ্টি হবে, কখন ঝড় হবে …

তিলু বলল, বাবা, ওদের কি সায়েন্স, আর্টস আছে?

আছে। তবে আর্টস পড়ে খুব কম পিপড়া। যারা অসম্ভব জ্ঞানী তারাই শুধু আর্টস পড়ে। ওদের কাজ হচ্ছে চিন্তা করা।

কি চিন্তা করে?

নানান বিষয় নিয়ে চিন্তা করে। পিপড়া কেন পৃথিবীতে তৈরি করা হল, এদের কি প্রয়োজন ছিল। এইসব ….।

নীলু বলল, পিপড়া হওয়া তো বাবা খুব মজা।

মজা তো বটেই। তারপর শোন কি হল, স্কুলের বড় আপা পিপলী বেগমকে ডেকে নিয়ে গেলেন। বড় আপা বললেন, পিপলী, তোমার রেজাল্ট এত খারাপ হল কেন? অঙ্কে উনিশ, ভূগোলে তেইশ। ব্যাপারটা কি বল তো?

পিপলী বলল, পড়তে আমার ভাল লাগে না, আপা।

বড় আপা অবাক হয়ে বললেন, কি বললে?

পড়তে ভাল লাগে না।

বড় আপা অবাক হয়ে পিপলীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই প্রথম একজনকে পাওয়া গেল যার পড়তে ভাল লাগে না। পিপড়ারা মানুষের মত। তাদের সবারই পড়তে খুব ভাল লাগে। এমন একজনকেও পাওয়া যায় না, যার পড়তে ভাল লাগে না। শুধু পিপলী বেগমকে পাওয়া গেল।

বিলু বাবার কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বলল, বাবা আমারো পড়তে ভাল লাগে না। মতিন সাহেব বললেন, তোমার কথাতো এখন হচ্ছে না। এখন পিপলী বেগমের কথা হচ্ছে। তোমার কথা পরে শুনব। যা বলছিলাম –পিপলীর পড়তে ভাল লাগে না শুনে বড় আপা বললেন, এত অদ্ভুত কথা তো আমি জন্মেও শুনিনি। তোমার কি সত্যি সত্যি পড়তে ভাল লাগে না? নাকি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ?

আমার সত্যি সত্যি পড়তে ভাল লাগে না। পড়ার কথা মনে হলেই রাগ লাগে। স্কুলে আসতেও ইচ্ছা করে না। অদ্ভুত অদ্ভুত সব ইচ্ছা হয়।

অদ্ভুত ইচ্ছা হয়? কি রকম অদ্ভুত ইচ্ছা?

বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করে। অনেক, অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছা করে। পৃথিবীটা ঘুরে দেখতে ইচ্ছা করে।

বড় আপা চেঁচিয়ে বললেন, কি দেখতে ইচ্ছা করে?

সবচে বেশি দেখতে ইচ্ছা করে মানুষদের।

মানুষদের দেখতে ইচ্ছা করে! তুমি তো ভয়ংকর কথা বললে! মানুষরা ভয়াবহ জীব। এদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়। অনেক দূরে। মানুষ কি করে জান? পিপড়া দেখলে পায়ে পিষে মেরে ফেলে। বিশেষ করে মানুষদের হোট ছোট বাচ্চারা পিপড়া মা’রতে খুব ভালবাসে।

তবু আমার মানুষ দেখতে ইচ্ছা করে। ওদের কত বুদ্ধি!

মানুষদের বুদ্ধি আছে। এই অদ্ভুত কথা তোমাকে কে বলল, পিপলী? এই পৃথিবীতে সবচে বোকা হল মানুষরা। আমরা যেমন খাবার ভাগাভাগি করে খাই, ওরা তা করে না। কোন কোন মানুষের বাড়িতে প্রচুর খাবার। আবার কারো কারো বাড়িতে কোন খাবার নেই। কারো কারো থাকার জন্যে বাড়ি আছে, কারো কারো নেই –তারা থাকে পথে, গাছের নিচে। পিঁপড়াদের বেলায় এই জিনিস কখনো হবে না। কখনো না।

তবু আমার মানুষ দেখতে ইচ্ছা করে। ওদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে।

ওদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে?

হু। ওদেরকে বলতে ইচ্ছা করে এই যে মানুষ, তোমাদের এত বুদ্ধি কিন্তু তোমরা এমন কেন?

কি সর্বনাশের কথা! কি সর্বনাশের কথা! তোমার শরীর ভাল আছে তো পিপলী বেগম? অনেক সময় শরীর খারাপ হলে উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা মাথায় আসে। তোমার কি রাতে ভাল ঘুম হয়?

মাঝে মাঝে ঘুম হয় না। মন খারাপ লাগে।

যা ভেবেছি তাই। তোমার শরীর খারাপ। শরীর খারাপ হলেই মন খারাপ হয়। কারণ মন বলে আলাদা কিছু নেই। আমার ধারনা তোমার শরীর খুবই খারাপ।

আমার শরীর ভালই আছে আপা।

তুমি বললে তো হবে না। ডাক্তার এসে দেখে বলুক। আমরা ধারণা তোমার জটিল কোন রোগ হয়েছে। খুব জটিল। এসো মা, তুমি এই টেবিলে শুয়ে থাক। আমি স্কুলের ডাক্তারকে খবর দিচ্ছি। ডাক্তার সাহেব এসে দেখুক।

বিলু বলল, বাবা, পিপড়াদের ডাক্তার আছে?

মতিন সাহেব বললেন, পিপড়াদের তুমি এত তুচ্ছ ভাবছ কেন মা? ওদের ডাক্তার আছে –ওদের হাসপাতাল পর্যন্ত আছে। ওদের যে বসতবাড়ি, সেই বসতবাড়ির একটা তলা হল ওদের হাসপাতাল। হাসপাতালে রুগ্ন, অসুস্থ পিপড়ারা থাকে। অসুখ-বিসুখ ওদের বেশি হয় না, কিন্তু একসিডেন্ট খুব বেশি। বেশির ভাগ রোগী আসে হাত ভাঙা, পা ভাঙা। অর্থাৎ পঙ্গু হাসপাতাল।

তারপর কি হল শোন। পিপলী বেগমের বড় আপা খুব ব্যস্ত হয়ে ডাক্তার ডেকে পাঠালেন। পিপলীকে শুইয়ে রাখলেন টেবিলের উপর। বড় আপার চিন্তার সীমা রইল না। স্কুলের দুজন ডাক্তার এসে নানাভাবে দেখলেন। জিভ দেখলেন, কান দেখলেন, গলা দেখলেন। ব্লাড প্রেসার মাপলেন। একটা ছোট্ট কাঠের হাতুরী দিয়ে টুক করে পিপলীর হাঁটুতে বাড়ি দিয়ে রিফ্লেক্স এ্যাকশান দেখলেন।

বড় আপা ভীত গলায় বললেন, কি দেখলেন ডাক্তার সাহেব? আমার খুব চিন্তা লাগছে। এতদিন ধরে স্কুলে পড়াচ্ছি, এমন তো কখনো শুনিনি! পিপলীর শরীর কি খুব বেশি খারাপ?

ডাক্তার সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, শরীরে তেমন কিছু পাচ্ছি না। বুকে কফ জমে আছে। ঠাণ্ডা লেগেছে বোধহয়। অবশ্যি ব্লাড প্রেসার নরমালের চেয়ে সামান্য নিচে। ভালমত খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিন। দিনকয় বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিক।

বেড রেস্টে থাকুক।

নীলু বলল, বাবা পিপড়ারা কি ইংরেজীও জানে?

দু একটা শব্দ জানে।

ওরা কোন ভাষায় কথা বলে বাবা? বাংলা ভাষা?

না ওদের ভাষা হচ্ছে পিপ-ভাষা। তোমরা কথা কিন্তু বেশি বলছ মা। এত কথা বললে গল্প বলব কখন।

আর কথা বলব না বাবা তুমি গল্প শুরু কর।

বড় আপা ঠিক করলেন পিপলীকে ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। সাতদিনের ছুটি। পড়াশোনার ক্ষতি হবে। কি আর করা! বাড়তি ক্লাস নিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে দিতে হবে। তাছাড়া রাণীমাকে খবরটা দিতে হবে। এতবড় ঘটনা রাণী মাকে না জানালে হবে না।

নীলু বলল, ওদের রাজা-রাণী আছে?

রাজা নেই, রাণী আছে। রাণীর ভয়ংকর ক্ষমতা। পিপড়াদের কারোর অতি সামান্য কিছু হলেও রাণীকে জানাতে হয়। কি কথা ছিল মা? বেশি প্রশ্ন করবে না। তুমি একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছ। যাই হোক, তারপর কি হল শোন –বড় আপা বললেন, পিপলী, তোমার ব্যাপারটা তো রাণী-মাকে জানাতে হয়। আমি নিজেই গিয়ে জানাব। উনি কি করবেন তা তো জানি না। হয়ত তোমাকে ডেকে পাঠাবেন। তোমার কি কখনো রাণী-মা’র সঙ্গে দেখা হয়েছে?

না।

তাহলে রাণী-মা’র সঙ্গে কথা বলার নিয়ম-কানুন খুব ভাল করে শিখে রাখ। কথা বলবে খুব আদবের সঙ্গে। খুব জোরেও বলবে না, আবার ফিসফিস করেও বলবে না। মনে থাকবে?

থাকবে।

রাণী-মা’র বাড়ির চারপাশে লাল দাগ দেয়া। বৃত্তের মত। কখনো ভুলেও সেই লাল দাগের ভেতরে যাবে না। লাল দাগের ভেতরে যাওয়া মানেই মহাসর্বনাশ।

কি সর্বনাশ?

সারা জীবনের জন্যে নির্বাসনদণ্ড। পিপীলিকা সমাজে মৃত্যুদণ্ড নেই। মৃত্যুদণ্ড থাকলে, মৃত্যুদণ্ডই হত। খুব মনে রাখবে –লাল দাগ।

পিপলী বলল, রাণী-মা দেখতে কেমন?

জানি না কেমন। আমরা কেউ কখনো দেখিনি। কেউ দেখা করতে গেলে উনি প্রাসাদের জানালার সামনে এসে বসেন। সেই জানালায় পর্দা দেয়া। কেউ তাকে দেখতে পায় না। তাছাড়া জানালার দিকে তাকানোও এক ধরনের অসভ্যতা। তাকালেও নির্বাসনদণ্ড হতে পারে। অনেকের হয়েছে।

এত কঠিন নিয়ম-কানুন কেন?

কি আশ্চর্য! রাণী-মা’র নিয়ম-কানুন কঠিন হবে না? উনি কি আর তোমার আমার মত সাধারণ? ও আচ্ছা, বলতে ভুলে গেছি —রাণী-মা যদি কথায় কথায় কোন হাসির কথা বলেন, তাহলে হাসবে কিন্তু খুব শব্দ করে হাসবে না।

শব্দ করে হাসলে কি হয়?

অসভ্যতা হয়। উনার সামনে অসভ্যতা করা যায় না।

উনি কি হাসির কথা বলেন?

বলবেন না কেন? বলেন। একবার কি হল শোন –আমি রাণী-মা’র সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। উনি এমন এক হাসির গল্প বললেন যে আমার মরে যাবার মত অবস্থা। এত হাসি আসছে, হাসতেও পারছি না –হাসলে যদি বেয়াদবী হয়। রাণী-মা আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, আচ্ছা এখন যাও। অন্য একদিন এসো। আমি ছুটি পেয়ে দৌড়ে রাস্তায় এসে হো হো করে হাসলাম।

পিপলী বলল, রাণী-মা কি আমাকেও হাসির গল্প বলবেন?

তা তো জানি না পিপলী। তোমার সঙ্গে উনি কি গল্প করবেন তা উনিই জানেন। তবে একটা কথা মনে রেখ –রাণীমা কোন প্রশ্ন করলে সত্যি জবাব দেবে। ভুলেও মিথ্যা বলবে না, কিংবা চুপ করে থাকবে না।

জি আচ্ছা।

আর রাণী-মা’র সঙ্গে কথা বলার আগে দুহাতে মাথা চেপে ধরে বলবে –হে পিপড়া সম্প্রদায়ের মহান রাণী। আপনার মঙ্গল হোক। কল্যাণ হোক। মনে থাকবে?

থাকবে।

আচ্ছা, এখন বাসায় চলে যাও। বাসায় গিয়ে তৈরি হয়ে থেকো। কে জানে তিনি হয়ত আজই তোমাকে ডাকবেন। তোমার ভয় করছে না তো আবার?

একটু একটু করছে।

তা ভয় তো করবেই। আমার এত বয়স হল –এখনো রাণী-মা’র কাছে যাওয়ার কথা উঠলে শরীর কাঁপতে থাকে। এই দেখ, আমার শুড় দু’টা কাঁপছে। দেখতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি।

রাণী-মা’র সামনে গঁড় কাঁপানো আবার এক ধরনের অসভ্যতা। তবে তিনি কিছু মনে করেন না –এটাই ভরসা।

বড় আপা রাণী-মা’র বাড়ির দিকে রওনা হলেন। পিপলী রওনা হল তার। বাড়ির দিকে।

.

পিপলীরা এক রুমের একটা ফ্ল্যাটে থাকে। সে, তার মা আর তার দাদীমা। দাদীমা’র অনেক বয়স হয়েছে। তিনি এখন চোখেও দেখেন না, কানেও খুব কম শুনেন। তবে কথা বলতে পারেন। দিনরাত বক বক করেন। কেউ তার কথা শুনছে কি শুনছে না তা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। কথা বলেই যাচ্ছেন, বলেই যাচ্ছেন। পিপলী রাতে দাদীমা’র সঙ্গে শোয়। মাঝে মাঝে দাদীমা তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলেন, একটা মজার ইতিহাস মনে হয়েছে রে পিপলী, শোন।

আমার শুনতে ইচ্ছা করছে না দাদীমা।

কি বললি?

আমার শুনতে ইচ্ছা করছে না।

কি বলছিস একটু চেঁচিয়ে বল না।

চেঁচিয়েই তো বলছি। তুমি কানে শুনতে না পেলে কি করব? আমার ঘুম পাচ্ছে। গল্প শুনতে ইচ্ছা করছে না।

বড়ই মজার ইতিহাস। একটু শোন লক্ষ্মী মেয়ে। তোর মত বয়সে আমি একবার হারিয়ে গিয়েছিলাম, বুঝলি? কি হল শোন। কদিন খুব বৃষ্টি হল। বৃষ্টিতে আমাদের ঘরবাড়ি সব পানিতে ডুবে গেল। রাণী-মা বললেন, এই বাড়িঘর ছেড়ে নতুন জায়গায় যেতে হবে। নতুন আবাস বানাতে হবে। বলে রাণী-মা খুব কাঁদতে লাগলেন।

কোন রাণীমা? আমাদের এখনকার রাণী-মা?

উঁহু, উনার আগের জন।

রাণী হুকুম দিলেন –আমরা সব খাবার-দাবার নিয়ে তৈরি হলাম। রাণী মা’র কাছে বিদায় নিতে গেলাম। রাণী-মা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। আহা রে! কি কান্না! সেই কান্নার শব্দে পাষাণ গলে যায়। আমরাও খুব কাঁদলাম।

পিপলী অবাক হয়ে বলল, রাণীমা কাঁদছিলেন কেন?

রাণী-মা কাঁদছিলেন, কারণ, আমরা সবাই নতুন জায়গায় যাব –কিন্তু রাণী-মা যেতে পারবেন না।

উনি যেতে পারবেন না কেন?

রাণীদের বাড়ি ছেড়ে যাবার নিয়ম নেই। তাঁকে সেখানেই থাকতে হবে। বাড়িঘর পানিতে ডুবে গেলে তাঁকেও পানিতে ডুবে মরতে হবে। কাজেই আমরা রাণী-মাকে ফেলে রেখে কাঁদতে কাঁদতে রওনা হলাম। আহা, কি কষ্ট! যাবার পথে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। সে এক বিচিত্র ইতিহাস। শুনবি?

বিচিত্র ইতিহাস শুনব না। তুমি ঐ রাণী-মা’র কথা বল।

আহারে বড় ভাল রাণী ছিল। আমরা উনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসবার সময়, তিনি আমাদের সবাইকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন।

তোমাকেও চুমুদিলেন।

হ্যা দিলেন। ভাল কথা আরেকটা মজার গল্প মনে হয়েছে। শুধু যে মজার তাই না, বিচিত্র ইতিহাস বলি?

না। ঘুম পাচ্ছে।

ছড়া শুনবি?

না।

বৃষ্টির ছড়া একটা শোন না। মজা লাগবে।

আমার এখন বৃষ্টির ছড়া শুনতে ইচ্ছা করছে না, দাদীমা। ঘুমুতে ইচ্ছা করছে।

ছড়া শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়। ছড়া শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তে অনেক বেশি মজা। বৃষ্টি যখন অসি আসি করে তখন এই ছড়া সুর করে পড়তে হয়। এই ছড়া পড়লে বৃষ্টি আসে না —

যা বৃষ্টি যা,
যেখান থেকে এসেছিলি
সেইখানেতে যা।
সেইখানে তোর মা আছে
মায়ের কাছে আদর আছে।
যা বৃষ্টি যা।
মায়ের কোলে বসে বসে
মায়ের আদর খা।

২. দাদীমাকে নিয়ে পিপলীর খুব সমস্যা
দাদীমাকে নিয়ে পিপলীর খুব সমস্যা হয়েছে। সারারাত জেগে পিপলীকে কবিতা শুনাবে, গল্প শুনাবে, ছড়া শুনাবে। সবচে সমস্যা হয় যখন গান শুরু করেন। দাদীমা’র গলা খারাপ। গানের সুরেরও কোন আগামাথা নেই। এই গানের সুর অন্য গানে, এক গানের কথা অন্য গানে। এমন বিরক্তিকর ব্যাপার। রাত জেগে জেগে হাত পা নেড়ে গান। দাদীমা’র ঘুম হয় না –সে পিপলীকেও ঘুমুতে দেয় না। তারা যদি একটা দুরুমের ফ্ল্যাট পেত খুব ভাল হত। দাদীমাকে একটা রুম দিয়ে দেয়া যেত। দুরুমের একটা ফ্ল্যাট তাদের পাওয়ার কথা কিন্তু তারা পাচ্ছে না। কারণ বাড়ি বানানোর মাটি পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির মাটি আনতে হচ্ছে অনেক দূর থেকে। সেখানে যাওয়া যেমন কষ্ট, পথও তেমনি বিপদজনক। কাছেই অবশ্যি ভাল মাটি পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু রাণী-মা সেই মাটি পছন্দ করলেন না।

রাণী মা বললেন, আমি জানি এই মাটি ভাল। এই মাটির ঘর মজবুত হবে তাও জানি –কিন্তু এই মাটির গন্ধ আমার পছন্দ হচ্ছে না। তোমাদের মাটি আনতে হবে দূর থেকে। জানি, তোমাদের কষ্ট হবে। মাটি আনতে গিয়ে অনেকেই মারা পড়বে। তবে সেই মৃত্যু হবে সুখের মৃত্যু। কারণ যারা মারা যাবে তারা মারা যাবে অন্যের সুখের জন্য। এই মৃত্যু বড়ই আনন্দের মৃত্যু। তোমাদের কাজ করতে হবে দিনরাত। বিপদকে তুচ্ছ করতে হবে।

পিপড়ারা তাই করে যাচ্ছে। তাদের সব কাজ ভাগ ভাগ করা। যারা মাটি আনে –তাদের কাজই হল মাটি আনা। তারা অন্য কাজ করবে না। তারা হল মাটি-বাহক। সারা বৎসর তারা শুধু মাটিই আনে। অবশ্যি খুব জরুরী পরিস্থিতিতে তারা পিপড়ার ডিম নিয়ে এক জায়গা থেকে একজায়গায় যায়।

বিলু বলল, বাবা আমি পিপড়াদের মুখে ডিম নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে দেখেছি।

তিলু বলল, আমিও দেখেছি।

শুধু নীলু দেখেনি। এই জন্যে নীলুর একটু মন খারাপ হল। মতিন সাহেব বললেন, আমাকে গল্প শেষ করতে দাও –কি বলছিলাম যেন?

নীলু বলল, তুমি বলছিলে একদল পিপড়া আছে এদের কাজ হল মাটি আনা। তাদের নাম –মাটি বাহক।

মতিন সাহেব বললেন, সেই মাটি চালুনি দিয়ে চেলে তাতে পানি মিশিয়ে, গাছের আঠা মিশিয়ে মাটি তৈরির কাজ করবে অন্যরা। তাদের নাম মাটি মিশ্রক। সেই তৈরি মাটি দিয়ে বাড়ি বানানোর কাজ আবার অন্যদের হাতে। তাদের বলে নির্মাতা পিপীলিকা।

আরেক দল আছে। যাদের কাজ খাদ্য অনুসন্ধান করা। এরা জায়গায় জায়গায় যাবে, খাদ্য খুঁজে বের করবে, খবর দেবে রাণী-মাকে। খাদ্যের নমুনাও খানিকটা ভেঙে নিয়ে আসবে। রাণীমা সেই খাদ্য চেখে দেখবেন। যদি দেখেন ভাল, তখন অন্য আরেক দলকে হুকুম দেবেন খাদ্য নিয়ে আসতে।

রাণী-মাকে পাহারা দেওয়া এবং পিপড়াদের নিরাপত্তার জন্য আছে বিশাল সৈন্যবাহিনী। তাদের দাঁতে আছে বিষ। এরা হিংস্র প্রকৃতির। যুদ্ধ করা ছাড়া তারা অন্য কোন কাজ জানে না। খাদ্য নিয়ে আসার সময় দলে দলে সৈন্য পাঠানো হয়। সৈন্যরা সারি বেঁধে যায়। রাস্তা ঠিক করে দেয়। অন্য কোন পোকা-মাকড় যাতে এই খাদ্য নিয়ে যেতে না পারে সেই দিকে তারা লক্ষ্য রাখবে। মাঝে মাঝে বড় ধরনের যুদ্ধও তাদের করতে হয়। এই যুদ্ধ হয় অন্য গোত্রের পিপড়াদের সঙ্গে। কিছুদিন আগেই এরকম একটা যুদ্ধে পিপলীদের দলের শত শত সৈন্য মারা পড়ল। এমন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনেকদিন হয়নি। ঘটনা কি হয়েছিল বলি —

পিপলীদের দল একটা বড় শুঁটকি মাছ পেয়েছিল। শুঁটকি মাছ হল পিপড়াদের জন্যে খুবই আদর্শ খাবার। পুষ্টিকর। উপাদেয়। অনেকদিন ঘরে রাখা যায়। নষ্ট হয় না। পিপলীদের সৈন্যবাহিনী পাহারা দিয়ে সেই খাবার নিয়ে যাচ্ছিল। কোন রকম সমস্যা হচ্ছিল না। হঠাৎ কালো পিপড়া গোত্রের একটা পিপড়াকে দেখা গেল এগিয়ে আসছে। সে ইশারায় বলল, কথা আছে। তার মুখ গম্ভীর।

পিপলীদের দলের একজন কর্নেল এগিয়ে গেল।

কি কথা?

কালো পিপড়া গম্ভীর গলায় বলল, আপনার পরিচয় দিন। আগে পরিচয়, তারপর কথা।

আমি রাণী-মা’র সৈন্যবাহিনীর একজন কর্নেল। আপনার কি পরিচয়?

আমি কালো গোত্রের একজন অনুসন্ধানী পিপড়া। এই যে খাবার তোমরা নিয়ে যাচ্ছ এই খাবার আমি প্রথম খুঁজে বের করি। তোমরা এটা নিয়ে যেতে পার না।

তোমার কথা সত্য না। তুমি যদি খাবার খুঁজে পেতে তাহলে খাবারের উপর তোমাদের পতাকা পুঁতে দিতে। সেই পতাকা দেখে আমরা বুঝতাম তোমরা খুঁজে পেয়েছ। খাবারের উপর তোমাদের পতাকা ছিল না।

আমাদের পতাকা পোতার নিয়ম নেই।

নিয়ম সবার জন্যই। সমস্ত পিপড় সম্প্রদায় এই নিয়ম মেনে চলে।

আমরা আগে মানতাম, এখন মানি না।

তুমি মিথ্যা কথা বলছ।

কাল পিপড়া হুংকার দিয়ে বলল, আমাকে মিথ্যাবাদী বলছ? তোমার সাহস তো কম না!

মিথ্যাবাদীকে মিথ্যাবাদী বলতে সাহস লাগে না।

কি বললে! আমি মিথ্যাবাদী?

হ্যাঁ।

তুমি কি যুদ্ধ করতে চাও?

আমি চাই না। আমাদের রাণী-মা অকারণে যুদ্ধ চান না। আমরা আমাদের খাবার নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের রাজ্যে ফিরে যেতে চাই।

শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ি ফিরে যেতে চাও –খুব ভাল কথা। শান্তি সবাই চায়। আমরাও চাই। তবে সেই শান্তি পেতে হলে খাবার রেখে যেতে হবে।

তা সম্ভব না।

তাহলে যুদ্ধ হবে।

কালো পিপড়া কথা শেষ করেই একটু দূরে সরে গিয়ে ইশারা দিল। আর তখনি শত শত কালো পিপড়া বের হয়ে এল। তারা এতক্ষণ আড়ালে ঘাপটি মেরে বসেছিল। কালো পিপড়ারা যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়েই এসেছে। মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেল। ভয়ংকর যুদ্ধ। কালো পিপড়ারা খুবই ভাল যোদ্ধা। এদের গায়ের জোর প্রচণ্ড। তাছাড়া তাদের সঁড়াশীর মত একটা অস্ত্র আছে। লাল পিপড়াদের তা নেই। তবে লাল পিপড়ারা অনেক সংঘবদ্ধ। এদের বুদ্ধিও বেশি। তারপরও লাল পিপড়ারা যুদ্ধে হেরে গেল। এদের শত শত সৈন্য মারা গেল। যারা বেঁচে গেল, কালো পিপড়ারা তাদের বন্দি করে নিয়ে গেল। বন্দি লাল পিপড়াদের এখন কাজ হচ্ছে কালো পিপড়াদের কাজকর্ম করে দেয়া। ওদের বাড়িঘর বানানো।

পিপলী বেগমের বাবা ঐ কালো পিপড়াদের হাতেই বন্দি। তিনি কেমন আছেন, কোথায় আছেন পিপলী বেগম কিছুই জানে না। মাঝে মাঝে বাবার জন্য সে কাঁদে। সবাই যখন খেলতে যায় সে যায় না চুপ করে বসে থাকে।

আজও বাড়ি ফিরে পিপলী বেগম চুপচাপ বসে রইল। পিপলীর মা বললেন, তোর কি হয়েছে রে?

পিপলী বলল, কিছু হয় নি।

কিছু হয়নি তো মুখ এমন অন্ধকার করে বসে আছিস কেন? স্কুলে আপার বকা খেয়েছিস?

না।

তাহলে এরকম চুপচাপ বসে থেকে রেশন কার্ড নিয়ে যা। খাবার নিয়ে আয়।

আমাদের খাবার যা আছে তাতে চলে যাবে মা। আর লাগবে না।

চিনি নেই তো। কয়েক দানা চিনি থাকা ভাল। বর্ষাকাল এসে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে এক-আধটু চিনি খেতে ভাল লাগে।

বেশি চিনি খাওয়া ভাল না, মা। ডায়াবেটিস হবে।

কে বলেছে তোকে?

স্কুলের আপা বলেছেন।

তোর দাদীমা’র চিনি খুব পছন্দ। এই বয়সে তাঁর অন্য কোন খাবার মুখে রুচে না। যা না রেশন কার্ডটা নিয়ে। লক্ষ্মী মা আমার। ময়না মা আমার।

যাচ্ছি, যাচ্ছি।

যাচ্ছিস যখন তখন তুই কি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারবি?

কি কথা।

এবছর আমাদের নতুন ফ্ল্যাট দেবে কি না।

মনে থাকলে জিজ্ঞেস করব।

তোর দাদীমা’র কথা বলিস। বেচারীর এখন একার একটা ঘর দরকার।

আচ্ছা বলব।

তোর মুখটা এমন কালো লাগছে কিছু হয়নি তো মা?

না।

পিপলী রেশন কার্ড নিয়ে গেল। পিপড়া সমাজের নিয়ম হল –সব খাদ্য স্টোর রুমে জমা হবে। তারপর হিসেব হবে কি পরিমাণ খাদ্য আছে। হিসেব মত সব খাবার সমানভাবে ভাগ করা হবে। কেউ বেশি পাবে না। কেউ কমও পাবে না।

মাঝে মাঝে কিছু খাবার পাওয়া যায় যার পরিমাণ খুবই অল্প –যেমন এক টুকরা চকলেট। খুব দামী খাবার পরিমাণ অল্প হলে রাণী মাকেই উপহার দেবার নিয়ম। তবে এদের রাণী মা কোন খাবার উপহার হিসেবে নেন না। যত ভাল খাবারই হোক প্রজাদের দিয়ে দেন। এ জাতীয় খাবারের বেলায় নিয়ম অন্য। কাকে বাড়িতে নিতে দেয়া হবে না –এখানে এসে খেতে হবে। খাবার সময় বলতে হবে –রাণীমা’র মঙ্গল হোক।

ষ্টোর ইনচার্জ পিপলীকে দেখে বললেন, কি খবর মা? মুখ মলিন কেন? শরীর ভাল।

জি চাচা শরীর ভাল।

খাবার নিয়েছিস?

হু।

পিপলীর ভাগে পড়ল চারদানা চিনি। এক টুকরা নোনতা বিসকিট। শাদা শাদা এক ধরনের গুড়া। স্টোর-ইন-চার্জকে পিপলী বলল, চাচা, ওটা কি? খেতে ভয়ংকর তিতা।

স্টোর-ইন-চার্জ রাগী গলায় বললেন, তুই কি এটা খেয়ে দেখেছিস?

হু।

তোকে নিয়ে তো বড্ড যন্ত্রণা হল। কতবার বলেছি জিজ্ঞেস না করে কিছু মুখে দিবি না।

জিনিসটা কি চাচা? বিষ না-কি?

না, বিষ না। এক ধরনের সাবান। গুড়া সাবান। গায়ে মেখে গোসল করার জন্যে আনা। তোর বুদ্ধিশুদ্ধি এখনো হলো না। কিছু দেখলেই ফট করে মুখে দিয়ে দেয়া। যা, জিনিসপত্র নিয়ে বিদেয় হয়ে যা। একা সব নিতে পারবি, না লোক দেব?

না, লোক লাগবে না। আমি নিজেই নিতে পারব। একবারে না পারলে দুবারে এসে নেব।

বাহু, এই তো লক্ষ্মী মেয়ের মতো কথা। নিজের কাজ নিজে করার আনন্দই আলাদা। তোর দাদীমা কেমন আছে রে পিপলী?

ভাল। আচ্ছা চাচা, আমরা কি এ বছর নতুন ফ্ল্যাট পাব না?

উঁহু। রাণী-মা’র হুকুমে বাড়ি বানানো এখন বন্ধ। এই মাটিও রাণী-মা’র পছন্দ হচ্ছে না। আরো দূর থেকে মাটি আনতে বলেছেন। তবে বাড়ি তৈরি হলে প্রথম ফ্ল্যাটটা তোদের দেয়া হবে। তোর দাদীমাকে এই নিয়ে কিছু ভাবতে নিষেধ করবি।

আচ্ছা। যাই চাচা?

কাল মনে করে আসিস। ভালখাবার পাওয়া গেছে শুঁটকি মাছ। অনেক দূর থেকে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসার কথা। কাল ভোরেই সব ভাগাভাগি করে দেব।

পিপলী বলল, শুঁটকি মাছ নিয়ে আগের বারের মত কালো পিপড়াদের সঙ্গে যুদ্ধ হবে না তো।

না। বার বার কি যুদ্ধ হয়। কিছুই হবে না দেখিস।

আমাদের সৈন্য যায় নি চাচা। গিয়েছে।

আগের বারের চেয়ে অনেক বেশি গিয়েছে?

না। আগের বার যত জন গিয়েছিল, এবার ততজনই গেছে।

আরো বেশি পাঠানো উচিত ছিল না চাচা?

পাঠালে ভাল হত। তবে এসব ব্যাপারতো মা রাণীমাই ভাল বুঝেন। উনিই সব ঠিক করেন। আমাদের নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার দায়িত্ব তো রাণী মা’র। ঠিক না-মা?

হ্যাঁ ঠিক চাচা।

পিপলী বাড়ি ফিরে দেখে সব কেমন থমথম করছে। পিপলীর দাদীমা বিছানায় শুয়ে বিড় বিড় করে বলছেন, কি সর্বনাশ হয়ে গেল রে। কি সর্বনাশ হয়ে গেল রে। আশে পাশের ফ্ল্যাট বাড়ি থেকেও কান্নার শব্দ শুনা যাচ্ছে। পিপলীর মা একবার ছুটে রাস্তায় যাচ্ছেন, আরেকবার ঢুকছেন ঘরে। পিপলী বলল, কি হয়েছে মা?

যুদ্ধ লেগে গেছে রে। ভয়ংকর যুদ্ধ লেগে গেছে। এই মাত্র খবর এসেছে।

কালো পিপড়াদের সঙ্গে যুদ্ধ?

হ্যাঁ। ভয়ংকর যুদ্ধ।

বল কি মা? আমাদের এখান থেকে সৈন্য যাচ্ছে না?

না। রাণী মা হুকুম দিয়েছেন শ্রমিক পিপড়াদের যুদ্ধে যাবার জন্যে।

ওরা তো যুদ্ধ জানে না।

রাণী হুকুম দিয়েছেন। কিছু তো করার নেই।

এ রকম হুকুম উনি কেন দিলেন মা? উনি সৈন্য পাঠালেই পারেন। আমাদের কি সৈন্যের অভাব আছে?

রাণী মা যখন শ্রমিক পাঠাতে বলেছেন তখন ভেবে চিন্তেই বলেছেন। উনি অনেক কিছু জানেন যা আমরা জানি না। রাণী-মা’র মঙ্গল হোক। বলেই পিপলী বেগমের মা ছুটে বের হয়ে গেল।

পিপলীও গেল মা’র পেছনে পেছনে। কি করুণ দৃশ্য শ্রমিক পিপড়ারা বাড়ি থেকে বের হচ্ছে, তাদের ছেলেমেয়েরা কাঁদছে। শ্রমিক পিপড়া মাথা নিচু করে নামছে রাস্তায়। শুকনো মুখে এগুচ্ছে সামনের দিকে। প্রধান রাস্তার শুরুতে উঁচু মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে শহরের মেয়র রাণী-মা’র হুকুম পড়ে শুনাচ্ছেন —

শ্রমিক পিপীলিকার জন্যে
রাণী মা’র জরুরী বার্তা।

কালো পিপড়াদের সঙ্গে আমরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছি। নির্দেশ দিচ্ছি সকল শ্রমিক পিপীলিকাদের তারা যেন এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। অপ্রাপ্তবয়স্ক, রুগ্ন ও অসুস্থ পিপীলিকারাই শুধু এই নির্দেশের বাইরে থাকবে।

শ্রমিক পিপীলিকার জন্যে
রাণী-মা’র জরুরী বার্তা

কালো পিপড়াদের সঙ্গে আমরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছি …

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পিপলী নির্দেশ শুনল। তার এত মন খারাপ লাগছে। শ্রমিক পিপড়ারা যুদ্ধের কিছুই জানে না। এরা যাবে আর মারা পড়বে। রাণী-মা কেন এদের পাঠাচ্ছেন?

পিপলী এগিয়ে গেল মেয়রের দিকে। চিকণ গলায় ডাকল, মেয়র চাচা, মেয়র চাচা।

মেয়র তাকালেন পিপলীর দিকে। তাকিয়েই চমকে উঠলেন –আরে পিপলী। তুমি আমার আশে পাশে থাক। তোমার সঙ্গে জরুরী কথা আছে। তোমার মা’র সঙ্গে দেখা হল কিছুক্ষণ আগে তাঁকে বলেছি। তোমাকে বলা হয় নি। তোমার মা তোমাকে খুঁজছেন।

কি ব্যাপার চাচা?

বলছি। একটু সামাল দিয়ে নি। এক সঙ্গে সব ঝামেলা মাথায় এসে পড়ে। শ্রমিক পিপড়াদের বার্তা আগে শেষ করি। বলতে বলতে গলাও গেছে ভেঙ্গে।

আপনাকে এই বার্তা আর কষ্ট করে বলতে হবে না চাচা। সবাই এর মধ্যে শুনে ফেলেছে।

তা ঠিক সবাই শুনেছে।

আচ্ছা চাচা রাণী-মা সৈন্য না পাঠিয়ে এদের পাঠাচ্ছেন কেন?

আমি তো ঠিক জানি না মা। রাণী-মা কে আমিতো আর প্রশ্ন করতে পারি না। তবে আমার মনে হয় তিনি প্রথম শ্রমিক পিপড়া পাঠাচ্ছেন যাতে ওরা মনে করে আমাদের কোন সৈন্য নেই। সৈন্য শেষ হয়ে গেছে। এই ভেবে যখন তারা অসতর্ক হয়ে পড়বে তখন হয়ত আমাদের আসল সৈন্যরা যাবে।

কিন্তু তার আগেইতো আমাদের এরা সবাই মারা যাবে।

মেয়র দুঃখিত গলায় বললেন, তা ঠিক মা। তা ঠিক।

পিপলী বলল, আমার সঙ্গে আপনার কি জরুরী কথা চাচা?

খুবই জরুরী কথা মা। খুবই জরুরী কথা। রাণী-মা তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমার কাছে পাস পাঠিয়ে দিয়েছেন। পাস নিয়ে বাসায় চলে যাও।

পিপলী হকচকিয়ে গেল। নরম গলায় বলল, কখন যেতে হবে চাচা?

সব পাসের উপর লেখা আছে। আগামী কাল। মা এখন আমার সমানে থেকে যাও —বড়ই ব্যস্ত —

শ্রমিক পিপীলিকার জন্যে
রাণী মা’র জরুরী বার্তা .

পিপলী বাড়ি ফিরে দেখে তার মা খুবই উত্তেজিত। তিনি ছোটাছুটি করছেন। উত্তেজনার জন্যে ঠিকমত কথাও বলতে পারছেন না।

কথা জড়িয়ে যাচ্ছে –

ও পিপলী, তোকে রাণী-মা ডেকে পাঠালেন কেন?

জানি না মা।

কি আশ্চর্য কথা! এই দেখ, আমার হাত-পা কাঁপছে। রাণী-মা ডেকে পাঠিয়েছেন –সহজ কথা তো না। তের ভয় লাগছে না পিপলী?

একটু লাগছে?

লাগারই কথা। তবে ভয়ের কিছু নেই। রাণী-মা খুব দয়ালু। রাণী-মা’র সঙ্গে দেখা হলে কি বলতে হবে জানিস তো? প্রথমেই বলতে হবে –হে পিপড়া সম্প্রদায়ের মহান রাণী! আপনার মঙ্গল হোক, কল্যাণ হোক! আর কথা বলার সময় রাণী-মা’র চোখে চোখে কখনো তাকাবি না। কথা বলার সময় রাণী-মা’র চোখের দিকে তাকানো খুব অসভ্যতা। রাণী-মা’র সঙ্গে খুব জোরেও কথা বলা যাবে না, আবার ফিসফিস করেও কথা বলা যাবে না। দুটোই অসভ্যতা।

আমি জানি মা।

আজ রাতে তোকে উপোষ থাকতে হবে।

কেন?

রাণী-মা’র কাছে ভরা পেটে যেতে নেই। রাণী-মা’র কাছে ভরা পেটে যাওয়াও অসভ্যতা।

রাতে উত্তেজনায় পিপলী বেগম, পিপলী বেগমের মা এবং দাদীমা কেউই ঘুমুতে পারল না। তিনজন একসঙ্গে বসে গল্প করে করেই রাত কাটিয়ে দিল। এত বড় একটা যুদ্ধ হচ্ছে তা যেন কারোর মনেও নেই। পিপলীর দাদীমা বললেন, আমার কাছ থেকে একটা ছড়া ভালমত শিখে যা পিপলী। ছড়া শিখে গেলে রাণী-মাকে শুনাতে পারবি। রাণী-মা খুশি হবেন।

রাগও হতে পারেন। তোমার ছড়াগুলি যা পচা পচা।

এই ছড়াটা সুন্দর। আর তুই যদি গানের মত করে বলিস তাহলে শুনতে ভাল লাগবে। ইচ্ছা করলে নেচে নেচেও শুনাতে পারিস। তবে নেচে নেচে শুনানো অসভ্যতা কিনা তাও জানি না। ছড়াটা বল।

রাণী-মা, রাণী-মা
গালে তার লালিমা …

পিপলী দাদীমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাণী-মা’র গালে লালিমা কি-না তা তো কেউ জানে না। কেউ তো রাণী-মাকে দেখেনি …

আচ্ছা, তাই তো। তাহলে তুই কি একটা মশার ছড়া শুনাবি?

মশার ছড়া? মশার ছড়া শুনে উনি কি করবেন?

হয়ত উনার ভাল লাগবে —

মশা মশা মশা
চুপচাপ বসা
কাছে গেলে
উড়ে যায়
দূরে যায়
দিন রাত
গান গায়।
ফুল খায়
ফল খায়
মানুষের রক্ত খায়।
মশা মশা মশা
চুপ চাপ বসা।

পিপলী, ছড়াটা কেমন লাগল রে?

ভাল লাগেনি। আর ছড়া-টড়া বলার দরকার নেই। এসো দাদীমা, আমরা চুপচাপ বসে রাত পার করে দিই। আমার ভাল লাগছে না।

ভাল লাগছে না কেন?

আমার শুধু মনে হচ্ছে রাণী-মা হয়তো আমার উপর বিরক্ত হবেন। আমাকে শাস্তি দেবেন।

ওমা, এ কেমন কথা! তোর উপর বিরক্ত হবেন কেন?

তা জানি না। কিন্তু মনে হচ্ছে বিরক্ত হবেন।

অলুক্ষণে কথা বলিস না তো।

.

খুব ভোরে পিপলী বেগমের মা পিপলীকে সাবান মাখিয়ে গোসল করিয়ে আনলেন। পিপলীর চোখ এম্নিতেই সুন্দর, তারপরেও চোখের দুপাশে কাজল লাগিয়ে দিলেন। পিপলীকে সুন্দর দেখাতে লাগল। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তোর বাবা থাকলে আজ কত খুশি হত! আনন্দে হয়ত চিৎকার করে কাঁদত –তার মেয়ে যাচ্ছে রাণী-মা’র সঙ্গে দেখা করতে –সহজ কথাতো না। কত বড় কথা! কত আনন্দের কথা! আহা, মানুষটা আজ কোথায় না জানি আছে।

দাদীমা বললেন, ভয় লাগছে না-কি রে পিপলী?

পিপলী বলল, না। তার কিন্তু ভয় লাগছে। বেশ ভয় লাগছে।

.

সূর্য আকাশে অনেকখানি উঠেছে। পিপলী বেগম রওনা হয়েছে রাণী-মা’র কাছে। পিপলীর মা ঘরে বসে কাঁদছেন।

রাণী-মা’র বাড়ি পিপড়াদের মূল বসতবাড়িগুলি থেকে দূরে। শুধু দূরে নয় অনেকখানি দূরে। পিপড়াদের বসতবাড়ি মাটির নিচে, খুব নিচে নয় –অল্প নিচে। সূর্যের আলো যেন সেখানে যেতে পারে তার ব্যবস্থা আছে। রাণী-মা’র বাড়ি তারচেয়েও অনেক নিচে। সুরঙ্গ পথে যেতে হয়। সুরঙে কিছুক্ষণ পর পর পাহারা। বাজখাই গলায় পাহারাদাররা চেঁচিয়ে উঠে, কে? কে যায়?

পিপলী ভয়ে ভয়ে বলে –আমি। আমি পিপলী বেগম।

যাওয়া হচ্ছে কোথায়?

রাণী-মা’র বাড়ি। উনি ডেকে পাঠিয়েছেন?

পাশ আছে?

আছে।

আছে বলে হাবার মত দাঁড়িয়ে থেকো না। দেখাও।

পিপলী পাশ দেখায়। আরো খানিকক্ষণ যায়। আবার একজন চেঁচিয়ে ওঠে —-কে? কে যায়?

এমন করে যেতে যেতে সে একটা সমতল ভূমিতে এসে পৌঁছল। জায়গাটা তত অন্ধকার না। আবছা করে হলেও সব দেখা যাচ্ছে। উঁচু দেয়াল-ঘেরা জায়গা। এই দেয়ালের নাম প্রথম দেয়াল। এরকম আরো দু’টা দেয়াল পেরুবার পর রাণী-মা’র বাড়ি।

প্রথম দেয়ালে একটিমাত্র গেট। বন্ধ গেটের বাইরে বেশ কজন উঁচু পদস্থ কর্মচারী। এরা সবাই গম্ভীর। এদের মেজাজও মনে হয় ভাল না। একটু দূরে রক্ষীবাহিনীর একজন বড় অফিসারকে ঘিরে কয়েকজন অফিসার। প্রথম গেটটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই গেটে পাশ পরীক্ষা করা হয়। সেই পরীক্ষা খুব জটিল পরীক্ষা। পরীক্ষার পর এই পাশ রেখে নতুন পাশ দেয়া হয়।

পিপলী বেগমের পাশ দু-তিনজন মিলে পরীক্ষা করল। পাশ ঠিকই আছে। রক্ষীবাহিনীর অফিসার বললেন –পিপলী বেগম, তোমার সঙ্গে কি কিছু আছে? কোন বিপদজনক অস্ত্র বা এই জাতীয় কিছু?

জি না। এই দেখুন আমার হাত খালি।

তোমার চোখ এমন দেখাচ্ছে কেন? চোখে কি দিয়েছ?

আমার মা দিয়ে দিয়েছেন –কাজল।

এইত সমস্যা হল। চোখে কাজল পরে রাণী-মা’র কাছে যাওয়া যায় কি-না তাও তো জানি না। নিয়ম-কানুনের বইটা দেখো তো।

নিয়ম-কানুনের বই অনেকক্ষণ ধরে ঘাঁটা হল। কিছুই পাওয়া গেল না। অফিসার বললেন –এ তো দেখি ভাল যন্ত্রণা হল!

পিপলী বেগম বলল, আমি না হয় কাজল মুছে ফেলি।

না, তার প্রয়োজন দেখছি না। কষ্ট করে তোমার মা চোখে কাজল দিয়ে দিয়েছে। দেখাচ্ছেও সুন্দর। আচ্ছা চল, তোমাকে দ্বিতীয় দেয়ালে নিয়ে যাই। ওরা বোধহয় জানে।

দ্বিতীয় দেয়ালের একটামাত্র গেট। সেই গেট পাহারা দিচ্ছে সৈন্যবাহিনী। শুধু গেট না –সমস্ত দেয়াল জুড়েই সৈন্যবাহিনীর সারি। দেখলেই ভয়ে গা কাঁপে। কি তাদের চেহারা! কি তাদের স্বাস্থ্য!

দ্বিতীয় দেয়ালের গেটে পিপলীকে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হল। তারাও চোখের কাজল সম্পর্কে কিছু পেল না। সেনাবাহিনীর অফিসার বললেন, সবচে ভাল হয় কাজল তুলে ফেললে। পিপলী তাতে রাজি। বসে থাকতে তার আর ভাল লাগছে না। তা ছাড়া তার অসম্ভব খিদে পেয়েছে। খুব পিপাসাও পেয়েছে সে চোখের কাজল মুছে ফেলল।

সেনাবাহিনীর অফিসার নিজেই তাকে সঙ্গে নিয়ে তৃতীয় দেয়ালের গেটে পৌঁছে দিলেন। তৃতীয় এবং শেষ দেয়াল পাহারা দিচ্ছে রাণী-মা’র নিজস্ব সৈন্যবাহিনী। এই বাহিনীর সব সৈন্যই মেয়ে। পিপলীর মনে হল এরা পুরুষ সৈন্যদের চেয়েও ভয়ংকর। কারণ এদের প্রত্যেকের দুটি করে সাঁড়াশী আছে। ধারালো সাঁড়াশী ঝক ঝক করছে। মেয়ে সৈন্যবাহিনীর প্রধান পিপলী বেগমকে নিজের অফিসে ডেকে নিয়ে গিয়ে যন্ত্রের মত গলায় বলল —

শোন পিপলী বেগম –এখন থেকে তোমার সঙ্গে কেউ যাবে না। তুমি একা হেঁটে হেঁটে রাণী-মা’র প্রাসাদের দিকে যাবে। দূর থেকেই প্রাসাদ দেখা যায়। তোমার চিনতে কোন অসুবিধা হবার কথা না। প্রাসাদের সামনে দাঁড়ালেই তুমি রাণী-মাকে দেখতে পাবে। রাণী-মা দিনের প্রথম অংশে বারান্দায় সিংহাসনে বসে থাকেন। প্রাসাদের চারদিকে লাল দাগ দেয়া আছে। লাল দাগের ভেতরে যাবে না। ভেতরে যাবার নিয়ম নেই। লাল দাগের ভেতরে পা দেয়ার অপরাধের একটাই শাস্তি –নির্বাসন। মনে থাকবে?

হু

হু আবার কি? আদব-কায়দা তো মনে হচ্ছে কিছুই শেখোনি। বল –জ্বি মহামান্যা। মনে থাকবে।

জী মহামান্যা, মনে থাকবে।

রাণী মা’র সঙ্গে দেখা হবার পর তুমি যা বলবে তা হচ্ছে –হে পিপীলিকা সমাজের মহান রাণী! আপনার মঙ্গল হোক, কল্যাণ হোক। মনে থাকবে?

জি মহামান্যা, মনে থাকবে।

এখন এসো, প্রতিজ্ঞা কর।

পিপলী বিস্মিত হয়ে বলল, কি প্রতিজ্ঞা?

রাণী-মা’র কাছে যাবার আগে প্রতিজ্ঞা করতে হয়।

কিভাবে প্রতিজ্ঞা করব?

হাঁটু গেড়ে বস।

পিপলী হাঁটু গেড়ে বসল।

বল —

শপথ চন্দ্র ও সূর্যের নামে, শপথ পৃথিবীর নামে, শপথ আমার
পিতা ও মাতার নামে, –শপথ বৃর্ষার প্রথম বৃষ্টির নামে,
শপথ খাদ্যের নামে মহান রাণী-মা’র কোন অনিষ্ট করিব না
কিংবা কাউকে অনিষ্ট করিতে দিব না।

পিপলী বলল। তখন তাকে গেটের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। সে হতভম্ব হয়ে দেখল রাণী-মা’র প্রাসাদ। এ তো প্রাসাদ নয়, এ যেন এক স্থলপদ্ম ফুটে আছে। কি প্রকাণ্ড! কি কারুকার্যময়! প্রাসাদের গায়ে কত না ফুল, লতা পাতা আঁকা। কি অপূর্ব সব নকশা! কত অসংখ্য গম্বুজ —কত যে খিলান। প্রাসাদের নিচটা টকটকে লাল —যতই উপরের দিকে যাওয়া হচ্ছে লাল রঙ ততই কমছে। প্রাসাদের উপরের দিকটা ধবধবে শাদা। লাল থেকে প্রাসাদ হয়েছে শাদা। কোথায় লাল রঙের শুরু, কোথায় শাদা রঙের আরম্ভ বোঝার কোন উপায় নেই। ভেসে আসছে সুমধুর বাঁশি। পাতার বাঁশি। প্রসাদের ভেতর বসে অনেকেই একসঙ্গে বাঁশি বাজাচ্ছে।

পিপলী প্রাসাদের দিকে হাঁটতে শুরু করল। একসময় এসে পৌঁছল। রাণী মাকে দেখা যাচ্ছে –বারান্দায় সিংহাসনে বসে আছেন। কি সুন্দর লাগছে রাণী মাকে। কি সুন্দর! তবে যে তাকে বলা হল –রাণী মা কাউকে দেখা দেন না। তিনি থাকেন পর্দার আড়ালে। এইত সে দেখতে পাচ্ছে। যদিও রাণী-মা’র দিকে তাকানোর নিয়ম নেই। তাকালে অসভ্যতা হয়। অসভ্যতার শাস্তি নির্বাসন। তবু পিপলী চোখ নামাতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে সে সারাজীবন রাণী-মা’র দিকে তাকিয়ে থাকতে পারবে।

কি সুন্দর! কি সুন্দর! আর তাঁর সিংহাসনটাই কত সুন্দর! সিংহাসনের নিচটাও লাল উপরের দিকটা শাদা। অবিকল প্রাসাদের মত।

রাণী-মা’র সঙ্গে দেখা হবার পর তাঁকে যেসব কথা বলতে হয় তার কিছুই এখন পিপলী বেগমের মনে নেই। সব ভুলে গেছে। সে কয়েকবার বলল, হে মহান! হে মহান! হে মহান! … বাকি কথাগুলি আর মনে পড়ল না। রাণী-মা হাসলেন। চাপা হাসি। তারপর নরম গলায় বললেন —

কেমন আছ পিপলী বেগম?

পিপলী বেগমের গলায় কথা আটাকে যাচ্ছে। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল, ভা ভা ভা ভাল আছি রাণী মা। সে আবার কথাগুলি বলার চেষ্টা করল, হে মহান হে মহান করল কিন্তু লাভ হল না। কিছুই মনে পড়ছে না।

রাণী-মা বললেন, তুমি নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত?

পিপলী মাথা নাড়ল। সে ক্ষুধার্ত। অসম্ভব ক্ষুধার্ত। রাণীমা নিজ থেকে বলার আগে তা সে নিজেই বুঝতে পারে নি। রাণী-মা বললেন –পিপলীকে খেতে দাও।

দুটি পিপড়া থালায় করে খাবার আনছে। কিন্তু তারা এমন অদ্ভুতভাবে হাঁটছে কেন? এলোমেলোভাবে পা ফেলছে। শুধুমাত্র অন্ধরাই এমনভাবে হাঁটে। আচ্ছা, এরা কি অন্ধ?

দুটি পিপড়া যন্ত্রের মত এক সঙ্গে বলল, তোমার জন্যে খাবার এনেছি। খেয়ে নাও।

পিপলী কৌতূহল সামলাতে না পেরে বলল, আচ্ছা, আপনারা কি অন্ধ?

তোমার এত কথার দরকার কি? খাবার এনেছি, খাও।

আপনাদের ধন্যবাদ।

আমাদের ধন্যবাদ দেয়ার দরকার নেই। রাণী-মাকে ধন্যবাদ দাও।

রাণী-মাকে ধন্যবাদ।

থালাভর্তি তরল সোনার মত খাবার।

ঝিকমিক করছে। কি তার গন্ধ! চারদিক মোহিত হয়ে যাচ্ছে। পিপলী একটু মুখে দিল –এত মিষ্টি! এত স্বাদ! ইশ, সে যদি তার মাকে আর দাদীমাকে একটু খাওয়াতে পারত! খানিকটা খাবার কি সে তাদের জন্যে নিয়ে যাবে? নিয়ে গেলে কি অসভ্যতা হবে? রাণীমা রাগ করবেন?

যারা খাবার এনেছে তাদের একজন ফিসফিস করে বলল, গবগব করে খেও না। রাণী-মা’র সামনে গব গব করে খাওয়া অসভ্যতা। পিপলী বলল, এই খাবারটার নাম কি?

নাম দিয়ে তুমি কি করবে? এই খাবার কি আর খেতে পারবে? আর পারবে না। এ হচ্ছে রাণী-মা’র খাবার। নিশি ফুলের মধু। নাম শুনেছ কখনো?

না।

দেখ, তোমার কত ভাগ্য, যে খাবারের নামও কখনো শুননি সেই খাবার খেতে পাচ্ছ। চেটেপুটে খাও। ফেলে রেখো না।

পিপলী চেটেপুটে খেল। তার ইচ্ছা করছে যে থালায় করে খাবার এনেছে সেই থালাটাও খেয়ে ফেলতে। এতই মজার খাবার!

রাণী-মা বললেন, পিপলী বেগম।

জি রাণী মা!

আমি শুনেছি তোমার পড়াশোনা করতে ভাল লাগে না। এটা কি সত্যি পিপলী?

সত্যি নয়, রাণী-মা।

তাহলে তুমি মিথ্যা কথা বলেছ তোমার বড় আপার কাছে?

জি রাণী-মা।

তুমি অপরাধ করেছ পিপলী বেগম। শাস্তি পাবার মত অপরাধ।

জি রাণী-মা।

কিন্তু তুমি অঙ্কে উনিশ পেয়েছ। ভূগোলে মাত্র তেইশ। তুমি কি অঙ্ক এবং ভূগোল ঠিকমত পড়নি?

ঠিকমতই পড়েছি।

তাহলে পরীক্ষা খারাপ হল কেন?

ইচ্ছা করে পরীক্ষা খারাপ দিয়েছি। জানা অঙ্ক ভুল করেছি।

কেন?

কারণ আমি জানি পরীক্ষা খারাপ করলে আপনি ডেকে পাঠাবেন। এর আগে একজন পরীক্ষা খারাপ করেছিল –আপনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

কি কথা বলতে চাও?

আমি কি আপনার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারি রাণী-মা?

পার।

পিপলী রাণী-মা’র দিকে তাকাল। রাণী-মাও এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে না তিনি খুব রাগ করছেন। বরং মনে হচ্ছে। তিনি মজা পাচ্ছেন।

পিপলী বেগম!

জি রাণী-মা।

বল, কি বলতে চাও।

পিপলী কি বলবে গুছিয়ে নিল। যদিও রাণী-মাকে এখন আর ভয় ভয় করছে না, তবু তার কাছে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীর হালকা লাগছে। একটু যেন ফুর্তি-ফুর্তি ভাবও হচ্ছে। এরকম হচ্ছে কেন? খাবারটার জন্যে হচ্ছে?

রাণী-মা বললেন, চুপ করে আছ কেন? শুরু কর। আমি তোমার কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছি।

রাণী-মা, আপনার সঙ্গে দেখা হলে যে কথাটা বলতে হয় সেই কথাটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। এখন মনে পড়েছে –হে পিপীলিকা সম্প্রদায়ের মহান রাণী, আপনার মঙ্গল হোক! কল্যাণ হোক!

রাণী-মা বললেন, তোমারও মঙ্গল হোক। কল্যাণ হোক।

রাণী-মা এখন আমি বলি –কি জন্যে এসেছি।

বল।

বলার আগে আমার খুব নাচতে ইচ্ছা করছে। রাণী-মা, আমি কি একটু নাচতে পারি? বেশি নাচব না। অল্প একটু নাচব।

বেশ তো নাচ। আমি অনেকদিন নাচ দেখি না।

পিপলী বেগম ঘুরে ঘুরে খানিকক্ষণ নাচল –গুন গুন করে নাচের সঙ্গে গানও গাইল —

নাচে পিপলী নাচে রে
ধিন ধিনাধিন নাচে রে
ঘুরে ফিরে নাচে রে
শুড় ঘুরিয়ে নাচে রে।
পা কাঁপিয়ে নাচে রে
নাচে পিপলী নাচে রে।

৩. নাচতে পিপলীর ভাল লাগে
নাচতে পিপলীর সব সময়ই ভাল লাগে। আজ যেন আরো ভাল লাগল। মনে হল সারাদিন সে শুধু নেচেই যাবে। নেচেই যাবে।

তোমার নাচ কি শেষ হয়েছে, পিপলী?

জি, রাণী-মা।

এখন বল কি বলতে এসেছ?

আপনাকে আমি পছন্দ করি না, রাণী-মা?

আমাকে তুমি পছন্দ কর না?

না।

শুনে দুঃখিত হলাম। আমার উপর কি তোমার প্রচণ্ড রাগ আছে?

আছে।

তোমার কি ইচ্ছা করছে আমাকে মেরে ফেলতে?

হ্যাঁ, ইচ্ছা করছে।

বল কেন ইচ্ছা করছে।

পিপলী নেচে-নেচে খানিকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আবার কথা বলা শুরু করার আগে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিল —

রাণী মা?

বল, আমি শুনছি।

আমরা সব সময় বলি –পিপীলিকা সম্প্রদায়ের মহান রাণী –আপনার মঙ্গল হোক, কল্যাণ হোক। আমরা সব সময় আপনার মঙ্গল চাই, কল্যাণ চাই —-কিন্তু আপনি আমাদের মঙ্গল চান না।

এ রকম কথা কেন বলছ?

রাণী-মা, আমি অনেক চিন্তা করেছি। চিন্তা করে করে বের করেছি। কিভাবে বের করেছি বলব রাণী মা?

বল।

কালো পিপড়াদের সঙ্গে আমাদের একবার যুদ্ধ হল। আপনার কি মনে আছে রাণী-মা?

মনে আছে। আমার স্মৃতিশক্তি ভাল, পিপলী বেগম। আমার স্মৃতিশক্তি খুবই ভাল। আমার সবকিছু মনে থাকে। আমি কিছুই ভুলি না। যুদ্ধের কথা আমার মনে আছে। সেই যুদ্ধে তোমার বাবা কালো পিপড়াদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন এই খবরও আমি জানি। তোমার বাবার জন্যে আমার দুঃখ হয়।

কিন্তু রাণী-মা, যুদ্ধ শুরু হবার পর যখন আমাদের অবস্থা খুব খারাপ হল –তখন আরো সৈন্য পাঠানোর জন্যে খবর পাঠানো হল। আপনি বললেন, প্রয়োজন নেই। আমাদের কিন্তু তখনো অনেক অনেক সৈন্য ছিল। আপনি ইচ্ছা করলেই সৈন্য পাঠাতে পারতেন।

আমাকে তো সবকিছু ভাবতে হয় পিপলী। খাবার নিয়ে সামান্য যুদ্ধে যদি আমার সব সৈন্য চলে যায় তাহলে কিভাবে হবে? আমরা কত বিপদ-আপদের মধ্যে বাস করি! আমাদের শক্ত সৈন্যবাহিনী দরকার। তুমি তো জান না, পিপলী, পিপড়াদের সবাই সৈন্য হয় না। যাদের জন্ম হয় মাথায় কাঁটা নিয়ে, তারাই হয় সৈন্য। দশ হাজার ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে দেখা যায় এদের মধ্যে সৈন্য মাত্র বিশ-পঁচিশটা।

হ্যাঁ, তাও ঠিক রাণী-মা। হাজার হাজার ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। আপনি নিজে পরীক্ষা করে দেখেন এদের মধ্যে কজন সৈন্য। তাঁদের আপনি বাঁচিয়ে রাখেন। বাকিদের মেরে ফেলেন। এটা কি ঠিক রাণী-মা?

অবশ্যই ঠিক। পিপড়ার রাণী কখনো ভুল কাজ করতে পারে না। ভুল কাজ করার তাদের নিয়ম নেই। সব পিপড়াদের বাঁচিয়ে রাখলে অবস্থা কি হত ভেবে দেখ। পিপড়ার সংখ্যা যেত বেড়ে। এদের কোত্থেকে খাবার দিতাম? এদের বাড়ির ব্যবস্থাই বা কিভাবে করতাম? কাজেই পিপড়ার সংখ্যা বাড়ানো যাবে না।

পিপড়ার সংখ্যা বাড়ানো যাবে না, কিন্তু সৈন্যের সংখ্যা বাড়ানো যাবে। আপনার সৈন্য বাড়ছে –হুঁ হু করে বাড়ছে।

তুমি তো ভুল কথা বললে পিপলী। খুব ভুল কথা। আমার সৈন্য তো বাড়ছে। আমাদের সৈন্য বাড়ছে। ঐ সৈন্যরা, তুমি যখন বিপদে পড়বে, তখন তোমার পাশে দাঁড়াবে।

তা কিন্তু রাণী-মা দাঁড়ায় নি। আমাদের শত শত কর্মী পিপড়া কালোদের হাতে ধরা পড়ল। আমরা দল বেঁধে ছুটে গেলাম আপনার কাছে। আপনি আমাদের সঙ্গে দেখাও করেন নি।

রাণীর নিয়ম তুমি জান না পিপলী। রাণী শুধু তাকেই দেখা দেন, যাকে তিনি ডেকে পাঠান। তোমাকে আমি ডেকে পাঠিয়েছি বলেই দেখা দিয়েছি। তোমার কি আরো কিছু বলার আছে?

আছে।

বল, আমি শুনছি। আমি খুব মন দিয়ে তোমার কথা শুনছি।

আবারো কালো পিপড়াদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হচ্ছে। আপনি সৈন্য পাঠান নি। আপনি সাধারণ পিপড়াদের পাঠিয়েছেন। এরা যুদ্ধ করতে জানে না। এরা যাচ্ছে আর মারা যাচ্ছে।

মৃত্যু খুব স্বাভাবিক ব্যাপার পিপলী। সবাইকে মরতে হয়। মৃত্যু নিয়ে দুঃখ করতে নেই।

আপনার সৈন্যরা যুদ্ধ করবে না?

প্রয়োজন হলেই করবে। প্রয়োজন এখনো হয়নি। পিপলী কথা বলতে বলতে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। তুমি কি আরো কিছু খাবে?

না।

আমি কি বলি জান? আমি বলি –কিছু খেয়ে নাও।

রাণী-মা’র ইঙ্গিতে দুটি পিপড়া থালায় করে আরো খাবার নিয়ে এল। নিশা ফুলের মধু। পিপলী খুব আরাম করে খেল। এত ভাল লাগল তার। এবারো ইচ্ছা করল থালাশুদ্ধ খেয়ে ফেলতে। শুধু তাই না –তার নাচতেও ইচ্ছা করল। এই খাবারের মধ্যে কি কিছু আছে –যা খেলে এ রকম হয়? খুব আনন্দ হয়, ভয় কেটে যায়? মনের মধ্যে যেসব লুকানো কথা আছে সেসব বলে ফেলতে ইচ্ছা করে।

রাণী-মা।

বল পিপলী বেগম।

আমার গান গাইতে ইচ্ছা করছে। নাচতে ইচ্ছা করছে।

বেশ তো গান গাও। গান শুনতে আমার খুব ভাল লাগে।

পিপলী বেগম গান ধরল —

ভাল লাগছে ভাল লাগছে।
আমার বড় ভাল লাগছে।
মজা লাগছে মজা লাগছে
আমার বড় মজা লাগছে।
আনন্দ হচ্ছে আনন্দ হচ্ছে।
আমার বড় আনন্দ হচ্ছে।

রাণী মা।

বল পিপলী।

আমাদের বাড়ির খুব অভাব। মাটির অভাবে বাড়ি তৈরী হচ্ছে না। মাটি আনতে হয় অনেক দূর থেকে। পথে পথে বিপদ। শত শত পিপড়া মাটি আনতে গিয়ে মারা পড়ে রাণী-মা।

যে কোন কাজেই বিপদ আছে পিপলী।

খুব কাছেই এক জায়গায় মাটি পাওয়া গিয়েছিল রাণী-মা। অনুসন্ধানী পিপড়া খুব ভাল মাটির খোঁজ এনেছিল। বাড়ি তৈরির এত ভাল মাটি না-কি হয় না। আপনি সে মাটি পছন্দ করেন নি। আপনি চেয়েছেন –দূরের জায়গা থেকে মাটি আনতে।

হ্যাঁ, তা চেয়েছি। দূরের মাটির খুব সুন্দর গন্ধ। আমি সুঘ্রাণ পছন্দ করি।

আমার কিন্তু অন্য কথা মনে হয়। আমার কি মনে হয় জানেন রাণী-মা –আমার মনে হয় আপনি সবাইকে দূরের পথে পাঠান যাতে তারা মারা পড়ে। কারণ আপনি পিপড়ার সংখ্যা কমাতে চান।

তোমার বুদ্ধি ভাল পিপলী। আসলেই আমি পিপড়ার সংখ্যা কমাতে চাই। আমরা সংখ্যায় কম থাকলে আমাদের খাদ্যের অভাব হবে না। রাণীকে অনেক কিছু ভাবতে হয় পিপলী। অনেক কিছু।

আপনি অনেক কিছু ভাবেন না। আপনি শুধু নিজের কথাই ভাবেন।

তোমার কথা কি শেষ হয়েছে?

হয়েছে।

তুমি যখন নাচানাচি করছিলে তখন তোমার পা লাল দাগের ভেতর পড়েছিল। লাল দাগে পা পড়া কি তা তো তুমি জান পিপলী। জান না?

জানি।

যদি জান, তাহলে বল তো কি শাস্তি?

নির্বাসন।

হু, নির্বাসন। নির্বাসনের শাস্তি আগে ছিল –এখন তা বদলেছি। এখন থেকে শাস্তি হচ্ছে মৃত্যু। আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যু। আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যু।

রাণী মা আমার পা কিন্তু লাল দাগে পড়ে নি। আমি খুব সাবধান ছিলাম।

রাণীর সঙ্গে তর্ক করার শাস্তিও কিন্তু মৃত্যুদন্ড। আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যু।

এই শাস্তি কবে থেকে চালু হল রাণী-মা?

এখন থেকে। আজ থেকে তবে তোমার বয়স অল্প। এবং আমি দয়া দেখাতে ভালবাসি বলেই তোমাকে নির্বাসন দেব। আগুনে পুড়িয়ে মা’রব না। তোমার নির্বাসন হবে অন্ধকূপে। সেখানে আলো নেই, বাতাস নেই এবং খাদ্য নেই তোমার মৃত্যু হবে –তবে কিছুদিন বেঁচে থাকবে। কিছুদিন বেঁচে থাকাও তো ভাগ্যের ব্যাপার। তাই না পিপলী বেগম?

জী রাণী-মা, ভাগ্যের ব্যাপার। আপনার অসীম দয়া।

রাণী-মা’র নির্দেশে মেয়ে সৈন্যরা এসে পিপলীকে ধরে নিয়ে গেল। পিপলী অবাক হয়ে দেখল –মেয়ে সৈন্যরাও সবাই অন্ধ। তারা তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কূপের দিকে। পিপলী বেগম বলল, অন্ধ কূপে ফেলার আগে আমি কি আমার মা এবং দাদীমা’র সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?

ওরা কর্কশ গলায় বলল, না।

পিপলী বলল, আমি কোন কথা বলব না, শুধু একবার তাঁদের দেখব।

না

অনেক দূর থেকে দেখব –শুধু একবার।

না।

তারা পিপলীকে অন্ধকূপে ফেলে দিল। গহীন সেই কূপ। পিপলী পড়ছে তো পড়ছেই। মনে হচ্ছে এই কূপ কখনো শেষ হবে না। ঘড়ঘড় শব্দে কূপের মুখ পাথর-চাপা দেয়া হল। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। সেই অন্ধকার ভয়াবহ অন্ধকার। পিপলী ডাকল –মা! মাগো! কেউ তার ডাক শুনতে পেল না। সে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। দেয়ালে ঘা খেয়ে তার কান্নার শব্দ তার কাছেই ফিরে আসছে। মনে হচ্ছে অসংখ্য পিপলী বেগম এক সঙ্গে কাঁদছে।

.

গল্প এই পর্যন্ত বলে মতিন সাহেব হাই তুলে বললেন, এবার খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমুতে গেলে কেমন হয়? রাত কম হয়নি। তিন মেয়েই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল –না-না-না। নীলু বলল, পিপলী বেগমকে জেলখানায় রেখে গল্প শেষ করা যাবে না। কিছুতেই না। কিছুতেই না। কিছুতেই না।

আমাকে কি করতে হবে?

তা আমি জানি না।

বিলু বলল, বাবা রাণী-মাকে আমার এত ভাল মনে হয়েছিল, সে এখন এত খারাপ হল কি ভাবে?

তা তো আমি বলতে পারি না, মা।

তিলু বলল, ঐ দেশে রাজা নেই, বাবা?।

না। পোকা-মাকড়দের দেশে রাজা নেই বললেই হয়। মৌমাছিদের বেলাতেই দেখ। ওদের আছে রাণী মৌমাছি। রাজা মৌমাছি বলে কিছু নেই। মৌমাছিদের রাণী মহাসুখে থাকে। অন্য মৌমাছিদের কষ্ট করে নিয়ে আসা মধু চুকচুক করে খায়। অন্যরা খেটে মরে তার জন্যে।

নীলু বলল, অন্যরা খাটাখাটানি না করলেই হয়। অন্যরা কেন বলে না –তুমি পচা রাণী, আমরা তোমার কাজ করব না। করব না, করব না।

মতিন সাহেব বললেন, এরকম কিছু বললে তো হবে না। কীট-পতঙ্গের জগতে এই ধরনের কথা বলা যায় না। ওদের জগতের আইন-কানুন, খুবই কড়া। ওদের জগতের রাজা-রাণীদের আইন বড়ই কঠিন আইন।

নীলু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমাদের পিপলী বেগম যে অন্ধকূপে চলে গেল, এখন কি হবে বাবা?

দেখা যাক কি হয়।

ও কি ছাড়া পাবে?

বুঝতে পারছি না। গল্প শেষ হোক। শেষ হলে বোঝা যাবে।

মতিন সাহেব আবার শুরু করলেন –চরম বিপদে পিপড়াদের কি করতে হয় তা স্কুলে শেখানো হয়। যেমন পানিতে পড়ে গেলে কি করতে হবে, আগুনের কাছাকাছি চলে গেলে কি করতে হবে –এইসব। কিন্তু অন্ধ কূপে কাউকে আটকে ফেললে কি করতে হবে স্কুলে তা শেখানো হয় নি। কোন বই এও কিছু লেখা নেই। পিপলী বেগম অনেক উঁচু থেকে নিচে পড়েছে, কিন্তু ব্যথা পায়নি। তার কারণ সে স্কুলে বইএ পড়েছে –উঁচু থেকে হঠাৎ নিচে পড়ে গেলে কি করতে হয়। মাটির দিকে পা এবং শুড় বাড়িয়ে দিতে হয়। প্রচণ্ড চাপে পা, শুড় ভেঙে যাবে তবে ভয় পাবার কিছু নেই। শুড় ও পা সবই গজাবে। নতুন পা এবং নতুন গঁড় হবে আগের চেয়েও মজবুত।

পিপলী প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। তার শুড় ভেঙেছে কিন্তু পা ভাঙে নি। সে তীব্র ব্যথা নিয়ে এখন এগুচ্ছে অন্ধের মত। কেন এগুচ্ছে তাও জানে না। সে বুঝতে পারছে পুরো জায়গাটা পাথরের তৈরি। মাটির তৈরি হলে মাটি ফুটো করে বের হবার একটা চেষ্টা করা যেত। অবশ্যি সে চেষ্টা করলে লাভ হত না, কারণ মাটি ফুটো করার বিদ্যা সে জানে না।

পিপলীর ভয় ভয় করছে। একা থাকার ভয়। অন্ধকারের ভয়। ভয় কাটানোর জন্যে সে বলল –কেউ কি আছে?

তার নিজের কথাই দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। বার বার শব্দ হতে লাগল, কেউ কি আছে? কেউ কি আছে? কেউ কি আছে?

ভয় লাগছে। পিপলীর প্রচণ্ড ভয় লাগছে। ভয় লাগলে কি করতে হয় স্কুলে পড়িয়েছে। ভয় পেলে নিজেকে প্রশ্ন করতে হয়। কি কি প্রশ্ন করতে হয় তাও বইয়ে লেখা। সেই প্রশ্নের জবাব নিজেকেই দিতে হয়। প্রশ্নগুলির জবাব দিলেই ভয় কমে যাবার কথা। পিপলী নিজেকে প্রশ্ন করা শুরু করল।

পিপলী, তুমি কি ভয় পাচ্ছ?

হ্যাঁ।

খুব বেশি ভয় পাচ্ছ?

হ্যাঁ।

কেন ভয় পাচ্ছ, পিপলী?

কারণ জায়গাটা খুব অন্ধকার।

তুমি যে ভয় পাচ্ছ তাতে কি কোন লাভ হচ্ছে –অন্ধকার কমে যাচ্ছে?

না।

তাহলে ভয় পাচ্ছ কেন? ভয়ে তোমার কোন লাভ হচ্ছে না। বরং ক্ষতি হচ্ছে। কাজেই ভয় দূর কর। যা করছিলে কর। তুমি এখন কি করছ?

হাঁটছি।

তাহলে হাঁটতে থাক। তুমি কি গান জান?

জানি।

গান গাইতে গাইতে হাঁট।

পিপলী গান ধরল —

এসো ভাই, গান গাই
গান গেয়ে মজা পাই

গান গাইতে গাইতে পিপলী এগুচ্ছে –হঠাৎ ধমকের শব্দে সে চমকে উঠল —-কে গান গায়?

পিপলী থমকে দাঁড়াল। ভীত গলায় বলল, আমি।

আমি কোন পরিচয় নয়। আমার নাম পিপলী বেগম।

তুমি মেয়ে পিপড়া?

হ্যাঁ

এসো পিপলী, এসো। আজ আমাদের বড়ই আনন্দের দিন। আজ আমাদের হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ হল। এতদিনের প্রতিক্ষার অবসান হল।

আমি কিছুই বুঝতে পরাছি না। আপনি কে?

আমার নাম অরং। আমি অতি বৃদ্ধ এক পিলিলিকা। রাণী-মা তোমাকে যেমন নির্বাসন দিয়েছেন, আমাকেও দিয়েছেন। আমার মত হাজার হাজার পিপড়াকেও দিয়েছেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আমরা অপেক্ষা করেছি একটি মেয়ে পিপড়ার জন্যে। আজ তোমাকে পাওয়া গেল। কি আনন্দ! কি আনন্দ।

পিপলী অন্ধকারে কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু টের পাচ্ছে এই বুড়ো পিপড়া যার নাম অরং, সে আনন্দে লাফাচ্ছে। হাততালি দিচ্ছে। অরং কি পাগল? পাগল হবারই কথা। দীর্ঘদিন অন্ধ কূপে থেকে থেকে মাথা খারাপ হয়েছে। পিপলী ক্ষীণ গলায় ডাকল –বৃদ্ধ অরং।

কি গো মা!

আপনি এমন লাফালাফি করছেন কেন?

খুব আনন্দ হচ্ছে তো মা –তাই লাফালাফি করছি।

আপনি পাগল হয়ে যাননি তো?

হতেও পারি। হয়ত আনন্দে পাগল হয়ে গেছি। তুমি সত্যি পিপলী বেগম তো? আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?

না, আপনি স্বপ্ন দেখছেন না। আপনি দয়া করে আমার হাত ধরুন। হাত ধরে নিয়ে চলুন। আমার ভীষণ ভয় লাগছে।

অরং এসে হাত ধরল।

তারা হাঁটতে শুরু করল। মাঝে মাঝে বৃদ্ধ অরং পিপলীর হাত ছেড়ে দিয়ে খানিকক্ষণ নাচানাচি করে নেয়। বিকট শব্দে চিৎকার করে। পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে। পিপলী বেগম চলে এসেছে। তারপর আবার হাঁটা শুরু করে। তারা নানান সুরঙ্গ পার হল। পথ যেন শেষ হতেই চায় না। হাঁটতে হাঁটতে তারা এক সময় সুরঙ্গ ছেড়ে একটা খালি ময়দানে এসে পড়ল। সেখানে হাজার হাজার পিপড়া অপেক্ষা করছে। পিপড়াগুলিকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু এদের নিঃশ্বাসের শব্দ পিপলী শুনতে পাচ্ছে।

বৃদ্ধ অরং চেঁচিয়ে বলল, সুসংবাদ। সবার জন্যে সুসংবাদ। বড়ই সুসংবাদ। আমরা পেয়ে গেছি পিপলী বেগমকে। এতদিন যার জন্যে আমরা অপেক্ষা করছিলাম, তাকে আমরা পেয়ে গেছি। সবাই হাততালি দিন।

তুমুল হাততালি হল। শুধু হাততালি না –সবাই একসঙ্গে লাফাতে লাগল। পিপলী কিছুই বুঝতে পারল না। সে অরংকে কানে কানে বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এসব কি হচ্ছে?

বুঝবে, কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝবে। তোমাকে সব বুঝিয়ে দেয়া হবে। আমরা এতদিন তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম —পেয়ে গেছি। আমরা পেয়ে গেছি।

সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, পেয়ে গেছি। আমরা পেয়ে গেছি।

তাদের লাফালাফি, হৈচৈ আর থামতেই চায় না। এক সময় তারা বৃদ্ধ অরং এবং পিপলীকে কাঁধে তুলে নাচতে লাগল। এবং বিকট স্বরে চেঁচাতে লাগল –পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে। পিপলী আবারো ফিসফিস করে বৃদ্ধ অরংকে বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

বৃদ্ধ অরং বলল, আমাদের পিপলী বেগম কিছুই বুঝতে পারছে না। এখন তাকে আমরা সব বুঝিয়ে দেব। আপনারা হৈচৈ বন্ধ করুন।

হৈচৈ থেমে গেল।

বৃদ্ধ অরং বলল, পিপলী বেগম, তুমি খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনবে। শুধু শুনলে হবে না। কথা শুনবে এবং সেই সঙ্গে বুদ্ধি দিয়ে জ্ঞান দিয়ে বিচার করবে।

পৃথিবীতে অসংখ্য পিপীলিকা গোত্র আছে। সব গোত্রেরই রাণী আছে। আমাদের গোত্রেরও আছে। আমাদের রাণীদের সঙ্গে অন্য রাণীদের কিছু অমিল আছে। অমিলগুলি মন দিয়ে শোন —

এই রাণী মা, আমাদের কোন খাবার খান না। যত ভাল খাবারই হোক তিনি পুরোটা ফিরিয়ে দেন। ঠিক না?

ঠিক ঠিক।

সব গোত্রের পিপীলিকা রাণী থাকেন পিপীলিকাদের মাঝখানে। তিনি থাকেন, মাঝখানে তাঁকে ঘিরে থাকে অন্যরা। তিনি কখনোই আলাদা থাকেন না। আমাদের রাণীমা থাকেন আলাদা। অনেক আলাদা। ঠিক কিনা বল তো পিপলী?

ঠিক ঠিক?

সব গোত্রের রাণী-মা’র কাছে যাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের রাণী-মা’র কাছে যাওয়া যায় না। তিনি থাকেন লাল দাগের ভেতরে। সেই লাল দাগের ভেতরে কেউ গেলে সঙ্গে সঙ্গে নির্বাসন। কেন বল তো পিপলী বেগম?

আমি জানি না।

চিন্তা কর।

চিন্তা করে কিছু পাচ্ছি না।

রাণী-মা লাল দাগ দিয়ে রেখেছেন যাতে কেউ তাঁর কাছে যেতে না পারে। তিনি সাধারণত কাউকে দেখা দেন না। তবু যদি ভুলে কেউ দেখে ফেলে সে জন্যেই এই সতর্কতা। কারণ কেউ ভালমত তাকালেই বুঝে ফেলবে আমাদের রাণী-মা আসলে অন্ধ।

রাণী মা অন্ধ।

হ্যাঁ অন্ধ। আমাদের রাণী মা জন্মান্ধ।

সে কি!

শুধু রাণী-মাই না, রাণী-মা’র প্রাসাদে যারা থাকে তারাও অন্ধ। যে মেয়েসৈন্যরা রাণী-মাকে ঘিরে থাকে তারাও অন্ধ।

হ্যাঁ তাই তো!

এখন বল, এই পৃথিবীতে কোন্ প্রজাতি জন্মান্ধ?

উই পোকা।

এখন বল পিপলী বেগম –রাণী মা কি তোমাকে কোন খাবার দিয়েছিলেন?

হু। নিশা ফুলের মধু।

পিপীলিকার কি খাদ্য তা স্কুলে পড়ানো হয়? হয় না!

হয়।

সেখানে নিশা ফুলের মধু নামের কোন খাবারের নাম পড়েছ?

না।

এই খাবার কাদের খাবার জান?

জানি না।

এটা হচ্ছে উই পোকাদের খাবার।

উইপোকাদের খাবার?

হ্যাঁ। ওরা এই খাবার সংগ্রহ করে। খায়। খেয়ে নাচানাচি করে।

এখন কি বুঝতে পারছ আমাদের রাণী-মা আসলে একটি জন্মান্ধ উইপোকা? এই জন্যে তিনি আমাদের খাবার খান না।

বুঝতে পারছি।

কি ভয়ংকর ঘটনা! তাই না পিপলী?

হ্যাঁ, তাই এতবড় একটা ঘটনা অথচ কেউ বুঝতে পারল না কেন?

পারবে না কেন? পেরেছে। অনেকেই বুঝতে পেরেছে। অনেকেই অনুমান করেছে। তবে যারাই অনুমান করেছে –তাদেরই জায়গা হয়েছে এই অন্ধকূপে।

পিপলী হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তার হতভম্ব ভাব কাটতে সময় লাগল। সে বলল, একটা উইপোকা কি করে আমাদের রাণী হয়ে বসল?

অরং দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মাঝে মাঝে পিপীলিকা গোত্রে এরকম হয়। উইপোকা এসে পিপড়ার রাণীকে মেরে তার জায়গা দখল করে নেয়। কাজটা তারা এমনভাবে করে যেন কেউ কিছু বুঝতে না পারে। জন্মান্ধ উইপোকা অসম্ভব ধূর্ত। তবে আমরা এখন তাকে উচিত শিক্ষা দেব।

কিভাবে?

সেটা তুমি ঠিক করবে। তুমি যেভাবে শিক্ষা দিতে চাও! সেই ভাবেই শিক্ষা দেয়া হবে। হুকুম দিতে হবে তোমাকে।

পিপলী অবাক হয়ে বলল, আমাকে কেন?

তুমি একটা বড় ব্যাপার এখনো ধরতে পারছ না। পিপীলিকা গোত্রের একটা প্রধান নিয়ম হল রাণীর হুকুম ছাড়া তারা কিছু করতে পারে না। তাদের কিছু করতে হলে রাণীর হুকুম লাগে।

আমরা এই অন্ধকূপে দীর্ঘদিন পড়ে আছি। এই জায়গাটা পাথরের তৈরী। কিন্তু আমরা খুঁজে খুঁজে এমন একটা জায়গা বের করেছি যা মাটির তৈরি। আমাদের কর্মী পিপড়ারা অল্প কিছুদিন পরিশ্রম করলেই এই মাটিতে সুরঙ্গ তৈরী করে ফেলতে পারবে। কিন্তু তারা তা করবে না –যতদিন পর্যন্ত না রাণী হুকুম দিচ্ছেন। এখন পিপলী বেগম, তুমি হবে আমাদের রাণী। তুমি আমাদের হুকুম দেবে।

আমিই রাণী?

হ্যাঁ, তুমি রাণী। এখানে আমরা যারা আছি তারা সবাই পুরুষ। পিপীলিকা গোত্র পুরুষের হুকুমে চলে না। তাদের রাণীর হুকুম লাগে। এখন তুমি আমাদের রাণী। তুমি হুকুম দেবে, আমরা কাজ শুরু করব।

আপনারা মুখে বললেই আমি রাণী হয়ে যাব?

এ ছাড়া আর উপায় কি?

বৃদ্ধ অরং একটুক্ষণ থেমে বলল –পিপলী বেগম এখন থেকে আমাদের রাণীমা। রাণীর কল্যাণ হোক! মঙ্গল হোক!

সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে বলল, রাণী-মা’র কল্যাণ হোক। মঙ্গল হোক। পিপীলিকা গোত্রের মহান রাণী –আমরা আপনার হুকুমের অপেক্ষা করছি।

পিপলী বলল, হুকুম দেবার আগে আমি জানতে চাচ্ছি এই যে দীর্ঘদিন আপনারা বেঁচে আছেন, কিভাবে বেঁচে আছেন। খাদ্য পেয়েছেন কোথায়?

বৃদ্ধ অরং বলল, সেই দুঃখের কাহিনী আপনার না শোনাই ভাল রাণী-মা। আমাদের মধ্যে যারা মারা গেছেন –তাদেরকে আমরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছি। এ ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না। আমরা জানি পিপীলিকা গোত্রের কাছে আমরা অপরাধ করেছি। অপরাধের যে শাস্তি আপনি দেবেন সেই শাস্তিই আমরা মাথা পেতে নেব।

পিপলী বলল, আপনারা অপরাধ করেছেন। বিশেষ ভয়ংকর পরিস্থিতির কারণে অপরাধ করেছেন বলেই আমি তা ক্ষমা করলাম। এখন আপনাদের মধ্যে যারা কর্মী তাঁরা সুরঙ্গ খোঁড়ার কাজে লেগে যান। যারা কর্মী নন তারাও সুরঙ্গ খোঁড়ার কাজে সাহায্য করবেন।

সুরঙ্গ খোঁড়া শেষ হবার পর আমরা কি করব রাণী-মা?

তা ঠিক করা হবে যখন আমরা অন্ধকূপ থেকে বের হব, তখন। আপনারা কাজে লেগে পড়ুন। শুধু বৃদ্ধ অরং থাকবেন আমার পাশে। আর সবাই কাজে যাবেন।

সব পিপড়া একসঙ্গে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বৃদ্ধ অরং রইল পিপলী বেগমের কাছে। পিপলী ফিসফিস করে বলল, সুরঙ্গ খোঁড়া শেষ হলে আমরা কি করব?

অরং বলল, তা তো রাণী-মা আপনাকেই ঠিক করতে হবে।

আপনি আমাকে বুদ্ধি দেবেন না?

পিপীলিকা গোত্রে রাণীকে বুদ্ধি দেবার নিয়ম নেই।

শুনুন, বৃদ্ধ অরং আমি সব পুরানো নিয়ম-কানুন ভাঙব। আমি করব নতুন নতুন নিয়ম। আমার নতুন নিয়মে আপনি বা আপনার মত যারা জ্ঞানী তারা আমাকে বুদ্ধি দিতে পারবেন। এখন আমাকে বুদ্ধি দিন।

বৃদ্ধ অরং বলল, উইপোকা রাণীকে খুব সহজেই সরানো যাবে। জন্মান্ধ উইপোকা আলো সহ্য করতে পারে না। আমরা এমনভাবে মাটি ফুটো করব যেন আলো গিয়ে পড়ে উইপোকা রাণীর প্রাসাদে। এতেই কাজ হবে।

এ ছাড়া আর কোন বুদ্ধি কি আপনার আছে?

আমরা মাটি ফুটো করে সরাসরি উইপোকা-রাণীর প্রাসাদে চলে যেতে পারি। তখন আমাদের যুদ্ধ করতে হবে রাণীর নারী সৈন্যদের সাথে। সেইসব সৈন্যদের সবাই অন্ধ। কাজেই আমাদের যুদ্ধে জেতার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাছাড়া একবার সত্য প্রকাশ হয়ে পড়লে পিপীলিকা সৈন্যরা আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।

মাটি কেটে সুরঙ্গ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। বিপুল উৎসাহে সবাই মাটি কাটছে। নতুন রাণী পিপলী বেগম এগিয়ে গেল। শান্ত গলায় বলল, আমিও মাটি কাটব। আমাকে দেখিয়ে দিন কিভাবে মাটি কাটতে হয়।

অরং অবাক হয়ে বলল, আপনি হচ্ছেন সবার রাণী-মা। আপনি সুরঙ্গ কাটবেন তা-কি করে হয়?

সবাই কাজ করবে, আমি বসে বসে দেখব তা হয় না। তাছাড়া আমি তো আপনাদের বলেছি –আমার রাজত্বের নিয়ম-কানুন আলাদা। আজ থেকে নতুন নিয়ম –কেউ বসে থাকতে পারবে না। সবাইকে কাজ করতে হবে।

.

সুরঙ্গ কাটা হয়েছে। আলো এসে পড়েছে অন্ধকূপে। দলে দলে পিপড়া বের হয়ে আসছে। সবার সামনে আছে নতুন রাণী পিপলী বেগম। নতুন রাণীর মুখ হাসি-হাসি হলেও চোখ দুটি বিষণ্ণ। তার সামনে অনেক সমস্যা, অনেক দায়িত্ব। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে এক বিশাল গোত্রের রাণী। তার চোখ বিষণ্নতো হবেই।

.

মতিন সাহেব হাই তুলে বললেন –গল্প শেষ। মায়েরা, চল ভাত খাই। খাবার পর সবাই ঘুমুতে যাও। তিলু বিলু খাবার টেবিলে চলে গেল। শুধু নীলু গম্ভীর মুখে বসে রইল। মতিন সাহেব বললেন, কি হল মা? তুমি এমন কঠিন মুখ করে বসে আছ কেন? নীলু রাগী গলায় বলল, বাবা, গল্প মোটেও শেষ হয়নি। তুমি শেষটা এখনো বলনি। শেষটা না বললে আমি ঘুমুতে যাব না।

মতিন সাহেব বললেন, শেষটা কি মা?

শেষটায় নতুন রাণী পিপলী বেগম, উইপোকা রাণীকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে।

আচ্ছা বেশ, তাড়িয়ে দিল। তারপর?

তারপর পিপলী বেগম বলবে –এখন থেকে পিপড়াদের আর স্কুলে যেতে হবে না।

সে কি?

ওদের স্কুলের কোন দরকার নেই, বাবা। ওদের স্কুল ভাল লাগে না।

তোমার স্কুল ভাল লাগে না বলে ওদেরও ভাল লাগবে না, তা তো না। ওদের স্কুল খুবই ভাল লাগে।

না বাবা, তুমি জান না ওদের স্কুল ভাল লাগে না।

আচ্ছা বেশ, ওদের স্কুল ভাল লাগে না।

পিপলী বেগম বলবে –আজ থেকে স্কুল নেই, পড়াশোনা নেই। সবাই শুধু আনন্দ করবে। হৈচৈ করবে।

ঠিক আছে করবে।

আর পিপলী বেগম বলবে, এখন থেকে দেশে কোন সৈন্য থাকবে না।

তা কি করে হয় মা? সৈন্য ছাড়া ওদের চলবে কি করে?

ওদের সৈন্য ভাল লাগে না, বাবা। ওরা সৈন্যকে ভয় করে।

তুমি ভয় কর। কিন্তু তাই বলে ওরা কেন ভয় করবে।

না, ওরাও করে।

আচ্ছা বেশ, ওরাও করে। এখন খেতে চল মা যাও মা।

রাতের খাবার শেষ করে নীলু বাবার গলা জড়িয়ে ঘুমুতে গেল। এবং এক সময় ঘুম-ঘুম গলায় বাবার কানে কানে বলল, বাবা, আমার খুব পিপলী বেগম হতে ইচ্ছা করছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত