ত্রিকোণ প্রেম অথবা প্রেমের ত্রিভুজ গড়ে ওঠা প্রায়শই ঘটে যাওয়া, নিতান্তই স্বাভাবিক ঘটনা। তাই আমরা, মানে আমি, প্রদীপ্ত, সুষমা, রাধাপ্রসাদ, বনানী সকলেই বিক্রম, অভিজিৎ ও শর্বরীর একত্রিত প্রীতি-মধুর ঘনিষ্ঠতায় বিস্মিত বা উদ্বিগ্ন ছিলাম না। ইউনিভার্সিটির দিনগুলোতে, কোনও সমস্যার উদ্রেকও হয়নি। বিক্রম একবছরের সিনিয়র, শর্বরী ও অভিজিৎ আমাদের সহপাঠী। বিক্রম ও আমি আবার একই পাড়ায় থাকি, সেই সূত্রে বাল্যবন্ধু। তাই বিক্রমের সঙ্গে আমার একটা সহজ সখ্যতার সম্পর্ক ছিল। আবার, দীর্ঘ পাঁচ বছর, একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে, অভিজিতের সঙ্গেও আমার গভীর বন্ধুত্ব ছিল। উভয়েই তাদের শর্বরী সংক্রান্ত মনোভাবনা নির্দ্বিধায় আমার কাছে খোলাখুলি ব্যক্ত করত। প্রেমের লুকোচুরি খেলার আবেগঘন প্রেক্ষাপটে, যে সমস্ত ভাল লাগার ফুল ঝুরঝুরিয়ে ঝরে বিক্রম ও অভিজিতের মনের জমি ভরিয়ে তুলেছিল, সে সমস্ত ফুলের সৌন্দর্য ও সুবাস তাদের উভয়ের মাধ্যমে আমারও সুপরিচিত ছিল।
বিক্রম আমাদের এক বছর আগেই পাশ করে বেরোল, ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে। ভাল রেজাল্টের জন্যই তোক বা তদ্বিরের খাতিরেই হোক অথবা ভাগ্যের দাক্ষিণ্যেই হোক, সরকারি মহাবিদ্যলয়ের এক অধ্যাপকের পদ অলঙ্কৃত করে ফেলল। অভিজিতের পাশ করে বেরোবার আগেই। তখন আমি শুধু বিক্ৰমরে বন্ধু নই, তার ব্যক্তিগত উপদেষ্টাও বটে। তাই, বিক্রম যখন আমাকে জিজ্ঞেস করল, দেখ তিমির, শর্বরীকে কি এখন বিয়ের কথা বলব? তুই কী বলিস?
ভেবে-চিন্তে, সুপরামর্শই দিলাম, আঘাত তো একজনকে পেতেই হবে। শর্বরীকে প্রস্তাবনা দিতে, এই-ই প্রশস্ত সময়। অভিজিৎ তখনও ছাত্র। বিক্রম যদি ধৈর্য ধরে বসে থাকে, কবে শর্বরী তার দিকে নিশ্চিতভাবে হেলবে, তবে ভুল করবে। শর্বরী, বিক্রম ও অভিজিৎকে দুপাশে নিয়ে, সোজা পথে হেঁটে চলেছে। যে আগে হাত ধরে কাছে টানবে, জিত তারই। বিক্রম এখন প্রতিষ্ঠিত ও পরিচয়যোগ্য ব্যক্তি। বেচারি অভিজিৎ। এখন সহজেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে যাবে। কিন্তু অভিজিৎ নিজের। পায়ে দাঁড়িয়ে গেলে, পরিস্থিতি কী হবে বলা মুস্কিল।
বিক্রম ও শর্বরীর মধ্যে পারস্পরিক কি ধরনের বাক্য বিনিময় হয়েছিল, ট্রফি জিতে যাওয়ার পর, বিক্রম তা আর আমাকে জানায়নি। আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার পরপরই আমরা সকলে অভিজিৎ শুদ্ধ বিক্রম শর্বরীর বিয়েতে নেমন্তন্ন খেয়ে এলাম।
পরবর্তী এক বছরের ইতিহাসে, বিক্রমের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের ভাঁটা পড়ল, জোয়ারে ভেসে এল অভিজিৎ কারণ অভিজিৎ তখন উত্তীয়ের ভূমিকায়, ব্যর্থ প্রেমিক। এবং বিজয়ী বিক্রম বীর বিক্রমে পার্শ্ববর্তিনী শর্বরী সমভিব্যাহারে সারা কলকাতা বিনোদবিহার করে বেড়াচ্ছে। আমার সঙ্গে দেখা করার ফুরসৎ মিলছে না তার। বিক্রমের অবস্থা যেন গগনবিহারী পক্ষীরাজ। বন্ধুদের কথা সে সম্পূর্ণ বিস্মৃত। আমি তখন ক্রমে ক্রমে অভিজিতের ব্যক্তিগত পরামর্শদাতা হয়ে উঠছি। প্রথমদিকে অভিজিৎকে সান্ত্বনা দিয়ে, শর্বরীর কথা ভুলে যেতে পরামর্শ দিতাম। কিন্তু তাতে দেখি, বেচারা বেশি মনমরা হয়ে পড়ছে। বরং শর্বরীর সঙ্গে তার প্রাক্ মেলামেশার ইতিহাসে, সে আমার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করে আনন্দ পায়। ইতিমধ্যে শর্বরী তার বিবাহবৎসর পূর্তি উপলক্ষে প্রাক্তন ঘনিষ্ঠ সহপাঠীদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানালে অভিজিৎ আমার কাছে উপদেশ নিতে এল, তার পক্ষে শর্বরীর বাড়ি যাওয়াটা শাভঙ্গ হবে, না কি না যাওয়াটা দৃষ্টিকটু হবে? আমার মনে হল, নিমন্ত্রণ রক্ষা করাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। বললাম, শর্বরীর সঙ্গে তুই পুরনো বন্ধুর মত সহজ হয়ে যা।
.
অতএব, যাওয়া হল। শর্বরীর ব্যাঙ্ক থেকে যে নতুন ঝকমকে ফ্ল্যাট ভাড়া করে দিয়েছে, আমরা সেখানেই পৌঁছে গেলাম। হাসি-হুল্লোড়ে সান্ধ্য মজলিস যখন সরগরম এবং নিমন্ত্রিরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্যালি জাহিরে ব্যস্ত, আমি সেই ফাঁকে খুঁটিয়ে শর্বরীকে লক্ষে রাখলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, শর্বরী সমস্ত অতিথিদের মধ্যে, অবশ্যই অভিজিতের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছে। আমার অনুমান যে নির্ভুল, তা বিদায় মুহূর্তে অভিজিতের উদ্ভাসিত মুখ দেখে সুনিশ্চিত হওয়া গেল। শর্বরীকে আমি মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম। শর্বরী, অভিজিৎ সম্পর্কে নির্দয় ও নির্দায় হতে চায়নি। প্রাক্তন প্রীতির মর্যাদা দেওয়ার মতন উৎসুক উদার নরম মন তার রয়েছে।
যাই-ই হোক, শুরু হল দ্বিতীয় অঙ্ক। বিক্রমকে বদলি হয়ে যেতে হল মফঃস্বল কলেজে। শর্বরী ব্যঙ্কের চাকরি ছাড়তে চাইল না। কলেজে ছুটিছাটা প্রচুর। মফঃস্বল কলেজে আবার স্ন্যাক-সেশনে, দুটো অফ ডে। পুজো ও গ্রীষ্মবকাশ বাদ দিলেও, ছাত্র ধর্মঘট, অধ্যক্ষ ঘেরাও, অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ, পরীক্ষার খাতা ছিঁড়ে-খুঁড়ে ছাত্রছাত্রীদের হল ছেড়ে বেরিয়ে আসা, ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে নন-টিচিং স্টাফের হরতাল ইত্যাদি অনুষঙ্গের কারণে, কলেজে ক্লাস নেওয়ার হাত থেকে প্রায়ই অব্যাহতি মেলে। তাই কর্মস্থলে স্টাফমেসে থাকলেও, সেখান থেকে কলকাতা যাতায়াত, বিক্রমের পক্ষে এমন কিছু অনিয়মিত ব্যাপার ছিল না। তবে, শর্বরীকে সঙ্গদান করতে, বিক্রমের আগ্রহের অভাব ঘটেছিল কিনা, তা জানবার সুযোগ আমার না হলেও, এটুকু কানে এল যে, বিক্রমের অনুপস্থিতির দিনগুলো শর্বরীকে নিঃসঙ্গ বোধ করতে হয় না। কারণ অভিজিৎ তখন শর্বরীকে নিয়মিত সঙ্গদান করে।
মফঃস্বলে বদলি হওয়ার পর, বিক্রমের সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার অবকাশ মেলেনি। অভিজিৎও, শর্বরীকে নিয়ে বিশেষ ব্যস্ত থাকায়, আমাকে স্মরণ করেনি। আমি নিজেও তখন বনানীকে খোলাখুলি প্রেম নিবেদনে কৃতকার্য হতে পারিনি। ‘বলি বলি করি-বলিতে না-পারি’ এই ধরনের মানসিক দ্বন্দ্বে হাবুডুবু খাচ্ছি। ভদ্রসম্মত চাকরি একটা জুটলেও, সেটি ছিল সম্পূর্ণ অস্থায়ী। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাঠে, বনানীর মুখোমুখি বসে চীনেবাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে রোজই মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছি, ঝপ করে বলেই ফেলি, ঘর বাঁধলে কেমন হয়? কিন্তু হিম্মতে কুলোচ্ছে না। কয়েক মাস কেটেই গেল, বিক্রম, শর্বরী অভিজিৎ কারো খবর পাই না।
আচমকা এক সন্ধ্যায় বিক্রম ‘জরুরি কথা আছে’ইও বলে, বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গেল। দুজনে পাশাপাশি হেঁটে চলেছি, বিক্রম বলছে না কিছুই। আমিও তাড়া মারছি। একটা ট্যাক্সি ডেকে ওঠাল। আমরা আকাশবাণী ভবন ছাড়িয়ে, খানিক এগিয়ে, ট্যাক্সি ছেড়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পদচারণা পর, গঙ্গার ধারে বসা গেল। সিগারেটের পর সিগারেট ধ্বংস করে, পরোক্ষে আমাকে দূষিত বিষিত করে, মিনিট পাঁচেক অস্ফুট বাক্যালাপের প্রয়াসের পর, মিনিট দুয়েক বিরতি। অবশেষে, নিষ্কম্প সুস্পষ্ট অথচ অনুচ্চস্বরে, বিক্রম ঘোষণা করল, শর্বরীর অনুমতিক্রমে সে ডিভোর্স চায়।
আমি কী বলব, বা আদৌ কিছু বলা উচিত হবে কি না, বুঝে উঠতেই পারলাম। এরপর সে প্রেম ও বিবাহ সম্পর্কিত একটি সারগর্ভ নাতিদীর্ঘ ভাষণ সমাপনান্তে, যে উপসংহারে উপনীত হল, তা হল এইরকম : শর্বরীকে সে ভালবাসে। কিন্তু বর্তমানে শর্বরী, বিক্রমের মধ্যে ভালবাসা বা সুখ খুঁজে পাচ্ছে না। তখন, যার চোখের চাওয়ার শর্বরীর মনে দোলা লাগে, সে হল অভিজিৎ। শর্বরীর হৃদয়ের নিভৃতিতে বর্তমানে যে ঠাই নিয়েছে, সে হল অভিজিৎ।
বিক্রম মনে করেছিল, তার জীবনের প্রতিটি দিন শর্বরীর নিচ্ছিদ্র ভালবাসায় উদ্বেল হয়ে উঠবে। প্রতিটি রাত্রি মধুর হতে মধুরতর হবে শর্বরীর সুখ-সান্নিধ্যে। প্রতিটি আকাক্ষিত মুহূর্ত উপভোগ্য হয়ে উঠবে, দ্বৈত কামনায়। প্রতিটি দুঃখের ক্ষণ গরীয়ান হয়ে উঠবে, মিলিত অপাতে। বিক্রমের এবম্বিধ প্রেম-পরিণয়-পরিক্রমার রাবীন্দ্রিক বৃিত্রি পর, আমার বক্তব্য বাহুল্যই ছিল, তবু, একেবারে নীরব থাকলে, বিক্রম মনে করতে পারে, আমার উদাসীন এবং তার সমস্যায় অংশ নিতে অনাগ্রাহী।
তাই প্রকৃত শুভানুধ্যায়ী হিসাবে প্রশ্ন রাখলাম, শর্বরীর সঙ্গে কথা বলব? কখনই নয়, সার্টেনলি নট।
পরিবার-পরিকল্পনার যুগে, সন্তান-সন্ততির ঝুট-থামেলা না থাকায়, বিবাহবিচ্ছেদে কোনওরকম অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির উদ্ভব হল না। অতএব বছর দেড়েকের মাথায়, আইনের পথ অনুসরণ করে, উভয়ের সম্মতি ও সমর্থনে বিক্রমের বিদায় পর্ব মসৃণ ও সরলপথে সঙঘটিত হল। রঙ্গমঞে অভিজিতের প্রবেশ পূর্বক শর্বরীর দ্বিতীয় বিবাহ অনুষ্ঠিত হল রেজিস্ট্রি অফিসে।
এখন, বিক্রম তার কর্মস্থলে। শর্বরী-বিক্রমের পুরান ফ্ল্যাটে, নতুন সংসার পাতল অভিজিৎ। আমরা ক’জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধব সাধারণ বুদ্ধিতে ধরেই নিয়েছিলাম পিতৃমাতৃহীন বাধাবন্ধ হারা বিক্রম বুঝি বা আর কলকাতামুখো হবে না। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটল না। সুখী ও জয়ী অভিজিৎ মহান ঔদার্যে বিক্রমকে সপ্তাহান্তিক অবকাশযাপনের সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখল। এবং বিষম বিস্ময়ের বিষয়, বিক্রম আমন্ত্রণ রক্ষা করতে কুণ্ঠিত হল না। আমরাও সকৌতুক সিদ্ধান্তে এলাম, বেতাল পঞ্চবিংশতি কাহিনী অনুসরণে, বিক্রম ও অভিজিতের মধ্যে কে মহত্তর তারই মহড়া চলছে।
এরমধ্যে আমার ও বনানীর বিয়েতে শর্বরী-অভিজিৎ-বিক্রম তিনজনে জোটবেঁধে নেমন্তন্ন খেয়ে গেছে। আর, শরৎ-সমগ্র উপহার দিয়েছে, একসঙ্গে তিনজনের নাম লিখে। পূর্বরাগ অধ্যায়ে, আমার ও বনানীর সান্ধবিহার বাঁধা ছিল। এখন, আর তার প্রয়োজন বোধ করি না। বনানী স্কুলে পড়াচ্ছে, সেই আগে বাড়ি ফেরে। আমার অফিস ছুটি ছটায়। শনিবার পুরো বন্ধ। কোনও সন্ধ্যাতেই আর যৌথ বিহারের সময় হয় না। শনি রবি আলসেমি আসে। টিভিতে সিনেমা দেখি।
সে শনিবার ছিল ‘শ্যামলী’—উত্তম-কাবেরী। আমরা দুজনেই একাগ্র। উত্তমকুমার তো কানীর প্রাণপ্রতিম এবং দীর্ঘাঙ্গিনী সুঠাম সুডৌল কাবেরীকে আমি বিভিন্ন কোণ থেকে মনে মনে মেপেজুপে নিচ্ছিলাম। উত্তমকুমারের একটি আকর্ষণীয় ফোটো বুকে জড়িয়ে কাবেরী বসু অবিরাম অশ্রুপাত করছে। আমি তখন বিমোহিত হয়ে কাবেরীর মূক অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেই, বনানীর মন্তব্য করে উঠল উত্তম কুমারের অমন অনবদ্য একখানি ছবি বুকে নিয়ে, যে কোনও মেয়েই আবেগে অশ্রুমতি হবে, কষ্ট করে চোখে জল আনার অভিনয় করতে হয় না। দু’জনে হেসে উঠতেই ডোরবেল বাজল।
খুলেই দেখি। ত্রিমূর্তি শর্বরী-অভিজিৎ ও বিক্রম প্রেমের ত্রিকোণমিত্রি এমন চলমান বিজ্ঞাপনে, আমি ও বনানী সসংকোচ হাস্যে সকুণ্ঠ অভ্যর্থনা জানালাম। বনানীর কথা জানি না, আমার তো বিক্রমের ওপরই রাগ হল। এ আবার কেমনতর আত্মত্যাগের পরাকাষ্ঠা। শর্বরীকে ছাড়তেই যদি পারবি না, তবে বিবাহ-বিচ্ছেদের ভড়ং–এর কি দরকার?
বিক্রম ঘরে ঢুকেই টিভি বন্ধ করে দিল। বনানী চটে গেল, উত্তমকুমারকে চোখে হারাতে হল বলে। আমিও কাব্রেীকে হারিয়ে, মনে মনে নিঃশ্বাস ফেললাম। হাসি-গল্প-চা-চানাচুর-রসগোল্লা শেষ হতে, দম্পতিটি অর্থাৎ শর্বরী-অভিজিৎ, শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিল। বিক্রম একা হতেই আমি আর বনানী ভয়ানক অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। বনানী পরিস্থিতি খানিক সহনীয় করতে বলে উঠল, বিক্রমদা আজ থেকেই যান। বিন্দুমাত্র আপত্তি না তুলে, বিন্দুমাত্র আপত্তি না তুলে, বিক্রম সংক্ষেপে ‘আচ্ছা’ বলে সিগারেট ধরাল।
বনানী রান্নাঘরে উঠে গেলে, বিক্রমের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছিস?
খুব ভাল, চমৎকার।
শর্বরীর জন্য মন খারাপ হয়?
একেবারেই না, প্রতিদিন তো দেখা হয়।
বিষম খেলাম আমি, প্রতিদিন।
হ্যাঁ, শর্বরী ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে বাড়ি তো যায় না। সেই ইউনিভার্সিটির চনমনে দিনগুলোর মতন, আমরা কখনও গঙ্গার ধার, কখনও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কখনও একাডেমি অফ ফাইন আর্টস, এইসব করি আর কি! স্তম্ভিত আমার বাক্যস্ফূর্তি হয় না।
পরদিন অভিজিৎ আমার অফিসে এল। চিন্তিতমুখে বলল, বিশেষ পরামর্শ রয়েছে, তোর সময় হবে? নিশ্চয়ই হবে। অভিজিতের এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। মিনিট দশেক কাটল, অভিজিৎ মুখ খোলে না। আমি সদয় হলাম। নিজের থেকে যে কথা বলতে ও দ্বিধান্বিত, আমাকেই তা শুরু করিয়ে দিতে হবে। বলেই ফেললাম ‘শোন অভিজিৎ, বিক্রম যদি আবার শর্বরীকে বিয়ে করতে চায়, সেটুকু মেনে নেওয়ার মতন আধুনিক মন তার নিশ্চয় রয়েছে।‘
‘শুধু আধুনিক নয়, সর্বাধুনিক মন রয়েছে আমার। কিন্তু বিক্রমদা তো শর্বরীকে বিয়ে করবে না। ওর কাছ থেকেই তো আসছি। এখন তো বিক্রমদারই অ্যাডভানটেজিয়স পোজিশন। পুনর্মুষিক হতে চাইছে না। ভাগ্যহীন স্বামীর ভূমিকায় বিক্রমদা আর ফিরে যাবে না।‘ অভিমান ভরা প্রশ্বাস গ্রহণ করে, অভিজিৎ জানাল, ‘বিক্রমদার রোল এখন সার্থক প্রেমিকের’, বুকঠেলা নিঃশ্বাস ফেলে, শেষ বক্তব্য রাখল, শর্বরীর স্বামী অভিজিৎ ‘আমি এখন ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো, অভাজন স্বামী মাত্র।‘