আমার বন্ধু ভোলার নাকি একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। আর সেটা হলো সে ভুত দেখতে পায়। এই তো সেইদিন মুদি চাচার সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে বলে উঠলো,
– আরে বিঞ্চু দাদু , কেমন আছেন আপনি? কথাটা শুনে সবার মতই আমারও চোখ কপালে উঠে গেল। বিঞ্চু দাদু মানে মুদি কাকুর বাবা। তিনি গত হয়েছেন প্রায় বছর বিশ হলো। আমরা অবশ্য তাকে দেখিনি লোকের মুখেই শুনেছি। মুদি কাকু তো প্রায় কেঁদে কেঁদেই বললো,
– ওরে ভোলা, আমার বাবা তো মারা গেছে রে। তুই তাকে কোথায় পেলি?
– ওমা ঐ তো তোমার পাশে দাড়িয়ে আছে।
কথাটা শুনেই মুদি কাকু তো প্রায় অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা। কোনো রকম ধরে দোকানে এনে মাথায় পানি দিতে একটু ভালো হতেই আবার ভোলা বলে উঠলো,
– আরে না দাদু, ও কিছু না। তোমার কথা এত দিন পর শুনলো কিনা তাই কাকু এমন করছে। তা দিন কাল ভালো তো? কথাটা বলে একটু চুপ থাকলো ভোলা। দেখে মনে হলো কারো কথা খুব মন দিয়ে শুনছে। একটু পর আবার বললো,
– সে কী দাদু, কাকু কে নিয়ে যাবেন কেন? তাহলে আমাদের মুড়ি মাখা কে খাওয়াবে বলো তো? না না দাদু তুমি এটা করতে পারো না। তারপর আবার চুপ। এবারও একই ভঙ্গি। দেখে মনে হচ্ছে কারও কথা শুনছে। একটু পর মুখটা ভার করে বললো,
– তাহলে আর কী করার, যান নিয়ে। আমাদের কথা তো আর শুনবেন না। কথাবার্তা শেষ হতেই মুদি কাকু ভোলাকে বললো,
– হ্যাঁ রে ভোলা, তুই কী সত্যিই বাবাকে দেখলি?
– বাহ্ রে, শুধু কী দেখা? কথাও তো বললাম। মুদি কাকু মুখটা এবার ভয়ে প্রায় শুকিয়েই গেল। তারপর ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলো,
– হ্যাঁ রে বাবা কী বললো?
– কী আবার বলবে? বললো তোমার সময় নাকি ফুরিয়ে এসেছে। খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে এসে নিয়ে যাবে।
মুদি কাকু হার্টের রোগী, কথাটা শুনেই হাত পা চিৎ করে কাঁপতে কাঁপতে আবার শুয়ে পড়লো। শ্বাস চলছে কিন্তু হুস নেই। আশেপাশে থেকে লোক এসে ভীড় করলো। ভোলা তাদেরকেও একই কথা বললো। সবাই তো রেগেই আগুন। যতসব গাজাখুরি কথাবার্তা। মরা মানুষ আবার ফিরে আসে নাকি? কথাটা বলেই দুই তিনটা চড় থাপ্পড়ও মেরেছিলো লোকজন। আমি আর কী করবো ভোলাকে নিয়ে বাড়ি চলে আসলাম। চড়গুলো যে বেশ কষিয়েই মেরেছে তা ওর চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এইদিকে মুদি কাকু তো চিন্তায় নাওয়া খাওয়া একেবারে ছেড়ে বিছানা নিয়েছে। দোকান কে খুলবে? আর দোকান না খুললে মুড়ি মাখবে কে? ভোলাকে আচ্ছা মত গালি দিলাম। ভোলা উল্টে বললো,
– আমি আবার কী করলাম? দাদু আমাকে যা বললো আমি তো তাই বললাম তাই না? এখানে আমার দোষ কোথায়?
ঘটনাট ঘটলো তার সাত দিন পর। সবাই মুদি কাকুর দেহটা নিয়ে শ্মশানের দিকে যাচ্ছে। আমি আর ভোলা দুর থেকে দেখছি।
-দেখলি তো? এবার বিশ্বাস হলো? দেখ আমি সত্যিই ভুত দেখতে পাই।
আমি তখনো চুপ। ওর থেকে একটু দুরে সরে আসলাম। সত্যি বলতে কী একটু ভয়ই করছে। এই তো জলজান্ত্য একটা মানুষ। সে কি না এই দিনে পটল তুললো?ভোলার দিকে আড় চোখে একবার তাকাতেই দেখি কিছু একটা দেখে বেশ হাসছে। আমিও সেইদিকে তাকালাম। কিন্তু কই কিছুই তো নেই।
– কী কাকু, বলেছিলাম না? সত্যি হলো তো? যাই বলো কাকু এবার কিন্তু মুড়ি মাখাটা খুব মিস করবো বুঝলে। যাও যাও এখানে দাড়িয়ে না থেকে শ্মশানে যাও, এখনি তো পোড়াবে তোমাকে। কথাগুলো শেষ করেই ভোলা আমার দিকে এগিয়ে আসলো। আমার বুকটা ধুরু ধুরু কাঁপছে। মুড়ি মাখা! তার মানে তো মুদি কাকু। তবে কী মুদি কাকুর ভুতও এসেছিলো নাকি?
– বুঝলি তো, মুদি কাকু এসেছিলো। ভারী দুঃখ প্রকাশ করলো বুঝলি। চল এখানে আর থেকে কাজ নেই। এখন বরং বাড়ি যাওয়া যাক।
কোনো কথা না বলে ভোলার পিছু পিছু বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। ভোলার বাড়ি ছাড়িয়ে একটা জঙ্গল তারপরই আমার বাড়ি। বাড়ি আসতেই বাবা দিলো আচ্ছা মত পিটানি। কারণ টা ঠিক কী সেটা বুঝে উঠতে পারলাম না। প্রশ্ন করার সাহসও হয়নি। হাত মুখ ধুয়ে বই নিয়ে বসলাম। পড়াতে মন নেই। ভোলার কথা বার বার মনে পড়ছে। ভোলা কী আসলেই ভুত দেখতে পায় নাকি? পায় হয়তো, না হলে কেউ এমন কথা বলতে পারে? পরেরদিন সকালে ভোলার কোনো দেখা পেলাম না। স্কুলেও আসেনি। তাহলে গেল টা কোথায়। দেখা হলো তিনদিন পর। ওর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতেই একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়লো। বড় বড় করে লেখা, শ্রী ভোলানাথ মিত্র তারপর ব্যাকেট দিয়ে লেখা ভুত বিশেষজ্ঞ।
– বানিয়েই ফেললাম বুঝলি, আমার মত এমন মহৎ লোক সবারই দরকার। আর ক্ষমতা যেহেতু একটা আছেই, সেহেতু লোকের একটু সেবা করলে মন্দ হয় না, কী বলিস?
– হ্যাঁ তা ঠিক। কিন্তু…..
– ওরে পাগল, সব হবে সব। আর তাছাড়া এরই মধ্যে লোকের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। তুই চাইলে আমার সহকারী হয়ে থাকতে পারিস কিন্তু। কি থাকবি নাকি? ভালো মাইনে দিবো। স্কুল ছুটি হলে চলে আসবি। যাহ এখন আমার অনেক কাজ বাকী রয়ে গেছে। এখন আমাকে কতই কাজই যে করতে হবে রে পাগলা।
কথাগুলো বলতে বলতে ভোলা পাশের একটা ভাঙা মন্দিরে ডুকে পড়লো। আমার আর কাজ কী, হাতে বই নিয়ে ছুটলাম স্কুলে। প্রথমে অঙ্ক স্যারের ক্লাস। এমন কড়া মাষ্টার আমি এই জীবনে দেখিনি। ভোলাকে দিয়ে কিছু একটা করিয়ে নিতে হবে। আর ভোলা তো বললোই, আমি ওর সহকারী হিসাবে থাকবো। তাই আমি কিছু বললে ভোলা ফেলতে পারবে না। যথারীতি স্কুল ছুটির পর বই খাতা বাড়িতে রেখে মন্দিরের দিকে চললাম। যেতেই দেখি তিন গ্রাম ওপারেই লক্ষণ দা কাঁধে বিশাল লাউ আর হাতে মিষ্টির পাতিল নিয়ে এগিয়ে আসছে।
– কী লক্ষণ দা কোথায় যাবে?
– বাবা ভোলানাথের কাছে।
– বাবা ভোলানাথ? এই বাবাটা আবার কে?
– আরে তোমাদের গ্রামের ছেলে তোমরাই চিনো না? আরে আমাদের ভোলা।
– বাব্বা ভোলা আবার বাবা হলো কবে থেকে গো? আর হাতে এইসব কেন?
– বাবাকে খুশি করতে আনলাম। একটা কাজ আছে।
– তো চলো, আমিও ও সেখানেই যাচ্ছি।
মন্দিরে ডুকতেই দেখে ভোলা একটা লাল গেরুয়া পরে মাথায় তিলক দিয়ে বসে আছে। মাথায় আবার একটা লাল কাপড়ও বাঁধা। প্রথমে তো ভোলাকে চিনতেই পারিনি।গা বেশ ছমছম করতে লাগলো। হাজার হলেও ভুত নিয়ে কারবার। ভয় তো একটু করবেই।
– আয় আয়, পাশে বস। ভয় নেই, আমি ভোলানাথ তোর সাথে আছি। বুম বুম ভটাস।
– এ আমার কী?
– মন্ত্র মন্ত্র, ও তুই বুঝবি না। কত মন্ত্রই যে পড়তে হয় রে পাগলা।
– বুম বুম ভটাস, এ আবার কেমন মন্ত্র?
– আহ প্রশ্ন করিস না তো, জগতের সব ভুতকে ডাকছি। চুপচাপ থাক।
– বাবা, আপনার জন্য কিছু জিনিস এনেছিলাম। যদি খুশি হয়ে নিতেন।
এরই মধ্যে লক্ষণ দা ডুকেই বললো কথাটা। ভোলা চোখ বন্ধ করে আমার দিকে ইশারা করে দেখলো। অনেকগুলো মিষ্টি। ভোলা তো চোখ বন্ধ করে আছে। দুই তিন টা যদি খাই তবে কী বুঝতে পারবে? না বাবা থাক, ভুতের কারবার বুঝতেও পারে। মিষ্টির পাতিলটা পাশে রাখলাম। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। হঠাৎ করেই ভোলা বলে উঠলো, চিরিৎ চরাৎ ভুটাস। কথাগুলো যে এত জোরে বললো আমি চমকেই উঠলাম। তারপর শান্ত গলায় ভোলা বললো,
– কী চাই? কথাটা যে লক্ষণ দা কে বলেছে সেটা বুঝতে পারলাম।
– বাবা, তুমি অসীম, আমার বউটা দুই বছর আগে মরেছে। তুমি যদি একটু দেখিয়ে দিতে। বউটাকে আমি খুব ভালোবাসি। বাবা দয়া করো।
– এত এত ভুতের মধ্যে তোর বউ কোনটা?
– বাবা ওর নাম লতিকা।
– হুমম তাহলে তোর বউ তোর ঠিক পিছনে দাড়িয়ে আছে।
কথাটা বলতেই লক্ষণ চিৎ পটাং। হয়তো বউয়ের কথা শুনে নিজেকে সামলাতে পারেনি। খুব ভালোবাসতো কিনা। এই ভাবেই চলতে লাগলো। অনেক দুর দুরান্ত থেকে লোকজন আসে ভোলার সাক্ষত পেতে। ভোলা যে তাদের ভুত দেখাতো তেমন নয়, বরং ভোলা নিজেই ভুতের সাথে কথা বলে ভুতেরা কী বললো সেটা সবাইকে বলতো। এতেই লোকজন খুশি। হাতেও কিছু আসতো। আর তাছাড়া মিষ্টি দই, মাখন তো আছেই। বাবাকে খুশি করতে সবাই আনতো। তার থেকে আমিও একটু ভাগ পেতাম আরকি।
চারিদিকে ভোলার জয়গান। ওর বাবা মা তো আল্লাদে আটখানা হওয়ার পালা। ছেলে তাদের এত বড় মানুষ সেটা তারা আগে জানতে পারেনি কেন সেই আফসোস করে সারাদিন মাথা ঠোকে। আমিও স্কুলে খুব একটা যাই না। স্কুল কামাই করলে অবশ্য মাষ্টার মশাই রোদে দাড় করিয়ে রাখতো। কিন্তু এখন আর তেমনটা করে না। স্বয়ং ভোলানাথের সহকারী বলে কথা। বাবা অবশ্য আগে বকাঝকা করতো কিন্তু এখন আর করে না।
এই তিন মাসে ভোলার সুনাম ছড়িয়ে গেছে বিশ গ্রাম। শত শত লোক আসে ভোলার কাছে। ভোলার সাহায্য অঙ্কের মাষ্টার মশাইকে ভুতের ভয় দেখিয়ে মাঝ রাতে তিনদিন পুকুরে নামিয়ে রেখেছিলাম। আচ্ছা জব্দ হয়েছেন তিনি। তার পর থেকে আর আমাকে কিছু বলে না। বরং আমাকে দেখলেই ভয় পায়। দেখতে বেশ ভালোই লাগে। যত দিন যায় ভোলার কথা ছড়িয়ে যায় চারিদিকে। দুর-দুরান্ত থেকে লোক আশা শুরু করলো। বেশ ভালোই চলছিলো। হঠাৎ একদিন এক লোক আসলো। লোকটাকে বিশ গ্রামের মধ্যে বলে তো মনে হলো না। বলা যায় না হয়তো ভোলার কথা আরও দুর অবদি পৌছে গেছে।
– বাবা আপনি কী সব রোগের চিকিৎসা করতে পারেন? আমি শুনেছি আপনি খুব কাজের। তাই খুব আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। লোকটার কথায় ভোলা একটু হুড়কে গেল। সে তো ডাক্তার নয়, তার কাজ ভুতেদের নিয়ে। কিন্তু এখন তো বলাও যাবে না যে ভোলা রোগের চিকিৎসা করতে পারে না। যদি বলি তবে তো লোকের কাছে বলবে কথাটা। আর তখন খুব বড় ঝামেলা হয়ে যাবে। লোকে ভোলার কাছে আসা বন্ধ করে দিবে। আর এইদিকে আমারও মিষ্টাই মিষ্টান্ন জুটবে না।
– হ্যাঁ, বাবা সব পারে। আমার কথার সাথে তাল মিলিয়ে ভোলাও বললো,
– আমার অসাধ্য কিছু নেই। বল তো কী হয়েছে। ভোলার কথায় লোকটা একটা নিশ্চিন্ত হলো। তারপর বললো,
– যাক তাহলে ঠিক যায়গায় এসেছি বাবা।
– বল তোর কী সমস্যা? চোখ বন্ধ করে ভোলা প্রশ্ন করলো।
– বাবা আমার দিকে একটু তাকান বাবা। লোকটার কথায় ভোলা চোখ খুললো। আর তখনি লোকটা নিজের মাথা খুলে ওর সামনে রেখে বললো,
– বাবা আমার মাথাট একটু ঠিক করে দেন। এই মাথাটার জ্বালাই আর পারছি না। আপনি কিছু একটা করুন বাবা।
কথাটা কী ভোলার সামনে রাখা মাথাটা থেকে আসলো নাকি অন্য কোথাও থেকে সেটা বোঝার আগেই ভোলা চিৎ পটাং। আমিও এক দৌড়। দৌড় দৌড় দৌড়। এক দৌড়ে বাড়িতে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি। লোকটার খুলে রাখা নিজের মাথাটা এখনো চোখে ভাসছে। কিন্তু ভোলা? ভোলা কই? দেখার জন্য আস্তে আস্তে মন্দিরের দিকে যেতেই দেখি অনেক লোকের ভীড়। সবার হাতেই লাঠি, কারো বা হাতে দা। যাওয়ার আর সাহস হলো না। নিজের জীবনটা রক্ষা করা উচিত। মাসখানের মামা বাড়িতে কাটিয়ে আসার পর দেখলাম পরিবেশ মোটামুটি ঠাণ্ডা। স্কুলে যাওয়ার সাহসও হচ্ছিলো না। মাষ্টার মশাইকে পানিতে নামিয়ে রেখেছিলাম। এখন গেলে নির্ঘাত ঠেংঙ্গাবে। তবুও ঘরে বসে তো আর থাকা যায় না। ভয়ে ভয়ে স্কুলে গেলাম। গিয়ে দেখি ভোলা সামনের বেঞ্চে বসে আছে। আমাকে দেখেই বললো, এসেছিস তুই?
মাথা নাড়ালাম।
ভোলার আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, বুঝলি তো ভাই, ভুত দেখা যায় না। আর দেখলেও আমার মত অবস্থা হয়। বলেই জামাটা উঠালো। বুঝতে আর বাকি রইলো না যে কারো একটা মারও মাটিতে পড়েনি, সব ওর পিঠে পড়েছে। এবার আমার পালা, মাষ্টার মশাই আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে।