ইন্জিনিয়ার জামাই

ইন্জিনিয়ার জামাই

রফিক চাচার মেয়ে শিলা পালিয়েছে সপ্তাহ তিনেক আগে৷ প্রথম ক’দিন উনার পরিবারের সবার মন মেজাজ গরম ছিল৷ মেয়ের জামাইকে পেলেই কেটে কুচি কুচি করে ফেলবে একটা ভাব৷ আব্বা গিয়েছিল তাদের শান্তনা দিতে৷ আমিও গিয়েছিলাম৷ চা-বিস্কুট খেয়ে শান্তনা দিলাম৷ আব্বার ডায়াবেটিস৷ তাই খায়নি৷ ছেলে হিসেবে দায়িত্ব মনে করে আমি খেয়েছিলাম আব্বার পক্ষ নিয়ে৷”

ঘরে এসে আব্বা বলল, দেখ তোর প্রেম থাকলে আমারে বলবি৷ তবুও পালাবিনা৷” আমি হেসে মাথা নাড়লাম৷ এখন সারাদিন শুয়ে বসে ফোন টিপি৷ ইচ্ছেমতো ঘুমাই৷ আম্মা কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না৷ আগে পান থেকে চুন কষলেই আম্মা অমুক তমুকের তুলনা দিতেন৷ এখন মোটামুটি তুলনা দেয়ার কেউ নেই৷ পাশের বাসার ভালো ছেলেটা নেশাখোর হয়ে গিয়েছে৷ আম্মার আবার ঠিক নেই৷ কোনদিন জানি বলে বসে, অমুক নেশা করে! তুইতো সেটাই করতে পারিস না!” খুব ভয়ে আছি৷”

আব্বার মন মেজাজ ভালো থাকলে পত্রিকা পড়ে পড়ে বলতো, অমুক প্রেম করে৷৷ তুইতো পারিসই না৷” আমি অপমানবোধ করতাম ভেতরে ভেতরে৷ তারপর বর্তমান প্রেমিক সমাজের দূরাবস্থার মোটামুটি ধরনের একটা বানোয়াট চিত্র তুলে ধরতাম৷” এখন আর সেসব হয় না৷ গুণবতী শিলার সাথে তুলনা দিতো৷ সে পালিয়েছে৷ পাশের বাসার আন্টির মেয়েটা একবার পালাতে গিয়ে ধরা খেয়েছে৷ আম্মার বান্ধবীর ছেলে পড়ার জন্য আমেরিকা গিয়ূ বেটা আর ফিরতে চাচ্ছেনা৷” আম্মার বান্ধবী মাঝেমধ্যে দুঃখ বোঝাতে আসে৷ আম্মার সাথে মিলে আমিও শান্তনা দেই৷ মনে মনে বলি, আমি গেলে আমিও আসতাম না৷”

পাড়ার মোড়ের মুরব্বিগুলাও ভালো হয়ে গিয়েছে৷ আমাকে রাস্তায় দেখলেই আদর করে কাছে ডেকে যারা তাদের পুত্রের গুণগান শুনিয়ে বলতো, তুমি কী করলে বাবা? খাচ্ছো আর ঘুরছো! শরম করে না?” এখন তারা আমার কাঁধে হাত রেখে বলে, বাবা তুমিই সেরা৷ তুমিই আমাদের গর্ব৷” এখন আমার জন্য প্রতিদিন বিয়ের প্রস্তাব আসে৷ ছেলে হয়েও মেয়ের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাই আমি৷ অদ্ভূত না? এই প্রস্তাব পাওয়ারও কারণ আছে৷ পাড়ায় আমার চেয়ে উঁচু র্যার্কিং এর যারা ছিল৷ তারা সবাই কাউকে না কাউকে নিয়ে পালিয়েছে৷ এখন আমিই সেরা৷ ব্যাপারটা যদি ক্রিকেটের ভাষায় বলি, ধরুন, বিরাট, স্মিথ, ওয়ার্নার, সাকিব তাবৎ তাবৎ প্লেয়ার সব নিষিদ্ধ হয়েছে হুট করে৷ আর আমি হলাম ইমরুল ব্রো৷ মানে এখন আমিই সেরা৷ আমিই রাজা আমার রাজত্বে৷”

আমার সততা দেখে শিলার বাবা রফিক চাচা মুগ্ধ হয়েছে৷ উনার দোকানের ম্যানেজারের দায়িত্বে আমি৷ আমিও কিন্তু একদম অকর্মা নই৷ বাবা জোর করে ডিপ্লোমা নামক মুরগীর ফার্মে ঢুকিয়ে দিয়েছিল৷ ৪বছরে আমি শুধু ইংলিশে ইন্জিনিয়ার বানানটা শিখেছি৷ যা আমি আগে থেকে জানতাম৷ তবুও আমি মনে মনে ভাবি, এটা আমি ডিপ্লোমায় ভর্তি হয়ে শিখেছি৷” তারপর আমি চাকরি পাচ্ছি না৷ আব্বাও কিছু বলে না৷ শিলার ভাইও আমার সাথে পড়েছিল৷ সে হিসেবে আমরা বন্ধু৷ সে রফিক চাচার ক্যাশ মেরে দিচ্ছে প্রেমিকার খরচ মেটাতে৷ তাই ওর পদটা আমি পেয়েছি আমার সততার গুণে৷” এই পদ পাওয়ার আগে আমি মাসের শেষে আব্বার কাছে টাকা চাইতাম৷ না দিতে চাইলেই বলতাম, দেখো আমিও পালিয়ে যাবো৷ সম্মান থাকবে তোমার?””

আব্বা চুপচাপ টাকা তুলে দিতো৷ মাসের শেষর সপ্তাহ আমি বাসায় থাকতাম না৷ হদিস থাকতো না আমার৷ প্রথম প্রথম আব্বা ভাবতো, এই বুঝি আমি পালালাম৷ তাদের বিশ্বাস দৃঢ় হওয়ার আগেই আমি ফিরে আসতাম৷” এখন আমি চাকরি পেয়েছি রফিক চাচার দোকানে৷ আব্বা নিশ্চিন্ত৷ রফিক চাচাকে শর্ত দিলাম, মাসের শেষের সপ্তাহ আমি থাকবোনা৷” রফিক চাচা নাহু নাহু করে মেনে নিলেন৷ কথায় কথায় শিলার কথা তুললাম৷ ভাবলাম রফিক চাচা রেখে যাবে৷ কিন্তু নাহ৷ আমাকে অবাক করে উনি রাগেননি৷ বরং হেসে হেসে বলল, মেয়ের জামাই ইন্জিনিয়ার৷ মেয়ে আমার বুদ্ধিমতী৷” আমি বললাম, ফিরে এসেছে?” রফিক চাচা বললেন, নাহ৷ জামাই নাকি এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি৷”

-চাচা মেয়ে জামাই খুব বুদ্ধিমান দেখছি৷ ভাগ্যিস পালিয়েছে শিলাকে নিয়ে৷ নয়তো সে পায়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে শীলার ছেলে এতদিনে মাঠে খেলতো৷” চাচা হাসে৷” শিলা পালানোর আগে তার সুনাম ছিল পাড়ায়৷ মাঝেমধ্যে তাকে পাড়ার রাস্তায় আমার সাথে দেখা যেতো৷ তখন আমার সুনাম ছিল না তেমন৷ লোকেরা নাক সিটকে বলতো, তুমি এই ছেলের সাথে হাঁটবেনা মা৷ তুমি লক্ষী মেয়ে৷” শিলা ওসব কানে তুলতোনা৷ আমাকে বলতো, আপনি মন খারাপ করবেন না৷”

শিলা নেই৷ দিন পাল্টেছে৷ এখন পাড়ার লোকেরা আমাকে বলে, আমার মেয়েটাকে সময় দিও৷ মোবাইলে লুডু স্টার খেলতে পারো, ইমোতে কল দিতে পারো৷” আমার ছেলেটাকে বুঝাও বাবা একটু৷ আমার ছেলেকে তোমার মতো ভালো বানাতে চাই” আমি বলি, আমার সময় নেই চাচামিয়া৷” “বিকেলে মাঠের পাশে বসে বাচ্চাদের খেলা দেখছি৷ এককালে কত খেলেছি এই মাঠে৷ এখন খেলিনা৷ খেলতে গেলে ক্যালরি খরচা হবে৷ এই সময়ে এসে আর ক্যালরি খরচ করার ইচ্ছে আমার নেই৷ কাঁধে টোকা লাগতেই পেছন ফিরে তাকালাম৷ ছেলেটার চেহারাটা আমি কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে৷ আমি মনে করার চেস্টা করি৷ ছেলেটা হাসে৷ তারপর কোলাকোলি করতে করতে বলল, বন্ধু চিনেছো আমায়?” আমি “না” বলি৷

-রাফি আমি৷”

চিনতে পেরেছি আমি৷ কলেজে সেকেন্ড লাষ্ট বেন্ঞ্চে আমার সাথেই বসতো৷ ল্যাব ক্লাস থেকে দু’জন একসাথে বেরোতাম৷ সবার কান ফাঁকি দিয়ে রাফি বলতো, ক্লাসে কিছু বুঝেছিস?” আমি বলতাম, না রে৷” রাফি আফসোস করে বলতো, এসব পড়ে কি লাভ হবে বন্ধু?” আমি রাফির কাঁধে হাত রেখে পড়ালেখার উপকারীতা বোঝাতাম৷ পরদিন সকালে আমি রাফিকে বলতাম, এসব পড়ে কি হবে? তারপর সে আমাকে বোঝাতো৷ ডিপার্টমেন্টে কোনো মেয়ে ছিল না আমরা আফসোস করতাম৷ পরক্ষণে খুশি হতাম এই ভেবে, পড়া না পারলে এখন নিদ্বির্ধায় বেন্ঞ্চে দাড়িয়ে যেতে পারি৷ মেয়ে থাকলেতো দাঁড়াতে ইজ্জতে লাগতো”

-বন্ধু খুশির খবর আছে!” রাফি বলল৷
-কী?
-মনে আছে, তুই আমাকে একবার ডিপ্লোমার উপকারীতা বুঝিয়েছিলি?
-কী বলেছিলাম?”
-ঐ যে,

ল্যাব ক্লাসের শেষে আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলি৷ ডিপ্লোমা হচ্ছে একটি সম্পদ৷ তুমি কিছু পারো না পারো৷ ৪ঃবছর তুমি ইন্জিনিয়ার বন্ধু৷ এবার ধরো, তোমার প্রেমিকা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে৷ তুমি প্রেমিকা নিয়ে পালাবে৷ তারপর তুমি বাসা থেকে হ্যান্ডসাম লুক নিয়ে বেরোবে৷ নির্দিষ্ট দূরত্বে গিয়ে তুমি মাটি কাটো, গাছ কাটো, চুল কাটো, খৎনা স্পেশালিষ্ট, ভ্যান, ট্রাক, বাস, বাসের হেল্পারি, লন্ঞ্চের হেল্পারি, তেলাপোকা, ছাড়পোকার ঔষধ বিক্রি করো৷ ঐগুলা তোমার ব্যাপার৷ মনে রাখবা দিনশেষে তুমি ইন্জিনিয়ার৷ প্রেমিকার বাবার সামনে গিয়ে বলতে পারবে, বাবা আমি ইন্জিনিয়ার৷ গাড়ি বানাই, দালান বানাই!” মেয়ের বাবাও বলবে, মেয়ে আমার ইন্জিনিয়ার এর সাথে পালিয়েছে৷”

বন্ধু তোমার মোটিভেশন আমি বুকে ধারন করে ক’দিন হলো প্রেমিকা নিয়ে পালিয়েছি৷ আমি বাসের হেল্পারি করি, তোমার ভাবীকেও বলিনি সেটা৷ বলেছি আমি ইন্জিনিয়ার৷ আমিতো মিথ্যে বলিনি৷ আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ বন্ধু৷”
রাফির চোখেমুখে খুশি খেলা করে৷ ছেলেটা খুশি হয়ে পেটপুরে বিরিয়ানী খাওয়ালো আমায়৷” রাফি বিদায় নিলো৷ আমি ঢেকুর তুলতে তুলতে শিলাকে ফোন দেই৷ আর মনে মনে ভাবি, আমার মোটিভেশন পেয়ে রাফি কাজ সেরে ফেলেছে৷ আর আমি কিনা বোকার মতো শিলাকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি৷”” রিং হতেই ফোন তুলল শিলা৷ আমি শিলাকে বললাম, চলে আসো শিলা!”

-আসবো মানে?” ওপাশ থেকে শিলার জবাব৷
-তোমায় নিয়ে তোমার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলবো, আমিই শিলাকে নিয়ে পালিয়েছি চাচা৷ চাকরি পাইনি বলে পালিয়ে বেড়ালাম৷ এবার চাকরি হয়েছে৷ ঢাকায় পোস্টিং আমার৷ লাখটাকা স্যালারী!” ওপাশ থেকে শিলা উত্তেজনা ভরা কন্ঠে বলল, লাখ টাকা! ওগো তুমি সত্যি বলছো?”

আমি হেসে বললাম, বোকা মেয়ে৷ এগুলাতো কথার কথা৷ তোমার বাবাকে ইম্প্রেস করার কথা৷ এমনিতে ঢাকা গিয়ে বাসের হেল্পারি করবো৷ কিছুদিন পর ড্রাইভার৷ তারপর পদোন্নতি করে লাখ টাকা কামাবো৷৷” ফোনের ওপাশে খানিকক্ষণ নীরবতা৷ তারপর মিনমিন করে শিলা বলল, অনিক ভাই! আপনি আমার ভাই! আপনি আপন ভাই না হয়েও আমার জন্য অনেক করেছেন৷ আসল কথা হচ্ছে, আমি এখন আমার প্রেমিকের সাথে পালাচ্ছি৷ সে ইন্জিনিয়ার৷ তবে আপনার মতো না৷ তার গাড়ির শো-রুম আছে৷ আপনি আমাকে কখনো ফোন দিবেন না৷ ভাই হিসেবে বোনের স্বামীকে দেখার ইচ্ছা আপনার থাকতে পারে৷ তাই আপনার ইমোতে আমাদের কাপল পিক দিয়ে ব্লক মারবো৷”

শিলার কথাশুনে আমি বড়সড় রকমের শক খেলাম৷ মনকে বোঝালাম খানিকক্ষণ৷ তারপর ইমোতে ঢুকলাম৷ “শিলা কাপল ছবি দিয়েছে৷ ছবির মেয়েটা শিলা৷ আর ছেলেটাকে আমি চিনি৷ গুণধর বন্ধু “রাফি”! আমার মনটা শান্তি হল৷ মনে মনে বললাম, বোকা মেয়ে! ম্যানেজার ইন্জিনিয়ার বাদ দিয়ে তুমি বাসের হেল্পার ইন্জিনিয়ার নিয়ে পালালে৷” ফোনটা আবারো বাজলো৷ আব্বা ফোন দিয়েছে৷ রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলল, বিয়ের প্রস্তাব এসেছে তোর জন্য৷ আমরা “হ্যা” বলবো?

– হ্যা বলে দাও৷ আর বলো, আমার লাখটাকা স্যালারী৷” আব্বা বলল,
-বেশি হয়ে যাচ্ছে না?”
-নাহ৷ দিনে মাটি কাটবো, বিকেল হলে পার্কে বাদাম বেচবো, সন্ধ্যা হলে চুড়ি ফিতা বেচবো৷

অন্ধকার নামলে কোট-টাই পরে ঘরে ফিরে বৌ এর সাথে চাপা মারবো “আই এম ইন্জিনিয়ার”! বৌ খুশিতে গদগদ করবে৷ যদি বিশ্বাস করতে না চায়৷ ফুটুংফাটুং করে দু’একটা ইংরেজি বলে বিশ্বাস করিয়ে নিবো৷”  বাসার দিকে হাঁটা দিলাম৷৷ সারা পাড়ায় থমথমে অবস্থা৷ মেয়েদের বাবারা হতাশ৷ কেউ চরম হতাশ হয়ে বলছে, বিয়েতে হ্যা বলে কাজটা তুমি ঠিক করোনি বাবা৷ আর ক’দিন পরেইতো আমার মেয়ের আঠারো হতো! কত শখ ছিল একটা ইন্জিনিয়ার ছেলেকে জামাই বানাবো৷ মনটা ভেঙে দিলে৷” আমি বলি, সমস্যা নেই৷ ১৮হোক তারপর করবো৷”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত