আমি তালাকপ্রাপ্তা হয়ে বাবার বাড়ি ফিরে আসার একবছর পর,একদিন দুপুরে ভাত খেতে বসে বাবা হঠাৎ বললেন মিনু তোর একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে পাশের গ্রাম থেকে। ছেলে প্রাইমারী স্কুলের মাষ্টার, ইকবাল নাম।পাত্রের দুই টা ছেলে মেয়ে আছে কিছুদিন আগে বউ হার্ট এট্যাকে মারা গেছে। দুইটা মা হারা বাচ্চাদের মা হতে হবে। তোর কি মত?
আস্তে করে বললাম বাবা আপনারা যা ভালো মনে করেন সেটাই করেন। এছাড়া কি বলবো আমি? তিন বছর সংসার করার পর,আমি বাজা মহিলা আমার কোনদিন সন্তান হবে না এই কথা বলে আমাকে তালাক দিয়ে স্বামী আরেকটা বিয়ে করেছে। সেই থেকে বাবার বাড়িতে আছি। বাবার সামান্য কিছু জমিজমা আছে তাই দিয়ে সংসার চলে, সাথে ভাই এর লেখাপড়ার খরচ আছে। চিন্তা করে দেখলাম ভাই বিয়ে করে আনলে ভাই এর সংসারে বোঝা হওয়ার থেকে মা হারা দুই বাচ্চার মা হয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া অনেক ভালো। কয়েকদিনের মধ্যে ইকবালের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল।বিয়ের আসরে দুইটা ছেলে মেয়ে কে দেখলাম। মা কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, মিনু ওরাই তোর ছেলে মেয়ে।
বাসর রাতে ইকবাল বলল,তোমাকে শুধুমাত্র বিয়ে করেছি আমার সন্তানদের মা হওয়ার জন্য। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি তোমার সন্তান হবে না এজন্য তোমাকে বিয়ে করেছি নাহলে এরচেয়ে অনেক ভাল সম্বন্ধ আমার জন্য এসেছিল।তুমি কথা দাও তুমি ওদের মা হয়ে থাকবে। আমি মাথা কাত করে বললাম, আমি কোনদিন মা ডাক শুনিনি ওদের পেয়ে আমি খুশি। সকাল বেলায় শাশুড়িমা বাচ্চাদের হাত ধরে আমার কাছে নিয়ে এসে বললেন, মুন্নি, রনি তোমাদের নতুন মা কে মা বলে ডাকো।আর শোন বউ মা, তুমি এদের মা, শুধু আদর করবা শাসন করতে যেও না, তাহলে ওরা ভয় পাবে তোমার কাছে যাবে না। জা কাছে এসে একই কথা বললো মিনু তুমি যেন বাচ্চাদের শাসন করতে যেও না ঐ দিকটা ওর আব্বু দেখবে আমরা আছি আমরা দেখবো।
আমি একটু অবাক হলাম, মা হবো অথচ শুধু আদর করবো শাসন করতে পারবো না! রনি, মুন্নি কে মাতৃস্নেহ দিয়ে হাসি আনন্দের মাঝে পাঁচ বছর কাটিয়ে দিলাম।একবারের জন্য ও মনে হয় নি ওরা আমার সন্তান না, আমার একটা সন্তান হলে ভাল হতো। মুন্নি এসএসসি ভালভাবে পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে আর রনি নবম শ্রেণীতে পড়ে। ইদানিং মুন্নির হাবভাব চালচলন একটু অন্যরকম লাগছে। মোবাইলে ফিসফিস করে গল্প করে।আমার বুকের ভিতর কেঁপে উঠলো তবে কি মুন্নি প্রেমে পড়েছে? ভাল ছেলের সাথে সম্পর্ক হলে তো ভালো আর যদি কোন খারাপ ছেলের পাল্লায় পড়ে তাহলে তো সর্বনাশ।
আমি মুন্নি কে চোখে চোখে রাখলাম,মুন্নি বাথরুমে গোসল করছে হঠাৎ ওর ফোনটা বেজে উঠলো সাহস করে ফোনটা রিসিভ করলাম অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসলো একটা ছেলের কণ্ঠ, হ্যালো মুন্নি মনে আছে তো আজ বিকেল পাঁচটায় ফিসারি অফিসের পাশে বাওড়ের পাড়ে দেখা করার কথা?হুম বলে ফোন রেখে দিলাম।আমার বুক দরুদুরু করছে যা সন্দেহ করেছিলাম তাই হলো। আমাকে বাওড়ের পাশে যেয়ে দেখতে হবে ছেলেটাকে। বিকেলে মুন্নি সুন্দর করে সাজুগুজু করে আমাকে বললো, মা আমার বান্ধবীর জন্মদিন আমি সেখানে যাচ্ছি। অবাক হয়ে বললাম, জন্মদিনে যাবি উপহার নিবি না? সে আমি যাওয়ার পথে কিনে নেবো,তুমি টাকা দেও।
টাকা নিয়ে মুন্নি চলে যাওয়ার সাথে সাথে আমি বোরকা পরে নাক মুখ ঢেকে নির্দিষ্ট জায়গায় চলে গেলাম।গাছের আড়াল থেকে ছেলেটার দিকে তাকাতেই হোঁচট খেলাম,আমার অভিজ্ঞ চোখ বলছে এই ছেলে মোটেও ভাল না চেহারা পোশাক আশাকের ভিতর কেমন মাস্তান ভাব একভাবে সিগারেট খাচ্ছে একহাত দিয়ে মুন্নি কে জড়িয়ে ধরে গল্প করছে। অবাক হয়ে ভাবলাম এমন ছেলেকে মুন্নি পছন্দ করলো কিভাবে?
সন্ধ্যার পর মুন্নি বাড়ি ফিরলে জিগ্যেস করলাম কোথায় ছিলি এতক্ষন? মুন্নি অবলীলায় মিথ্যে বললো, তোমাকে বললাম না বান্ধবীর জন্মদিন ভুলে গেলে? আমি কিছুই ভুলিনি, সত্যি করে বল কোথায় ছিলি? এক কথা কতোবার বলবো! জন্মদিনে ছিলাম। আমার হঠাৎ প্রচন্ড রাগ হলো কোনদিন যা করিনি তাই করলাম, ঠাস করে মুন্নির গালে চড় মারলাম। গালে হাত দিয়ে মুন্নি হিসহিসে গলায় বললো,তুমি আমাকে মারলে! তুমি ভুলে গেছো তুমি আমার সৎ মা আমাকে মারার কোন অধিকার তোমার নেই।
আমার মাথা ঘুরে উঠলো মুন্নি এসব কি বলছে! আমি সৎ মা! তাড়াতাড়ি খাটের উপর বসলাম। চেচাঁমেচি শুনে শাশুড়ি মা এবং জা ও ঘরে এসেছে। মুন্নি দাদিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বললো, উনি আমাকে মেরেছে। শাশুড়ি মা রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মা মরা মেয়েকে আমরা কোনদিনও ফুলের টোকা দিয়নি আর তুমি কোন সাহসে ওর গায়ে হাত তোল? আয় মুন্নি আমার সাথে এই বলে মুন্নি কে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। জা এগিয়ে এসে বললো,এটা তুমি কি করলে মিনু! ভাবি মুন্নি একটা বাজে ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে আমার কথা শেষ না হতেই জা বলে উঠলো ছি মিনু ছি, মুন্নি না হয় তোমার সৎ মেয়ে তাই বলে এভাবে অপবাদ দিবা, এই বলে জা ঘর ছেড়ে চলে গেল।
আমি হতভম্ব, মুন্নি আমার সৎ মেয়ে আর আমি মুন্নির সৎ মা! পাঁচটা বছর শরীরের রক্ত পানি করে ওদের মানুষ করে, শুনতে হলো আমি সৎ মা! দুচোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে কিছুতেই থামছে না, সেই সাথে রাজ্যের অভিমান আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ঠিক আছে আমি যখন সৎ মা তখন ওদের ভালমন্দ কোন ব্যাপারে আমি আর নেই। বিকেলে ইকবাল স্কুল থেকে ফিরে আসার সাথে সাথে, আমি যে মুন্নিকে মেরেছি এটা শাশুড়ি মা ইকবালের কাছে নালিশ করলেন। ইকবাল আমাকে ডেকে বললো মিনু, মুন্নির গায়ে হাত তোলা তোমার মোটেও উচিৎ হয় নি, ও কোন অন্যায় করলে আমাকে জানাতে। বলো ও কি অন্যায় করেছে? আমি আস্তে করে বললাম ও কোন অন্যায় করেনি আমার ভুল হয়ে গেছে আর কোনদিনও এমন হবে না।
এরপর থেকে মুন্নির সাথে খুব কম কথা বলি দুরত্ব রেখে চলি।কিছুদিন পর মুন্নি কলেজ থেকে ফিরতে দেরি হচ্ছে।ইকবাল স্কুল থেকে ফিরে শুনলো মুন্নি এখনও কলেজ থেকে ফিরে আসেনি। বান্ধবীদের কাছে ফোন করে জানা গেল কোন বান্ধবীর বাড়ি যায়নি।সবাই দুঃশচিন্তা করছি কোথায় গেল মুন্নি? ইকবাল দিশেহারা হয়ে উঠেছে সেই সময় ইকবালের ফোনে কল আসলো একনজর দেখে বললো মুন্নির কল।তাড়াতাড়ি লাউড স্পিকারে দিলো। মুন্নি অপর প্রান্ত থেকে বললো, বাবা তোমরা আমাকে খুঁজবে না আমি ভাল আছি।সোহাগ নামে এক ছেলেকে ভালবাসি ওকে বিয়ে করেছি। ইকবাল হায় হায় করে উঠলো মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে গেলো। মুন্নি চলে যাওয়ার চার মাস কেটে গেছে। উঠানে দড়িতে কাপড় মেলে দিচ্ছি হঠাৎ দেখি মুন্নি। এ কি চেহারা হয়েছে! রোগা কালো বিধ্বস্ত।
ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো, মা আমাকে মাফ করে দেও।আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। মা, তুমি কেন সেদিন একটা মাত্র চড় মেরেছিলে? আরও মারলে না কেন মা? তাহলে এই রকম মারাত্মক ভুল আমি করতাম না। সোহাগ একটা বাজে মাস্তান ছেলে, ড্রাগের ব্যবসা করে গতকাল পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তুমি যদি সেদিন আমাকে আরও মারতে শাসন করতে মা, তাহলে আমার জীবনটা অন্য রকম হতো। কিভাবে শাসন করবো সোনা আমি যে তোদের সৎ মা। মা গো, মা তো মা। মা কখনো সৎ হয় না।
ঠিক বলেছিস খুকি , মা যেমন সৎ হয় না তেমনি সন্তান ও কখনো সৎ হয় না আমার খুবই ভুল হয়ে গেছে, আমার অভিমান করা মোটেও উচিৎ হয়নি। আমার জোর গলায় বলা উচিৎ ছিলো, আমি তোদের মা তোদের ভাল মন্দ দেখা তোদের শাসন করা আদর করার অধিকার শুধু আমারই আছে। মুন্নি কে বুকের ভিতর জড়িয়ে নিয়ে বললাম,যা হবার হয়ে গেছে আর এমন ভুল হবে না সোনা। এখন থেকে তোদের শাসন করা আদর করার ভার আমার, আমি তোদের সৎ মা না শুধুমাত্র মা।