ও বাবাই বাবাই আমার মাম্মামের ছবিটা এখান থেকে কে সরিয়ে নিয়েছে? হঠাৎ করেই কান্না করে উঠলো আরাফ। ওর কান্না যতটা না কানে পৌছালো তার চেয়ে ও অধিক গুন বেশি পৌছালো আরাফের কথাটি”ও বাবাই বাবাই আমার মাম্মামের ছবিটি এখান থেকে কে সরিয়ে নিয়েছে” মনে পড়ে গেলো ১০ ১১ বছর আগের কথা। একজন খুব আদর করে আমার ছবিগুলো যত্ন করে রাখতেন। এক মিনিটের জন্য ছবি না দেখতে পেলে হৈ চৈ আরম্ভ করতেন। কড়া গলায় বলতেন বলি আমার মায়ের ছবিটা কি তোমাদের খুব জ্বালাচ্ছে নাকি? যে আমার মেয়েটার ছবি কয়েকদিন পর পর আমার চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে যায়।আমার ছোট্ট মায়ের ছবিটা কি ঠিক ঠাক জায়গায় আসবে নাকি বাড়ি থেকে সব লোকজন তাড়িয়ে দেবো।
-মেয়ে এতো বড় হয়ছে এখনো ছবির জন্য এমন করো কেন? সব ছবি তো আছেই শুধু ৬ মাস বয়সের ছবিটাই তো নেই।
-সেটাই থাকবে না কেন? এখুনি নিয়ে আসো আমার মায়ের ছবি।
-ছবিটার ফ্রেম ভেঙে গেছে কিভাবে থাকবে এখানে?
-আমি লাগিয়ে নিবো এখুনি এনে দাও।
-এই মিতু ছবিটা নিয়ে আয় তাহলে তো তোর বাবার পেটে পানি টুকু ও পড়বে না।
মায়ের কথা শুনে হাসতে হাসতে বাবার কাছে এসে বসতাম। কতোই না ভালবাসা ছিলো আমার বাবা আর আমার মাঝে। আর এখন? ভাবতে ভাবতেই চোখের অশ্রু এসে ভীর করে দিয়েছে নিত্যদিনের মতোই। ভেতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে আমার। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কান্না করে সেই মানুষটার কাছে চলে যাই। অনেক তো হলো অভিমান আর কতো? পেরেছো কি ভুলতে আমায় বাবা?
হ্যা আজ ৯ বছর হলো আমার বাবার থেকে দূরে আমি। আমার ভুলটা আমার কাছে সামান্য হলেও আমার বাবার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করেছি এক নিমিষেই। যে হাতে আদর করে মুখে খাবার তুলে দিতো আমায় সেই আমি কি না তাকে এভাবে ক্ষতবিক্ষত করলাম! এক মুহূর্ত আমার ছোট থেকে বড় হওয়ার ছবি সামনে না থাকলে পাগল হয়ে যেতো যে মানুষটা। যে মুখে মা ছাড়া ডাক আসতো না, সেই মুখটাই এখন দেখতে পারি না আমি! হ্যা বাবা বড্ড অপরাধী আমি। তোমার কষ্ট তোমার মান সম্মানের কথা একবারের জন্য চিন্তা করিনি আমি। তোমার অবাধ্য হয়ে আশিককে বিয়ে করেছি। তুমি ও তো তখন অবুঝ হয়েছিলে। হাজারবার চেষ্টা করেও বোঝাতে পারিনি তোমায়। তুমি তোমার মায়া মমতা এক পাশে রেখে জেদ বজায় রেখেছিলে। আমার শরীরে ও যে তোমারই রক্ত বইছে তাই তো আমার জেদ টা ও বজায় রেখেছিলাম।
তাই বলে এই ৯ টা বছর পার হয়ে গেলো তবুও তোমার মিতুকে দেখতে ইচ্ছে করে না? হাজারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ও মৃত বলতে একবার ও বুক কেপে উঠেনি? আজ ও কি জেদ টা বজায় রাখবে? আজও কি আমার জন্মদিনে আমাকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য পাগল হয়ে উঠোনা? আজ ও কি আমার ছবি গুলো এক মিনিটের জন্য চোখের আড়াল হতে দাও? নাকি এক বুক কষ্ট আর জেদ বজায় রেখে ছবি গুলো ফেলে দিয়েছো? আমি জানি না বাবা তুমি কি করেছো। কিন্তু আমার মন টা সব সময় বলে তুমি আমাকে কখনো তোমার মন থেকে সরে যেতে দাও নি। চোখের আড়াল থেকে ছবি সরিয়ে রাখলে ও মনের আড়াল থেকে কিভাবে সরাবে? ও মাম্মাম মাম্মাম? আরাফের কথায় যেন হুস ফিরে পেলাম। ছেলেটা না জানি কতক্ষন কান্না করেছে। কি হয়েছে আমার বাবাটার কান্না করেছো কেন?
-কান্না তো সেই কখন শেষ। তোমার ছবিটা বাবাই সরিয়ে দিয়েছিলো আবার এনে দিয়েছে। ও মাম্মাম জানো বাবাই আজ আমাদের ঘুরতে নিয়ে যাবে। আজ তোমার জন্ম দিন তাই না মাম্মাম? আমি ও তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিবো।
-কি সারপ্রাইজ?
-দাড়াও নিয়ে আসছি।
এসব বলে ছুটে পালিয়ে গেলো আরাফ। ছেলেটা যেন আমার বাবার আরেকটা কপি। আজ বাড়িতে থাকলে বাবা আমাকে নানান ভাবে সারপ্রাইজ দিতো। আমার ছেলেটা ও তাই হয়েছে। কিন্তু বাবার ভালবাসা কি আর পূর্ণতা পাবে? কখনো কি আর বুকে জরিয়ে নিবে না আমাকে?একটা ভুলের শাস্তি কি সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে? তোমার মেয়ে যে তোমায় ছাড়া ভালো নেই বাবা। সব অভাব পূরন হলে ও তোমার আর মায়ের অভাব কখনো পূরন হবে না। কেমন আছিস রে মা? হঠাৎ কাধে হাত দিয়ে পরিচিত একটা কন্ঠ বলে উঠলো। পিছন ফিরে তাকাতেই যেন স্তব্ধ হয়ে যাই আমি। হ্যা আমার বাবা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ ৯ টা বছর পর কাচা পাকা চুল নিয়ে আমার সামনে আমার বাবাই দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট ও হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি না তো আমি?
– কিরে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলবি? তোর এই বুড়ো বাবাটাকে ডাক দিবি না?
-বাবা! কান্না করেই বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। এতোটা বছর পর যেন আমার সুখ ফিরে পেয়েছি।
-অভিমানের পাহাড় টা তো বিশাল হয়ে গেছে তাই তো একদিন ও বাবা কে দেখতে যাসনি। আমাকেই আসতে হলো তোর অভিমান ভাঙাতে। আমি না’হয় কঠিন কিছু বলেছি তাই বলে বাসায় ও যেতে পারিসনি?
-তোমার ভয়ে যেতে পারিনি বাবা। বড্ড বেশি কষ্ট দিয়েছি যে তোমায়। এই কষ্টের যে ক্ষমা হয় না। কোন মুখে তোমার সামনে দাড়াবো? আমি যে তোমার সন্তান হবার যোগ্য নই।
-নারে মা। ভুল তো আমার ও ছিলো। আমি ও তোকে বোঝার চেষ্টা করিনি। নিজের জেদ কে বজায় রাখতে গিয়ে এতো গুলো বছর তোর ছবি বুকে আগলে রেখেছি তোকে দূরে সরিয়ে রেখে। তোর মায়ের জন্য আস্তে আস্তে সব বুঝতে পারি। মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে খোজ ও নিয়ে নিতাম। কি করবো বাবা হয়েছি তো। আর আজ তো তোর ছেলে আর আশিক বাসায় গিয়ে নিয়ে আসলো আমাকে আর তোর মা কে।
-আশিক তোমাদের বাসায় গিয়েছিলো?
-হ্যা। প্রথমে তো রাগ দেখিয়েছিলাম পরে আমার নানুভাই কে দেখে সব রাগ মাটি হয়ে গেছে। এই ছেলে তো দেখি তোর দ্বিতীয় বাবা। আমি মারা গেলেও আরেকটা বাবা থেকে যাবে তোকে আদর আর শাসন করার জন্য।
-না বাবা কি বলছো এসব। তুমি আমার থেকে কোথাও যাবা না আর।
-হয়েছে নাকি বাবা আর মেয়ের মান অভিমান ভাঙানো। তাহলে এবার কেক টা কাটা যাক।
আম্মু আশিক আর আরাফ এক সাথে বলে উঠলো হাসতে হাসতে। সত্যি বাবা মা যতোই রাগ অভিমান করুক সন্তান যতোই ভুল করুক বাবা একদিন তো ক্ষমা করবেই। কিন্তু যে হৃদয় একবার ক্ষতবিক্ষত করা হয় সে হৃদয় ঠিক হতে হয়তো অনেক টা সময় লাগে তবে মুখ ফিরে থাকতে পারে না বাবা মা। যে কষ্ট পায় সেই কষ্টের মতো কষ্ট হয়তো সারাজীবনে ও পায় না। তবু ও আমরা বাবা মা কেই কষ্ট দেই। আমার বাবা ও হয়তো আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে কিন্তু যে কষ্ট আমার কাছে থেকে পেয়েছে তা হয়তো আর কখনো পায়নি। তবুও সন্তানকে ক্ষমা করে দেন বাবা মা এটাই যে তাদের ভালবাসা। তাই তো মান অভিমান শেষ করে দিয়েছে। তোমাদের মতো আর কেউ হয় না বাবা। সব কিছুর মাঝে শ্রেষ্ট ভালবাসা যে বাবা মায়ের ভালবাসা। সবাই মিলে একসাথে আমার সেই চিরচেনা নিড়ে যাচ্ছি।
বাসায় ঢুকতে দেয়ালে চোখ আটকে যায়। চোখের কোনে অশ্রুরা ভীর জমায়। না এটা দুঃখের অশ্রু না সুখের অশ্রু।না আমার কোনো ছবি এ বাড়ির দেয়াল থেকে উঠেনি। প্রত্যেকটা ছবি আগের মতোই আছে। আদর যত্ন করে রেখে দিয়েছেন আমার বাবা। এতো বছর শুধু বাহিরে বাহিরে মান অভিমান চলছিলো আমাদের মধ্যে। আরও আগে আসলে হয়তো বাবার ভালোবাসা অনেক আগে থেকেই পেতাম। ভুল যে আরো একটা করেছি। তবুও সব ভুল ক্ষমা করে দিয়েছেন স্বযত্নে ছবি আগলে রেখেছেন। অভিমান ভাঙাতে গিয়েছে। সেই তো আমার বাবা।