মেয়ে

মেয়ে

নীলার মেয়ে বাচ্চার খুব শখ। কিন্তু তাকে হতাশ করে দিয়ে সৃষ্টিকর্তা তাকে একটা ফুটফুটে ছেলে বাচ্চার মা বানিয়ে দিলেন। বাচ্চা হওয়ার পর মায়েদের মুখে যেই মিষ্টি হাসি ফুটে উঠে সেটা দেখতে নার্স সুমিত্রার খুব ভালো লাগে। কিন্তু নীলার ছেলে বাচ্চা হয়েছে এটা শুনার পর নীলা সর্বপ্রথম যেই কথা বলল সেটা শুনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না সুমিত্রা। ‘আপনি ঠিক বলছেন তো? আমার ছেলে হয়েছে? অন্য কারোর সাথে আমার বাচ্চার অদল বদল হয়ে যায় নি তো?’ কতক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকার পর সুমিত্রা বলল

-না ম্যাডাম। আপনার ছেলে ই হয়েছে। আর কারোর সাথে আপনার বাচ্চার অদল বদল হয় নি। মুখ টা গোমরা করে নিজের ছেলেকে কোলে তুলে নিলো নীলা। ওর হাজবেন্ড আবির ওর সাথেই দাঁড়িয়ে ছিলো। নীলার ওই ধরণের প্রশ্নের জন্য ওকে খুব অপ্রস্তুত মনে হচ্ছে। নার্স চলে যাওয়ার পর আবির জিজ্ঞেস করলো..

-এটা কী ধরণের কথাবার্তা নীলা?
-কি আবার বললাম?
-আমাদের ছেলে হয়েছে তুমি খুশি হও নি?
-হয়েছি।
-তাহলে এমন মুখ গোমরা করে রেখেছো কেনো?
-ইশ! আমার কত স্বপ্ন ছিল আমার একটা মেয়ে হবে। ওকে সুন্দর সুন্দর ফ্রক পড়িয়ে, দুইটা ঝুটি করে দিয়ে, রাস্তায় হাঁটবো, স্কুলে নিয়ে যাবো। সুন্দর করে সাজাবো। তা আর হলো না। ছেলেদের তো সাজগোজ করার মত তেমন কিছুই নেই। ওর এমন ধরণের কথা শুনে মেজাজ গরম হয়ে গেলো আবিরের।

-এই চলো না আমরা একটা মেয়ে সন্তান দত্তক নেই? আবির বিরক্ত হয়ে বলল
-দেখো, আমাদের একটা ছেলে আছে। আমার আর কোনো বাচ্চার দরকার নেই। আর মেয়ে মেয়ে করে আমার মাথা নষ্ট করে দিও না প্লিজ। আমাদের যা আছে তাই নিয়ে আমি খুশি। নীলা চুপসে গেল। মোটা চশমা পড়া এক মহিলা জিজ্ঞেস করলো

-বাচ্চার নাম? নীলা বলল
-জিনিয়া। আবির বলে উঠলো
-এই নীলা এসব কি বলছো?? আমাদের ছেলের নাম জনি। জিনিয়া বলছো কেন?? ম্যাডাম ওর নাম জিনিয়া না। জনি।

ভদ্রমহিলা চোখের চশমা টা চোখের সাথে আরেকটু সেটে দিয়ে আবির আর নীলার সাথে আসা বাচ্চাটিকে দেখতে লাগলেন। বাচ্চাটির পড়নে লাল রঙের ফ্রক, চুল গুলি বড় বড় আর তাতে ঝুটি করা, দুইটা পুতুল ওয়ালা ক্লিপ ও লাগানো। কপালে ছোট একটা কালো টিপ, ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়া। একে দেখে কোনো মতেই ছেলে বলে মনে হচ্ছে না।  উনি ক্ষেপে গিয়ে বললেন…

-আগে আপনারাই ঠিক করুন ও আপনাদের ছেলে নাকি মেয়ে। তারপর বলুন। এক্ষুণি বের হয়ে যাবেন রুম থেকে। ও যদি আসলেই ছেলে হয়ে থাকে তাহলে ওকে ছেলেদের মত করেই নিয়ে আসবেন। নয়ত ওর ভর্তি এই স্কুলে হবে না।

দুইজনে অফিস রুম থেকে বের হয়ে আসলো। ছেলে হয়ে জন্ম নেওয়া সত্বেও জনি এই দীর্ঘ ৫ বছরে শার্ট অথবা ছেলেদের কোনো জামা পড়তে পারে নি। নীলা সবসময় ওকে মেয়েদের মত ফ্রক পড়িয়েছে, সাজিয়েও দিয়েছে মেয়েদের মত করে। চুল গুলিও বড় বড় করে ঝুটি করে দিয়েছে। বাসা জুড়ে সব মেয়ে বাচ্চাদের জামা কাপড়। আর এসব নীলা নিজেই কিনেছে। আবির যতবার ই শার্ট প্যান্ট নিয়ে এসেছে নীলা সেগুলি পাশের বাসার বাচ্চাকে দিয়ে দিয়েছে। আবির ওকে কত বুঝিয়েছে। কোনো কাজে দেয় নি।

-ও আমাদের ছেলে। মেয়ে না। তুমি এসব কি শুরু করেছো নীলা?? তুমি জানো আমাদের আত্নীয় স্বজন রা কত হাসাহাসি করে ওকে নিয়ে? নীলা আবিরকে ধমকে বলত

-তুমি চুপ করতো।

নীলার কম্পলিকেশন থাকার জন্য আর কোনো বাচ্চাও নিতে পারেনি। তাই জনিকেই ও নিজের মেয়ের মত মানুষ করেছে। অনেক সময় মেয়েদের ক্ষেত্রে বাবা মায়েদের অহংকার করে বলতে শুনা যায় ‘ও আমাদের মেয়ে না, ছেলে।’ জনির ক্ষেত্রে উল্টো। ওর মা বলে ‘ ও আমাদের ছেলে না, মেয়ে।’

আবির আজকে ভীষণ খুশি। ও জনির জন্য শার্ট প্যান্ট কিনছে। স্কুলে তো আর মিথ্যে পরিচয় দিয়ে ভর্তি করাতে পারবে না । অবশেষে নীলাকেও বুঝাতে পেরেছে যে জনি আমাদের ছেলে আর ওকে ছেলেদের মতই বড় হতে হবে। লম্বা লম্বা চুল গুলি যখন নাপিত মশাই কেটে দিচ্ছিলো নীলার সেকি কান্না! এমন বিদগুটে একটা অবস্থায় জনি বড় হয়েছে। ওর ছোটবেলার সবগুলিতে ছবিতে ওকে দেখা গেছে ফ্রক পড়া অবস্থায়। সাথে ঝুটি করা লম্বা চুল আর ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। ও যে ছেলে সেটা ওকে দেখে বুঝা যায় না। ওর সেই ছোট বেলার ফ্রক গুলি ওর মা এখনো গুছিয়ে রেখে দিয়েছেন। ভাগ্যিস এখন আর মায়ের সেই পাগলামি টা নেই। এখন ও ছেলেদের মত শার্ট প্যান্ট পরে। মাকে ও বারবার করে বলে দিয়েছে এই ছবি গুলি যেন কাউকে না দেখায়। কলেজের সব বন্ধুরা আজকে জনির বাসায় এসেছে। জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার এক পর্যায়ে হঠাৎ করে মুনিয়া বলে উঠলো

-আন্টি, জনির ছোটবেলার কোনো ছবি নেই? নীলা হেসে বলল
-থাকবে না কেন? অবশ্যই আছে। আমি এক্ষুণি নিয়ে আসছি। জনি চেঁচিয়ে বলে উঠলো

-মা, খবরদার ওই ছবি তুমি কাউকে দেখাবে না। কিন্তু কে শুনে কার কথা  ওর মা আলমারি থেকে ছবির এলবাম বের করে নিয়ে আসলো। আর মহা আনন্দের সঙ্গে ওদের কে জনির মেয়ের সাজে ছোট বেলার ছবি দেখাতে লাগলেন। আর ছবির পেছনকার বিভিন্ন কাহিনি বর্ণনা করতে লাগলেন। উনার যে মেয়ের খুব শখ ছিলো, আর তার বদলে জনির জন্ম হয়েছে সে বিষয়ে অনেক আফসোস ও করতে লাগলেন। ওর বন্ধুরা ওর মা কে শান্তনা জানালো। অনিক তো বলেই বসলো…

-আন্টি এখন থেকে জনি আমাদের বন্ধু না। বান্ধবী।
-এই জনি কি বলছিস?? ওর নাম এখন থেকে জিনিয়া। ওকে আমরা জিনিয়া বলে ডাকবো।
-হু। আর প্রয়োজন পড়লে ওকে বিয়ে করানোর জন্য মেয়ের বদলে ছেলে খুঁজবো।
মুনিয়া জনিকে বলল
-কিরে জিনিয়া. তুই চুপচাপ কেন? কথা বল।

নীলার চোখে আনন্দে পানি এসে গেলো। মা হয়ে নিজের ছেলের প্রেস্টিজের এমন ফালুদা বানাতে পারে সেটা দেখে জনি নির্বাক। মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে জনি জিজ্ঞেস করলো

-মা,তোমার এখন একটু ভালো লাগছে?
-হু
-জ্বর তো খুব বেশি। আমি ডাক্তার কাকুকে খবর দিয়েছি। তোমার কি কিছু খেতে ইচ্ছে করছে?
-না রে। আর আমি তো কিছুই রান্না করিনি। কে রান্না করলো? তোর বাবাও তো নেই বাসায়।
-আমি রান্না করেছি।
-আর ঘরের অন্য কাজ?
-সেগুলিও আমি করেছি। ঘর মুছেছি। কাপড় চোপড় ভাজ করেছি। রান্না করেছি।
-এজন্যই বলি তুই আমার ছেলে না। তুই আমার মেয়ে। মেয়েদের মত ঘরের সব কাজ করেছিস। হিহি। জনিও হাসলো। মনে মনে ভাবছে ‘আমি নাহয় তোমার জন্য মেয়ে হয়েই রইলাম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত