আজ আমার বিয়ের ৮ম দিন আর সকাল সকাল আমার শ্বশুর আমার বাবার বাড়িতে অনেক গুলো নতুন নতুন জিনিষ পত্র গাড়িতে করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এর একটু পর ই মায়ের ফোন এল। মা খুব রাগ রাগ আবার সাথে লজ্জিত ভাব নিয়ে এরকম করার কারণ কি জানতে চাইলেন। যেহেতু আমি কিছু ই জানি না তাই তেমন কিছু বলতে পারলাম না। বাবার বাড়িতে যেগুলো পাঠানো হয়েছে তা আমার না বরং আমার শ্বশুর নতুন নতুন সব কিনে আমার বাবা মায়ের জন্য পাঠিয়েছে এই যেমন, ফ্রিজ, ওভেন, ওয়াশিংমেশিন, আমাদের শোকেজ টা পুরনো হয়ে গিয়েছিল বিয়ের ৩য় দিন সেটা আমার শ্বশুর খেয়াল করেছেন তাই নতুন একটা কিনে দিয়েছেন।
আমি এসব দেখে হা করে দাড়িয়ে আছি। আজ এক জায়গায় আমাদের দাওয়াতে যাওয়ার কথা আমার ফুপু শাশুড়ির মেয়ের বিয়ের পাকা কথা হবে। আমি শাড়ি পড়ে সেঁজেগুজে রেডি হয়ে গেলাম। আদিব অফিস থেকে তাড়াতারি চলে আসল ছুটি নিয়ে। কিন্তু শাড়ি পড়ে এক রুম থেকে অন্যরুমে যেতে ই হোঁচট খেয়ে পরলাম সাথে সাথে শাড়িটা এলোমেলো হয়ে গেল। আমি তেমন ভালো করে পারিনা পড়তে। আমার শাশুড়ি এসে একদম ঠিকঠাক মত শাড়ি পরিয়ে দিলেন। দাওয়াত খেয়ে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। কিন্তু আমার শ্বশুর নাকি কোনো কিছু না খেয়ে ই চলে এসেছেন রাগ করে। প্রচন্ড রাগ করে এখনো পর্যন্ত ঘরের কারো সাথেও কথা বলছেন না।
পরদিন বিকালে বাজার থেকে এনার্জি বাল্ব ১০/১৫ নিয়ে এসে শ্বশুর মশাই আমার শাশুড়ির হাতে দিলেন। এত বাল্ব একসাথে কিনে আনার দরকার কি বুঝলাম না। সাথে বলে দিলেন এই ঘরে বা বউমার বাবার বাড়িতেও যদি বাল্ব নষ্ট হয় তখন যেন এখান থেকে ব্যবহার করার জন্য দেওয়া হয়। আমার বাবার বাড়িতে..! আমার শ্বশুরের কিছু অদ্ভুত আচরণ আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলে বার বার।
এর এক ঘন্টা পর বাবা ফোন দিলেন। বাবা কিছু কথা বলতে শুরু করে ই কান্না করে দিলেন প্রায়। জানতে চাইলে বলেন, বাবা লাইট কিনতে বাজারে গিয়ে ছিলেন সেখানে আমার শ্বশুরের সাথে দেখা । বলে রাখা ভালো আমার বাবার বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি কাছাকাছি দু গ্রামের মাঝে বাজার টা পরে আমাদের। কি কিনতে এসেছেন জানতে চেয়ে যখন বললেন লাইট তখন নাকি আমার শ্বশুর বললেন, ” আপনার ঘরের আলো তো আমি নিয়ে এসেছি বেয়াইমশাই, তাই পরিবর্তে কৃত্রিম আলোটা না হয় আমি দিয়ে দিলাম। ” এই কথা বলে প্রায় ১০ টা এনার্জি বাল্ব বাবার হাতে ধরিয়ে দিলেন। বাবা নিতে না চাইলে বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসেন। বাড়িতে যাওয়ার পর আমার বাবা আমার শ্বশুরকে এসব জিনিষপত্র ফিরিয়ে নিতে বললেন, মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে আসা জিনিষ লোকে শুনলে খারাপ বলবে লজ্জা দিবে। এগুলা পাঠিয়ে দিব কালকে।
তখন নাকি আমার শ্বশুর অনেক টা রেগে গিয়ে কাকে ফোন দিয়ে ঘর সাঁজানোর জিনিষপত্র যেমন ঝাঁরবাতি, ওয়ালম্যাট, ভিবিন্ন ধরনের প্যান্টিং আরো অনেক কাঁচের সিরামিক এর জিনিষ আনিয়ে বললেন, এগুলাও রাখুন যদি কেউ খারাপ কথা বলে লজ্জা দেয় আমাকে বলবেন। আমি দেখে নিব। আর যদি আপনি এসব নিতে মানা করেন তাহলে, আপনার মেয়েকে আপনার বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। এইকথা বলে নাকি হন হন করে চলে এসেছেন। কে চাইবে তার মেয়ে শ্বশুরঘর থেকে চলে আসুক। আমি যত ই এসব শুনছি তত ই অবাক হচ্ছি। উনার কথা হল মেয়ে এনে মেয়ের বাবার ঘর খালি করেছি যা এসব জিনিষপত্র দিয়েও শোধ হওয়ার নয় তাও যদি একটু পারেন। মানে, মেয়ে এনে মেয়ের বাবাকে যৌতুক দেওয়ার মত অবস্থা যেন এ ঋণ ফুরাবার নয়। মানুষ কতটা মন থেকে পরিষ্কার হলে এমন করে আমি চিন্তা করছিলাম শুধু!
বিকেলে মায়ের সাথে নাস্তার তৈরি করছি। হঠাৎ দরজার সামনে কেউ একজন ক্ষ্যাপা নাম ধরে ডাকছেন শুনলাম।
আমার শাশুড়ি চলে গেলেন, উনি নাকি আমার শ্বশুরের বন্ধু। ক্ষ্যাপা নামটা শুনে আমার হাসি পেল। উনি চলে যাওয়ার পর মাকে জিজ্ঞেস করলাম এমনটা ডাকার কি কারণ, আমার শাশুড়ি বললেন, উনাকে এই ঘরে বিয়ে দিয়ে আনা হয় একজন পাগলের জন্য। একরোখা যা মন চায় তাই করে বাবা মার অবাধ্য যা নিজে বুঝে তো বুঝে। অনেকে আমার শ্বশুরের এরকম স্বভাব দেখে মাথায় সমস্যা আছে বলে ধারণা করেন। উনাকে নাকি অনেক সময় ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যেতে হয়ে ছিল।
কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। শাশুড়ি বললেন, উনি ভয়ে ভয়ে থাকতেন। কখন কি করেন কিন্তু যখন তিনি বুঝতে পারলেন মানুষটার পাগলামির আড়ালে আছে একটা মুগ্ধ করার মত একটা মন তখন থেকে তিনি এই মানুষটাকে আপন করে নিতে শুরু করলেন। আদিব যখন ছোট তখন এক ভিখারী তার সন্তানকে নিয়ে এসেছিল তখন আদিব খাচ্ছে তা দেখে ঐ মহিলার ছেলেও কান্না শুরু করে। আমার শাশুড়ি তাকে আলাদা খাবার দিলে শ্বশুর তা ফেলে দিলেন তিনি নিজ হাতে আদিব যা যা খাচ্ছিল তা তা দিয়ে ঐ ছেলেকে খেতে দিলেন আদিবের পাশে। তখন থেকে এই মানুষ টা কে চিনতে আর ভুল হয়নি।
এমনকি চাকরি জীবনেও বিপত্তি ছিল এসব নিয়ে। খুব কাছের কলিগের সাহায্য করেন নিজ জমি বন্ধক রেখে অথচ সেই কলিগ নাকি টাকা নিয়ে উধাও। ভালো মানুষ পেলে মানুষ এর ফায়দা লুটে। এরপরে নাকি উনাকে চাকরি থেকে সরিয়ে আনা হয়। উনিও স্বেচ্ছায় চলে আসেন। ব্যবসা শুরু করেন। কেউ ওভার টাইম করে তার পাই পাই হিসাব করে দেন আর কেউ সময়ের নড়চড় করলে কাজে ইচ্ছা করে না আসলে তার বাড়িতে খাবার ভর্তি টিখিন ক্যারিয়ার পাঠিয়ে দেওয়া হয় একদিনের আর ছুটি দেওয়া হয় ২ দিন। একদিন খাবে অন্যদিন কাজে না আসলে সেই কাজের মর্ম বুঝবে। এরকম অদ্ভুত সব নিয়ম উনার। আমি হা করে তাকিয়ে আছি। এমনকি আমি খেয়াল করেছি আদিবের বন্ধুরা আসলে যতটা না আদিবের সাথে গল্প করে তার থেকে দ্বিগুণ আমার শ্বশুরের সাথে সময় কাটায়।
এই ক্ষ্যাপা মানুষটার জন্য কোথায় খুব মায়া জন্মাচ্ছিল খুব করে। এরপর থেকে বাবার সব কাজ আমি নিজে করতাম বাবা মা দুজনের কাজ। এরপরে ই হঠাৎ আরেকটা ঘটনা ঘটল, আমার দেবর মানে আমার শ্বশুরের বড় ভাইয়ের ছেলে তাদের ঘরের কাজের মেয়ের খারাপ সম্পর্ক গড়ে তুলে। এখন মেয়েটি বিচার চাইলে তারা মেয়ে টিকে মুখ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। বাবা মায়ের বিগড়ে যাওয়া সন্তান সমাজে আলাদা মান আছে সেই সম্মান হারানোর ভয়ে বিষয়টা লুকানোর চেষ্টা করছেন। মেয়েটি আমার শ্বশুরকে চিনত। সে উনার কাছে আসে।
বাবা উনার ভাইয়ের সাথে কথা বলেও কাজ হল না দেখে অনেক রাগারাগি করেন এমনকি ঘরে এসে অনেক জিনিষ ভাঙচুর শুরু করেন। আমার শাশুড়ি অনেক বুঝিয়ে শান্তত করতে পারলেন না। এরকম নাকি হয় কোনো অন্যায় বা খারাপ কাজ দেখলে নাকি উনি পাগলের মত হয়ে যান তখন সামলানে মুশকিল। আদিব অনেক বুঝিয়ে শান্ত করল আইনের ব্যবস্থা নিয়ে সব ঠিক হল। অথচ মেয়েটি আমাদের কেউ ই না। এসব কাজ শেষে বাবার শরীর টা খারাপ হতে লাগল কাজ দৌড়াদৌড়ি এসব নিয়ে অনেক চাপ গেছে। হঠাৎ বিকেলে একদিন আমার ঐ চাচা শ্বশুর আসলেন ক্ষমা চাইতে উনার ছেলে নাকি এখন আর আগের মত না অনেক অনেক পরিবর্তন এসেছে বিয়ের পর।
আমার শ্বশুর বললেন, কার দ্বারা কি হবে আমরা কেউ জানি না তবে সৎ ভালো কাজে অবশ্যই অবশ্যই ভালো কিছু লুকিয়ে থাকে। কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ কর না।নিজের বিবেক যা বলবেন সেই মোতাবেক চল কারণ বিবেক কখনো ভুল পথের নির্দেশ দেয় না। হ্যা সেখানে তোমাকে অনেকে বোকা বানাবে কিন্তু তা তে কি তুমি ইহকাল পরকাল দু জায়গায় মুক্তি পেয়ে যাবে। এই মুক্তির আনন্দ সব আনন্দ কে হার মানায়। কথা গুলো শুনে কোথায় যেন ব্যথা লাগল। সারা রাত কথাগুলো মনে করে খচঁখচ করতে লাগল। ভালো লাগল না আর। সকালে নামাজ পড়ে চা নিয়ে বাবার রুমে গিয়ে ডাক দিয়ে কোনো সাড়া পেলাম না। হাত দিতে ই দেখি হাত পা ঠান্ডা। আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম। সবাই জড়ো হয়ে গেল।
মৃত্যুর খবর শুনতে পেয়ে আসেপাশে যত লোক ছিল উনার শুভাকাঙ্খী বা সমালোচনাকারী সবাই আসল সাথে ঐ লোকটাও আসল যে জমি বন্ধকের টাকা নিয়ে পালিয়ে ছিল। শেষ ক্ষমা চাইতে নাকি রওয়না হয়ে ছিল কিন্তু সে সুযোগ পেল না। কান্না করে একদম পাগলের মত অবস্থা লোকটার সত্যি ভালো সৎ কাউকে ঠকিয়ে কোনো দিন কেউ ভালো থাকতে পারে না। আজ সবাই তা বুঝতে পারছে। এরকম একটা ক্ষ্যাপার খুব প্রয়োজন আমাদের সমাজে। বাবার মৃত্যুর বেশ কয়দিন পর লক্ষ্য করলাম আদিব কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে। চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেছে। কেমন জানি বাবার রুপটা প্রতিয়মান হতে শুরু করল ওর মাঝে আমি আর মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। এটা কোন খেলা চলছে বিধাতার!!