বিছানায় ছিটে ফোঁটা রক্তের দাগ লেগে আছে। মাইশাকে পড়ানোর জন্য বসে আছি। রক্ত দেখে মাথাটা ঘুরবে মনে হচ্ছে। চেয়ারে ঝিম মেরে বসে রইলাম। মাইশার আম্মা রুমে ঢুকলো চা বিস্কুট নিয়ে। ওদিকে না তাকিয়ে কপালে হাত দিয়ে বসে আছি। খাটের এক পাশে চা রেখে বললো,
– এভাবে কপালে হাত রেখে বসে আছো কেনো? তখনো আমার নজর শুধু বিছানার রক্তের দিকে। আমি বললাম,
– আন্টি এখানে রক্ত কিসের? আর মাইশাকে দেখছি না, ও কোথায়? আন্টি মুচকি হাসি দিয়ে রক্ত লাগা স্থানে পরনের কাপড়ের আচল দিয়ে ঢেকে বললো,
– মশার রক্ত। রাতে ও বললো মশা অনেক জ্বালাচ্ছিল। তখন হয়তো মেরে ফেলছে। আন্টির মুখের দিকে তাকালাম। হাসি দেখে বুঝতে পারি, আন্টি মিথ্যা বলছে। যেহেতু আন্টি মিথ্যা বলছে, তাহলে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলাম না। আমি বললাম,
– আন্টি মাইশা আজ পড়বে না?
– মনে হয় পড়বে না আজ। শরীরটা ভালো না ওর।
মনে মনে ভাবলাম, “হঠাৎ এমন অসুস্থ হবে?” ভাবনাটা আবার অন্য দিকেও নিলাম। বয়সটা যেহেতু ১৩ বছর তাহলে হয়তো! আন্টি আমার সামনে বসা। বার বার মাইশার কথা এড়িয়ে যেতে চাইছে। সামনে নাস্তা রেখে খালি মুখে বসে আছি বলে চা খেতে বললো। প্লেট থেকে চায়ের কাপটা হাতে নিলাম। ঠোঁটের ডগায় কাপটা নিয়ে মাইশাকে দেখবো বলে অনুমতি চাইলাম। চুপচাপ খুটির মতো বসে রইলো। কি বলবে ভাবছে হয়তো। মিনিট দুয়েক পর ওর রুমে যাওয়ার অনুমতি দিল। কাপটা রেখে মাইশার রুমে গেলাম। দেখি কাঁথা গায়ে দিয়ে মুখ বের করে শুয়ে আছে। খুব মায়া লাগলো তখন। একদিন পড়াতে না আসলে ও বার বার ফোন করে জিজ্ঞেস করতো, ভাইয়া তুমি আসবে না কেনো? আজ যদি না আসো তাহলে আমি আর তোমার কাছে পড়বো না। বাধ্য হয়েই আমার আসতে হতো। আন্টি আমার পিছনে দাঁড়ানো। আমি বললাম,
– আমি কি ওরে জাগাতে পারি?
– ওর শরীরটা ভীষণ খারাপ। কয়েকদিন রেস্টে থাকুক ও।
– আমি তাহলে না পড়িয়ে প্রতিদিন দেখা করে যাবো ওর সাথে।
বাসায় এসে হাত মুখ ধুয়ে আরাম করছি। পাশের রুম থেকে গুনগুন কারো কথার শব্দ শোনতে পেলাম। মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলাম ভাবীর কণ্ঠ। বড় ভাই প্রবাসী, এখন তার ডিউটির টাইম। তাহলে ভাবী এখন কার সাথে কথা বলতে পারে? প্রায় লক্ষ করতাম ভাবী এমন বিকেল হলে কারো সাথে কথা বলে আর মুচকি মুচকি হাসে। এদিকে পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। মা’কেও দেখছি না। ভাবীকে ডাকলাম। কিছুক্ষণ পর ভাবী না এসে দেখি পাশের বাড়ির সায়মা এলো। সায়মা এবার ইন্টারমিডিয়েট-এর ছাত্রী। আমি বললাম,
– তুই এখানে কেনো?
– তোমার ভাবী একটু কাজ করতেছে, তাই আমিই আসলাম।
– আমি এটা বলি নাই। বলছি যে, তুই আমাদের বাড়িতে কেনো?
– আসছি তো কি হয়েছে? এ বাড়িতে কারো আসা নিষেধ নাকি?
– সবার নিষেধ না, তবে তোর জন্য নিষেধ।
কর্কট ভাষায় কথা বলে সায়মাকে তাড়িয়ে দেই। কারণ, ও দেখতে সুন্দরী হলেও ওর মনটা তার বিপরীত। গাঁয়ের লোকে বলাবলি করে ও ছেলেদের সাথে ফ্লট করে টাকা নেয়। ভালোবাসার নামে বাজে কথা বলে অনেকের থেকেই টাকা নিয়েছে। এ নিয়ে গ্রামে বিচারও হয়েছে কয়েক বার। রাত পৌনে নয়টা, টেবিলে বই মেলে পড়তেছি। মা খাটের সাথে হেলান দিয়ে আমার মোবাইলে গেইম খেলছে। হঠাৎ ভাবী খাবারের জন্য ডাকতে লাগলো। দু’জনে উঠে খাবার ঘরে গেলাম। ভাবী প্লেটে ভাত বেড়ে দিল। আমি ভাত মাখাচ্ছি আর মাকে বলছি,
– বাড়ির লোকজনের মতিগতি তেমন সুবিধার মনে হচ্ছে না। মা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– তুই কার কথা বলতেছিস? বাড়িতে শুধু আমি আর তোর ভাবী। তুই তো সারাক্ষণ পড়া নিয়েই ব্যস্ত থাকিস।
– যাকে বুঝিয়েছি সে বুঝলেই হলো মা। এ বাড়িতে বাজে স্বভাবের মেয়ের কোনো স্থান হয়ও নাই আর হবেও না। আমি চাইনা অন্য কারো জন্য আমাদের বাড়ির বউদের অসম্মান হোক। মা ভাত মুখে দিয়ে চিবাচ্ছে আর বলছে,
– তুই কি বলতেছিস কিচ্ছু বুঝতেছি না আমি।
– তুমি খাও। যে বোঝার সে ঠিকই বুঝে নিয়েছে। পরক্ষণেই ভাবী মাথা নিচু করে নরম সুরে বললো,
– ভুল হইছে আমার। সায়মা আর আসবে না এ বাড়িতে। ও আমার ফোন দিয়ে ওর ক্লাসের ছেলে বন্ধুর সাথে নাকি কথা বলতো। আমি চেঁচিয়ে বললাম,
– কে কার সাথে কথা বললো না বললো সেটা শোনতে চাইনা।
খেয়াল করলাম ভাবীর চোখে পানি চলে আসছে। সময়তে ভুল সিদ্ধান্তের জন্য রাগিয়ে কথা বলতে হয় আমার। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পরিপাটি হয়ে আন্টিকে ফোন দিলাম। মাইশা কেমন আছে জিজ্ঞেস করলাম। আন্টিও হেসে হেসে উত্তরে বললো, একটু সুস্থ এখন। আমি আন্টিদের বাসায় মাইশাকে দেখতে যেতে চাইলাম। কিন্তু সে অনুনয় করে নিষেধ করলো। ব্যাপারটা জমাট বাঁধানোর মতো লাগলো। মন খারাপ করে না বলেই ফোনটা কেটে দেই। সাত পাঁচ না ভেবেই আন্টিদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেল বাজালাম। বেল বাজিয়ে এক মিনিটের মতো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আবার বেল দিলাম। কিছুক্ষণ পর আন্টি এসে দরজা খুললো। মুখের দিকে তাকাতেই দেখি কপাল বেয়ে বেয়ে ঘাম পড়ছে। দরজার বাহিরে দাঁড়ানো অবস্থায়-ই জিজ্ঞেস করলাম,
– ভরদুপুর বেলায় কপাল বেয়ে ঘাম? ম্লান স্বরে বললো,
– ঘামের আবার ভরদুপুর বলে কথা আছে নাকি?
– তা নেই। ভিতরে যেতে বলবেন না?
আন্টি উত্তরে কিছু বললো না। ভিতরে যাওয়া শুরু করলো। আমিও তার পিছন পিছন হাঁটতে থাকি। ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে রইলাম। হঠাৎ মাইশার চিৎকারের শব্দ শোনতে পাই। দৌড়ে ওর রুমে গেলাম। রুমে ঢুকেই অবাক হলাম। দেখি আন্টি মাইশার চুলে ধরে ইচ্ছামত দুই গালে থাপ্পড় দিচ্ছে। তড়িঘড়ি করে মাইশার চুল ছাড়িয়ে দু’জনকে আলাদা করে দিলাম। কখনো আন্টির সাথে রাগান্বিত হয়ে কথা বলি নাই। আমি বললাম,
– এভাবে কেউ কাউকে মারে? কি করেছে ও?
মাইশা ভয়ে আমাকে জড়িয়ে আছে। আন্টি আবার ওরে মারার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাইশাকে শক্ত করে ধরে রাখলাম। আমি আবার বললাম,
– বলেন ও কি করেছে? চেঁচিয়ে বললো,
– কি করবে ও, ওর বান্ধবী কোন ছেলের সাথে কিনা কি করেছে। এখন ওর উপর দোষারুপ দিচ্ছে। ওই মেয়ের মা বাবা মাইশাকে দোষারুপ করছে। মেয়েটা মোবাইলে কোন ছেলের সাথে কথা বলে না বলে সেটাও নাকি ওর দোষ এখন। দুইদিন আগে হাত কেটে কি অবস্থা করছে ও। তুমিই বলো, কোনো সন্তান যদি এমন করে হাত কাটে তাহলে মায়ের কেমন লাগতে পারে? স্তব্ধ হলাম কথা শোনে। ক্লাস এইটের মেয়ে এখনি প্রেম করে, আবার তার বান্ধবীকেও ফাঁসায়! কি বোঝে ওরা ভালোবাসা সম্পর্কে কে জানে। আন্টিকে বললাম,
– তাহলে ও হাত কাটবে কেনো? আগে তো বলেননি ও হাত কাটছে? মুহূর্তেই দেখি আন্টির চোখে পানি। মাইশার হাত ধরে ভেজা কণ্ঠে বললো,
– দেখো, ব্লেড দিয়ে হাত কেটে কি করেছে। মাইয়াটার এতো রাগ। শুধু একটা থাপ্পড় মেরেছিলাম, সহ্য করতে না পেরে হাত কাটছে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খাইলাম। এতটুকু বাচ্চা মেয়ে, ও আবার হাত কাটার পদ্ধতি কিভাবে শিখে ফেললো? মাইশাকে বললাম,
– মাইশা, তুমি আমাকে বড় ভাইয়া বলে ডাকো তাইনা? তাহলে বড় ভাইয়ার কথা শোনতে হবে। বড় ভাইয়া যা বলবে সেটাই মানতে হবে। মাইশা কান্না করে বলে,
– হ্যাঁ ভাইয়া, তুমি যা বলবে সব কিছু শুনবো।
– তোমার আব্বু বিদেশ থাকে। এমন কিছু করবে না, যেন পরিবারের সবার মান সম্মান চলে যায়। মাইশাকে আন্টির কাছে দিলাম। আন্টি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি বললাম,
– আন্টি বর্তমান সমাজের নিয়ম কানুন কিছুই বুঝি না। সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে, নাকি লোহার দোষে জাহাজ ডুবে! আন্টি আমার দিকে ড্যাবডেবে ভাবে তাকিয়ে বললো,
– তুমি বলতে চাচ্ছো সব দোষ আমার?
– না আন্টি, আপনার এভাবে মারা’টা ঠিক হয়নি। ও বাচ্চা পোলাপান, বোঝার বয়স এখনো পুরোপুরি হয়ে ওঠেনি। আপনি আদর করে বুঝাতে পারতেন। ও নিশ্চিত মেনে নিতো।
– ওর নামে এমন বাজে কথা শোনে রাগ হচ্ছিল খুব। তার জন্য রাগটা ওর উপরেই খাটাইছি।