ইন্টেলিজেন্ট কিড

ইন্টেলিজেন্ট কিড

৫ম শ্রেণীতে পড়ুয়া আমার ছোট বোনের নাম শ্রুতি ৷ ইদানিং, সে আমার ফোনটা একটু বেশিই ইউস করছে ৷ সে ফোন দিয়ে গেমও খেলেনা, কার্টুনও দেখেনা ৷ তাহলে কি করেটা কি? অনেক গবেষণা ও অনুসন্ধানের পর রহস্য উদঘাটন হলো ৷

বোনটা আমার ফোন নিয়ে একটা পিচ্চির সাথে কথা বলে ৷ কল রেকডিং সিস্টেম অন করা ছিল ৷ ফাইল ম্যানেজারের রেকডিং ফোল্ডারে জমা হওয়া রেকডিং শুনে বুঝতে পারলাম যে শ্রুতি এই বয়সেই একজনের প্রেমে পড়ে গেছে ৷ রীতিমত কথা বলছে তারই ক্লাসমেট সাওনের সাথে ৷ কয়েকদিন ধরে শ্রুতিকে ফলৌ করছিলাম ৷ আজ হাতে নাতে ধরে ফেললাম আমার কিউট বোনটাকে, সে ঐ পিচ্চির সাথে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত ৷ চুপিচুপি শ্রুতির নিকট গিয়ে, খাম্বার মত দাঁড়িয়ে রইলাম ৷ ক্ষণিক পর তার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিলাম ৷ তার কান ধরে কৃত্তিম রাগ দেখিয়ে ক্ষিপ্তস্বরে বললাম,

—-কি হচ্ছে এসব? শ্রুতি চমকে গেলো ৷ ভয়ের অভিব্যক্তিতে চোখ দুটো গোলগোল বানিয়ে তাকিয়ে রইলো ৷ তবে আমার মুখ থেকে কথা বের হতে দেখে নিজেকে শামলে নিলো ৷ কিছুই হয়নি, এমন ভান ধরলো ৷ অতঃপর টসটস করে বলল,

—-তোমার ফোন দিয়ে এতক্ষণ বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতেছিলাম ৷ বুঝতে পারছো? শ্রুতির কথায় যেন আকাশ থেকে সাগরে পড়লাম, সাগরে ঠান্ডা পানিতে ডুবে হাবুডুবু খাচ্ছি, যে ঠান্ডা পানি তাতে বরফ হয়ে অজ্ঞান হবার কথা, অথচ হচ্ছিনা; কারণ, শ্রুতির আরো সাহসীক কথাবার্তা শুনতে হবে ৷ হতবুদ্ধি আমি ছোট বোনটার শিকারী চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম এতক্ষণ, এবার তার লাল টুকটুকে গাল টিপে তীক্ষ্ণকন্ঠে বললাম,

—বেয়াদপ, এই বয়সে কিসের বয়ফ্রেন্ড? শ্রুতির সহজ সরল জবাব,

—কিসের আবার বয়ফ্রেন্ড হবে, গার্লফ্রেন্ডের বয়ফ্রেন্ড! আমি গার্লফ্রেন্ড সাওন বয়ফ্রেন্ড ৷ শোনো, আমরা তোমার মত না যে দুদিন প্রেম করে সম্পর্ক নষ্ট করবো ৷ আমাদের এই সম্পর্ক চিরদিনের জন্য ৷ আজীবন আমরা প্রেম করে যাবো!

—-তোর এত সাহস হয় কেমনে বড় ভাইয়ের ফোন দিয়ে প্রেম করিস? ভয় করেনা?
—-বড় ভাইয়ের ফোন দিয়েই প্রেম করতে হবে ৷ তাছাড়া তো হবেনা ৷ আমার যে ফোন নাই!
—-আজ থেকে আমার ফোনে হাতে দিবি না, বলে দিলাম ৷ অন্যথায় আমার হাতের থাপ্পর খেতে খেতে মরতে হবে!
—-আমি চুরি করে ফোন ব্যবহার করবো, তুমি টেরই পাবেনা!
—তবুও, পিচ্চিটার সাথে কথা বলা বাদ দিবিনা?
—-ভাইয়া, যাকে ভালবাসি তার সাথে কেন কথা বলা বাদ দিবো! না খেয়ে থাকবো তবুও তার সাথে কথা বলা বাদ দিবনা!

—-ওর কথা ভুলে যা ৷ অনেকগুলো চকলেট কিনে দিব ৷
—-চকলেট খাওয়া ভুলে যাবো তবুও ওকে ভুলবোনা ৷
—-চুপ বেয়াদব! দিনে দিনে বেয়াদব হচ্ছিস!
—-ভাইয়া, তুমি কি বাংলা সিনেমার ভিলেন ভাইদের মত হবে? আমার পবিত্র প্রেম ভাঙতে ভিলেনের দায়িত্ব পালন করবে?
—-সত্যি সত্যি এবার থাপ্পর খাবি ৷ যা, আমার সামনে থেকে ভাগ!

ছোট বোনটা ভয়ে দু-তিনদিন পিচ্চিটার সাথে কথায় বললোনা ৷ কিন্তু তিনদিন পর দেখতে পেলাম রাত ১০ টার দিকে বেলকণিতে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কার সাথে যেন কথা বলছে ৷ কাছে গিয়ে ভাল করে শুনতে পেলাম বারবার কাকে যেন জান, প্রাণ, বেবি বলে ডাকছে ৷ বুঝতে বাকি রইলোনা যে সে ফোনে সাওনের সাথেই কথা বলছে ৷ এবার রাগ চরমে উঠলো ৷ এভাবে চলতে থাকলে তার লেখাপড়ার ক্ষতি হবে ৷ এসবে মগ্ন হয়ে যাবে ৷ স্কুলে যাওয়াও একসময় বন্ধ হয়ে যাবে ৷ আমাকে জানতে হবে সাওন ছেলেটার বাসা কই? তাকে হুমকি ধামকি না দিলে আমার বোনটার পিছু ছাড়বেনা ৷ পিচ্চি মেয়েটার ব্রেন ওয়াশ করে ফেলেছে, এর একটা বিহিত করতেই হবে! পরেরদিন বিকেলে সাওনের নম্বর নিয়ে, দিলাম ফোন ৷ ফোনটা রিসিভ হলো ৷ গম্ভীর গলায় বললাম,

—-কে? সাওন নাকি? সাওন যেভাবে আমার কথার উত্তর দিলো সেটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না ৷ তীক্ষ্ণকন্ঠে সে আমাকে বলল,

—–হুম, সুমুন্দি সাহেব ৷ আমি সাওন ৷ থমকে দাঁড়ালাম ৷ হতবাক হয়ে গেলাম ৷ আওয়াজ উঁচু করে পিচ্চিকে বললাম,

—-এই মুখ শামলে কথা বলো ৷ আমি তোমার সুমুন্দি হলাম কিভাবে? সে গলা ঝেড়ে পুনরায় বলল,

—-বউয়ের বড় ভাই তো সুমুন্দিই হয়, নাকি? জানেন না আমি শীঘ্রই শ্রুতিকে বিয়ে করতে যাচ্ছি?
—-চুপ! একদম চুপ ৷ এখনো ফিটার খাও, দুধের দাঁত আজও ওঠেনি ৷ এখনোই বিয়ের চিন্তা? এই বেয়াদব, তোমার বাবার নামটা বলো?

—-আমার বউ তথা আপনার ছোট বোনের থেকে তার শ্বশুরের নামটা জেনে নিয়েন!

মেজাজ এত উচ্চমাত্রায় পৌঁছল যে রাগে ফোঁসফোঁস করছিলাম ৷ তাকে প্রতিত্তরে কিছু বলবো তার পূর্বেই ফোনটা কেটে দিলো ৷ পুনরায় ফোন দিতে গেলে ফোন বন্ধ পেলাম ৷ সিদ্ধান্ত নিলাম আগামীকাল বিকেলে সাওনের বাবার নিকট নালিশ দিতে যাবো ৷ এজন্য শ্রুতির থেকে ঠিকানা নিতে গেলাম এবং তাকে বললাম ঠিকানাটা বল ৷ কিন্তু সে সরাসরি বললো, “যখন যাবে তখনই সাওনের বাসার ঠিকানাটা পেয়ে যাবে!”

শ্রুতির স্কুল ছুটি হবে ৪টার দিকে ৷ এখন ৫টা বাজতে চলছে, অথচ বোনটা বাসায় আসছেনা ৷ চিন্তা হচ্ছিল খুব ৷ কই গেল সে? নাকি ফাজিল সাওন উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে তার বাসায় নিয়ে গেল? কিন্তু আমি তো তার বাসার ঠিকানা জানিনা ৷ তাকে খুঁজবো কই? আগে স্কুলে যেতে হবে ৷ দেরি না করে স্কুলের দিকে গেলাম ৷ স্কুল বন্ধ, তবে দপ্তরিকে পেলাম ৷ সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে ৷ অামাকে দেখে বললো আমি শ্রুতির ভাই কিনা ৷ হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ালে সে ফের বললো, “আপনার বোন পার্কে গেছে, শিশু পার্কে ৷ আমাকে বলে গিয়েছে তার ভাই স্কুলে আসবে, আসলে যেন বলি সে পার্কে গেছে ৷ স্কুলে আমার কাজ ছিল বলে এতক্ষণ অপেক্ষা করলাম ৷ তাকে স্কুলে আর না খুঁজে পার্কে চলে যান!”

দেরি না করে পার্কের দিকে চললাম ৷ ফাজিল সাওন আমার পিচ্চি বোনটাকে একদম পাল্টে ফেলেছে ৷ পার্কে পৌঁছতেই দেখতে পেলাম একটি সিটে সাওন ও শ্রুতি হাত ধর বসে আছে ৷ রাগ আগে থেকেই জমা ছিল ৷ ওদের একত্রে দেখে রাগের মাত্রা আরো বেড়ে গেল ৷ অগ্নিশর্মা হয়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম ৷ সোজা শ্রুতি ও সাওনকে কষে থাপ্পর মেরে ক্ষিপ্তস্বে বললাম,

—-তোমাদের এত অধঃতন? এই বয়সে এসব কি? হুহ? আজকেই দেখলাম ৷ পরবর্তিতে যেন তোমাদের একত্রে না দেখি ৷ অন্যথায় দুজনের হাত পা গুড়া করে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দিবো! কথাটা বলা শেষ হয়নি, অকস্মাৎ আমার পিঠে কার যেন ছোঁয়া পেলাম ৷ পিছন ফিরেই চমকে উঠলাম ৷ হকচকিয়ে উঠে হতভম্বের চোখে তাকিয় রইলাম মানুষটার দিকে ৷ আমার পাক্তণ সুস্মিতা ৷ আজ ১বছর পর তার দেখা পেলাম ৷ তার দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকা সুস্মিতার থাপ্পর উপহার পেলাম ৷ তাজ্জব আমি ৷ থাপ্পর মারলো কেন? আমার কৌতূহলের অবসান ঘটলো যখন সুস্মিতা হিংস্র বাঘিনীর রুপ ধরে রাগের সীমা অতিক্রম করে ক্ষিপ্তস্বরে বলল,

—আপনার সাহস হলো কেমনে ওতোটুকু বাচ্চাদের গায়ে হাত তোলার? এখনই ওদের কাছে সরি বলবেন, বলুন সরি! নিস্তব্দ আমি ৷ ভয়ার্ত চোখে দৃষ্টি বিনিময় করছি সুস্মিতার দিকে চেয়ে ৷ চোখ পিটপিট করছিল আমার ৷ ঢোক গিলতে লাগলাম বারবার ৷ নিস্তব্দতা ভুলে জবাব দিলাম,

—কেন মেরেছি, সেটার কারণ আগে জানা উচিত ছিল ৷ এই যে পিচ্চি মেয়েটা, সে আমার ছোট বোন ৷ এই বয়সে প্রেম করছে ৷ ওকে মারবোনা তো কি করবো? ধাঁই করে আমার বোন শ্রুতি জোরালো কন্ঠে বলল,

—-তাহলে বুঝো ভাইয়া, সুস্মিতা আপুর বড় ভাই কিসের জন্য তোমাকে মেরেছিল? সেও চাইনি তার বোনের সাথে কেউ সম্পর্ক করুক ৷ তোমাদের দুজনকে সে হাগ করা অবস্থায় দেখেছিল ৷ আপুকে তোমার থেকে ছাড়িয়ে নেবার পর , অনবরত তোমার গালে থাপ্পর মেরেছিল ৷ সুস্মিতা আপুকে রাগ দেখিয়ে জিজ্ঞেসা করেছিল, “এই ছেলেটার সঙ্গে কিসের সম্পর্ক” সুস্মিতা আপু ভয় পেয়ে গিয়েছিল ৷ ভেবেছিল সম্পর্কের কথা বললে তোমার ও তার ব্যাপারে কঠিন সিদ্ধান্ত নিবে ৷ এই ভয়ে বলেছিল কোনো সম্পর্ক নেই!  অথচ ভাইয়া তুমি আপুর কথাটার সঠিক অর্থ না বুঝে তার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করেছিলে ৷ পরের দিন তোমার নিকট এসেছিল সরি বলতে , অথচ তুমি তাকে ক্ষমা না করে সত্যি সত্যি সম্পর্কের ইতি টেনেছিলে!

এটা মোটেও ভাল করোনি ৷ সামান্য একটা ভুলে তোমাদের ২ বছরের সম্পর্ক নষ্ট করে দিয়েছিলে ৷ এতটাই ঘৃণা জমা রাখলে আপুর প্রতি যে তার সাথে একটাবারও দেখা করলেনা ৷ অথচ ডায়েরীতে ঠিকই তাকে নিয়ে কতশত মনের কথা প্রকান করতে ৷ ছাদে গিয়ে কান্না করতে করতে বলতে এমনকি আজও বলো সুস্মিতাকে খুব মিস করছো!
শোনো, আমি সাওনের সাথে প্রেম করছি তোমাদের দুজনকে এক করার জন্য ৷ সাওন হচ্ছে সুস্মিতা আপুর চাচাতো ভাই ৷ তোমার কষ্ট দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে করে হোক তোমাদের মধ্যকার ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্কটা পুনরায় জোরা লাগাবো ৷ তাইতো, এতসব প্ল্যান ৷ এসব না করলে তুমি সুস্মিতা আপুর দেখা পেতেনা ৷ যদিও সে সবসময় চাইতো তোমার সাথে দেখা করতে ৷ কিন্তু তুমি তো চাইতেনা ৷ আপু ঠিকই তোমার পথ চেয়ে বসে ছিল ৷ আমি আর কিছু বলবোনা ৷ যা বলার তোমরা বলো!

সুস্মিতা আমার হাত দুখানা শক্ত করে ধরলো ৷ মৃদ্যুস্বরে ও কম্পমান গলায় সে আমাকে বলল, “সরি, আমাকে মাফ করো ৷ আর ওরকম ভুল হবেনা ৷ এতদিন পর তোমার দেখা পেলাম, এবার অন্তত রাগ অভিমান ভুলে ভালবাসায় আমাকে ভরিয়ে তোলো!” কোনোরুপ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সঙ্কোসবোধ মনেতে না রেখে সুস্মিতাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলাম! এতদিনের কষ্টটা যেন তার পরশে মুহূর্তে হারিয়ে গেল! দুজনেই সুখের চোটে আনন্দ অশ্রু ঝরাচ্ছি ৷ ওদিকে আমার ছোট বোন সাওনকে চেঁচানো স্বরে বলল, “শোনো, আজ থেকে তোমার সাথে সমস্ত সম্পর্ক শেষ ৷ ব্রেকআপ তোমার সাথে!’ সাওন কেঁদে দিলো ৷ কাঁদতে কাঁদতে বলল,

—-না, তুমি এরকমটা করতো পারোনা ৷ জানোনা, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবোনা! শ্রুতি সাওনকে মৃদ্যুভাবে থাপ্পর মেরে মিষ্টি হেসে বলল,

—-আরে বোকা, আমরা তো ছোট ৷ যতদিন না বড় হচ্ছি ততোদিনের জন্য সম্পর্কচ্ছেদ ৷ বড় হলে তো আমি তোমার হয়ে যাবো! অতঃপর আমি বেহুশ!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত