দুইবোন

দুইবোন

-আরেকটা বোন থাকা নাকি খুব জরুরি সাবাই বলে। কিন্তু আমার লাগবে না। আমরা এক ভাই এক বোন তো বেশ আছি।

তারপরও আমাদের আরেকটা বোন হলো। তখন আমি ইন্টারে। ভাই ক্লাস সেভেনে। কি লজ্জা ছিলো বিষয়টা। বন্ধুরা সবাই ভীষণ রাগাতো আমায়। হাসাহাসি করতো। তারচেয়েও বেশি হিংসা লাগত তখন, যখন বাসায় এসে ওকে নিয়ে আধিখ্যেতা দেখতাম। মা কাজ করতে না পারার কারণে আমাকে করতে হতো সব কাজ। কারণ আমি তখন বড় হয়ে গিয়েছি । এতদিন অবধি ছোট্ট খুকি ছিলাম মায়ের জন্য। যখন ঠাম্মিরা বলত মেয়েকে কাজ শিখাও মা বলত- কি বলেন এত্ত ছোট মেয়ে আমার কি কাজ করবে?

আর শুনেছি আমি যখন হয়েছিলাম সবাই নাকি ছেলে আশা করেছিলো ঠাম্মি বাবা সবাই নাকি আমাকে প্রথমে দেখেই নাই। পরে যখন আমি সবার চোখের মণি হয়ে উঠি এই গল্প অনেক শুনেছি কিন্তু তখন খারাপ লাগতো না এখন লাগছে বাবা এই মেয়েটাকে এত আদর দিচ্ছে যেনো চোখে হারাচ্ছে। মা আমাকে এত আদর দিতে পারত না কারণ তখন অনেক মানুষ ছিলো কাকু পিসি ঠাম্মি অনেকে এখন কেউ নাই। কাজের লোক আছে মা সারাক্ষন এই মেয়েকে নিয়ে বসে থাকে। খুব হিংসা হতো কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারতাম না কারণ আমি তখন সত্যিই অনেক বড় হয়ে গেছি। আগে ভাইটা বাইরে থেকে আসলে সারাক্ষন আমার সাথে খুনসুটি আর ঝগড়া। এখন ওর দেখাও মিলে না। সারাক্ষন বাবুনি বাবুনি। এত গ্যাপে বোন আমার কি বুঝবে? আমি আমার কোন সমস্যা ওকে বলতে পারব? কি দরকার ছিলো বোনের আমার?

আমি ওকে কম দেখতে পারতাম ব্যাপারটা সবাই মোটামুটি বুঝেই গেলো কিন্তু কেউ কিছু বলত না। কি আধিখ্যেতা সবার। ও হাসছে খেলছে কথা বলছে হাটছে৷ যেনো সব নতুন দেখছে মা বাবা। ভার্সিটির থার্ড ইয়ারে উঠে মহিনের সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়। বোন তখন সবে চার বছর। এই নিয়ে শশুড় বাড়িতেও কম হাসির পাত্রী হতে হয় নি। তখনও যেন পিছু ছাড়ছে না। মহিনও কম না। মাঝে মধ্যে পিন মারত এত ছোট শালী কিছু করতেও পারি না। যত দিনে বড় হবে আমি বাঁচি কিনা সন্দেহ। খুব লাগত কথা গুলো।

দেখতে দেখতে আমারও দুইটা ছেলে হয়ে গেল। মা এসে খুব সাহায্যে করত কিন্তু থাকতে পারত না কারণ বাসায় ইরা একা। তখনো খুব রাগ লাগত যদি আমি একা মেয়ে হতাম মা এখানেই থাকতে পারত। মা বলত – রাগ করিস না মিরা। একদিন বুঝবি বোন কি জিনিস। বোনের মধ্যে মায়ের ছায়া থাকে। আমি মুখ ভেংচি দিয়ে বলতাম আমার বয়ে গেছে ও মেয়ের মধ্যে তোমার ছায়া খুজব। একদিন সব পাল্টে গেলো। মা বাবা এক্সিডেন্টে মারা গেলো। ইরা তখন ক্লাস সিক্সে। ভাই তখন ডাক্তারি পড়া শেষ। ওরটা ও নিজেই থাকতে পারে। সমস্যা হলো ইরাকে নিয়ে। আর কেউ তো নেই। আমার কাছেই রাখতে হলো। আমার কাছেই থাকতে শুরু করল। খুব আদুরে করে রেখেছে মা। খুব জ্বালাত এটা করে দাও ওটা পারি না। আমি মরি নিজের বাচ্চা নিয়ে নিজের জ্বালায়।

কিন্তু আস্তে আস্তে বোনটা বড় হতে শুরু করল। যেদিন ওর প্রথম পিরিয়ড হলো খুব ভালো করে ওকে বুঝালাম। খুব আদর করলাম ওইদিন খুব কষ্ট পাচ্ছিল। যেন মায়ের জন্য না কাদেঁ তা খেয়াল রাখছিলাম । এই দিন বুঝলাম বোন আমার কত আপন। ও বড় হচ্ছিল। আমাকে সাহায্য করত৷ বাচ্চাদের দেখত, আমি মহিনের সাথে কোথাও গেলে ওর উপর ঘর দিয়ে চলে যেতাম। ভাই টাও বিয়ে করেছে। বউটাও খুব ভালো৷ তবে বেশি যেতে ইচ্ছে করে না। আদর আপ্যায়ন করে। তবে কি বলব খুজেঁ পায় না ভাইয়ের বউয়ের সাথে৷ তারচেয়েও ইরার সাথে অনেক কথা হয় এখন।

আজ ইরার বিয়ে। আমার পছন্দেই ওর বিয়ে ঠিক করেছি। আমার উপর কথা বলে না। তাও ওর মতের যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিয়ে ঠিক করলাম। সবাই ভাবল আমি ওর মা। অনেকে বলেই ফেলল – এমা ওনি বোন নাকি? আমি তো মা ভাবছিলাম। অনেক এইজ ডিফারেন্ট তাই না? ঔদিন আমার খারাপ লাগেনি একটু ও। ভালোই লেগেছে। আমি তো ওর মা।

খুব কষ্ট লাগছিল বোনটাকে বিদায় দিতে। যেনো আমার আপন কেউ নেই আর। সময় চলে যায়। ইরার দুইটা মেয়ে এখন। আমার বাচ্চার এখন বড় হয়ে গেছে। এখন ইরার সাথে আমার বেশ মিল। দুই জনের শরীর দেখতে একই। তলপেট বাড়ছে কোমরে মেদ জমে ভাজ পড়ে। শাড়ি কাপড় ও মিলে যায়। এখন সংসারের কথা নিয়ে বসলে ঘন্টা চলে যায় মোবাইলে কথা বলতে।

ভাইয়ের বাসায় যায় কোন অনুস্ঠানে। যায় খেয়ে চলে আসি। তবে ইরার বাসায় কোন অনুস্ঠান করলে আমাকে একদিন আগে যেতে হয়। আমার উপর রান্না দায়িত্ব চাপিয়ে ও অন্য কাজ সারে। আমার বাসায় ও কোন কাজ পড়লে ইরা বাচ্চাদের নিয়ে চলে আসে। বেশ লাগে তখন। ইরার মেয়েরাও বড় হচ্ছে। আমার ছেলেরা তখন পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করে। একে একে ছেলেদের বিয়ে করিয়ে দিলাম। আমার তখন শরীর টা ভালো যাচ্ছে না। ইরাই সব করছে। ইরা মাসিকে পেলে ওদের সব হয়ে যায়। আমার যেনো আর কোন কাজ নেই এখন আর। কারো সাথে কথা বলব সে ইরা ছাড়া আর কেউ নেই।

নাতিদের নিয়ে ইরার বাসায় যায় প্রায়। দুইবোনে কথার ফুলঝুরি খুলে বসি। আমাদের কথা ওর ছোট বেলার কথা। মা বাবার কথা। পিসিত মাসিত বোনদের হাড়ির খবর নিয়ে গল্প জুরি। আমার বাসার পাশে থাকত সে বৌদির কথা। তার ছেলে মেয়ে কি করে। মহিনের কথা। যেনো শেষ ও হয় না। মাঝে মধ্যে ভালো না লাগলে ছেলেরাই বলে ইরা মাসির ওখানে গিয়ে ঘুরে এসো দুইবোনের গল্প করে কাটিয়ে দিবে সময়। ইরা ওর মেয়েদের সব সময় একই জামা কিনে দিতো। আমি আর ইরা কখনো একই জামা বা শাড়ি পড়ি নি। পড়ব কিভাবে? আমি যখন জামা পড়তাম ইরা তখন বেবি ফ্রক। যখন ও জামা পড়ত আমি তখন শাড়ি পড়ি। যখন ও শাড়ি পড়া শুরু করল আমি হালকা কালার আর ও লাল নীল সবে শুরু করল।

একদিন নাতিকে স্কুলে দিয়ে আসার সময় এক দোকানে দুইটা শাড়ি দেখলাম। বেশ হালকা তবে সাদা সবুজে বেশ৷ দুইজনকেই বেশ মানাবে এখন। দুইটা মিলিয়ে কিনে নিলাম। ইরার বাসায় গেলাম। শাড়ি পেয়ে বেশ খুশি ইরা। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে করে পানের বাটা নিয়ে দুই বোন ব্যালখনিতে বসলাম। আজ শেষ বেলায় এসে দুইবোন একই শাড়ি পড়লাম।

ইরা তেল এনে মাথায় লাগাতে শুরু করল। তখন হালকা শীত নিয়ে বিকেলে শীত আলো গায়ে লাগছিল। মৃদু বাতাসে ইরার তেলের গন্ধ যেন বেলী ফুলের গন্ধ ছড়াচ্ছে। ইরার ফুলের টবে নীল ফুলটার উপর আলো পড়েছে। কোথায় যেন একটা শালিকের কিচির মিচির শোনা যাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে সব যেন অনুভব করছিলাম। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিলো। বোন কি জিনিস একদিন বুঝবি বোনের মধ্যে মায়ের ছায়া থাকে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত