আজ সাত বছর পূর্ণ হলো। আমি আমার নিশি থেকে দূরে। নিশি আমার স্ত্রী। ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম আমরা। প্রচুর ভালবাসতাম ওকে। আমাদের সংসারটাও যে কম সুখের ছিল তা না। খুব সুখেই ছিলাম আমরা। কিন্তু সুখ খুব বেশী স্থায়ী হলো না আমাদের জীবনে।
নিশি তখন তিন মাসের প্রেগন্যান্ট। চাকরির সুবাদে আমাকে সুন্দর পুর বদলি হতে হলো। সুন্দর পুরে আমার এক বন্ধু র বাগান বাড়ি ছিল। আমরা তাই আর কোথাও বাড়ি না খুঁজে সেখানে গিয়েই উঠি। সেটাই ছিল আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল। বাড়িটা ছিল খুবই সুন্দর। শান্ত পরিবেশ। বাড়ির কেয়ার টেকার আবদুল মিয়া ছাড়া বাড়িতে কেউই থাকতো না। নিশি নিজে হাতে বাড়ি টাকে গুছিয়ে নিল। আর আমিও ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম আমার কাজে। সময় গুলো ভাল চলছিল কিন্তু সমস্যা শুরু হলো নিশির প্রেগ্ন্যাসির চার মাস পূর্ণ হওয়ার পর থেকে। এই টুকু লিখেই ধমকে গেলাম । সেদিনের রাত টা এখনো মনে পড়লে গায়ের লোম কাটা দেয়।
হঠাৎ করেই সেদিন দুপুর থেকে নিশির প্রচুর জ্বর। এতো জ্বর যে সে রীতিমতো জ্বরের ঘোরে কথা বলছে। আবদুল মিয়া আমাকে কল করে অফিস থেকে ডেকে আনলো। অফিস থেকে ফিরে দেখি নিশি রীতিমতো জ্বরে বেহুশ। নিশির গায়ে হাত রেখে মনে হচ্ছে হাত পুড়ে যাবে। সেদিন সকাল বেলাও আমি নিশিকে সুস্থ দেখে গিয়েছিলাম। কতো কথাই না বললো সে আমাকে। সুস্থ মানুষ টা দুপুরে এভাবে জ্বরে বেহুশ হয়ে থাকবে ভাবতেও পারিন।
“আমি ভাবিরে অনেক বার নিষেধ করছিলাম পোয়াতি হইয়া বাড়ির পেছনে উত্তর দিকে না যাইতে। কিন্তু সে আমার কথা শোনে নাই। বিড়বিড় করে বললো আবদুল মিয়া। আমি এবার ধমকের স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, “স্পষ্ট করে বলো যা বলবা। আর কি হয়েছে আজকে?
“দুপুরের ঘটনা স্যার। আমি ঘুমাতে যামু এমন সময় ভাবি আইসা আমারে কইলো, বাড়ির উত্তর দিকে গাছ লাগাবে । উত্তর দিকটা ফাঁকা তার ভাল লাগে না। তাই মাটি খুঁড়ে দিতে। আমি বললাম এই ভর দুপুরে ঐ দিকে না যাওন ভালো। আর ঐ দিকে গাছ লাগনোর দরকার নাই। কিন্তু ভাবি জেদ করলো আমি তখন তাকে মানা করলাম বাড়ির উত্তর দিকে না যাইতে। কারণ টাও বললাম কিন্তু আফনে রা পড়া লেখা জানা মানুষ জন কি আমাদের কথা বিশ্বাস করেন? ভাবি ও তাই করলো। আমি আবার জোরে ধমক দিয়ে বললাম, পুরো কথা শেষ করো।
” আমি শুয়ে পড়ছিলাম। কতক্ষণ পর জানি না হঠাৎ ভাবির চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে যায়। আমি ঠিক জানতাম ভাবি উত্তর দিকে গেছে। আমি সেইখানে যাই দেখি। ভাবি একটা কোদাল দিয়া গর্ত করছে কিন্তু সে গর্তের ভিতর একটা মাথা কাটা পুতুল শোয়ানো। মনে হচ্ছিলো কেউ যেন খুব যত্ন করে পুতুল টাকে মাটি চাপা দিয়ে রাখছে।
এই বলেই আবদুল মিয়া চুপ। আমি ধরে নিয়েছিলাম নিশি হয়তো পুতুল দেখে ভয় পেয়েছে। সুন্দর পুর ছিল গ্রাম। ছোট একটা গ্রাম। আবদুল মিয়া কে সদর থেকে ডাক্তার আনতে পাঠালাম। আর আমি রইলাম নিশির কাছে। দিন যতো গড়াচ্ছিল নিশির জ্বর ততো বাড়ছিল। কি সব যেন বিড়বিড় করে বলছিল সে। সারাদিন মাথায় পানি দিলাম। হঠাৎ করে সন্ধ্যার দিকে তুমুল ঝড় উঠলো। এমন ঝড় যেন সব লন্ডভন্ড করে নিয়ে যাবে। মনে হচ্ছিলো অাজ হয়তো কারও জীবনে ঝড় বইবে। সারা বাড়ির কারেন্ট চলে গেল। আমি নিশির পাশে একটা হারিকেন জ্বালিয়ে বসে রইলাম। তখনো নিশির গায়ে আগুনের তাপ। হঠাৎ নিশি চোখ খুললো। আমি নিশির চোখ খোলা দেখে আস্তে করে নিশির কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম,
“নিশি! কিছু লাগবে তোমার?
” ভুল হয়ে গেছে সামিউল বিরাট বড় ভুল। তুমি আমাদের সন্তান কে বাঁচাও প্লিজ সামিউল প্লিজ।
এই বলে নিশি আবারো চোখ বন্ধ করে ফেলল। আমি ভাবলাম হয়তো সে জ্বরে বিলাপ করছে বা দুঃস্বপ্ন দেখেছে। সারাদিন প্রচুর ক্লান্ত থাকায় নিশির পাশে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম মনে নেই। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় ঘরের জানালা খুলে গেল। জানালা খোলার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠে দেখি বাইরে ফুটফুটে জোছনা। মনে হচ্ছিলো এতো সুন্দর জোছনা আমি আর জীবনে দেখিনি। হঠাৎ দেখি নিশি আমার পাশে নেই। পুরো ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম কোথাও নেই নিশি।
বাতাসে মৃদু কাঁঠালি চাপা ফুলের ঘ্রাণ আসছে আর আসছে নিশির গলা। নিশির গলা কোন দিক দিয়ে আসছে বোঝার চেস্টা করলাম। বুঝতে একটু কস্ট হলেও নিশির গলা বাড়ির বাহির থেকে আসছে বুঝতে পারলাম। হারিকেন জ্বালিয়ে ঘর থেকে বের হলাম। বাগান বাড়িটি ছিল দু তালা। আমরা ছিলাম বাড়ির নিচতলায়। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আসতে কাঁঠালি চাপার ঘ্রাণ তীব্র হতে লাগলো। আর নিশির গলাও পরিস্কার হতে লাগলো। মনে হচ্ছিল কেউ যেন কিছু চিবাচ্ছে আর ভাঙা গলায় ঘুম পাড়ানী গান গাচ্ছে। বাড়ির বাহিরে এসে বুঝতে পারলাম বাড়ির পেছনে উত্তর দিক থেকে নিশির গলা পাওয়া যাচ্ছে। ছুটে গেলাম বাড়ির পেছনে।
“নিশি এই নিশি। নিশি চুল ছেড়ে দিয়ে বসে গুনগুন করে গান গাচ্ছে আর কি জানো চিবাচ্ছে।
” নিশি এই নিশি। কি করছো এখানে ঘরে চলো।
তাও নিশির কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি ওর আরো কাছে এগিয়ে গেলাম। তারপর ওর গায়ে হাত দিয়ে বললাম, ‘”নিশি ওঠো ঘরে চলো।
নিশি গান থামিয়ে আমার দিকে ফিরলো। হয়তো না ফেরাই ভাল ছিল। নিশিকে দেখে আমি ওর কাছ থেকে দূরে সরে গেলাম। আমার চোখ যেন ভয়ে বেড়িয়ে আসছিলো। নিশির সারা মুখে রক্ত লাগানো। এতোক্ষন ধরে যে চিবানোর আওয়াজ আসছিল তা হলো নিশি এতোক্ষণ নিজের হাত নিজে খাচ্ছিল। ওর কোলে একটা পুতুল। পুতুল টার মাথা নেই। আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
সকালে উঠে দেখি আমি ঘরে। সেই রাতে আমার জ্ঞান হারানোর পর আবদুল মিয়া ডাক্তার নিয়ে আসে আমাকে সেই উদ্ধার করেছে। সকালে জানতে পারলাম নিশিকে হাত পা বেধে রাখা হয়েছে। সে নিজেই নিজের হাত পা ক্ষত বিক্ষত করেছে। তাই তাকে বেধে রাখা হয়েছে। আর দেরি করলাম না। সেদিনই ঢাকায় নিয়ে এসে নিশিকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করলাম। মানসিক হাসপাতালে ই আমাদের ছেলের জন্ম হলো। কিন্তু বাচ্চা টা মৃত জন্মালো। আমাদের বাচ্চাটা মাথাবিহীন জন্মেছিল। আমি এতোটাই দূর্ভাগা যে নিজের ছেলের মৃত দেহ টাও দেখার সাহস পাইনি আমি হতভাগ্য আমি হতভাগ্য আমি হতভাগ্য!
এই টুকু লিখেই ধমকে গেলাম। তারপর সাত বছর কেটে গেছে। নিশিকে কোনদিন দেখতে যাই নি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত তিনটা বাজে। না মাথাটা আবার ধরেছে। ডায়েরিটা বন্ধ করে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি খুব পরিচিত একটা মুখ। ভাল করে তাকিয়ে দেখি নিশি। রীতিমতো ভরকে গেলাম নিশিকে দেখে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারতেছিলাম না। সত্য কি নিশি তা জানতে তড়িঘড়ি করে চারতালা থেকে নিচে নামলাম। পাগল এর মতো দৌড়ে বাড়ির বাইরে এসে দেখি কেউ নেই। নিজেকে পাগল প্রায় লাগছিলো। বাসায় এসে আবার বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম হয়তো চোখের ভুল ভেবে বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম ভাঙলো ফোনের চিৎকারে। কিছুটা বিরক্ত হয়ে ফোন ধরলাম।
“আপনি কি সামিউল হক?
” জ্বী।
“আমি মানসিক হাসপাতাল থেকে বলছি। আপনার স্ত্রী কাল রাত তিনটা র দিকে আত্মহত্যা করেছে।