সুন্দরী বড়লোক ছাত্রীর বার্থডে।একমাস আগে দাওয়াত দিয়েও গত কদিন ধরে বারবার রিমাইন্ডার দিয়ে যাচ্ছে।বলেছিলাম,ব্যস্ত।টিউশনির জন্য দৌড়াদৌড়ির অন্ত নেই।সেই সকালে বাসা থেকে বের হয়ে গভীররাতে বাসায় ফিরতে হয়।তবুও তারা নাছোড় বান্দা।যেতেই হবে।
তাকে ক্লাস নাইন থেকে পড়াই,তখন আমি ভার্সিটির ছাত্র।এখন কলেজে পড়ে।এখনো পড়াই নিয়মিত ।সেই হিসেবে তাদের সাথে সম্পর্কটা মোটামুটি ভালোই বলা চলে।তাই বার্থডে না গেলেও খারাপ লাগে।
সেদিন যেসব টিউশনি ছিল,সব বাদ দিয়ে দিয়েছি আগের দিন যোগাযোগ করেই।সকালে ইস্ত্রি করা শার্ট-প্যান্ট পরে কলেজে গিয়ে ক্লাস করেছি।কলেজ শেষ হতে হতে অনেকটা বিকেল হয়ে গেল।অফিসরুমে বসে এসির হাওয়া খাচ্ছিলাম,অমনি কথুকে সেই ছাত্রী এসে ধরল,”স্যার,আজ তো আমার বার্থডে,চলুন আমাদের বাসায়।” বিব্রত হলাম।বললাম,”আরে নুসরাত!এখন কেন?তোমার বার্থডে পার্টি তো রাতে,আমি তখনই যাব।” “না স্যার,আপনাকে এখনই যেতে হবে,কোন কথা শুনব না।” বললাম,”না না!আসলে এখন আমার মিটিং আছে তো তাই।তাছাড়া আজ তোমার বার্থডে,খালি হাতে তো আর যাওয়া যায় না,তুমিই বাসায় চলে যাও।আমি যথাসময়ে পৌঁছে যাব।
নুসরাতের বাসায় রওনা হলাম একটা ‘শো পিচ’ গিফট পেপারে মুড়িয়ে।পাঁচতলা বাড়ির সামনে গিয়েই অবাক চোখে দেখলাম বাড়ির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত রঙ বেরঙের ঝিলিক বাতি ঝলমল করছে।আরে বাবাহ!দেখে মনেই হবে না জন্মদিন,মনে হচ্ছে কোন কোটিপতির একমাত্র কন্যার বিয়ে।বড়লোকের যা বৈশিষ্ট্য আরকি।
যাই হোক,ছোট্ট গিফটখানা হাতে নিয়ে আমি ধীরেধীরে তিনতলায় উঠে ঘরে প্রবেশ করলাম।সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রীর বাবা-মা এসে আমাকে সাদরে গ্রহণ করল।বিশাল বড় ডাইনিং রুম জনস্রোতে ভরপুর,চারদিকে আলোকসজ্জা।লাল-নীল শাড়ী,পাঞ্জাবি পড়ে চারদিকে বিভিন্ন বয়সের ছেলে মেয়েরা ছোটাছুটি করছে।পাশেই ড্রয়িং রুমে জাঁকজমক আলোকসজ্জার মাঝে হৈহুল্লোড়ে মেতেছে জোয়ান-বৃদ্ধ সকলে,তারই একপাশে একটা রুমে বড় একখানা কেক রাখা আছে।উপরে ডায়মন্ডের মত জ্বলজ্বল করা কী একরকম পাথরে লিখা আছে ‘HAPPY BIRTHDAY’। এসি করা ছোট্ট একটা সাজানো রুমে আমাকে বসানো হল।আমি অভিভূত হয়ে চারদিকটা দেখছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম।
এক/দুই ঘন্টা কেটে যাচ্ছে।আমি এখনো রুমে বসে আছি।সারাদিনের পরিশ্রমের দরুন আমার খিদে পেয়েছে ভালোই,অথচ চারদিকে সবাই ছোটাছুটিতে ব্যস্ত;কেক কাটার নাম গন্ধও পাচ্ছিনা আমি।নুসরাতের মা কিছুক্ষণ আগে এসে বলে গেছেন,ছোটখাটো একটা মিলাদের আয়োজন করেছে তারা,হুজুর আসতে দেরি হচ্ছে বলেই প্রোগ্রামটা শুরু হতে বিলম্ব হচ্ছে।আরো আধঘণ্টা প্রায় একলা রুমে অপেক্ষা করে আমি ডাক দিলাম ছাত্রী নুসরাতকে।লাল শাড়ী পরা সুন্দরী নুসরাতকে আজ আরো সুন্দর লাগছে।সে কাছে এসেই বলল,”স্যার আসেন,একটা সেলফি তুলি।” দু/একটা তোলার পরই সে আমার ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে নিজেই নিজের সেলফি তুলতে তুলতে মনের অজান্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।মেয়েদের যা স্বভাব আরকি!ছবি তোলাই সব!
বেশ কিছুক্ষণ পর নুসরাতের সাথে রুমে প্রবেশ করেছে তার মা,বাবাসহ আরো ক’জন তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বোধ হয়,সঙ্গে আছে টুপি-দাড়িওয়ালা এক হুজুরও।বললাম,”মিলাদ শুরু হবে?আমি সামনে আসব?” নুসরাতের বাবা বলে উঠল,”না না!এটা ছোটখাটো মিলাদ,আমরা আমরাই সারব এই রুমে।একটু অবাক হয়ে আমিসহ যারা আছি সবাই খাটের উপর গোল হয়ে বসলাম।মিলাদ শুরু হলো।হুজুর সাহেব দোয়া-দরূদ পড়ছেন।সকলেই চোখ বন্ধ করে আছে।আমিও বাকিদের ফলো করে নিজের চোখ বন্ধ করে হুজুরের দুর্বোধ্য দোয়া শুনে যাচ্ছি।হঠাৎ-ই একপর্যায়ে এসে আচমকা কানে বাড়ি দিল এক অদ্ভুত আওয়াজ,
“মোহাম্মদ আমিরুম ইসলামের একমাত্র কন্যা নুসরাত বিনতে খানমকে জনাব আখতারুজ্জামান,(পিতা: আসাদুজ্জামান) দশলক্ষ এক টাকা দেনমোহরে বিবাহ করিতেছে,বলুন কবুল।”
“কী!!!” আমি চোখ খুলে আকাশ থেকে পড়লাম!”কী হচ্ছে কী এসব?কে বিয়ে করছে,কেন আমি কবুল বলব,এসবের মানে কী!!!” নুসরাতের মা আমার মুখ বন্ধ করে দিল চেপে।যে কয়জন সেখানে ছিল,সবাই-ই আমাকে ঘিরে ফেলল চারপাশ দিয়ে।হযবরল অবস্থা!আমি বিস্ফোরিত চোখে সকলের দিকে চেয়ে আছি।নুসরাত হঠাৎ কাছে এসে বলল,”বিশ্বাস কর,তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি।আমাকে তোমার বিয়ে করতেই হবে।তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবনা।” কী এক অবস্থা!চার বছরের পুরোনো স্যারকে ছাত্রী ‘তুমি তুমি’ করে বলছে???আমি তো থ বনে গেলাম।কী হচ্ছে এসব!নুসরাতের মা এসে বোঝালো,”আমার পাগল মেয়েটা তোমাকে ছাড়া বাঁচবে না।বিশ্বাস কর,তোমাকে ও খুব সুখে রাখবে।” কিছুক্ষণ পর নুসরাতের বাবা পাশে এসে বসলেন।বললেন,”দেখ আখতার,অনেক বছর ধরেই তোমার সাথে আমাদের পরিচয়।আমাদের সম্পর্কেও তুমি জানো।ইনশাল্লাহ আমাদের ধনসম্পত্তির কমতি নেই।চাইলেই আমি আমার মেয়েকে কোটিপতির ঘরে বিয়ে দিতে পারতাম,কিন্তু মেয়েটা তোমাকে ছাড়া বাঁচবেনা।ও রোজই তোমার নাম করে নামাযের পাটিতে কান্নাকাটি করে।বিশ্বাস কর,এছাড়া আমার কোন উপায় ছিলনা।”
মেজাজ আমার ক্রমেই চারশোবিশ হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছিলাম।হার্টবিট অনবরত বেড়েই চলছে।চারদিক পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলাম আমাকে রুমে বন্দী করা হয়েছে।বের হওয়ার জো নেই।আমার মোবাইল???ওহ,আই সি!মোবাইলও ভনিতা করে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে আগেই।মহাকেলেঙ্কারি!যারা এই ধরনের একটা জঘন্য কাজ করতে পারে তাদের মেয়েকে বিয়ে করলে তো সারাজীবন আমাকেই ভুগতে হবে!তাছাড়া,বিয়ে তো ছেলেখেলা নয়,পাত্রী রূপসী হলেই বিয়ে করা যায় না।আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।নিজেকে বোঝালাম,জোরজবরদস্তি করে লাভ হবে না,আমি জিম্মি হয়ে গেছি।যা করার বুদ্ধি দিয়ে করতে হবে।
এরইমধ্যে আরো ঘণ্টাখানেক চলে গেছে।আমি এখনো রুমে বন্দী।সঙ্গে হুজুর বেশি কাজী,নুসরাত,নুসরাতের মা বাবা সবাই আছে।একে একে সবাই আমাকে বোঝাচ্ছে।লক্ষণ ভালো নয়,দেখে বোঝা যাচ্ছিল সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকাতেও তারা প্রস্তুত।বেশ কিছুক্ষণ আত্মরক্ষার উপায় খুঁজে অবশেষ তাদের বললাম,”দেখুন,বিয়েটাতো বললেই হয়না।আত্মীয়স্বজন ছাড়া,কারো মতামত ছাড়া কীভাবে কী!সত্যিকথা বলতে ছোটকাল থেকে আমারও স্বপ্ন ছিল নুসরাতের মতই কোন এক সুন্দরী আমার বউ হবে,নুসরাত আমাকে ভালোবাসে এটা আমার পরম সৌভাগ্য।কিন্তু তাই বলে হুটহাট এইভাবে তো সম্ভব নয়।অন্তত আমার ফোনটা দিন,আব্বা-আম্মাকে বলে দোয়া চেয়ে নিই।”কথা শুনে নুসরাত খুশিতে লাফিয়ে উঠলেও নুসরাতের বাবা-মা একে অপরের চোখে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন।নুসরাত শাড়ীর আঁচল থেকে ফোনখানা আমাকে দিতে যাবে,অমনিই নুসরাতের মা ফোনটা নিজের হাতে কেড়ে নিল।নুসরাতের বাবা আমাকে বোঝাল,”বিয়েটা আগে হয়ে যাক,তারপরই সব করা যাবে।”
বিরক্ত হয়ে আমি রেগে যাচ্ছিলাম।অনেক কষ্টে দমিয়ে রেখেছি নিজেকে।বললাম,”বিশ্বাস করুন।বিয়েটা আমি করবই।শুধু একটিবার মায়ের দোয়া নিই?প্লিজ!” প্রশ্ন এলো কানের ভেতর,”যদি তাঁরা রাজি না হয়?ভালোই ভালোই আগে বিয়েটা হয়ে যাক।” একটু ভেবে বললাম,”আচ্ছা তাহলে আমার বন্ধুদের অন্তত একটু বলি?তাদের অনেকদিনের ইচ্ছে,দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার বিয়ে দেখবে।প্লিজ,অন্তত কয়েকজনকে?”
অনেক কথাবার্তা,শর্তের পর ফোনটা দু’মিনিটের জন্য আমার হাতে দেওয়া হলো।আমাকে রুমে বন্দী করে বাকিরা থেকে থেকে আসা-যাওয়া করছে।সুযোগ বুঝে আমিও বেলকনিতে গিয়ে দ্রুত ফোন দিলাম সবচেয়ে কাছের ক’জন বন্ধু অলয়,রাফসান আর আরমানকে।উত্তাল হার্টবিট নিয়ে একে একে তাদের বললাম পুরো ঘটনা–আমাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে।বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।তোরা যতজন পারিস,যতদ্রুত পারিস পুলিশ নিয়ে এই এই ঠিকানায় ছুটে আয়।
কথাগুলো আরমান,রাফসানকে বলার পর একটু নিশ্চিন্ত হলাম।ফোনটা আবার নিয়ে যাওয়া হয়েছে।সকলে বসে আছে চারপাশে।অপেক্ষা আমার বন্ধুদের।আমি বলেছি,”আমার বন্ধুরা আসছে,ওরা এলেই আমি বিয়ে করব।” নুসরাতের বাবা মেইন দরজার সামনে গিয়ে অপেক্ষা করছে আমার বন্ধুদের জন্য।ভেতরে আমি ক্লান্ত হয়ে বসে আছি।বাকি রুমগুলোতে তখনো জন্মদিনের হৈচৈ,হুল্লোড়।দেখে মনে হচ্ছে অতি অল্পকজন ছাড়া কেউ আসল ব্যাপারটা জানেই না।সকলেই মিথ্যা জন্মদিনের উৎসবে মাতোয়ারা।সময় যাচ্ছে।নুসরাত একটু পর বড় এক টুকরো কেক এনে আমার মুখে পুরে দিয়েছে।সামনে শরবত,পানি,মিষ্টি সবই আছে।ক্ষুধায় আমার পেট যায় যায়,তবুও গিলতে পারছিনা কিছুই।নিরব-নিবিড় চিত্তে আমি সময় গুণে যাচ্ছিলাম কখন আমার বন্ধুরা পুলিশ নিয়ে আসবে।
ক্লান্ত আমি বিছানায় প্রায় শুয়ে পড়েছিলাম।বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ এক চিৎকারে চোখ খুলে ফেললাম।আলহামদুলিল্লাহ!!!অলয়,রাফসান,আরমান মোটামুটি বেশকিছু পোলাপান নিয়ে রুমে ঢুকেছে।বিছানা ছেড়েই দৌড়ে গিয়ে তাদের চিৎকার করে বললাম,”তোরা এসেছিস?আমাকে বাঁচা।এরা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।আমি কিছুতেই কবুল বলিনি।তোরা আমাকে বাঁচা।”
কিছুই বুঝলাম না।আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধুমহলের সকলেই বিশাল বিশাল পুষ্পমাল্য বের করে আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে পরিষ্কার গলায় বলে উঠল,”কাজী সাহেব,বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।ও কবুল বলবে না,ওর বাপ কবুল বলবে!!!