সকালে চায়ের কাপে সবে একটা চুমুক দিয়েছি, এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। একটু অবাকই হলাম। আমার বাড়িতে লোকজন খুব একটা আসেনা, তার উপর রবিবার এত সকালে! ঘড়িতে দেখলাম ন’টা বাজে। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। আর যিনি দাড়িয়ে আছেন, তাকে দেখে প্রায় চমকে উঠলাম। দেখি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন আমার ছোট-মামা। তাড়াতাড়ি প্রণাম করে বললাম, “তুমি আবার কষ্ট করে আসতে গেলে কেন? আমাকে ফোন করলেই তো আমি চলে আসতাম।”
ছোট-মামা সামান্য হেসে সোফায় বসতে বসতে বললেন, “চলে এলাম আর কি। আসলে কি জানিস বাবু, সারা জীবন এত ছুটোছুটির পর এই বুড়ো বয়সে বাড়িতে বসে থাকতে কি ভালো লাগে, বল? তার উপর তোর মামিমাও তো নেই। বুবাইও থাকে আমেরিকায়। আমার এখন এমন অবস্থা, যে মরে পড়ে থাকলেও লোকে জানতে পারবে না, যতক্ষণ না পরের দিন বেলায় রান্নার লোক আসছে। যাই হোক, এক কাপ চা খাওয়া আগে, তারপর একটা মজার জিনিষ দেখাব।”
আমি উঠে গিয়ে এক কাপ চা ঢেলে আনলাম থারমোফ্লাক্স থেকে। চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে মামা বললেন, “সেই দোকানের চা। ছ্যাঃ। কতবার বলেছি এক খানা বিয়ে কর, তা না। বসে বসে থারমোফ্লাস্কে চা খাচ্ছে।”
তারপর একটু থেমে আবার বললেন, “বুঝলি, কাল হঠাৎ কি মনে হতে চিলেকোঠার ঘরের পুরনো ট্রাঙ্কগুলো খুলে দেখছিলাম বুঝলি, হঠাৎ নজরে এল এইটে।” বলে কাঁধের ঝোলায় হাত ঢুকিয়ে বের করলেন একটা শত জীর্ণ ডাইরি।
ডাইরিটা হাতে নিয়ে নাড়া চাড়া করে দেখলাম। উপরের মলাটটার অর্ধেকটা ছিঁড়ে গেছে। বাকি অর্ধেকটা দেখে মনে হল রংটা হয়তো নীল বা বেগুনী ধরনের কিছু ছিল, তবে এখন কালচে হয়ে গেছে। খুলে দেখলাম হলদেটে মচমচে পাতার উপরে মুক্তর মত হাতের লেখায় লেখা ১৯৯৭ – ১। তার নীচে লেখা লেখকের নাম – সুনীল রঞ্জন মিত্র উরফে আমার ছোটমামা।“এটা পড়ে দেখিস, তোর গল্পের রসদ পেতে পারিস,” শেষ চুমুকটা দিয়ে কাপটা টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন ছোটমামা।
আরও বেশ কিছুক্ষন গল্প করে উনি চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বললেন, “বুঝলি বাবু, অলৌকিকে আমার কোন দিনই বিশেষ বিশ্বাস ছিল না। তোর মামিমা বিশ্বাস করতেন খুব। কিন্তু এই ঘটনাটার পর সব কিছু কিরকম যেন গুলিয়ে গেল।” মামা চলে যাওয়ার পর আমি ডাইরিটা খুলে বসলাম। হলদে পাতাগুলো খুব যত্ন সহকারে উল্টাতে হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল একটু জোরে চাপ পড়লেই পাতাগুলো পাঁপড়ের মত মড়মড় করে ভেঙে যাবে। প্রথম দিকে সেরকম কিছুই ছিল না বিশেষ। জানুয়ারি থেকে মার্চ অবধি দৈনিক রোজনামচা লেখা। কিন্তু, তারপর… ২৩ মার্চ ১৯৯৭
আজ সকাল থেকে শরীরটা খুব একটা ভাল যাচ্ছে না। এই সময়টায় যে একটা সিজিনাল চেঞ্জ হয়, সেটা প্রায় প্রতি বছরই আমাকে কাবু করে ফেলে। যদিও এই কাবু করার অসুখটা আমার বেশিদিনের নয়। কলকাতায় থাকতে এই ব্যাপারটা ছিল না। ওখানে তো ঠাণ্ডা মানে একমাস, তাও আবার ১৩-১৫ ডিগ্রী। কিন্তু এই পলাশপুর নামক আধা গ্রাম আধা শহরে ঠাণ্ডা থাকে প্রায় মার্চের মাঝামাঝি অবধি। ঠাণ্ডা মানে সে দারুণ ব্যাপার। গতবছর ঠাণ্ডা পড়েছিল প্রায় ১ ডিগ্রী। এই বছর একটু কম, তাও ৫-এর বেশি হবে বলে তো মনে হয় না। কালকের থেকে আজকে যেন শরীরটা একটু বেশিই খারাপ লাগছিল। তাই থানায় ফোন করে বলে দিয়েছি যে আজ সকালে আর যাব না। দেখি বিকেলের দিকে একবার যদি পারি তো ঢু মেরে আসব। আসলে আমাদের এই পলাশপুরে ক্রাইম রেট এত কম যে, গত বছর ইন-চার্জ হয়ে আসার পর কতগুলো কেস এসেছে সেটা হাতে গুনে বলে দিতে পারব। ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে হলে বেশ মুষড়ে পড়তাম কাজের অভাবে। কিন্তু আমার রিটায়ারমেন্টের আর বছর দুই বাকি। এই সময় এই শান্তির চাকরিটা বেশ উপভোগই করছি।
স্ত্রী ছেলে কলকাতায় বলে নিজেকেই সব কাজ করতে হয়। শুধু দুপুরে একবার রানুর মা এসে দুবেলার মত রান্না করে দিয়ে যায়। কাঁপা হাতে এক কাপ লবঙ্গ-চা করে খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল রানুর মায়ের ডাকে। শরীরটা খানিকটা সুস্থ বোধ করছি। ভাবলাম দুপুরে খেয়ে একবার থানাটা ঘুরে আসি। কাজ যে বিশেষ আছে তা না, তাও দিনে একবার না গেলে ঠিক ভালো লাগে না। তাছাড়া কিছু সই-সাবুদও করার আছে। ২৪ মার্চ ১৯৯৭ কাল রাতে শরীরটা বড্ড খারাপ ছিল তাই লিখতে পারিনি। কিন্তু কাল যে ঘটনাটা ঘটেছে, সেটা না লিখেও থাকতে পারলাম না।
দুপুরে অফিসে গিয়ে দেখি একটা আজব দৃশ্য। আমাদের থানার লাগোয়া যে সেল বা এক কামরার জেল-খানাটা আছে, তার ভিতরে জনা ছয়েক ছেলে বসে আছে। আজব বলছি কারণ পলাশপুরের জেলে যে এক সাথে ছ’জন আসামী থাকতে পারে, সেটা কেমন যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমাকে দেখে থানার ছোটবাবু সেলুট করতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি হে সুবিমল, এরা আবার কারা?” “আর বলবেন না স্যার, এই ছোট বয়সে জুয়ার নেশা ধরেছে ব্যাটাদের। হাইস্কুলের পিছনের মাঠটায় বসে জুয়া খেলছিল। আমি আর অভিরাম গেছিলাম রাউন্ড দিতে, ব্যাস, ধরে ফেললাম,” মুখে একটা গর্বের হাসি নিয়ে বললেন থানার ছোটবাবু সুবিমল খাঁড়া। আমি সেল-টার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছেলেগুলোর বয়স আন্দাজ ১৬-১৭ বছর। চেহারা বা পোশাক দেখে মনে হয় না খুব সম্ভ্রান্ত পরিবারের বলে। আমাকে দেখে একটা ছেলে ভ্যা করে কেঁদে দিল।গম্ভির গলায় বললাম, “কি রে কাঁদছিস কেন?”
“হুজুর, আমাদের ছেড়ে দিন হুজুর। বাপ জানতে পারলে খুব মারবে, হুজুর।”
“বাপ কি করে তোর?”
“দোকান চালায় হুজুর, শ্যামল নন্দী।”
“নন্দী স্টোরের শ্যামল?”
ছেলেটা মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। বাকি ছেলেগুলোর পরিচয় যা পেলাম তারা সবাই পলাশপুর হাই-স্কুলের ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র। আর সবার বাবাই ক্ষেতে না হয় দোকানে কাজ করে। সুবিমলকে ডেকে বললাম, “এদের বাবাদের খবর দাও। দেখে যাক তাদের গুণধর ছেলেরা কি করছে।”আমার কথা শুনে ছেলেগুলো হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। আমি সুবিমকে আড়ালে ডেকে বললাম, “কাউকে ডাকার দরকার নেই বুঝলে, বেকার মার ধর করবে বাচ্চাগুলোকে। একটু ভয় দেখিয়ে বিকেলের দিকে ছেড়ে দিও খন।” আমার কথা শুনে সুবিমল সামান্য হেসে বলল, “সে আর বলতে। ঐ একটাকে বাদ দিয়ে তো সব কটাকেই চিনি।”
“কোনটাকে?”
“ওই যে, সাদা রংয়ের ছেড়া পাঞ্জাবী পরা ছেলেটা।”
আমি একটু অবাক হলাম। কই খেয়াল করলাম না তো? আবার গেলাম সেল-টার সামনে। ভিতরের হালকে বাল্বের আলোয় লক্ষ্য করলাম, সেলের এক কোণায় বসে আছে একটা ছেলে। মুখটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। মনে হল আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি হাত নেড়ে বললাম, “কি রে তোর নাম কি?” ছেলেটা কোন উত্তর দিল না।
আমি এবার একটু চেঁচিয়ে বললাম, “কি হল, কথা কানে যাচ্ছে না? সামনে আয়।” ছেলেটা খুব আস্তে আস্তে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। চেহারা বাকি ছেলেগুলোর মতই। ময়লা রঙ, রোগা, চুল উসকো খুসকো। কিন্তু যে ব্যাপারটা ভীষণ ভাবে আমার চোখ টানল, সেটা হল ছেলেটার চোখ দুটো। ছেলেটার চোখের মনির রঙ নীল। আমি এই পলাশপুরে কাউকে দেখেছি বলে তো মনে হয় না যার চোখের মণি নীল। আরও একটা ব্যাপার যেটা আমার চোখে লাগল সেটা হল এই বয়সের ছেলেদের চোখে যে একটা অস্থিরতা থাকে সেটা এই ছেলেটার চোখের মধ্যে অনুপস্থিত। চোখ দুটো ভীষণ রকম স্থির।
“কি নাম তোর?” জিজ্ঞেস করলাম। কিছুক্ষন চুপ থেকে মিহি গলায় উত্তর দিল, “দীনু।” “কোথায় থাকিস?” কোন উত্তর দিল না ছেলেটা। শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। “কি রে, কি জিজ্ঞেস করছেন স্যার? থাকিস কোথায়?” ধমকের সুরে বলল সুবিমল। দীনু কিছুক্ষন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সুবিমলের দিকে, তারপর বলল, “নদীর ওপারে, মুচি পাড়ায়।” মুচিপাড়া পলাশপুরের থানার আওতায় পড়ে না। ওটা পড়ে ডুংরি থানার জিম্মায়। ডুংরি থানার বড়বাবু আমার পরিচিত। সুবিমলকে বললাম, “খবর নাও।”
এই বলে চলে আসছি, এমন সময় লক্ষ্য করলাম ছেলেটার হাতে এক বান্ডিল তাস। বান্ডিল বলা ঠিক হবে না, কারণ বাহান্নটা তাস থাকলে বাণ্ডিলটা যত মোটা লাগে এটা ততটা নয়। দেখে মনে হল খান পচিশেক তাস হবে। প্রথমে ভাবলাম একবার ভালো করে কড়কে দিই, তারপর ভাবলাম, না থাক, এমনিতেই ছেলেগুলো ভয়ে আধমরা হয়ে আছে। সুবিমলকে ডেকে বললাম, “ছেলেগুলোকে চারটে নাগাদ ছেড়ে দিও।” সুবিমল মাথা নেড়ে চলে গেল। চেয়ারে বসে বসে কখন যে চোখটা বুজে গিয়েছিল, বুঝতে পারিনি। তন্দ্রা কাটল একটা চেঁচামিচিতে। কেবিন থেকে বেরিয়ে দেখি সেল-এর ভিতর থেকে সেই দীনু নামক ছেলেটাকে সুবিমল বাইরে এনে বসিয়েছে। ছেলেটার ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। “কি হল?” উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলাম।
সুবিমল দীনুকে একটা চেয়ারে বসাতে বসাতে বলল, “আর বলবেন না স্যার, এ ব্যাটা নাকি আবার ভবিষ্যৎ বলে। তাই বলতে গিয়ে সুবিমলের কথা শেষ হল না। দীনু ডান হাতের তেলো দিয়ে ঠোঁটের রক্ত মুছতে মুছতে বলল, “ভবিষ্যৎ বলি না হুজুর। আমি ভবিষ্যৎ বলব কি করে। আমায় তাস যা দেখায়, আমি তাই বলি।” “মানে?” বললাম আমি। “আমি শুধু মানুষের মৃত্যু দিন বলতে পারি, আর কিছু না,” বলল দীনু। আমি মুচকি হেসে বললাম, “তাই! কি করে বলিস একবার দেখা। বল আমার মৃত্যু কবে হবে?” সুবিমল রেগে বলল, “ছাড়ুন না স্যার, সব শালার বুজরকি। আমাকে বলে কি না আমি ৩০ শে মার্চ মারা যাব।” সুবিমলের বয়স বছর ত্রিশেক হবে। বেশ সুস্থ সবল ছেলে। পুলিশ টিমে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলে। ও চাকরিটাও পেয়েছে এই স্পোর্টস কোটায়। আমি দীনুর দিকে ফিরে বললাম, “তাই! তুই বলছিস ও ৩০ তারিখ মারা যাবে?” দীনু মাথা নাড়াল।
“আর কাকে কাকে বলেছিস তোর এই গল্প?” সুবিমল বলল, “আপনি কেবিনে চলে যাওয়ার পর থেকেই দেখি সেল-এর মধ্যে এই চলছে। আমি একটু মজা করার জন্য জিজ্ঞেস করলাম। তার পর ঐ শ্যামল নন্দীর ছেলেকে বলল সে নাকি ২রা এপ্রিল মারা যাবে। ব্যাস, সে ব্যাটা গেল ক্ষেপে।” “আচ্ছা, তা বল দেখি আমি কবে মরব?” মজার ছলেই বললাম দীনুর উদ্দেশ্যে। দীনু পকেট থেকে সেই তাসের বাণ্ডিলটা বের করে আমার সামনে ধরল।বলল, “একটা তাস টানুন, হুজুর।”
আমি একটা তাস নিলাম। রুইতনের তিন। দীনু বলল, “এবার হুজুর আপনার জন্মদিন কবে একটু বলবেন?”“১৩ই জানুয়ারি ১৯৩৯।” দীনু চোখ বুঝে থাকল। তিরিশ সেকেন্ডের মত। তারপর বলল, “২৬ শে জুলাই ২০০৯।”বললাম, “সে কি রে। এতদিন… তা কি করে বলিস তুই এইসব?” দীনু বলল, “আসলে বাবু, আমি যদি কারুর জন্ম তারিখ জানতে পারি আর সে যদি আমার এখান থেকে একটা তাস টেনে আমায় দেয়, তাহলেই আমি বলে দেব।” “সে তো বুঝলাম, কিন্তু বলিস কি করে? অঙ্ক করে?” বেশ মজা লাগছিল আমার দীনুর সাথে কথা বলতে। কত অদ্ভুত ছেলেমানুষি মন থাকে এই বয়সে।
ছেলেটা বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বলল, “অঙ্ক জানি নে হুজুর। তবে তাসগুলো আমাকে দেখিয়ে দেয়। আমি চোখের সামনে দেখতে পাই অনেক সংখ্যা ছুটে বেড়াচ্ছে। তারপর আস্তে আস্তে কিছু সংখ্যা স্থির হয়ে যায়। আকার নেয় একটা তারিখের। আমি সেই তারিখটা বলি।” আমি সুবিমলের দিকে ফিরে বললাম, “ছেড়ে দাও ওদের। আর বলে দাও যে আগামি ছ’মাস শনিবার করে থানায় হাজিরা দিয়ে যাবে। ঠিক আছে?” ঘটনাটা খুবই সামান্য। কিন্তু কেন জানি না ছেলেটার চোখ দুটো আমাকে ভীষণ ভাবে আকর্ষিত করেছিল। এত শান্ত, এত গভীর চোখ যে কোন ষোল সাতেরো বছরের ছেলের হতে পারে সেটা আমাকে আরও বেশি অবাক করেছিল।
৩০ মার্চ ১৯৯৭
গতেক সপ্তাহ লিখতে পারিনি। যেটাকে সাধারন ঠাণ্ডা লাগা ভেবেছিলাম, সেটা যে এরকম মারাত্মক রূপ নেবে সেটা বুঝতে পারিনি। একেবারে শয্যাশায়ী। ১০৩ জ্বর, সাথে প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা। আজ সকালে উঠে বেশ খানিকটা সুস্থ বোধ করছিলাম। কিন্তু তারপর সারাদিন যা চলল, তাতে আমি এখন যে বসে লিখছে এই ঢের। দুপুরের দিকটায় একবার থানায় গিয়েছিলাম। আসলে গত এক সপ্তাহ যে কি হয়েছে, তার কিছুই আমার জানা নেই। থানায় ঢুকে দেখি সুবিমল বেশ হন্তদন্ত হয়ে বেরচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, “কি হল?” “আর বলবেন না স্যার। গত কাল এখানে একটা বাইক চুরি হয়েছিল। এই নিয়ে গত এক সপ্তাহে এটা পাঁচ নম্বর। নদীর পাশে যে পোড়ো বাড়িটা আছে না, খবর এসেছে সেখানে নাকি একটা তিনজনের দল এসে আস্তানা গেড়েছে। ওরাই এই সব চুরির পিছনে দায়ী। তাই আমি যাচ্ছি।”
“আর কে যাচ্ছে?”
“দুটো কন্সটেবেল,” এই বলে সুবিমল বেরিয়ে গেল।
আমারও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু শরীর অবস্থা এখনও ভালো না। বেশি ছোটাছুটির ধকল নিতে পারবে না। তাই “দরকার হলে বল,” বলে নিজের ঘরে গিয়ে বসলাম। কিছু টুকটাক কাজ ছিল – সেগুলো শেষ করতে করতে প্রায় এক ঘন্টা কেটে গেল। জানলার কাছে দাড়িয়ে সবে সিগারেটটা ধরিয়ে একটা টান দিয়েছি, এমন সময় থানার সিনিয়ার কন্সটেবেল মহেশ দাস প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কেবিনে এসে ঢুকল।
ওর ঐ অবস্থা দেখে আমি বললাম, “আরে, কি হয়েছে? তুমি এইভাবে আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই মহেশ প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “স্যার, ছোটবাবুকে ওরা মেরে ফেলেছে, স্যার।” আমি প্রায় চমকে উঠে পাশে রাখা চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়লাম। সুবিমল মারা গেছে! আমাদের এই পলাশপুরে, যেখানে সেল-এ রাখার আসামি থাকে না – সেখান পুলিশ অফিসার খুন? আমার মিনিট দুয়েক লাগলো নার্ভটা স্টেডি করতে। তারপর ড্রয়ার থেকে বন্দুকটা বের করে কোমরে বাঁধতে বাঁধতে বেরিয়ে গেলাম মহেশের সাথে। গিয়ে যা শুনলাম, সেটা মোটামুটি এই – সুবিমল দুজন কন্সটেবেল নিয়ে যখন বাড়িটায় হানা দেয়, তখন দুজন আততায়ী ওদের আক্রমণ করে। ওদের কাছে নাকি একটা পিস্তল ছিল। তার গুলিতেই নিহত হয় সুবিমল। আততায়ী দুজনই ফেরার।
সুবিমলের বডি হাসপাতালে নিয়ে গেলে, আমি মহেশকে নিয়ে ঢুকলাম বাড়িটার ভিতর। ভাঙা একতলা বাড়ি। প্রায় সব দরজাই ভেঙে পড়েছে। ছাদও নেই। তার মধ্যে একখানা ঘর একটু ভদ্রস্থ। মহেশ বলল এই ঘরেই নাকি ঘাঁটি গেড়েছিল দুষ্কৃতীরা। ঘরে ঢুকে দেখলাম এই ঘরটার অবস্থাও বাকি ঘরগুলোর মতই, তবে বসবাস করার মত করে নেওয়া হয়েছে। ঘরের মেঝেতে পাতা একটা শতরঞ্চি, তার তার পাশে খান দশেক মদের বোতল আর শতরঞ্চিতে ছড়নো এক বান্ডিল তাস। তাসটা দেখেই বিদ্যুতের মত মনে পড়ে গেল সেই বাচ্চা ছেলেটার কথা। দীনু। তারিখটা আমার মনেই ছিল। তাস দেখে সে সুবিমলকে বলেছিল যে তার মৃত্যু হবে ৩০ শে মার্চ। তার পরক্ষনেই মনে হল, ‘এ আবার হয় নাকি? একটা ছেলে কখনও বলে দিতে পারে আর একজনের মৃত্যুর দিন। একটা কাকতালীয় ঘটনা নিয়ে বেকার মাথা ঘামাচ্ছি।’
৩ এপ্রিল ১৯৯৭ গত দুদিন ডাইরি লেখার সময় পাইনি। আদা জল খেয়ে নেমেছিলাম আমি। সুবিমলের খুনিকে ধরতেই হবে। কিন্তু সে গুঁড়ে বালি। অনেক খোঁজ খবর করেও তাদের টিকিটাও পাওয়া গেল না। মনে হয় একদম গ্রাম ছেড়েই পালিয়েছে। আশে পাশের থানায় আগেই খবর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুষ্কৃতীদের কোন ছবি না থাকায় বাকি থানাও বিশেষ সুবিধে করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। ইতি মধ্যে থানায় জয়েন করেছে সুবিমলের পরিবর্তী শিবায়ন হোড়। জয়নিং পেয়েছে মাস দুয়েক আগে। ট্রেনিং-এর পর প্রথম পস্টিং এই পলাশপুর। আজ বিকেলে চা খেতে খেতে আমি ওকে বলছিলাম সেই দীনুর গল্পটা। পুরো ঘটনাটা বলে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি মনে হয়?”
“কাকতালীয় ঘটনা স্যার। এরকম আবার হতে পারে নাকি?”
“হু, যে ছেলেগুলকে সে দিন আটক করা হয়েছিল, আমি তাদের সাথে দেখা করেছি। আর তাদের দীনু কি কি বলেছে সেটাও শুনেছি।” আমি উঠে গিয়ে জানলার ধারে দাড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। তারপর একটা লম্বা টান দিয়ে বললাম, “শ্যামল নন্দীর ছেলেকে বলেছে তার মৃত্যু দিন ২ এপ্রিল ১৯৯৭।”
“তার মানে তো গতকাল?”
“হ্যাঁ, গতকাল রাত সাড়ে এগারোটায় মারা গেছে ছেলেটা।”
“কি করে?” চেয়ার থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠেছে শিবায়ন।
“ডাক্তার কিছু ধরতে পারেনি। জ্বর ছিল নাকি দিন দুয়েক ধরে।”
“শুধু জ্বরেই মরে গল?”
“বললাম না, ডাক্তার ধরতে পারেনি। তাছাড়া আমাদের এখানে হাসপাতালের যা অবস্থা, তাতে ধরতে না পারাটাই স্বাভাবিক। তাই না?” শিবায়ন একটু চুপ করে থেকে বলল, “তা ঠিক, কিন্তু…”
“কিন্তু কি?”
“কিন্তু এটাও তো কাকতালীয় হতে পারে?”
“পারে, কিন্তু এই ভাবে? পর পর দুবার?”
এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের দুজনের মধ্যে কারুর কাছেই নেই। তবে এই ঘটনার অলৌকিক ব্যখ্যা মানতে আমার মন চাইল না। শিবায়নকে বললাম, “শোন, তুমি বরং একবার খবর লাগাও দীনু বলে ছেলেটার। ব্যাটাকে একবার থানায় নিয়ে এসো।” শিবায়ন আমার দিকে অবাক চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে, “আচ্ছা স্যার,” বলে চলে গেল।
৬ এপ্রিল ১৯৯৭
গত তিন দিন লিখতে পারিনি। যদিও সেরকম লেখার মত কিছু ছিলও না। তবে একটা ব্যাপার যেটা আমাকে অবাক করল সেটা হল শিবায়ন দীনুকে খুঁজে পায়নি। নদীর ওপারে যাকেই জিজ্ঞেস করেছে, সেই বলেছে যে দীনুকে দেখেছে তবে বাপ-মা মরা ছেলে কোথায় থাকে আর কোথায় যে যায় সেটা ঠিক বলতে পারবে না। তার উপর সেইদিনের ছেলেগুলোর মধ্যে আরও একজন মারা গেছে। দীনুর বলা দিন ৪ এপ্রিলেই। ভাবছি, কাল একবার নিজেই যাব খোঁজ করতে। দেখি ৭ এপ্রিল ১৯৯৭
আজ যেটা ঘটলো, সেটা আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। মনে হচ্ছে কোন ম্যাজিক দেখেছি। না হলে এই ঘটনার ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। আজ সকালে একাই জিপ-টা নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। লক্ষ্য হচ্ছে দীনু বলে ছেলেটাকে খুঁজে বের করা। অতি-লৌকিক-কে আমার বিশ্বাস নেই কোনদিনই, কিন্তু ইদানিং পর পর তিনটে মৃত্যুর পর আমার বিশ্বাসটাও যেন একটু নড়ে গেছে। একবার নিজের চোখে দীনুকে দেখতে চাই, জানতে চাই ওর ভবিষ্যৎ-বাণীর বেস (Base)-টা কি? সত্যি কিছু অলৌকিক শক্তি আছে ওর, নাকি পুরোটাই ভাওতা? কিন্তু সেটাই বা হয় কি করে – তাও পর পর তিনবার? নদীর ওপারের গ্রামটায় পৌঁছতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। আসলে নদী পেরিয়ে এলে অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যায়, কিন্তু গাড়িতে এলে প্রায় বিশ কিলোমিটার গিয়ে একটা ব্রিজ পড়ে, সেটা পেরিয়ে আবার কুড়ি কিলোমিটার পিছনে গেলে গ্রামটা পড়ে।
ব্রিজ পেরিয়ে মিনিট কুড়ি গেছি, দেখি রাস্তার পাশে একটা ছেলে বসে আছে। একটু কাছে যেতে বুঝলাম দীনু। ওকে যে না খুঁজেই পেয়ে যাব, সেটা আমার ধারনার বাইরে ছিল। শিবায়ন প্রায় দিন তিনেক খুঁজেও ওর কোন হদিস পায়নি।
গাড়িটা দাঁড় করালাম। পুরনো জিপ, সামান্য প্রতিবাদ করে থেমে গেল। গাড়ির আওয়াজে দীনু পিছন ফিরে তাকাল। আমাকে আস্তে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে হাতের তাসের বাণ্ডিলটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “নমস্কার হুজুর।”
আমি বললাম, “তোকে তো খুঁজেই পাওয়া যায় না। কোথায় থাকিস?” ও কিছুক্ষন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “আমি তো এখানেই থাকি হুজুর। আপনি খুঁজছিলেন আমায়?” বললাম, “হ্যাঁ, একটু কথা ছিল তোর সাথে। থানায় চল।” “থানায় তো এখন যেতে পারব না বাবু।”“কেন?” আমি একটু অবাক হলাম।
দীনু কিছু বলল না। আগের মতই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। এমন সময় প্রচণ্ড একটা বাজ পড়ার শব্দে প্রায় চমকে উঠলাম। সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা হয়ে ছিল। কিন্তু এই রকম বজ্র-বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টির আশঙ্কা ছিল বলে মনে হয়নি। কিন্তু এখন আকাশ প্রায় কালো হয়ে এসেছে। সাথে দুয়েক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ল মনে হল। আমি বললাম, “তোর বাড়িটা ঠিক কোথায় বল তো?” দীনু উত্তির দিল না। বলল, “মানুষের ভাগ্য দিনে দিনে পালটে যায় হুজুর। সবার যদিও যায় না, কিন্তু অনেকের যায়।” এই বলে পকেট থেকে সেই তাসের বান্ডিলটা বের করে বলল, “একটা তাস দেখবেন নাকি, হুজুর।” দীনুর গলা ইস্পাতের মত ঠান্ডা। আমার কিরকম যেন অস্বাস্তি হচ্ছিল। বললাম, “না না, ওসব করতে আমি আসিনি। তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। তুই যে এই সবার মৃত্যুর দিন বলে বেড়াস, তা তুই কি সত্যিই কিছু বলিস, না কি পুরোটাই আন্দাজ?” এবারও দীনু কোন উত্তর দিল না।
আমার একটু রাগই হল। বললাম, “তুই যে সবার মৃত্যুর দিন বলে বেড়াস, তা নিজের মৃত্যুর দিনটা দেখেছিস?”
দীনু আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড নিস্পলক চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, “জানি। ১৩ ডিসেম্বর ১৯৯৩।” ডাইরিটা টেবিলে রাখলাম। মাথাটা এখনও চক্কর দিচ্ছে। এটাও কি সম্ভব? হঠাৎ পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে চোখ রাখতে দেখলাম ছোটমামার ছেলে বুবাই ফোন করেছে। আমেরিকার নয়। ‘বুবাই হঠাৎ ফোন করল? আমেরিকায় তো এখন অনেক রাত? তবে কি কোন ফোনটা ধরতে গিয়ে উপরে লেখা তারিখটায় চোখ পড়তেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। ২৭ জুলাই ২০০৯।