মেঘের আড়াল

মেঘের আড়াল

: বিপু, তুই আমাকে বিয়ে করবি কিনা?
: আমি আরও সময় চাচ্ছি।

রুহির চোখ ফেটে জল এল। আজ বার বছর পর কেমন করে বিপ্লব এ কথা বলতে পারে! একযুগ! একযুগ রুহি অপেক্ষা করেছে ওর জন্য। সেই ছোটবেলার খেলার সাথী, কৈশোরের খুনসুটির সঙ্গী। আর যৌবনের প্রেমিকপুরুষ। ওর জন্য কি না করেছে রুহি। যখন সময় এসেছে, ও ফিরিয়েছে সবাইকে। আজ! আজ বিপু, ওর বিপু বলছে একথা! সেই ছোট্টবেলা। ওর জন্য ভোর তিনটায় উঠে শিউলি কুড়াতো শীতকালে। রুহির জন্য দুইটাকা জমিয়ে রাখত আইসক্রিম কিনে দিবে বলে। কাঁচের বোতল জমিয়ে রাখত রুহির জন্য। কটকটিওয়ালা আসার অপেক্ষাতে মশগুল রইত। রুহির চোখের জল মুছে দেবার জন্য যে দুটো হাত সবসময় তোলা থাকত, সে হাত দিয়ে রুহির বানানো চা ফেলে দিল ছুড়ে!

: আমি আরও সময় চাচ্ছি…বুঝতে পারছিস!
: সময়!
: হ্যাঁ, সময়।
: আমি এখুনি বিয়ে করতে চাই। আর বেবী নিতে চাই।

রুহির দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে বিপ্লব। মনে হচ্ছে রুহি যা বলছে, যে আবদারখানা করছে, তা অযথা আর অমূলক। কারণ, এখন তাই। ও কিভাবে সব লুকোবে তাই ভাবছে। কিন্তু রুহি জানে তার বয়স এখন থার্টি ফাইভ চলছে। আর দু’বছর পর ওর বাচ্চা ধারন ক্ষমতাই হয়ত রিস্কি হয়ে উঠবে। হয়ত তখন তা তার জন্য পূর্ণতা নাও দিতে পারে।

বিপু, রুহির বিপু, বিপ্লব রায়হান। ইয়াহিয়া আঙ্কেলের একমাত্র ছেলে। ইয়াহিয়া আঙ্কেল রুহির বাবার জিগার দোস্ত। ওরা এক বিল্ডিংয়েরই বাসিন্দা। বিপুর ছোট দুইটা বোন আছে। সায়মা আর রাইমা। তারাও জানে একটা অলিখিত সত্য। রুহি তাদের ভাবী। এভাবেই সত্য হয়ে উঠেছে দুই পরিবারের কাছে, রুহি বিপুর একচ্ছত্র অধিকারী। যেদিন বিপু তার ভাগ্যের অন্বেষণে আমেরিকা পারি জমায়, সেদিনের ছবি কেমন করে ভুলবে রুহি! রুহির হাতখানা আকড়ে ধরে ছিল বিমানবন্দরের গেইটের আগ পর্যন্ত। বারবার ফিরেফিরে রুহিকেই দেখছিল বিপু। রুহি কাঁদেনি। একবারও চোখের জল ফেলেনি বিপুর সামনে। যদি বিপু কষ্ট পায়, যদি বিপু মত পাল্টে ফেলে। কত কষ্ট করে ভিসা পেয়েছে সেটা রুহি জানে। রুহির খুব ইচ্ছে করছিল গলা ছেড়ে কাঁদে। মনে হচ্ছিল ওর দেহ থেকে কেউ আত্মা আলাদা করে ফেলেছে সেদিন। তারপর তিনদিন রুহি প্রতিরাত বিছানায় বালিশ ভিজিয়েছে কেঁদে। প্রথম যখন ফোন এল! সেদিনের স্মৃতি ভুলবে কি করে! ও সময় নিয়েছে। স্ক্রিনের দিকে ও অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল।

: বিপু বল। হো হো করে হেসেছিল বিপু।
: তুই আমাকে চিনলি কি করে? টের পেলি কি করে এটা আমি! রুহি দীর্ঘ করে শ্বাস টেনেছিল।
: তুই ফোন করেছিস আমি টের পাবনে!
: জানিস রুহি তোকে বড্ড মিস করছিরে…

রুহি চুপ করে শুনেছিল। অনেক কথা বলতে পছন্দ করত বিপু। রুহি শুনে যেত। কখনও ক্লান্তি লাগত না। রাতে বিপুর কথা শুনতে শুনতেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়ত রুহি। কত গল্প! বোস্টনের গল্প। ওর ইউনিভার্সিটির গল্প। ওর বন্ধুদের গল্প। ওর একটা নিগ্রো বন্ধু জুটেছে। ফাতিমা আমান। নাইজেরিয়ান। ফাতিমাকে রুহির অনেক গল্প বলেছে বিপু। ফাতিমা রুহিকে ওদের দেশীয় হাড়ের বানানো গহনা দিয়েছে। আর রুহি? সেতো একটা পাগল মেয়ে। বিপু শুঁটকি পছন্দ করে। পরিচিত যেই আমেরিকা পাড়ি জমায়, শুধু বিপুর জন্য শুঁটকি পাঠায়। প্যাকেট করে করে। ইলিশের শুঁটকি, চ্যাপা শুঁটকি, চিংড়ি শুঁটকি…আরও কত কি। শুকনো পিঠা। ফুল পিঠা, গোলাপ পিঠা, ঝুরি পিঠা, পাতা পিঠা! ওসব পেয়ে ফোনের ওপার থেকে ধমক দেয় বিপু।

: তোর কি কাজকাম নাই!

এমন ধমক খেয়ে নতুন উদ্যমে লেগে যায় রুহি। শাহানা খালাকে খবর পাঠায়। নতুন করে চাল কেনার টাকা দেয়, তেল, চিনি, গুড় কিনে দেয়। ঐতো শুনলো পাশের বাসার রিংকির ভাই যাচ্ছে নিউইয়র্ক। হোকনা অন্য রাজ্য। বিপু ঠিক এসে রুহির পাঠানো পিঠা নিয়ে যাবে। রাত্তিরে রুহি ঠায় বসে থাকে ডেক্সটপের সামনে। সিপিওতে মডেম লাগিয়ে বসে থাকে কখন নেট কানেকশন পাবে।

: শালা গ্রামীন। এত ডিস্টার্ব দিস কেন!

হটাৎ কানেকশন পায় নেট। রুহি আনন্দে নিজের মনেই হাসে। স্কাইপে ফোন করে। ভিডিও কল। মাঝেমাঝে ভিডিও স্থির হয়ে যায়। অস্থির হয়ে ওঠে রুহি। খুলে আবার মডেম লাগায়। আবার নতুন করে ফোন কল হয়। মাঝেমাঝে ইয়াহিয়া চাচীও আসেন ছেলের সাথে কথা বলবেন বলে। সায়মা, রাইমাও আসে। ওরা ভাইয়ার সাথে কথা বলে। ভাইয়া স্বপ্নের গল্প শোনায়, সুখের গল্প শোনায়। রুহি ভালবাসায় সিক্ত হয়। এইতো সেদিন! কেমন করে গত হয়ে গেল।
এরপর রুহি অনার্স পাশ করল। মাস্টার্স ভর্তি হল। বাবার শরীরটা বড্ড খারাপ হয়ে এল। বাবা রুহিকে বিপুর হাতে দিতে চান। ইয়াহিয়া চাচুও রাজি।

: বিপু তুই কদিনের জন্য দেশে আয়।
: কেন?
: সবাই আমাদের একসাথে করতে চান।
: রুহি, তুই কি আমাকে অবিশ্বাস করছিস?
: নাতো!
: তাহলে অপেক্ষা কর।

সবে নতুন চাকরীতে জয়েন করেছি। গ্রীনকার্ডের আবেদন করেছি। কটা দিন সবুর কর।
রুহি জানায় সবাইকে। মা কাঁদেন। বয়েস বাড়ছে রুহির। ঘটক ঘোরে বাড়ির আশেপাশে। বিয়ের প্রস্তাব আসে। মা আসেন ভয়েভয়ে রুহির কাছে।

: আর কত অপেক্ষা করবি রুহি?
: মানে?
: মাস্টার্স শেষ। চাকরীও দুবছর হলো। একটা ভাল ছেলে ছিল। বিসিএস ক্যাডার। অনুমতি দিলে দেখি।
: মা, আমি একজনকে কথা দিয়েছি।
: কোন ভুল হচ্ছে নাতো রুহি!
: মা, বিপুকে তুমি ছোটকাল থেকে চেন। ভুল হবে কেন? মা তার কান্না লুকোন। বাড়ির আশপাশ, আত্মীয়স্বজন কানাকানি করে। কি বলবেন তিনি!
: মা, যা সত্যি তাই বলবে।
: কি সত্যি?
: আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ছেলে ফিরে আসলেই বিয়ে।

আকাশে যেমন মেঘ করে, তেমনি রুহির চারপাশে হঠাৎ করেই যেন মেঘ করেছে। হাসিখুশি রুহি হঠাৎ করেই মেঘের আড়াল হয়ে যাচ্ছে যেন। বিপু যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছে। রুহি তিনবার ফোন করলে একবার রেসপন্স করে। কখনওবা রেসপন্স করেও না। প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো, এরপর খারাপ লাগাটাও কাজ করত না। রোবট হয়ে গেছে রুহি। অপেক্ষা ছাড়া ওর জীবনে আর কোন এপ্রোপিয়েট শব্দ আর নেই। একদিন অবাক হল। যখন রাইমা শোনাল বিপুর গ্রিনকার্ড পাওয়ার গল্প। গল্পই বলবে রুহি। কারণ রুহিকেই জানায়নি বিপু! তাও নাকি দু’মাস হয়ে গেছে।

: রুহিপু, তোমাদের বিয়েটা কবে হচ্ছে?
: তোর ভাই এলে।
: ভাইতো গ্রিনকার্ড পেয়ে গেছে। রুহি পাথরের মতন শক্ত হয়ে বসে ছিল কতক্ষণ। কিছু বলতে মন চায়নি। কারণ অপেক্ষারা ওকে পাথর করেছে এখন। বিপুর নির্লিপ্ততা ওকে আর কাঁদায়না। শুধু রাইমাকে বলেছিল একটি শব্দ।

: কনগ্রেচুলেশন।

রাইমা চলে যাবার পর দরজা আটকে কেঁদেছিল রুহি। হু হু করে কেঁদেছিল। তারপর বালিশে মাথা রেখে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই রুহির। তিনমাস অভিমানে ফোন করেনি বিপুকে। কি আশ্চর্য! বিপুও ওকে একবারও মনে করেনি। মেঘের বাসাতে গাঢ় অন্ধকার ভর করেছে। রুহি চেপে যায় পরিবারের কাছে। ওরা যে আশায় দিন গোনে। কি জবাব দেবে রুহি। হঠাৎ সকাল। রাইমা ওর দরজায় নক করছে।

: রুহিপু…ও রুহিপু রুহি বাথরুম থেকে বের হয়।
: কে?
: আমি রাইমা। দরজা খোল। রুহি দরজা খোলে। এত সাতসকালে! রুহি কিছু বোঝার আগেই রাইমা জড়িয়ে ধরে রুহিকে।
: আরে বাবা ছাড় লাগছে
: কাল রাতে ভাইয়া ফিরে এসেছে।

রুহি সাড়া দেয়না। পয়ত্রিশ বসন্ত পেরিয়ে আসা রুহির মুখে কথা সরে না। অপেক্ষারা কি তবে টাটা বাই বাই বলতে এসেছে? রুহি সাজে। মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজে। বিপুকে কত দিন পর দেখবে। হিসেব করে। বার বছর! অনেক কথা জমে আছে। সব বলবে বিপুকে। মনের মেঘ কেটে গেছে। মেঘেরা আর কিছুই আড়াল করতে পারবেনা।

: রুহি, স্যরি।
: মানে?
: তোকে বিয়ে বা বাচ্চা কোনটাই আর আমি দিতে পারব না। রুহি চুপ করে থাকে। বিপুর কথা শেষ হয়নি।
: আমি একজন আমেরিকান মেয়েকে অলরেডী বিয়ে করেছি।

রুহি এবার নিশ্চুপ কহয়ে যায়। আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। একবারও জিগেস করতে ইচ্ছে করছেনা ওর বারটি বছর কেন নষ্ট করেছে। কেন এখন বলার পরও সময় চাচ্ছিল, এ ধোঁকা কিসের জন্য। কেন ধোঁকা দিচ্ছে। ওর কান্না পাচ্ছে না আর। বিপুর মুখখানা মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে ক্রমশ। রুহি পয়ত্রিশ বসন্ত পেরিয়ে মেঘের আড়ালের কাউকে আর খুঁজতে চায়না। রুহি ওর পরণের শাড়ীর দিকে তাকায়। নীল শাড়ী জুড়ে মেঘের আড়াল। রুহি নিচু হয়ে ভেঙে যাওয়া কাপের টুকরোগুলোন কুড়িয়ে নেয়। ফেলে দিতে হবে। নয়ত নিজের পায়েই লেগে পা কাটতে পারে, যেমন করে ওর জীবনে বিপু কেটে গেছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত