জ্বী স্যার

জ্বী স্যার

পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। দশ মিনিট তর্কাতর্কির পর দুইটা থাপ্পড় খেয়ে সোজা গাড়িতে উঠে পড়লাম। পাশে দীপ্তি ভয়ে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। কি দিয়ে কি হচ্ছে মাথায় খেলছে না! লজ্জা আর ভয়ে দম আটকে যাবার মতন অবস্থা। আমাদের সাথে আরও বেশ কিছু কাপলরা বসে আছে। তারাও ছোটার জন্য আকুতি মিনতি করছে। তাদের হিসেব আলাদা, হয়তো তারা ভালোবাসা দিবসে অতি ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে ধরা খেয়েছে, কিন্তু এদের সাথে আমাদের কেন ধরে নিচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছি না। আমরা তো আর প্রেমিক প্রেমিকা নই। ভুল বুঝাবুঝিতে এত বড় সর্বনাশ হতে চলছে কিছুতেই মানতে পারছিলাম না।

দীপ্তি আমার পুরনো স্টুডেন্ট। ক্লাস নাইন থেকে কেমিস্ট্রি পড়াই তাকে। আগে ব্যাচে পড়তো, কলেজে উঠার পর বাসায় গিয়ে পড়ানো শুরু করলাম। তার ইন্টার পরীক্ষা অতি সন্নিকটে। পরীক্ষার আগের সিরিয়াস মুহূর্তে হুট করে প্রাইভেট বাদ দিতে হচ্ছে। কারণ পরশু আমার ফ্লাইট ঠিকঠাক, এমএসসি করতে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি আমি। হুট করে ডেট ফিক্সড হওয়ায় ছাত্রী প্রাইভেট নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়, এই কয়দিনের জন্য সে এখন স্যার পাবে কই! আমারই বা কি করার আছে। তবুও সে পুরনো স্টুডেন্ট, তাকে এভাবে বিপদে ফেলে যেতে খুব মায়া লাগছিল। নিজের দায়বদ্ধতা থেকে অল্প সময়ে যতটুক পারলাম তাকে সর্বোচ্চ সাহায্য করে গেলাম। যেসব অধ্যায়ে সে দুর্বল তার জন্য ঝটপট আলাদা ভাবে নোট রেডি করে ফেললাম। এখন নোটপত্র দিতে ছাত্রীর বাসায় যে যাবো সেই সময়টুকুও বের করতে পারছিলাম না।

এম্বাসিতে ছুটোছুটি, কেনাকাটা আরও কত কি কাজ বাকি। শুক্রবার থাকায় বিকেলে একটু সময় বের করলাম। দীপ্তিকে আগেরদিন ফোন দিয়ে জানালাম শুক্রবার বিকেলে বাসায় আসছি তোমাদের। দীপ্তি জানালো সে বাসায় থাকবে না, কলেজে বসন্ত বরণ উৎসব হচ্ছে সেখানে যাবে। বললাম সন্ধ্যায় আসি? তাতেও সে নারাজ, ইনিয়েবিনিয়ে বললো.. আসলে স্যার আপনি তো জানেনই আমার বাসায় আম্মু আপনাকে নিয়ে অনেক সন্দেহ করে আমাকে, একটু পরপর আম্মু রুমে উঁকি দিয়ে দেখে যায়, আপনিতো সব বুঝেন ই। কয়দিন আগেই আপনি আম্মুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন এখন যদি আবার বাসায় আসেন তাও আবার ভ্যালেন্টাইনের দিনে! ব্যাপারটা কেমন কেমন হয়ে যায় না? এক কাজ করেন আপনি আমার কলেজের কাছে এসে কল দিয়েন, সেখান থেকে নোট নিয়ে যাবনি।

হুম মেয়েটির কথায় যুক্তি আছে, ভেবে দেখলাম দীপ্তি ঠিকই বলছে, কালকের দিনে বাসায় না যাওয়াটাই ভালো৷ ইদানিং তার মায়ের কি যেন হয়েছে, কয়েক মাস ধরে আমাকে অযথা সন্দেহের চোখে দেখে। অথচ দীপ্তির সাথে আমার ওসব কোনো সম্পর্ক নেই। এরপর শুক্রবার বিকেলে দেখা করতে রাজি হয়ে গেলাম। কে জানতো বাইরে দেখা করতে এসে তাকে নিয়ে এমন মহাবিপদে পড়ে যাবো।

কলেজ থেকে সামান্য এগিয়ে যেই মাত্র দুজন মার্কেটের নিচে দাঁড়িয়েছি অমনি দেখি পেছনের চাপা সিঁড়ি বেয়ে পুলিশ বেরিয়ে আসছে। তারা কিছু ছেলে মেয়েদের গাড়িতে তুলে নিচ্ছে। হুট করে এক পুলিশ হাত ধরে বললো গাড়িতে উঠ! চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বললাম “আশ্চর্য গাড়িতে উঠবো কেন?” “আপনারা এইমাত্র হোটেল থেকে বের হলেন না?” দীপ্তি উত্তেজিত হয়ে বলছে “ছিঃ কি বলতেছেস এসব, আমরা ভেতরে যাব কেন! রাস্তা ক্রস করে মাত্র দাঁড়িয়েছি এখানে” পুলিশের এক লোক হাতকড়া পড়ানো হোটেল গার্ডকে জিজ্ঞেস করলো “এই এইদুজন একটু আগে ভিতরে ছিল না?”

বেটা কি খচ্চর, “জ্বী স্যার” বলে সম্বোধন দিয়ে দিল! সাথে সাথে পুলিশ আমার কলার টেনে ধরলো, আরেক লেডিস পুলিশ এগিয়ে এসে দীপ্তির হাত ধরে টানাটানি শুরু করলো, চুপচাপ গাড়িতে উঠ! তাদের নোটপত্র দেখিয়ে কতবার বুঝানোর চেষ্টা করলাম, কে শোনে কার কথা। থাপ্পড় খাওয়ার পরেও ধস্তাধস্তি চললো কিছুক্ষণ। কিন্তু যখন পুলিশ বলে উঠলো হাতের সামনে চারটা গাল আছে, দুইটা গাল ব্যবহার করে ফেলছি এখন কিন্তু বাকি দুইটা ব্যবহার করতে বাধ্য হবো! ঠিক তখনি দীপ্তির গালের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেলাম। দুধে আলতা গায়ের বরণে ফুলের টোকা পড়লেও দাগ হয়ে যাবে৷ আমার সামনে অমন মেয়েকে কেউ আঘাত করবে এটা সহ্য করা অসম্ভব। পাশেই লেডিস পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, পুলিশকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। সবার সামনে থাপ্পড় মেরে বসলে এই অপমান কিছুতেই সে সহ্য করতে পারবে না৷ দেরি না করে দীপ্তিকে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম।

কিছুদূর এগিয়ে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো এক পুলিশ কন্ট্রোল রুমে৷ বাকিদের কই নেওয়া হয়েছে জানা নেই। ছোট্ট রুমে আমি আর দীপ্তি বসে আছি। বাইরে দুজন গার্ড। একটুপর অফিসার এসে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো। কতদিনের প্রেম? ফ্যামিলি জানে কি না? ইত্যাদি সব আজগুবি প্রশ্ন। কিছুতেই তাদের বিশ্বাস করাতে পারলাম না আমরা অমন কেউ নই, কিন্তু পুলিশরা তাদের বিশ্বাসেই অটল। অফিসার কেমিস্ট্রি নোট উল্টেপাল্টে দেখে হেসে হেসে বললেন.. “খুব ভালো কেমিস্ট্রি ক্লাস হয়েছে আজকে, এবার তবে কাজী ডাকিয়ে বায়োলজি ক্লাসের ব্যবস্থা করে ফেলি! কি বলো তোমরা?” এমন অশ্লীল ইংগিতে কথাবার্তা শুনে দীপ্তি মুখে ওড়না চেপে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। দীপ্তির সামনে এসব মন্তব্য শুনে আমার নিজেরই লজ্জায় কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। এক পর্যায়ে ব্যর্থ হয়ে বলি স্যার যা হওয়ার হইছে মাফ করে দেন, এবারের মতো যেতে দেন আমাদের। সন্ধ্যা হয়ে আসছে মেয়ের বাসায় চিন্তা করবে। মনে মনে বলি মেয়ের মা যদি এসব শুনে আমাকে জ্যান্ত পুতে ফেলবে! এমনেতেই আমাকে নিয়ে তার মনে রাজ্যের সন্দেহ।

অফিসার বলছে.. যেহেতু অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অপরাধে ধরা হয়েছে তাই সমাধান এখানে দুইটা। এক, মেয়ের অভিভাবক খবর দিয়ে তাদের হাতে তুলে দেব, নয়তো দুই.. আমাদের ভ্রাম্যমাণ কাজী দিয়ে দুজনকে বিয়ে পড়িয়ে দেব। আজ অলিতে-গলিতে হোটেল ক্যাফে থেকে যাদের ধরা হচ্ছে সবার জন্য একই বিধান। সোজা কথা, মেয়ের অভিভাবক ছাড়া কোনো মেয়েকে ছাড়া হচ্ছে না। যারা যারা অভিভাবক ডেকে আনছে তাদের ছেড়ে দিচ্ছি। পারলে কল দিয়ে অভিভাবক ডেকে আনুক, নয়তো সে বিয়ে করে আপনাকে অভিভাবক বানিয়ে নিক। আমরা মেয়েকে অভিভাবকের হাতে তুলে দিব ব্যাস, এটাই শেষ কথা। ভাবার জন্য হাতে পাঁচ মিনিট সময় দিয়ে অফিসার সিগারেটের ডগায় আগুন লাগিয়ে রুমের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমি দীপ্তিকে বললাম.. ” দীপ্তি, আমরা সাংঘাতিক ভাবে ফেঁসে গিয়েছি, তারা কোনো ভাবে মানছে না, আইন আজকে ভয়ানক কড়া।

আমি বলি কি তোমার ভাইকে যদি একটা কল দিতে? তোমার ভাইতো পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ঢাকা এড়িয়াতেই আছে, যেহেতু ভাইয়ার সাথে তোমার বন্ধুসুলভ সম্পর্ক, যদি একটু তাকে ফোন দিয়ে বুঝিয়ে বলতে, শুধু একটা কল দিলেই কিন্তু এরা ছেড়ে দিবে” দীপ্তি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আমাকে বলছে.. “স্যার আপনার কি মাথা খারাপ! আমি ভাইয়াকে এসব কাহিনী বলতে যাব ভাবলেন কী করে? যদি ভাইয়াকে বিষয়টা বুঝিয়ে ম্যানেজ করিও তবুও যখন এই পুলিশরা জেনে যাবে আমি তাদের অমুক স্যারের বোন, ভাইয়ার মানসম্মান কই যাবে ভেবে দেখেছেন? পুরো ডিপার্টমেন্টে হাসির রোল পড়ে যাবে। বরং এর চেয়ে ভালো আমাকে এক বোতল বিষ কিনে দেন, খেয়ে মরে যাই আমি” এই বলেই ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে দিল।

তাহলে কি করার, অপশন একটাই বাকি বিয়ে করে ফেলা! এটা শুনে মেয়ে আরও দ্বিগুণ স্পিডে কান্না জুড়ে দিল। মাথা এমনেতেই জ্যাম হয়ে আছে, দিলাম দুইটা ধমক। বললাম সারারাত কি এখানেই বসে থাকবো আমরা? একটা তো সমাধানে যেতে হবে নাকি? এভাবে কেঁদে কেঁদে কি সমাধান হবে? ঠান্ডা মাথায় তাকে বুঝালাম আজকের মতো বিয়েটা আমরা করে ফেলি, এরপর সুযোগ বুঝে ডিভোর্স করে নেয়া যাবে। ঘটনাটা নিজেদের মাঝে চাপা রাখলে আর জানাজানি হবে না। মেয়ে আমার কথাগুলো কিছুক্ষণ ভেবে দেখে ছোট্ট করে সম্মতি দিয়ে দিল। এরপর অফিসার তাদের ভ্রাম্যমাণ টিমে থাকা কাজীকে ডেকে দুজনের বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। এক কপি কাবিননামা তাদের কাছে রেখে আরেক কপি আমাদের হাতে তুলে দিয়ে দুজনকে মুক্ত করে দিলেন।

দীপ্তিকে তার বাসার গেইট পর্যন্ত রেখে এলাম। পুরো রাস্তায় মেয়েটা লজ্জায় একটা কথাও বলেনি আমার সাথে। আমিও কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। পরিচিত কোনো মেয়ে হুটকরে সম্পর্কে বউ হয়ে যাওয়াটা বড্ড অস্বস্তিকর। যদিও ডিভোর্স হয়ে যাবে তবুও তো আইনগত ভাবে সে এই মুহূর্তে আমার বউ! কেমন একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি। একদিকে লজ্জা অপরদিকে মেজাজ সাংঘাতিক গরম। সমস্ত রাগ গিয়ে জমেছে হোটেলের দাড়োয়ানের উপর। এই বেটারে শায়েস্তা না করে গেলে আমি কিছুতেই শান্তি পাব না৷ তার একটা মিথ্যে সাক্ষী আজ এতবড় ঘটনা বাঁধিয়ে দিল।

পরেরদিন সোজা চলে গেলাম সেই হোটেল বিল্ডিং এর নিচে। দেখতে পেলাম সিঁড়ির সামনে ভূরি ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই অসভ্য দারোয়ান। কল দিলাম বাবু ভাইকে। বাবু ভাই এই এলাকার একজন প্রভাবশালী লোক। ভাইকে ঘটনা বলে কয়টা পোলাপান পাঠিয়ে দিতে বললাম। আধঘন্টার মধ্যে বাইকে করে চার জন স্পটে এসে উপস্থিত। তাদের নিয়ে ধরলাম সেই দারোয়ানকে। টেনে হিঁচড়ে মধ্য সিঁড়িতে নিয়ে উঠালাম। কথা বলার আগেই দিলাম কয়টা এলোপাতাড়ি থাপ্পড়। এরপর বললাম.. “বল.. এভাবে মিথ্যা বলে কাল আমাকে কেন ফাঁসালি?” স্যার আমি ভাবছিলাম আপনি হয়তো উপরে ছিলেন, বুঝতে পারি নাই মাফ করে দেন। পাশ থেকে এক ছেলে বলে উঠলো.. ভাই সে মিথ্যা কইতেছে, পোলাপান পিটাইয়া বড় হইছি আমরা, কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা মুখ দেখলেই বুইঝা ফেলি, যদি অনুমতি দেন চাকু দিয়া ভূরি ফুটো করে দেই? সত্য একাই বেরিয়ে আসবে!

এই থ্রেট শুনে দারোয়ান স্যার স্যার বলে মাফ চাওয়া শুরু করে দিল, বলতে লাগলো.. “গরীব মানুষ কয়টা টাকার লোভ সামলাইতে পারি নাই, মাফ করে দেন” আচ্ছা! এরমানে পুলিশের সাথে চুক্তি করে কাপল ধরিয়ে দিস! মানুষকে বিপদে ফেলে ভালোই ব্যবসা শুরু করেছিস? না স্যার, শুধুমাত্র আপনার জন্য টাকা বরাদ্দ ছিল। আমার জন্য মানে? আমি তাকে ছেড়ে দিয়ে বললাম যাহ তোকে মাফ করে দিব, সব পরিষ্কার ভাবে খুলে বল আমাকে।

দারোয়ান বলা শুরু করলো আপনার লগে কাল যে মাইয়াডা ছিল, উনি সকালে এক পুলিশকে সাথে নিয়ে আমার কাছে আইছিল। উঁচা লম্বা ফরসা, দুজনের চেহারায় খুউব মিল, মনে হইলো তারা ভাইবোন। আমাকে বললো আজ বিকেলে এক মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল ধরা হবে। মেয়ে সেই ক্রিমিনালকে নিয়ে এই হোটেলের নিচে দাঁড়িয়ে থাকবে, কেউ জিজ্ঞেস করলে সবার সামনে যেন বলি আপনারা দুইজন এই হোটেলে ছিলেন। আমি আমতা-আমতা করতেছিলাম, কি দিয়ে কি বলি যদি ভুল হয়ে যায়। এরপর আর মানা করতে পারলাম না যখন আপায় আমারে টাকার অফার দিল, বললো মাত্র দুইটা শব্দ বলবেন “জ্বী স্যার” ব্যাস তাতেই বকশিস পেয়ে যাবেন নগত দুই হাজার টাকা!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত