হত্যাকারী

হত্যাকারী

স্বামীকে প্রিজন ভ্যানে ওঠানোর আগে শেষ বারের মতো কথা বললেন আফরানিকা আহমেদ। তাঁর স্বামীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। যদিও রায় শুনে তিনি মোটেও বিচলিত হন নি। কারন, তার সাক্ষ্য প্রমাণ এর উপর ভিত্তি করেই আদালত এই রায় ঘোষণা করেন।

—ইহকাল আর পরকাল দুই জীবনের সঙ্গী আপনি আমার। ইহকালে তো পেলাম না তবে স্রষ্টার কাছে একটাই চাওয়া পরকালে যেন তিনি আমায় বঞ্চিত না করেন। আপনাকে যেন আমার সাথী হিসেবে দেন। মানুষের সব পাপের শাস্তি তখনি হয় যখন তার ভিতরে অনুশুচনা বোধ তৈরি হয় এবং মানুষ তীব্র অনুশুচেনায় দগ্ধ হয়ে স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণ করে। বান্দার অন্যায় যত বড়ই হোক না কেন, শুদ্ধ অন্তরে তওবা করলে আল্লাহ মাফ করে দেবেন , ইনশাআল্লাহ। এই জীবনে তো আপনার জন্য কিছু করতে পারি নাই তবে স্রষ্টার কাছে প্রতিদিন ই চাইবো তিনি যেন আপনাকে ক্ষমা করে দেন।__ কথাগুলো বলে উল্টো দিকে ফিরে চোখের পানি আটকাতে চেষ্টা করছে আফরানিকা।

এতোক্ষণ ধরে নিজের স্ত্রীর কথা শুনে আরিফ সাহেব বললেন,” তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। যদিও আমি ক্ষমার অযোগ্য তবুও পারলে এই মহাপাপীকে ক্ষমা করে দিও, আফরিন।” বাসায় ফিরে অন্য দিনের মতো সব কাজ গুছিয়ে নিলো আফরানিকা।আজ তার ঘর খাঁ খাঁ করছে। জীবনে যে মানুষ টা তার দিকে ফিরেও তাকায় নি,এমনকি প্রতিমুহূর্তে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন ছাড়া অন্য কিছু দেয় নি সেই মানুষটির জন্য আজ তার মন ছটফট করছে।

স্বামী সুখ কি জিনিস সেটা সে জানে ও না। শুধু জানে, চার বছরের সংসার জীবনে সে দেখেছে স্বামী নামক এক হিংস্র মানুষ রূপী পশুকে আর তার হিংস্রতাকে।এই সবকিছুর মধ্যে তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছিল তার শ্বশুর- শ্বাশুড়ি। কিন্তু, ভাগ্য তাদের কে ও দুরে ঠেলে দিয়েছে। বিয়ের দুই বছরের মাথায় তার শ্বশুর এবং গত ছয় মাস আগে তার শ্বাশুড়ি মারা গেছে। আজ সে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায়!! চার বছর আগে,, একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় আফরানিকার আম্মু আব্বু। র্দুভাগ্যক্রমেই সে বেঁচে যায়। আর সেই বেঁচে থাকা আজ তার কাল হলো। এই ঘটনার কিছু দিন পর তার বিয়ে হয় আরিফের সাথে। আরিফের আব্বা ছিল তাদের দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। আরিফের আব্বা আম্মা দুইজন ই ভীষণ ভালো বাসতো তাকে। সেও ভীষণ ভালোবাসতো তাদের। মা- বাবার জায়গা ছিল তাদের জন্য।

কিন্তু যার সংসার সামলাতে সে আসলো সেই আরিফ কোনো কারণ ছাড়াই তাকে সহ্য করতে পারতো না। এমনকি বিয়ের দিন থেকেই তার সাথে নোংরা ব্যবহার করা শুরু করে। আরিফ তাকে স্ত্রী নয় নিজের দাসী মনে করতো। বিনা কারণেই গায়ে হাত তুলতো। কিন্তু আফরানিকা কোনো দিন এর প্রতিবাদ করে নি। আরিফের ব্যবহারে তার মা – বাবা অনুতপ্ত হতেন কিন্তু আফরানিকা তার ভাগ্য কে মেনে নিয়েছিলো এবং সে যে মা- বাবা পেয়েছে এই খুশিতে পূর্ণ ছিল।

বিয়ের আটমাসের মাথায় আফরানিকা পায় তার জীবনের সবচেয়ে বড় খুশির খবর। সে বিসিএস পরীক্ষায় প্রশাসন ক্যাডারের নিবার্হী ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে নিয়োগ পায়। পরম চাওয়া ছিল তার। শ্বশুর শাশুড়িকে খবর দিতেই তারা তাকে মন ভরে আশীর্বাদ করে। সমস্ত দিন ধরে আরিফের জন্য অপেক্ষা করে সে নিজের মুখে এই খুশির খবর টা দেবে বলে কিন্তু আরিফের কোনো দেখা নেই। হঠাৎ করেই রাত দুইটার দিকে আরিফ এসে কলিং বেল চাপে দরজা খুলতে একটু দেরি হওয়ায় সেদিন মনের সুখে আরিফ তাকে মারে। লজ্জায় অপমানে সেই রাতে আত্মহত্যা করতে গিয়ে ও শ্বশুর শাশুড়ির মুখ মনে করে সেদিন ফিরে আসে।

এর পর কিছুদিনের মধ্যেই তার শ্বশুর মারা যায়। তার মাথার উপর থেকে একটা হাত চলে যায়। আরিফের অত্যাচার ও দিন দিন বাড়তে থাকে।যে নিজে সমস্ত মানুষের অধিকার আদায়ের ন্যায়বিচার দেওয়ার জন্য কাজ করে তাকে কে ন্যায়বিচার দেবে? তাকে কে নায্য অধিকার দেবে?? তার নিজের ঘরে যে আগুন জ্বলে সেই আগুন কে নেভাবে?? প্রায় ছয় মাস আগের কথা, হঠাৎ করেই তার শ্বাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পাশের ফার্মাসি থেকে ওষুধ এনে খাওয়ানোর পর আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। অবস্থা সংকটজনক দেখে তাড়াতাড়ি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় আফরানিকা। সমস্ত রাত ধরে হাসপাতালে সকালে ডাক্তার জানান তার শ্বাশুড়ি মারা গেছেন। এবং অতিরিক্ত বিষ এর কারনে তিনি মারা গেছেন। এইবিষ দীর্ঘদিন ধরে তার শরীরের প্রবেশ করানো হচ্ছে।

কথা গুলো শুনে, আফরানিকা একদম পাথর হয়ে গেলো। বিষ! তার শ্বাশুড়ি কে দেবে? খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে , গোসল করানো , ওষুধ খাওয়ানো সব তো সে নিজের হাতে করে। তাহলে বিষ কে দিল? শ্বাশুড়ি মারা যাওয়ার পনের দিন পর আফরানিকা আবার ডাক্তারের কাছে আসেন এবং মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চায় আবার ও। তখন ডাক্তার রোগীর ওষুধ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানতে চাই এবং ওষুধ গুলো ল্যাব টেস্টের জন্য পাঠিয়ে দেয়। তিন দিন পর রিপোর্ট আনতে গিয়ে সে জানতে পারে দিনের পর দিন ভেজাল ওষুধ খাওয়ার জন্য তার শ্বাশুড়ির মৃত্যু হয়েছে।

তখন সে বাড়ির পাশের সেই ফার্মাসিতে খোঁজ নিয়ে ওষুধ এর সাপ্লাইয়ারের খোঁজ নিয়ে ওষুধের কারখানায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালায় এবং ওই কারখানা সিলগালা করে এর মালিককে গ্রেফতার করে। কিন্তু সেই মালিক আর কেউ না, তার ই স্বামী আরিফ আহমেদ!!! যার তৈরি ভেজাল ওষুধ তার নিজের মাকে মেরে ফেলেছে। স্বামীর বিরুদ্ধে সরাসরি হত্যা মামলা করে সে নিজে।আর সেই মামলার ই রায় দিয়েছে আজ। আফরানিকা মনে মনে খুশি আবার কষ্টে ভারাক্রান্ত। সে অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে নাই। মা হত্যার বিচার পেয়েছে কিন্তু সেই হত্যাকারী আর কেউ নয় তার ই স্বামী!! যে কিনা তার মায়ের একমাত্র সন্তান !!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত