সাক্ষী

সাক্ষী

লিপিস্টিক দেওয়া ঠোঁটের মতো লোকটির ঠোঁট লাল তবে লিপিস্টিকের রঙে নয় বাবা জর্দা মিশ্রিত পান খেয়ে তার এই অবস্থা । বিশেষ কোন প্রাণীর মতো পান খেয়ে সে সারাদিন জাবর কাটে । আদালত পাড়ায় তার বেশ নাম ডাক আছে, সাক্ষী মফিজ নামে উকিলদের কাছে সে পরিচিত । নাম মফিজ হলে কি হবে কাজে একেবারে সেয়ানা, ধুরন্ধর ব্যক্তি । মানুষের মাথায় কিভাবে কাঁঠাল ভেঙে খেতে হয় সেটা তার ভালোই জানা আছে । সাক্ষী মফিজ এখন বসে আছে এডভোকেট জয়নাল সাহেবের চেম্বারে । মুখে সেই বাবা জর্দায় মোড়ানো পান, যা সে জাবর কেটে চলছে,

— কি হে মফিজ মিয়া কি খবর তোমার ?
— জ্বি স্যার ভালো, তো কি মনে করে জরুরী তলব করলেন ?
— কেন জরুরী তলব করেছি সেটা তুমি ভালো করেই জান । সাক্ষী লাগবে তিনজন, একজন মহিলা একজন বুড়ো মানুষ আর একটা বাচ্চা হলে ভালো হয় । বাচ্চাদের কথা আদালত বিশ্বাস করে বেশি ।
— কি কেস স্যার ?
— মার্ডার কেস ।
— মার্ডার কেসে কেউ সাক্ষী দিতে চায় না ডিমান্ড অনেক । সাক্ষী দিতে গিয়ে ধরা পড়লে উল্টো জেল হাজত ।
— আরে দূর মিয়া এতো চিন্তা কর কেন । টাকা পয়সার ব্যবস্থা আমি করব তুমি শুধু সাক্ষী যোগাড় কর । কিভাবে কি বলতে হবে আমি সব শিখিয়ে দিব ।

রামপুরা বস্তির সামনে মফিজ মিয়া দাঁড়িয়ে আছে । যার জন্য দাঁড়িয়ে আছে সে এখনো বস্তিতে ফেরেনি । যার কাছে সে এসেছে, মহিলাটি বড্ড কাজের, কিভাবে এতো সুন্দর বানিয়ে কথা বলে আল্লাহ মালুম । আসলে মহিলারা পারেও বটেও, এরা জাত অভিনেত্রী । এদের অভিনয় শেখানো প্রয়োজন হয় না । এরা সময়ের প্রয়োজনে এক একজন পাক্কা অভিনেত্রী হয়ে উঠে ।

— সুলতানের মা এতো দেরি হইলো কেন
— আরে মফিজ ভাই যে এতোদিন বাদে বুঝি মনে পড়লো সুলতানের মারে ।
— ঘন ঘন তো আর এক সাক্ষী ব্যবহার করা যায় না । মুখ চেনার ও তো একটা ব্যাপার সেপার আছে ।
— আসেন, ঘরে আসেন, তারপর আলাপ সালাপ করি ।
— সুলতানের বাপ কই ?
— আর ঐ ভাদাইম্মার কথা বইলেন না এক দিন আসে তো সাত দিন খবর থাকে না । ভাত কাপড় দেওয়ার নামে তো কোন খবরই নাই আসে রঙ্গ করতে । এতো ঝাড়ু দিয়া পিটাই তাও লাজ শরম হয় না ।
— আর তোমার ছোট পোলাটা ।
— ও, সুলতানের কথা কইতেছেন । সুলতান রাস্তায় রাস্তায় এটা সেটা বিক্রি করে । এই তো আইসা পরবো কিছুক্ষণ পরেই ।

— এই বার কিন্তু তোমার পোলাটেরেও সাক্ষী হিসাবে লাগব !
— ও আল্লাহ ! কি কন এই গুলো, এতটুকু পোলা কোর্টে কি সাক্ষী দিব ! আর কেসটা কি সেটাও তো কইলেন না ?
— মার্ডার কেস, তবে ভয়ের কিছু নাই, জাদরেল উকিল জয়নাল সাহেব কেসটা লড়তেছে । আর প্রেমেন্টও ভালা পাইবা এতো চিন্তা কর কেন । পোলাডারে একটু বুঝাইয়া কইবা । আমার জানা মতে তোমার পোলাডাও টেন্ডর আছে, কইলেই সব বুঝবো । আদালত পোলা পাইনের সাক্ষী গুরুত্ব দেয় বেশি ।

কথা গুলো শেষ করে মফিজ পানের পিক দিয়ে বেড়ার ঘর এক পাশ নষ্ট করে ফেলেছে । সেদিকে তাকিয়ে সুলতানের মা ভাবছে পেটের দায়ে তাদের কতো কিছুই না করতে হয় । শুধু মিথ্যা সাক্ষীই না মাঝে মাঝে দলের লোক এসে তাদের মিছিল এবং সমাবেশের জন্য ধরে নিয়ে যায় । যেতে না চাইলে বস্তিতে আগুন দেওয়ার হুমকি দেয় । সারাদিন গলা ফাটিয়ে আর সমাবেশের তোতা পাখির বুলি গুলো শুনা শেষে তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় একশো টাকার একটি নোট । আর এই যে মফিজ নামের লোকটি বসে আসে তার কোন মিথ্যা মামলায় সাক্ষী দিলে পাঁচশো বা এক হাজার টাকার মতো পাওয়া যায়, সাথে কোর্ট পাড়ার হোটেলে মুরগির সালুন দিয়ে পেট পুরে খাবার । তার এই ছোট্ট জীবনে মিথ্যা সাক্ষী গুলো ঠিক ঐ পানের পিকের মতো অপবিত্র এবং রঙ্গিন । তবুও তার কিছুই করার নেই । সে যে দরিদ্রের শিকলে বন্দী ।

যে লোকটির সামনে মফিজ মিয়া বসে আছে লোকটি শিক্ষিত । এক সময় ব্যাংকে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ছিল । নিজের সারা জীবনের সঞ্চয় ছেলের হাতে তুলে দিয়ে সে এখন নিঃস্ব । ছেলে এবং ছেলের বউয়ের কাছে সে মূল্যহীন । তার হাত খরচ তো দূরের কথা তিন বেলা খাবারই ভালো মতো জুটে না । বড় বাজারের ব্যাগ হাতে লোকটিকে কাওরান বাজার দেখেছিল মফিজ । শকুনের চোখ মফিজের, অভাবি আর দুঃখী মানুষ চিনতে ভুল হয়নি মফিজ মিয়ার । কথায় কথায় সমস্ত ঘটনাই তাকে বলেছিল । সুযোগ বুঝে টোপ ছেড়েছে মফিজ মিয়া । গিলতে বেশি সময় লাগেনি । টাকা যেখানে জীবনের চাহিদা মেটায়, সততা আর মিথ্যা সাক্ষী সেখানে তুচ্ছ ।

— কিছু মনে কইরো না মফিজ মিয়া । বাসায় বসাইতে পারলাম না । ছেলের বউটা বড়ই রক চটা । কখন কি উল্টা পাল্টা বলে বসে বলা মুশকিল, তাই এখানে নিয়ে আসলাম ।
— সমস্যা নাই চাচা আমি জানি আপনার পোলার বউ সম্পর্কে । মাঝে মাঝে মনে চায় তারে চৌদ্দ শিকের ভাত খাওয়াইয়া আনি ।

— দূর মিয়া কি কও উল্টা পাল্টা, কাজের কথা কও ।
— সাক্ষী দেওয়ন লাগব । মার্ডার কেসের আসামি । তারে নির্দোষ প্রমাণ করন লাগব । মার্ডার কেস শুনে বুড়োর মুখটা ফেকাসে হয়ে গেছে । তার উপর একজন আসামি কে মিথ্যে সাক্ষী দিয়ে বাঁচিয়ে দিতে হবে ।

— কি চিন্তা করছেন চাচা ! কোন সমস্যা নাই প্রেমেন্ট ভালো পাইবেন ।
— তাই বলে একজন খুনের আসামি কে মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে বাঁচিয়ে দিব ।
— বাঁচাবেন না তো কি করবেন, সে তো আর ইচ্ছা করে খুন করে নাই । মাথা গরম হয়ছে খুন করে ফেলছে । এখন তো সেই মানুষটারে বাঁচানো আমাগো প্রয়োজন, নাকি !! আর সে তো আর ফ্রী ফ্রী সেবা চাইতেছেনা । টাকা দিব তাই সাক্ষী দিবেন ।

কি মনে করে যেন বুড়ো রাজি হয়ে যায় । চোখের চশমা নিতে হবে, চোখে ভালো দেখেন না আজকাল । নাতি নাতনিরা তার কাছে মাঝে মাঝে এটা সেটা আব্দার করে, টাকার জন্য কিনে দিতে পারেন না তিনি । তখন বড়ই লজ্জা করে নিজের কাছে । নীতি বাঁচিয়ে রেখে কি হবে, নীতি তো সেদিনই মরে গেছে যেদিন ছেলের হাতে নিজের সঞ্চিত সব তুলে দিয়েছিলেন । আর সেটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল । এডভোকেট জয়নাল সাহেবের টেবিলের সামনে সবাই গোল করে বসে আছে । তার হাতে একটি ছবি যাকে মিথ্যা সাক্ষীর বিনিময়ে বাঁচিয়ে দিতে হবে। কিভাবে কেমন করে সাক্ষী দিতে হবে সেটাও বুঝিয়ে দিচ্ছেন তিনি ।

— এই যে সুলতানের মা তোমাকে তো বেশি কিছু বলতে হবে না মনে করি । শুধু এতটুকু বলবা, কাজ শেষে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলে, দেখলে একটা লোকের পাশে একটা দুইজন আরোহী সহ মটর বাইক থামল এবং হঠাৎ করে লোকটির গায়ে গুলি ছুড়তে লাগলো । গুলি ছুড়তে দেখে পেছনের গাড়ি থেকে নেমে আসলো এই ছবির মানুষটি, মানে বাছেদ সাহেব । তাকে আসতে দেখে পালিয়ে যেতে লাগলো সন্ত্রাসীরা কিন্তু তাড়াহুড়া করতে গিয়ে হাত থেকে পিস্তল পরে গেছে এবং সেই পিস্তল দিয়ে বাছেদ সাহেব ধাওয়া করতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেছেন । যদি অপর পক্ষের উকিল জিজ্ঞেস করে বাছেদ সাহেব কেন লোকটি কে বাঁচাতে এগিয়ে এলো ? তুমি বলবা এই ব্যাপারে আমি কিছু জানি না । তখন যা বলার আমি বলবো । ঠিক আছে তো ?

— জ্বে স্যার ঠিক আছে আমি সব ঠিকঠাক কইতে পারুম সমস্যা নাই
— বাবা সুলতান কি বলছি বুঝতে পারছ । তুমিও তোমার মায়ের মতো হুবহু বলবা কোন ভয় পাইবা না ।
— দূর এটা কোন ব্যাপার হইলো, ফান্টা কইয়া কতো মানুষরে সেকারিন আর রঙের পানি খাওয়াই দেই, আর এই তো সামান্য মিথ্যা কমু এটা কোন ব্যাপার !

— সাবাস সুলতান, তুই আসলেই সুলতান । কথাটা শুনে ফোকলা দাঁতে খিল খিল করে হেসে উঠে সুলতান । সময়ের আগেই অনেক কিছু শিখে গেছে সুলতান । সৎ পথে এই কঠিন দুনিয়ায় বেঁচে থাকা বড়ই কষ্টকর তার থেকে কে আর ভালো বুঝে ।

— এই যে চাচা আপনি তো উকিলের জেরার মুখে উল্টা পালটা কিছু বলবেন না আবার । নীতি বিসর্জন দিয়েছেন সেটা জানি কিন্তু আমাদের সাথে কাজ করতে গিয়ে আবার নীতি যেন উৎলে না উঠে । মাঝ থেকে মফিজ মিয়া বলে উঠে না, না সেই রকম কিছুই কইব না চাচা মিয়া কে আমি ভালো মতো বুঝাইয়া আনছি।

জেরা হচ্ছে, কঠিন জেরা । একজন একজন করে সাক্ষী হাজির হচ্ছে । তারা তিনজন বাদেও মফিজ মিয়াকে আরো দুই জন সাক্ষী মেনেজ করতে হয়েছে, সেটা অবশ্য মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে । যেখানে লোকটিকে বাসেদ সাহেব খুন করেছে তার পাশেই চায়ের দোকানে বসা ছিল কর্মচারী মিন্টু আর মালিক সোলেমান । তাদের সাক্ষীটাই বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ আর বাদ বাকি তিনজনের সাক্ষী তো আছেই । অনেক তর্ক বিতর্ক, প্রমাণ, সাক্ষী , সব মিলিয়ে প্রমাণিত হলো বাছেদ সাহেব সম্পূর্ণ নির্দোষ সে বিজনেস পার্টনার কে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেছেন । আসলে সত্যিটা হলো অন্য, আজ কি একটা ব্যাপার নিয়ে তাদের মাঝে তুমুল ঝগড়া হয় আর এর প্রতিশোধ নিতেই জিদের মাথায় খুন করে তার বিজনেস পার্টনার তালিব সাহেব কে ।

অনেক দিন পর সাক্ষী মফিজের পকেট বেশ গরম । সবাই কে লাম ছাম বুঝিয়ে দিয়ে তার পকেটে এখন পঁচিশ হাজার টাকা অবশিষ্ট আছে । সবাই কে বিদায় দিতে গিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় পৌঁছানো দরকার । কোর্ট থেকে বেরিয়ে রিকশা খুঁজছে মফিজ মিয়া একটা রিকশাও ধারে কাছে নেই । কি মনে করে যেন হাঁটতে লাগলো কিন্তু তার কাছে মনে হলো তার পেছন পেছন কে যেন আসছে । পেছনে তাকাতেই কোন মানুষের হদিস পাওয়া যায় না । এমন কয়েকবার হয়েছে কিন্তু প্রতিবারই ধোঁকা খেয়েছেন । এবার মফিজ মিয়া দেখতে পারছে তার ঠিক সামনে ল্যাম্পোস্টের নিচে একটি ছায়া মানব দাঁড়িয়ে আছে । মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না কিন্তু সামনে আসতেই ছায়া মনবের চেহারাটা তার কাছে পরিচিত মনে হলো । আরে তাই তো, এতো খুন হওয়া তালিব সাহেবের ছেলে । এজলাসে তার সাথে অনেকবার চোখা চোখি হয়েছিলো । মফিজ মিয়া ছেলেটি কে সাইট কেটে চলে যাচ্ছিল কিন্তু মফিজ মিয়ার নাম ধরে ছেলেটি ডাক দিয়েছে ।

— ও মফিজ মিয়া,,, সাক্ষী গুলো তো ভালোই জোগাড় করেছিস । কি সুন্দর করে তোতা পাখির মতো বলে গেল কোন ভুল হলো না । এক মাত্র তোর জন্য আমার বাবার খুনীর শাস্তি হলো না । কিন্তু সেই শাস্তি যে তোকে পেতে হবে, তারপর বাছেদ সাহেবের পালা । জানি তাকে মারতে আমার বেগ পেতে হবে কিন্তু তবুও ছাড়বো না আমি । এই কথা বলে বিন্দু মাত্র দেরি করলো না ছেলেটি ।

হাতে লুকানো চকচকে ছুরিটি আকর্ষিক ঢুকিয়ে দিল সাক্ষী মফিজের তল পেটে । চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো মফিজ । না, আর এক মুহুর্ত দেরি করলো না ছেলেটি সেখান থেকে প্রস্হান করলো দ্রুত । হয়তো দুই একজন পথচারী দেখেছে ঘটনাটি কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি ভয়ে । এমন কি তাদের সামনে একটি লোক যে চিৎকার করতে করতে মারা গেল তবুও কেউ সাহায্য করলো না বাঁচানোর জন্য । কে চায় উটকো ঝামেলা মাথায় নিতে । সাক্ষী মফিজের খুনের জের ধরে তার বড় ভাই মামলা করেছে তবে কে খুনী তার কোন উল্লেখ নেই । নেই কোন সাক্ষী প্রমাণ । আদালত অনেকটাই বিরক্ত ।

— যে মামলার কোন আসামি নেই । নেই কোন সাক্ষী প্রমাণ তবে সেটা কিসের মামলা । সাক্ষী প্রমাণের অভাবে কেস এখানেই ডিসমিস করা হলো । যে একদিন উকিলদের সাক্ষী যোগাড় করে দিত আজ তার খুনের সাক্ষী পাওয়া গেল না । এটাই মনে হয় নিয়তি । এটাই মনে হয় প্রকৃতির প্রতিশোধ ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত