রিক্ততা

রিক্ততা

অন্যএকজনের জন্য যখন আমার শোয়ার ব্যবস্থা মায়ের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায় ঠিক তখন থেকে ই এই লোকটাকে আমি দেখতে পারতাম না আমার পছন্দ না।

আমার সবর্দা সহাস্য মুখে এক প্রকার অন্ধকার নেমে আসে। কারো সাথে কোনো রকম কথাবার্তা কিংবা অন্য সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেই। কেন জানি না এমন করি তবে নিজের মায়ের সাথে বাবা ছাড়া অন্য কোনো পুরুষকে আমার সহ্য হত না। ভাবতাম, বাবা চলে গেছেন বলে কি অন্য একজনকে বিয়ে করতে ই হবে..! অনেকটা নিজের মায়ের প্রতি খারাপ লাগার সৃষ্টি হল।

নিজেকে নিজের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলি। দরকারি কথাবার্তা ছাড়া তেমন কোনো কথা বলার প্রয়োজন বোধ করিনা কারো সাথে ই। সেই বারো বছর বয়স থেকে আমার আমি তে এই আমি টা গড়ে উঠা। মা অনেক সময় অনেক ভাবে চেষ্টা করেছে আমি যাতে আগের মত হই কিন্তু যেখান থেকে আমার মন উঠে গেছে সেখানে আর কিছু ই সম্ভব হয়নি।

কোনো ধরনের পছন্দ যেমন, খাবার পোশাক ঘুরতে যাওয়া তাতে আমি কোনো মত দিতাম না। আমার মা যা এনে দিত তা রাখতাম পছন্দ হলে পরতাম না হলে পরতাম না। তবে বলতাম না যে এটা আমার পছন্দ হয়নি।

এভাবে আমার স্কুল থেকে কলেজ অব্দি শেষ হয়। আমার এই একাকিত্বের জীবনে আদিব নামের একটা মানুষের আগমন ঘটে। যে আমি অন্যকারো সাথে কোনো কথা বলতাম না সেই আমি’টার একটা কথা বলার মানুষ পেয়ে যাই। পড়ালেখার সূত্র ধরে পরিচয় আমাদের সেই পড়ালেখা থেকে বেশি কিছু। আমার জমানো যত রাগ অভিমান কষ্ট সব সব আমি আদিবের কাছে শেয়ার করতাম। আর আদিব শক্ত করে আমার হাতটা ধরে আগলে রাখত।

রুমে রাত জেগে পড়াশোনা করা, মাঝে মাঝে কানে হেড ফোন লাগিয়ে গান শোনা, আনমনে হাসা তা হয়ত মা কিছুটা খেয়াল করে ছিলেন। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় মা একটা ছবি নিয়ে এসে আমাকে দিলেন। আমি ছবিটা না দেখে ই বলে দিলাম আমি এসব দেখতে পারব না। আর এসব নিয়ে আমি কথা বলতেও চাই না। মা আমাকে অনেক জোরাজুরি করেন আমি রাগ করে আর কথা বলিনি মায়ের সাথে।

২ দিন পর কলেজ যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে বের হব ঠিক তখন আমার দ্বিতীয় বাবা আমাকে বললেন, আমার কোনো পছন্দ আছে কি না। আমি উনার সাথে কোনো রকম কথা বলতে প্রস্তুত না। তাই কথা বাড়াতে চাই না বলে, বললাম ‘ না ‘।

তখন উনি বললেন, তাহলে ছবি দেখলে সমস্যা কি। আমি আর কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ না করে চলে গেলাম। পরে মনে হয়েছিল, আদিবের কথা বলে দেই। কিন্তু কেন জানি কথা বলেতে ইচ্ছে হয়নি।

আমার অনার্স শেষ হয়। আদিব ওর গ্রামের বাড়িতে যায় যেহেতু ও আমার দু বছর সিনিয়র তাই সে তখন মাস্টার্সে পরিক্ষা দেয়। যাবার দু দিন পর অব্দি কথা হয় আমাদের কিন্তু এর তিন চার দিন পর আর কোনো কথা হয়নি কোনো ভাবে ই আদিবের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। ফোন অফ অনলাইনে নাই কোনো কিছুতে ই আদিব নেই।

ভার্সিটি তে যাদের সাথে মিশত তাদের কাছে খবর নিলাম তারাও কোনো কিছু জানে না। অনেকটা পাগলের মত হয়ে যাই। আদিবের গ্রামের নাম রুপপুর শুধু এইটুকু জানি। আমি আমার সব কথা বলতাম আরো অনেক কথা হত কিন্তু তার পরিবার বা ওর ব্যক্তিগত তেমন কিছু ই আমি জানি না। শুধু নিজের মধ্যে পুষে রাখা রাগ কষ্ট গুলো আদিবকে শুনিয়েছি কখনো ওর বিষয়ে জানার কথা আমার মনে ই হয়নি হয়ত সব বলার মত একজনকে পেয়েছি বলে এতদিনের নিজের কথাগুলো বলেছি। অন্যকিছু মনে ই ছিল না। ওর সাথে সবাই পড়াশোনা শেষ করে এখান থেকে চলে যায়। আর আমার সবার সাথে তেমন যোগাযোগ ছিল না তাই কোনো খবর পাইনি আদিবের।

নিজেকে দ্বিতীয় বারের মত অসহায় মনে হচ্ছিল প্রথম মায়ের সাথে দুরত্ব ২য় প্রিয় মানুষের নিরুদ্দেশ । আমি ই ভুল করেছি নাকি অন্যকিছু। আদিবের বদৌলতে যতটুকু পরিবর্তন এসেছিল আমার মাঝে তা আদিবের চলে যাওয়ায় আবার সেই শূণ্যতার সৃষ্টি হয়। এখন আগের চেয়ে আমার অবস্থা ভয়াবহ হয়ে পরে। রুমে সারাদিন দরজা বন্ধ করে পরে থাকি।

হঠাৎ এক বিকেলে মা আমাকে বলল, মায়ের সাথে ডাক্তারের কাছে যেতে উনার কোমরের ব্যথা টা বেড়েছে। আমার সবকিছু তে ই কেন জানি ত্যক্ত বিরক্ত লাগত। আমি মায়ের মুখের উপর বলে দেই উনি উনার ২য় স্বামীকে নিয়ে যাচ্ছেন কেন উনি তো আছেন। এ কথা শোনার সাথে সাথে মায়ের চোখে জল চলে আসে আর বলেন, আমার ২য় বাবা বাড়িতে নেই কাজে বাইরে গেছেন কয়দিনের জন্য। তখনো চোখের পানি পরছিল শেষে বলেন, যখন বুঝবি তখন আমরা হয়ত আর থাকব না। একটু একটু খারাপ লাগছিল মনে। না গেলে না যাই তবে এমন কথা হয়ত বলা উচিত হয়নি।

এভাবে আরো দু চার দিন কেটে যায়। নানু আসেন আমাদের এখানে। এই নানুর সাথে আমার আরো রাগ। অসুস্থতার জন্য আসেন ঠিক তখন কোথায় হতে আমার বিয়ের কথাবার্তা শুরু হল। যার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমি রাগ করে না খেয়ে থেকেছি কিন্তু আমার মৃত্যুর পথযাত্রী নানুর কথা আর অমান্য করতে পারিনি। উনার সব ভুলের জন্য আমার কাছে ক্ষমা চান। উনার শেষ অনুরোধ রক্ষার্থে হ্যা বলতে হল আনাকে।

কার সাথে বিয়ে হচ্ছে কোথায় বিয়ে হচ্ছে কোনো কিছু জানার প্রয়োজনবোধ করিনি তখন শুধু একটা মানুষের কথা ই মনে পরছিল ‘ আদিব ‘। যেন ভিতরটা ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাচ্ছিল এক আকাশ সমান কষ্ট বয়ে নিতে পারছিলাম না। আর নতুন কাউকে নিয়ে ভাবার মন মানসিকতা আমার কোনো টাই ছিল না।

কিন্তু বিয়ের দিন আমার পাশের মানুষটাকে দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। হাত বা ঠান্ডা হয়ে আসে আমার সত্যি দেখছি নাকি অন্যকিছু। আমার পাশে বর বেশে আদিব বসে আছে। আমি কয়েক মুহুর্তের জন্য যেন থমকে যাই। হৃদয় সমুদ্রে যেন আচকমা ঢেউ উঠে। বিয়ে শেষে যা জানতে পারলাম তা শুনে আমি মাথা ঘুরে পরে যাওয়ার মত অবস্থা।

আদিবের বাবা মারা যান হঠাৎ করে। বাড়িতে তাদের সম্পত্তি নিয়ে অনেক সমস্যা এমনকি মারামারি পর্যন্ত হয় যেখানে মামলায় বিনা দোষে আদিব সহ তার পরিবারের অনেককে জেলে যেতে হয় আর সেখান থেকে সব যোগাযোগ বন্ধ। এতটুকু ঠিক আছে কিন্তু আদিব সহ বাকি সবাই মামলা থেকে মুক্ত করা তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া সবকিছু ই নাকি আমার ২য় বাবা ই করেছেন।

শুধু তা নয়। আমি যখন সেই ছোটবেলা থেকে পরিবার থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন স্বাভাবিক না কোনো রকম ভাবে নরমাল লাইফে ফিরছিলাম না তখন এই বাবা ই আদিবকে আমার জন্য পাঠান। আদিব বাবার বন্ধুর ছেলে। আদিবের ভাষ্যমতে, আমার জন্য আদিবকে উপযুক্ত মনে করেন এবং তিনি আমাকে আগলে রাখার জন্য আমার ভালো থাকার জন্য আদিব নিয়ে আসেন আমার জীবনে। কোনো উপায় না দেখে তিনি এরকম পথ বেছে নেন। আমি শুনছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম। তবে মুখ দিয়ে কোনো কিছু বলতে পারছিলাম না।

কৃতজ্ঞতা নাকি ভালোবাসা তাও বলতে পারছিলাম না। শুধু অপেক্ষা করছিলাম মানুষটার জন্য অনেক দিনের অপরাধ জমা আমার। সব আইনগত কাজ শেষ হলেও কিছু কাজ বাকি থেকে যায় তাই শেষ করে বাবা বাড়ি ফিরবে। আর আমার শর্ত ছিল আমার বিয়েতে যাতে উনি না থাকেন। আসলে সেই কারণে ই হয়ত এমন। নিজের কাছে খুব খারাপ লাগছিল কত টা তা বুঝাতে পারব না। শুধু অপেক্ষা কিন্তু সময় যেন যাচ্ছিল না। মায়ের সাথে আবার অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যাই। সকালে ফোন আসে হসপিটালে যেতে। আমি মা আর আদিব চলে যাই হসপিটালে।

কিন্তু যাওয়ার আগে ই শেষ হয়ে যায় সব। বাবা ব্রেইন স্টোক করেন শেষ সময়ে আমাকে দেখতে চাইছিলেন আমার নতুন জীবন আমাকে আর আদিবকে একসাথে তা আর হল না। কেউ একজন একটা কাগজ হাতে এনে দেয় আমার। তাতে লেখা, প্রিয় তিশা, আমার একমাত্র সন্তান। কোনো দিন কোনো কিছু করতে পারিনি তোর জন্য মা। জানি হয়ত তোর প্রিয় বাবা নামক মানুষের জায়গা টা আমার জন্য না। তবে আমি সবসময় ভেবেছি তুই আমার মেয়ে। আমি না পারি অন্যকেউ যাতে তোকে একটা সুন্দর জীবন দিতে পারে তাই আদিবকে দিয়ে গেলাম। না আদিব আমার মত খারাপ না অনেক ভালো অনেক ভালো রাখবে তোকে।

আমি কোনো দিন ইচ্ছা করেও তোকে কিছু দিতে পারিনি মা। শুধু একটা জিনিষ দিয়ে গেলাম ফেলে দিস না মা যখন জানতে পারবি আদিব কে আমি পছন্দ করেছি তোর জন্য.! এই একটা কথা রাখিস আর কোনো কিছু বলব না তোকে। জন্ম দিলে ই কি পিতা হয় এমনি হয় না। আর হ্যা, একটি বার মাত্র মাত্র একটি বার আমাকে বাবা বলে ডাকিস। জানিনা শোনার সৌভাগ্য হবে কি না আমার! কখনো কারো মুখে বাবা ডাক শোনার ইচ্ছা ছিল না মা। লেখাগুলো পড়ে আমি অঝোর ধারায় কাঁদছি। জন্ম না দিয়ে কিভাবে একজন পিতা তার দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে যেতে পারে তা সত্যি আমার জানা ছিল না।

মা বললেন, বাবা ই সন্তান নিতে মানা করেন। যাতে নিজের সন্তানের জন্য আমার কোনো কমতি না হয়। যাওয়ার আগে সব সম্পত্তি আমার আর মায়ের নামে লিখে দিয়ে যান। এসব শুনে আমি এমন সন্তান হওয়ার অপরাধের বোঝা বয়ে নিয়ে যাওয়ার মত সাধ্য আমার নেই। একজন জন্ম না দিয়েও অন্যের সন্তানকে এতটা আগলে রাখতে পারে আমার জানা ছিল। এমন মানুষকে কতটা ঘৃণা করেছি আমি। আজ নিজের কাছে নিজে ঘৃণিত।

১ম বাবা মারা যাওয়ার পর আমাকে আর মা কে আশ্রয়স্থল হিসেবে নানু মাকে বিয়ে দেন। কারণ মামাদের অবস্থা ভালো ছিল না আর কখন কি হবে তা ভেবে এমন করেন নানু। মায়ের শেষ বয়সের কথা চিন্তা করে। কিন্তু আমি! কখনো বাবার আদর না পাওয়া একরকম আর যে পেয়েও না জেনে হারিয়ে ফেলে এরচেয়ে কষ্ট আর কিছুতে নেই। আমার এই কষ্ট টা যে সব কষ্টকে হার মানিয়ে নিয়েছে। সহ্য হচ্ছিল না। যদি একটি বার আশীর্বাদ সরুপ বাবে ফিরে পেতাম….

একটি বার অনেক কষ্ট হয় খারাপ লাগে কিন্তু যখন আদিবকে দেখি তখন বাবার ছায়া দেখতে পাই। এটাই বড় সুখ বাবা তার সন্তানকে দিয়ে গেছেন। আর যাই হোক, বাবা সন্তানের জন্য খারাপ কিছু করেন না সেটা আদিবকে দিয়ে বুঝিয়ে গেছেন। আর মা শেষ সময়ে তার পথচলা মানুষের অনুসরণ করে একমাস পরে তিনিও বিদায় নেন।

কিছু কিছু সম্পর্ক রক্ত ছাড়াও কাছে টানে, কিছু ভালোবাসা নিঃস্বার্থ ভাবে দিতে ই থাকে আর কিছু মানুষ সারা জীবন মনে আসনে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে রাখে। ঠিক তেমনি ই এই রক্তের সম্পর্কহীন আমার এই পিতা। এক সন্তানের অপরাধী আর্তনাদ এখন আমার মাঝে। একবার যদি ফিরে পেতাম আমার পিতা কে…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত