দুদিন আগে নোমানের বিয়ে হয়েছে। মফস্বল এলাকায় মহা ধুমধাম করেই বিয়েটা হয়েছে। প্রায় দুইহাজার লোকের নিমন্ত্রণ ছিল। হবেই না কেন? নোমানের শ্বশুর এলাকার চেয়ারম্যান আর তার বাবা কলেজের অধ্যাপক।
আজ নোমানকে তার শালাশালীরা নিতে এসেছে ফিরানীর জন্য। এই একটা ব্যাপার। আধুনিক যুগেও বিয়ের ও বিয়ে পরবর্তী অনুষ্ঠানগুলোর প্রচলন আছে। যাইহোক নোমান তার স্ত্রীসহ শালাশালীদের নিয়ে শ্বশুরবাড়ি রওনা দিল। মাইক্রোবাসে করে প্রায় একঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেল তারা। এখানেও আনুষ্ঠানিকতার কমতি ছিল না। আদর-আপ্যায়নও যে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে, নোমান তা হাড়েহাড়ে টের পেল।
সন্ধ্যার পর নোমান তার ছোট শালা আরিফের সাথে বাজারে গেল। ঘোরাফেরা, আড্ডা, ক্যারাম খেলার পর আরিফ বায়না ধরল সে আইসক্রিম খাবে। নোমান অনেকগুলো আইসক্রিম কিনে নিল বাসার সকলের জন্য। আর দুজনে দুইটা আইসক্রিম খেতে খেতে বাসার দিকে রওনা দিল। আইসক্রিমটা শেষ করতে পারল না। প্রচণ্ড পেটব্যথায় নোমান রাস্তার উপর শুয়ে পড়ল। প্রায় অচেতন অবস্থায় তাকে বাসায় নিয়ে আসা হল। মফস্বল এলাকায় রাত নয়টা দশটার মধ্যে ডাক্তার পাওয়া যায়, তার উপর চেয়ারম্যান বাড়ির জামাই এর অসুখ। ডাক্তার এসে কিছু ওষুধ আর ইনজেকশন দিল। বাসার সবাই খুবই চিন্তিত। কারণ ইতোমধ্যে নোমানের বাসার লোকও তার অসুস্থতার খবর পেয়েছে। এর আগে নোমানের এমন কোন অসুস্থতা ছিল না। ডাক্তার এটাকে গ্যাস্ট্রিক বলে ওষুধ দিয়েছে। আর নোমানকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়েছে। ঘুমের আগমুহূর্তে সে নীলিমার মায়াবী মুখটা একবার দেখল।
প্রচণ্ড ঝাঁকুনি হচ্ছে। মনে হচ্ছে ভূমিকম্প। ঝাঁকুনিতে নোমানের ঘুম ভেঙে গেল। কিন্তু সে চোখ বন্ধ করে তার বাইরের পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছে। নীলিমা হয়তো এখনো তার পাশে বসে আছে। আস্তে আস্তে নোমান চোখ খুলল। তার পাশে নীলিমা নেই। সে তার শ্বশুরবাড়িতেই নেই। সে একটা বাসের পিছনদিকের সিটে শুয়ে আছে। নোমান কিছু বুঝতে পারছে না। সে হয়তো স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্নের বিভিন্ন স্তর আছে। শেষ স্তরের স্বপ্নগুলো বাস্তবিক মনে হয়। এটা হয়তো সেই স্বপ্ন। এই স্বপ্নের গতিপথ নিজের মত চালানো যায়। নোমান এটা জানে। তাই সে বাস থেকে নামল।
সে এদিকওদিক তাকিয়ে দোকানের সাইনবোর্ড দেখে বুঝল এটা ঢাকার গাবতলী। যে বাসটা থেকে নেমেছে ওটার নাম ও কোথা থেকে এসেছে দেখলে ভাল হত। কিন্তু খেয়াল করা হয়নি। ততক্ষণে বাসটা চলে গেছে। অসুস্থ হওয়ার আগে তার গায়ে ছিল শার্টপ্যান্ট কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তার গায়ে পাঞ্জাবী। পাঞ্জাবীটা ময়লা হওয়ায় তার থেকে দুর্গন্ধ আসছে। স্বপ্নে গন্ধ পাওয়া যায় না। কিন্তু শেষ স্তরের স্বপ্নে মাঝেমাঝে গন্ধও পাওয়া যায়। নোমান ভেবে পাচ্ছে না সে কী করবে। যা করার ঠাণ্ডা মাথায় করতে হবে। অবশ্য মাথা ঠাণ্ডা করারও বা কি দরকার? ঘুম ভেঙে গেলে সে দেখবে নিজের বিছানায় শুয়ে আছে আর নীলিমা তার পাশে বসে আছে।
রাস্তা পার হতে গিয়ে হোচট খেয়ে পড়ে গেল নোমান। পড়ে ডান হাতের তালু কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে। ব্যথাও লাগছে। স্বপ্নে কি ব্যথা লাগে? এটা মনে করতে পারছে না। হাটা শুরু করল সে। রাস্তার পাশে একটা সেলুন দেখে সেখানে ঢুকল। নিজের চেহারা দেখে অবাক হল। সারা মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। সে তো আসার আগেই শেভ করে এসেছে। স্বপ্নে এটা সম্ভব। সে কি নাপিতকে শেভ করে দিতে বলবে? ভাবতে ভাবতে নাপিত বলল, বসুন। চুল কাটাবেন নাকি শেভ করবেন? নোমান ভাবছে। যেহেতু স্বপ্ন সেহেতু দুইটাই করা যেতে পারে। প্রায় একঘণ্টার মত লাগল তার চুলদাড়ি কাটাতে। চুল কাটানোর পর নাপিত বলল, চুলে কালি করব? নোমান জিজ্ঞাস করল, চুল কি বেশি পাকা?
-হুম।
নোমান তখন আয়নায় খেয়াল করল তার চুল বেশিরভাগ পাকা। এটা কি করে সম্ভব? নোমানের বয়স সাতাশ, তার একটা চুলও পাকেনি। সে বলল, থাক, কালি করা লাগবে না। টাকা দিতে গিয়ে দেখল তার কাছে কোন টাকা নেই। নোমান বিব্রতবোধ করছে। এখন সে কী করবে?
-ভাই, আমার কাছে টাকা নাই।
-টাকা নাই মানে? কাজ করানোর আগে খেয়াল থাকে না? আমরা কি দাতব্য সেলুন খুলেছি নাকি?
স্বপ্নে এতবড় অপমান সহ্য করা কঠিন। এখন কেন জানি নোমানের মনে হচ্ছে এটা স্বপ্ন না, বাস্তব। সে তার পরিবার পরিজনের কথা মনে করার চেষ্টা করছে। শুধুমাত্র তার স্ত্রী নীলিমার কথা মনে আছে। আর কারও কথা এমনকি তার বাবামায়ের কথা পর্যন্ত মনে নেই। সে সেলুনের লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, ভাই, আমি কি স্বপ্ন দেখছি? এমন প্রশ্ন শুনে সে অবাক। তার মনে করুণা জন্মাল। জিজ্ঞেস করল, ভাই আপনার কী হয়েছে? মলম পার্টির খপ্পরে পড়ছিলেন নাকি?
-না, ভাই।
-তাহলে উল্টাপাল্টা কিছু খেয়েছেন নাকি?
-না, আমি উল্টাপাল্টা কিছু খাই না।
এরপর লোকটা নোমানকে একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার ব্লাড প্রেশার মেপে দেখল। ব্লাড প্রেশার খুবই কম। কিছু ওষুধ খাইয়ে দিল। সে ডাক্তারকে তার অসুস্থতার ঘটনা থেকে শুরু করে যাবতীয় ঘটনা বলল। ডাক্তার সব শুনে বলল, আপনি নেশা করেন?
-না।
-তাহলে কেউ হয়তো আপনাকে উল্টাপাল্টা কিছু খাইয়ে দিয়েছে।
যান, বাসায় গিয়ে রেস্ট নেন। ঠিক হয়ে যাবে। নোমান চলে এল। কোথায় যাবে ভেবে পাচ্ছে না। একটা পার্কের মত যায়গা দেখল। এখানে থাকা যায় কিছুক্ষণের জন্য। একটা বেঞ্চের উপর বসল। সন্ধ্যা হয় হয়। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকা উচিৎ। তাহলে হয়তো তার স্বপ্ন ভেঙে যাবে। কিন্তু সে স্বপ্ন দেখছে না।
ঘুম এল না। মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছে। সে কয়েকটা দোয়াদরুদ মনে করার চেষ্টা করল। তার সেগুলোও মনে পড়ল না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আবছা অন্ধকারে সে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখছে। তার হেলেদুলে হাটার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তার বয়স পঁচিশের কম হবে। পাশে বসে মেয়েটা তার হাতের প্যাকেট থেকে বাদাম খেতে লাগল।
মেয়েটা বাদামের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল, নেন, বাদাম খান। নোমান কিছু না বলে বাদাম খেতে লাগল। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা বলল, যাবেন?
-কোথায়?
-আমার সাথে? আপনার সাথে যাব কেন?
-আপনার দেহের জ্বালা মেটাবেন, আর আমার পেটের জ্বালা মেটাবেন।
-মানে?
-সবকিছু খুলে বলতে হবে?
নাকি এখনই খুলে দেখাতে হবে? অবশ্য অন্ধকারে কিছু ভাল করে দেখতে পারবেন না। নোমান বুঝতে পারছে না সে কী বলবে। তাই চুপ করে আছে। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর নোমান জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কী?
-রূপা।
-ও।
আবার চুপ। রূপা তার ব্লাউজের ভিতরে হাত দিয়ে একটা চকলেট বের করে বলল, চকলেট খান। আর আমার সাথে চলেন, অনেক কিছু খাওয়াবো।
-দেখ বোন, আমি নিজেই অনেক সমস্যায় আছি।
-শালা, বোন ডাকিস ক্যান? আমারে দেখে তোর বোন মনে হয়? ভাগ শালা।
রাগে হনহন করতে করতে রূপা চলে গেল। নোমান বুঝতে পারছে না যে সারাজীবন সম্মান পেয়ে এসেছে আর আজ নাপিত, পাড়ার মেয়ে তাকে অপমান করেই যাচ্ছে। এদিকে তার যে কী হয়েছে সে নিজেই বুঝতে পারছে না। সে বেঞ্চটার উপর শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল।
হালকা ঝাঁকুনি লাগছে। এর আগেরবার জোরে ঝাঁকুনি হয়েছিল। এবার হালকা ঝাঁকুনি। মনে হচ্ছে কেউ তাকে ধরে ধাক্কাচ্ছে। নোমানের ঘুম ভেঙে গেছে। চোখ বন্ধ করে আছে এখনো। একটা পরিচিত কণ্ঠ তাকে বলছে, এই এখনো ঘুমাচ্ছ? দেখ তামিমের বউ এসেছে। নোমান কণ্ঠটা চিনতে পেরেছে। ওটা নীলিমার কণ্ঠ। কিন্তু তামিমকে চিনতে পারছে না। চোখ মেলে তাকাল নোমান। তার পেটে ব্যথার সময় যে চেয়ারটায় নীলিমা বসে ছিল, সেই চেয়ারটায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছরের এক মহিলা বসে আছে। নোমানের মনে হচ্ছে এটাই নীলিমা। কিন্তু একরাতের মধ্যে সে কিভাবে চেঞ্জ হয়ে গেল। নোমান উঠে বসল। নীলিমা গদগদকণ্ঠে বলল, দেখ, তামিম কি মিষ্টি একটা বউ নিয়ে এসেছে।
-তামিম কে?
-তোমার ঘুম এখনো কাটেনি? তামিম আমাদের একমাত্র ছেলে।
নোমান কিছুই বুঝতে পারছে না। তিন চারদিন আগে তার বিয়ে হল। এর মধ্যে তার ছেলে হয়েছে আবার সে বিয়েও করেছে। একটা মেয়ে ঘোমটা পরে এসে তাকে কদমবুসি করল। তারপর নোমানের দিকে তাকালে নোমান তাকে চিনতে পারল।
নোমান জিজ্ঞেস করল তাকে, তোমার নাম রূপা না? -জ্বি বাবা। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নোমান নিজের পুত্রবধূর দিকে। সেই দৃষ্টিতে শুধুমাত্র বিস্ময় ছাড়া আর কিছুই ছিল না।