২৯. মেঘ-ছোঁয়া উত্তুঙ্গ পাহাড় চূড়া
মেঘ-ছোঁয়া উত্তুঙ্গ পাহাড় চূড়ার রাজ্য তাভান্তিন্সুইয়ু! তার ইতিহাসের চরম বিপর্যয়ের সঙ্গে যিনি জড়িত তাঁর কাহিনী ওদেশের জলপ্রপাতের মতোই এবার মন্থর থেকে দ্রুত হয়ে মালভূমির ঊর্ধ্বলোক থেকে সবেগে সমতলে নেমে গিয়েছে।
প্রেত-প্রাসাদের সামনে বিমূঢ় অস্থির সওয়ার সৈনিকের দল যখন সোরাবিয়া আর হেরাদার নির্দেশে তাদের পলাতক ঘোড়ার সন্ধান করছে কোরিকাঞ্চায় সাময়িক ফৌজি আস্তানা হিসেবে দখল করা অতিথিশালায় তখন বেশ একটু সাড়া পড়ে গিয়েছে।
সাড়া পড়েছে ফেলিপিলিওর জন্যে। সে যেন হেরাদার কাছ থেকেই খবর পেয়ে তার হুকুমে সৌসা থেকে হুয়াসকার-এর হত্যার খবর-আনা দূতের সঙ্গে দেখা করতে। চেয়েছে। সঙ্গে আবার একজন কোরিকাঞ্চার ছোট মোহান্তকেও আনতে ভোলেনি। হেরাদার তাকে এ কাজে পাঠানো অবশ্য স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছে সকলের। দূত হিসেবে যে এসেছে সে প্রথম এখানে এলে তার কথা সম্পূর্ণ বুঝে বোঝাবার মতো দোভাষী কাউকে তো পায়নি। কোনও রকমে হুয়াসকার আর ভিলিয়াক ভূমুর নামগুলো বার বার উচ্চারণ করে মূক অভিনয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছে।
এখন ফেলিপিলিও তার কাছে সমস্ত ব্যাপারটা ভাল করে জেনে নিতে পারবে। কোরিকাঞ্চার ছোট একজন মোহান্তকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে সে সেই উদ্দেশ্যে। সৌসার কাছে রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভূমু সম্বন্ধে প্রশ্ন করবার জন্যে একজনকে দরকার।
হেরাদা সৌসার দূতের আনা খবর ভাসাভাসা ভাবে বুঝে, ব্যস্ত হয়ে মার্কুইস-এর খোঁজে প্রেত-প্রাসাদের উদ্দেশে যাবার আগে তার অধীন যে সৈনিকের ওপর আস্তানার ভার দিয়ে গেছল সে ফেলিপিলিও বা তার সঙ্গীকে সন্দেহ করবার কথা কল্পনাই করেনি। সন্দেহ করবার কোনও কারণই অবশ্য তার ছিল না। এসপানিওল বাহিনীতে বিশেষভাবে সম্মানিত ও একান্ত বিশ্বাসী দোভাষীর এরই মধ্যে কী গভীর রূপান্তর হয়েছে তা আর সে জানবে কেমন করে?
অতটা নিশ্চিন্ত বিশ্বাস না থাকলে সৌসার দূতকে ফেলিপিলিও ও তার সঙ্গীর সামনে এনে হাজির করবার পর একটা জিনিস অন্তত সে লক্ষ করত। চেষ্টা করা সত্ত্বেও ফেলিপিলিওর সঙ্গীর মুখে এক সঙ্গে বিস্ময়-আনন্দ-ভয় উত্তেজনার অস্থির অদম্য প্রকাশ তার দৃষ্টি তা হলে বোধহয় এড়াত না।
ফেলিপিলিওর সঙ্গী যে কে তা বোধহয় আর বলবার দরকারই নেই। কিন্তু সৌসার দূতকে দেখে তাঁর সহসা ভাবাবেগে এমন উদ্বেল হয়ে ওঠার কারণ কী?
কারণ এই যে সৌসার দূত হয়ে যে এসেছে সে আর কেউ নয়—কয়া। কামালকা থেকে সোনা-বরদার হয়ে যেভাবে সে কুজকোতে এসেছিল সেইভাবে যেন সদ্য কৈশোর-পার হওয়া তরুণের ছদ্মবেশে রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভুমুর কবল থেকে পালিয়ে এসেছে কোনওরকমে।
কিন্তু কেন তাকে পালিয়ে আসতে হয়েছে? দূত হিসেবে যে নিদারুণ সংবাদ সে এনেছে তা কি সত্য?
সমস্ত বিবরণই কয়ার কাছে তারপর শোনা গেছে। কিন্তু কোরিকাঞ্চার ফৌজি আস্তানায় নয়, কুজকো থেকে কাকসামালকা যাবার পথে।
সে দুর্গম পার্বত্য পথে দুটি তেজিয়ান ঘোড়া সওয়ার নিয়ে দুরন্ত বেগে তখন কাক্সামালকার দিকে ছুটে চলেছে। একটির ওপর সওয়ার হয়েছেন নারীবেশেই
কয়া-কে নিয়ে গানাদো। আর একটি চালাচ্ছে ফেলিপিলিও।
প্রাণপণ বেগে ঘোড়া দুটিকে চালানো হচ্ছে বটে, তবু নেকড়ের পালের মতো পেছনে ধাওয়া করা সোরাবিয়া ও হেরাদার বাহিনীকে এড়িয়ে পালানো কি সম্ভব হবে?
সোরাবিয়া ও হেরাদার সওয়ার দলের অনুসরণে রওনা হতে একটু বিলম্ব অবশ্য হয়েছে। গানাদো ফেলিপিলিওকে নিয়ে বার হয়ে প্রেত-প্রাসাদের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। প্রথমত সে দরজা খোলাতে কিছু সময় গেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় গেছে গানাদো আর ফেলিপিলিও যে সব ঘোড়ার বাঁধন কেটে ছেড়ে দিয়েছিলেন সেগুলি আবার খুঁজে আনতে।
সওয়ার দলের সকলকে জড়ো করে সোরাবিয়া হেরাদার সঙ্গে সেপাইদেরই দুটি ঘোড়ায় চড়ে আগের রাতের নিজেদের ফৌজি আস্তানায় যখন পৌঁছেছে তখন সকালের প্রথম আলো কোরিকাঞ্চার সূর্য-মন্দিরের মাথায় এসে লেগেছে।
সেখানে এসে খবর যা তারা পেয়েছে তা সত্যিই খেপিয়ে দেবার মতো।
হেরাদা যার ওপর আস্তানার ভার দিয়ে গেছল সেই অধীন সেনানী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জানিয়েছে যে, ফেলিপিলিওকে অবিশ্বাস করবার কথা সে ভাবতে পারেনি। হেরাদার হুকুম নিয়েই সে এসেছে মনে করে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে তাকে আর তার সঙ্গীকে সৌসার দূতের কাছে বিস্তারিত বিবরণ নেবার জন্যে ছেড়ে দিয়ে গেছে। তারপর ভোরবেলায় তাদের খোঁজ করতে এসে দেখেছে, অতিথিশালায় তারা কেউ নেই। অস্থির হয়ে কুজকো শহরের চারিধারে সে সন্ধান করিয়েছে তন্ন তন্ন করে। তাদের কোথাও পাওয়া যায়নি। শুধু ভীত দু-একজন কুজকোবাসীর মূক ইশারায় যা বোঝা গেছে তাতে সন্দেহ হয় দু-টি ঘোড়ায় চেপে কুজকো থেকে কাক্সামালকার পথেই. তাদের তিনজনকে যেতে দেখা গেছে।
সোরাবিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করে আর বৃথা সময় নষ্ট করেনি। তার প্রচণ্ড রাগ শুধু কয়েকটা কুৎসিত গালাগাল আর হতভাগা সেনানীর গণ্ডে বিরাশি সিক্কার চপেটাঘাতে প্রকাশ করে হেরাদাকে নিয়ে সেই মুহূর্তেই সে কাক্সামালকার পথে রওনা হয়েছে সমস্ত দল নিয়ে।
পলাতক দল কয়েক দণ্ড আগে বার হতে পেরেছে ঠিকই। কিন্তু কতক্ষণ তারা এগিয়ে থাকতে পারবে। দুটি মাত্র ঘোড়া তাদের সম্বল! এসপানিওল রিসালার মতো বাড়তি ঘোড়া তাদের সঙ্গে নেই। নেই সেপাই আর ঘোড়ার দানাপানির ব্যবস্থাও।
একটি ঘোড়ার সওয়ারি আবার তাদের দুজন।
যত তাড়াতাড়িই রওনা হয়ে প্রাণপণে ঘোড়া ছোটাক না কেন, কামালকা পৌঁছোবার আগেই ধরা তারা পড়তে বাধ্য। এ পথের কোথাও কোনও ফ্যাকড়াও নেই যে তা দিয়ে পালাবার চেষ্টা করবে। কুজকো থেকে কামালকায় নামার পাহাড়ি দুর্গম সংকীর্ণ পথ ওই একটিই।
নিজের ঘোড়ার পিঠে কয়াকে নিয়ে ফেলিপিলিওর সঙ্গে যথাসাধ্য তাড়াতাড়ি কাক্সামালকার দিকে নামতে নামতে গানাদো নিজেই সে কথা ভাল করে বুঝেছেন। তাঁরা এসপানিওল রিসালার দুটি সেরা ঘোড়া পেয়েছেন ঠিকই। কিন্তু শুধু দুটি ঘোড়া নিয়ে সোরাবিয়ার এসপানিওল সওয়ার দলের সঙ্গে তাঁদের ব্যবধান বেশিক্ষণ বজায় রাখা যাবে না।
সোনাবরদার দলে যে তার সঙ্গী হয়েছিল সেই পাউলো টোপা থাকলে এই দুর্গম পাহাড়ি পথেও শুধু ইংকা বংশের লোকদের জানা গোপন লুকোবার জায়গার হদিস দিতে পারত। কিন্তু ফেলিপিলিও সামান্য একজন নাগরিক মাত্র, অভিজাত বংশেরও নয়। সে এসব আস্তানার কিছুই জানে না। কন্যাশ্রমের চার দেয়ালের মধ্যে লালিতা সূর্যকুমারী হিসেবে কয়ার তো এসব কিছু জানবার সুযোগই হয়নি জীবনে।
পেছনে হিংস্র নেকড়ের পালের মতো যারা আসছে তাদের হাতে ধরা পড়া অনিবার্য জেনেও গানাদো অবশ্য আত্মসমর্পণের জন্যে প্রস্তুত হয়নি। তাঁর পিঠের সঙ্গে লগ্ন কয়ার কোমল দেহের মধুর উত্তাপ সমস্ত শিরায় শিরায় প্রবাহিত রক্তস্রোতে অনুভব করে চরম হতাশার মধ্যেও আসন্ন ভয়ংকর নিয়তি ঠেকাবার উপায়ের কথা ভেবেছেন।
ইতিমধ্যে কয়ার কাছে সৌসার নিদারুণ বিপর্যয়ের বৃত্তান্ত বিশদভাবে শুনেছেন। ঘোড়ার পিঠে তাঁকে দু বাহুতে বেষ্টন করে পিছনে বসে কয়া তাঁর কানের কাছে মুখ রেখে সে বিবরণ শুনিয়েছে।
রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমু প্রথমে হুয়াসকারকে কয়ার বিরুদ্ধে সন্দিগ্ধ ও বিরূপ করে তোলবার চেষ্টা করেন। কোরাকেঙ্কুর দুটি পালক আর ইংকা নরেশের উষ্ণীষের রক্তিম ল্লান্টুর টুকরোটুকুর দরুন সে চেষ্টা বিফল হবার পর তিনি যে অমন পৈশাচিক চক্রান্ত করবেন কয়া তা ভাবতে পারেনি। যে সন্ধ্যায় ভিলিয়াক ভমুর সামনে হুয়াসকারকে তার অভিজ্ঞান দেখিয়ে সে নিজের বিশ্বস্ততার প্রমাণ দেয় তার পরের দিন ভোর না হতেই সে আবার গিয়েছিল হুয়াসকার-র বিশ্রাম কক্ষে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে। গানাদোর শিখিয়ে দেওয়া কয়েকটি কথা গোপনে হুয়াসকারকে তার বলার ছিল।
হুয়াসকার তখনও তাঁর কারা-নিবাসেই আছেন। তাঁর কক্ষদ্বারে কোনও প্রহরী কিন্তু নেই। আতাহুয়ালপার নির্দেশেই রাজপুরোহিতকে বাধ্য হয়ে যে হুয়াসকারকে। মুক্তি দিতে হয়েছে এটিই তার একটি নিদর্শন মনে হয়েছে কয়ার। নিশ্চিন্ত মনে ভেতরে গিয়ে ঢোকবার পর তাই সে স্তম্ভিত বিহ্বল হয়েছে অত বেশি। বিশ্রামকক্ষের দরজাতেই হুয়াসকার-র রক্তাক্ত মৃতদেহ তার চোখে পড়েছে। পিঠের দিকে বেঁধানো ছুরিসমেত হুয়াসকার-এর মৃতদেহ যেভাবে সেখানে পড়ে আছে তাতে একবার দেখলেই বোঝা যায় যে, হুয়াসকার অসন্দিগ্ধভাবে বিশ্বাসযোগ্য কারও সঙ্গে আলাপ সেরে বিদায় নেবার সময়ই পৃষ্ঠে এ ছুরিকাঘাত পেয়েছেন।
কয়া সরল অনভিজ্ঞ হলেও নির্বোধ নয়। তীক্ষ্ণ সহজ বুদ্ধিতে সে পৈশাচিক চক্রান্তটা অনুমান করতে পেরেছে, হুয়াসকারকে এভাবে নিহত অবস্থায় আবিষ্কার করা মানে সমস্ত অপরাধ নিজের ওপর নেওয়া। সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হুয়াসকার-এর সঙ্গে পরামর্শ করতে আসবে জেনেই বোধহয় রাজপুরোহিত আগের রাত্রে এ ফাঁদ পেতেছিলেন। বিশেষ প্রয়োজনে একলা দেখা করবার ছুতোয় এসে। গভীর রাত্রে ভিলিয়াক ভমুই বিদায় দেবার সময় পিছু ফেরার পর হুয়াসকারকে কাপুরুষের মতো হত্যা করেছেন এ বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই। তারপর কয়াকেই এ হত্যার জন্যে দায়ি করার ব্যবস্থা করেছেন। এক ঢিলে তাতে দু-পাখি মারবার সুবিধে হয়েছে। পথের কাঁটা হিসেবে হুয়াসকার দূর হয়েছে নিহত হয়ে, আর আতাহুয়ালপারও সর্বনাশের আয়োজন হয়েছে তিনিই দূতী পাঠিয়ে এ কাজ করিয়েছেন বলে প্রমাণের ব্যবস্থা করে।
কয়া একটু বেশি ভোরে আসার দরুনই বোধহয় হাতে হাতে ধরা পড়ার ব্যবস্থাটা এড়াতে পেরেছে। রাজপুরোহিত তাঁর সাজানো ভূমিকাটা নিতে আসার জন্যে তখন বোধহয় তৈরি হচ্ছেন।
আর এক মুহূর্ত সেখানে অপেক্ষা করেনি কয়া। শুধু নারীবেশের বদলে সোনাবরদার হিসেবে যে সাজে এসেছিল তা-ই পরে সে গুপ্ত গিরিপথে কুজকোতে রওনা হয়েছে। অমূল্য অভিজ্ঞান কোরাকেঙ্কুর পালক আর প্লান্টুর টুকরোর দরুন সে পথে কোথাও কোনও বাধা তাকে পেতে হয়নি।
কুজকো-তে এসে পৌঁছোবার পর আর একবার কিন্তু কয়াকে দিশাহারা হতে হয়েছে।
কুজকো শহরে এসপানিওল রিসালার উপস্থিতি তার কাছে স্বপ্নাতীত ঘটনা। এ শহরে কেমন করে কোথায় সে গানাদোর সন্ধান করবে। বিদেশি পাষণ্ডদের ভয়ে। দেশের মানুষ যেন মাটির তলায় গর্ত খুঁড়ে লুকিয়েছে। কোরাকেঙ্কুর পালকের এখানে কোনও দাম নেই।
শেষ পর্যন্ত সৌসার দূত সেজে এসপানিওলদের মধ্যেই গিয়ে আশ্রয় নেবার ছল তার মাথায় যে এসেছে সেটা তার বুদ্ধির বাহাদুরি বলতে হয়। এসপানিওল সেপাইদের হাতে প্রায় ধরা পড়তে পড়তে নিজেকে বাঁচাবার জন্যে এ ফন্দি তাকে অবশ্য ভাবতে হয়েছিল। এই ফন্দিতে সত্যি সত্যি সেই রাত্রেই গানাদোর দেখা পাওয়ার ও তার সঙ্গেই পালাবার সুযোগ মেলার মতো অঘটন ঘটবার আশা অবশ্য সে করেনি।
ফেলিপিলিওর সঙ্গে কোরিকাঞ্চার একজন ছোট মোহান্ত সেজে হুয়াসকার-এর হত্যার খবর নিতে এসপানিওল সওয়ারদের শিবিরে এসে দূত হিসেবে কয়াকে দেখেই গানাদো আর সেখানে সময় নষ্ট করা উচিত মনে করেননি। হেরাদার প্রতিনিধির মাথায় তাঁদের ওপর পাহারা রাখবার কল্পনাই ছিল না। সেই সুযোগ নিয়ে তৎক্ষণাৎ তিনি ফেলিপিলিও আর কয়াকে নিয়ে তাঁদের দখল করা ঘোড়ায় চড়ে রওনা হয়েছেন। সুস্পষ্ট কোনও পরিকল্পনা তখন তাঁর মাথায় ছিল না। কুজকো শহর আর এক মুহূর্তও তাঁদের পক্ষে নিরাপদ নয় বুঝে যত দূরে সম্ভব তা থেকে চলে যেতেই শুধু চেয়েছেন।
প্রায় অর্ধেক রাত সমানে ঘোড়া চালিয়ে কুজকো থেকে বেশ কিছু দূরে যে আসতে পেরেছেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তা সত্ত্বেও ক্রমশই তাঁর মনে হয়েছে যে কুজকো শহরেই লুকিয়ে থাকবার চেষ্টা করলে যা হত তার চেয়ে বেশি বিপজ্জনকই হয়ে উঠেছে তাঁদের অবস্থা। তাঁদের ঘোড়া দুটি ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে আসছে। পথে তেষ্টা মেটাবার জল একেবারে দুষ্প্রাপ্য না হলেও খাদ্য পাবার কোনও আশাই নেই। মানুষ যদি বা উপবাসী হয়ে দীর্ঘকাল যুঝতে পারে, ঘোড়ার মতো প্রাণীর পক্ষে খাবার না পেলে এই দুর্গম পার্বত্য পথে বেশিদূর সওয়ার বয়ে ছোেটা অসম্ভব। ক্রমশই তাদের গতি মন্থর হতে হতে শেষ পর্যন্ত তারা ভেঙে পড়বেই।
রাত কেটে গিয়ে কিছুটা বেলা বাড়বার পর এক জায়গায় বাধ্য হয়েই গানাদোকে ফেলিপিলিওর সঙ্গে তাঁদের ঘোড়া রুখতে হয়েছে তাদের একটু বিশ্রাম করতে দেওয়ার জন্যে। রাস্তার ধারে ফেলিপিলিওকে ঘোড়ার পাহারায় রেখে কয়াকে নিয়ে। গানদো কাছের একটা পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে উঠেছেন। এ শিখরদেশ থেকে কুজকো ও কাক্সামালকার যোগাযোগের আঁকাবাঁকা পার্বত্য পথ সামনে পেছনে অনেকখানি দেখা যায়।
দূরবিন তাঁদের ছিল না। তখনও পর্যন্ত দূরবিন যন্ত্র উদ্ভাবিতই হয়নি। কিন্তু খালি চোখে সামান্য যেটুকু দেখতে পেয়েছেন তাতেই গানাদোর মুখে হতাশার হাসি ফুটে উঠেছে।
কয়ার দিকে ফিরে মুখে সেই হাসি নিয়েই বলেছেন, আর ঘোড়াগুলোর সঙ্গে নিজেদের হয়রান করে কোনও লাভ নেই, কয়া। এখানে এই চূড়ার ওপর বসে থাকলেও যা হবে ঘোড়া ছুটিয়ে পালাবার চেষ্টা করলেও তা-ই।
কয়ার দৃষ্টিশক্তি গানাদোর চেয়েও বুঝি তীক্ষ্ণ। খাড়া সব পাহাড়চূড়াকে যেন কোনও মতে জড়িয়ে কুজকো থেকে সরু একটা ফিতের মতো যে পার্বত্য পথ ঘুরে ঘুরে নেমে এসেছে তার বহুদূরের একটি বাঁকে একরাশ পিঁপড়ের মতো এসপানিওল সওয়ার সৈনিকদের সে ভালভাবেই তখন দেখতে পেয়েছে। সে সওয়ার দলের তাদের কাছে পৌঁছোতে অবশ্য তখনও অনেক দেরি। কিন্তু নিজেরা তৎক্ষণাৎ রওনা হয়েও সে বিলম্বটা আর একটু বাড়ানো যাবে মাত্র। তার বেশি কিছু নয়। কামালকায় পৌঁছোলেই যে তারা নিরাপদ তা মোটেই নয়। তবু সেখানে পর্যন্ত পৌঁছোনো তাদের হবে না। তার অনেক আগেই এসপানিওল রিসালার কাছে তাদের। ধরা পড়তে হবেই।
ম্লান একটু হেসে সেই কথাই বলেছে কয়া, সত্যি, কোথায় ধরা দেব, এখানে, না আরও দূরে কোথাও, শুধু এইটুকুই এখন আমরা বেছে নিতে পারি।
হ্যাঁ—গানাদোর স্বর এই প্রথম যেন বড় বেশি ক্লান্ত শুনিয়েছে—আমাদের ধরে ফেলতে ওদের খুব কষ্টও করতে হবে না। কারণ পথ এই একটাই, আর আমরা বাদে তাতে আর কোনও যাত্রীও নেই।
কথাগুলো বলতে বলতে গানাদোর চোখে হঠাৎ যে ঝিলিকটা দেখা গেছে সেটা কি অমোঘ নিয়তির বিরুদ্ধে অসহায় নিষ্ফল আক্রোশের?
আগের পর্ব:
০১. অর্থাৎ তস্য তস্য
০২.হাসির লহরী কী হিংসার তুফান
০৩. বাজির খেলা
০৪. ভুলতে বারণ করেছিলেন
০৫. রাজধানী পানামায়
০৬. মোরালেস-এর ক্রীতদাস
০৭. উৎসবের আনন্দ কোলাহল
০৮. কুড়ি বছর বাদে আবার
০৯. সোরাবিয়ার শয়তানি ফন্দি
১০. আনা শেষ পর্যন্ত
১১. পিজারোর সেভিল-এর বন্দরে
১২. গাঢ় কুয়াশাচ্ছন্ন রাত
১৩. মার্কুইস আর মার্শনেস গঞ্জালেস
১৪. সূর্য কাঁদলে সোনার দেশ
১৫. তৃতীয় অভিযানেও পিজারো
১৬. মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা
১৭. ইংকা আতাহুয়ালপা
১৮. আতাহুয়ালপা যখন পিজারোর ভোজসভায়
১৯. ঘনরামকে তাঁর নির্দিষ্ট সেনাবাসে
২০. দিনের আলোর জন্যে অপেক্ষা
২১. মেয়েটির সমস্ত রহস্য
২২. প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপের সঙ্গে
২৩. অনুমান ভুল হয়নি গানাদোর
২৪. কয়ার ভিকুনার পশমে বোনা থলি
২৫. সূর্যদেবের উত্তরায়ণ
২৬. গানাদো অনেক কিছুই ভাবেন
২৭. কী করছেন তখন গানাদো
২৮. সোরাবিয়া ফেলিপিলিও
পরের পর্ব:
৩০. হেরাদা ও সোরাবিয়ার তাড়নায়
৩১. বন্দরে জাহাজ লাগাবার পর
৩২. পানামা থেকে বার হওয়া
৩৩. বন্দরের নাম নোমব্রে দে দিয়স
৩৪. ফেরারি গোলাম বলে চিহ্নিত হয়ে