বিরিয়ানি

বিরিয়ানি

মসজিদ থেকে বের হয়েই বিরিয়ানির প্যাকেট খুললো রাজন। প্যাকেটটা নাকের কাছে নিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো। আহ! কতোদিন পর আজ আবার বিরিয়ানি খাওয়া হবে। একপাশে দুইটা মাংসের টুকরা উকি দিচ্ছে, সাথে বড়সড় একপিস হাড্ডি। আলু আছে দুইপিস। বাসায় যাওয়ার তর সইছে না রাজনের। সে একমুঠো বিরিয়ানি তুলে মুখে দিলো। মিলাদের বিরিয়ানির টেস্টই অন্যরকম। একটুকরো মাংস মুখে নিলো। এটা গরু না খাসি, কে জানে! মনে হচ্ছে গরুই। খাসি দেয়ার জন্য টাকা বেশি লাগবে, অতো টাকা আফজাল চাচার কই? বিরিয়ানির টাকাটা কোথেকে যোগাড় করেছে তাই বা কে জানে। আহারে!

মানুষটা একদমই ভেঙে পড়েছে। একমাত্র ছেলের আকস্মিক মৃত্যু বাবার কাছে কতটা কষ্টের সেটা বাবা না হলে কেউ বুঝতে পারেনা। আর সমাজের নিয়ম দেখো! তিনদিন পর মসজিদে মসজিদে দোয়ার নাম করে খাওয়াদাওয়া। বিরিয়ানি না দিলে চলেই না। এর নামই নাকি সামাজিকতা! ভীষণ রাগ হয় রাজনের। সাথে অবশ্য একটু একটু ভালোও লাগে। কতদিন পর একবেলা পেটপুরে বিরিয়ানি খাওয়া হবে। ও লাস্ট বিরিয়ানি খেয়েছিলো তাও প্রায় দেড়মাস আগে। মজিদ আঙ্কেলের বৃদ্ধ বাবা মারা গেলেন হার্ট এটাকে, সেটারই মিলাদ ছিলো। সেবার অবশ্য কাচ্চিই ছিলো। মজিদ আঙ্কেলের তো আর টাকার অভাব নেই।

বিরিয়ানি রাজনের ভীষণ প্রিয় খাবার। ভীষণ প্রিয়। ও এই জিনিসের জন্য একদম পাগল যাকে বলে। বিরিয়ানি পেলে মাথা ঠিক থাকেনা। ওর ইচ্ছা করে প্রতিদিনই খেতে, কিন্তু সে ভাগ্য নিয়ে তো জন্ম হয়নি রাজনের। এক প্যাকেট হাফ বিরিয়ানির দামও সেই নব্বই টাকা। যে টাকায় চাল হয় প্রায় সাড়ে তিন কেজি। এই চাউলে ওদের বাসায় দুইদিন রান্না হয়। সুতরাং রোজ রোজ বিরিয়ানি খাওয়ার ইচ্ছা থেকে যায় স্বপ্ন হিসাবেই।

রাজনের বাবা নেই। মা মানুষের বাসায় ঝিয়ের কাজ আর ঘরে দর্জিগিরি করে কোনোমতে সংসার চালায়। বাড়িতে দুই বোন আর ছোট এক ভাই, মোট পাঁচজনের সংসার। অতএব এলাকায় কেউ মারা গেলেই শুধুমাত্র একবেলা বিরিয়ানি জোটে রাজনের। তাও সবসময় না। গত সপ্তাহে মনিরের মা মারা গেলে মিলাদে মাংস খিচুড়ি দিয়েছিলো। খিচুড়ি খেতেও ভাল্লাগে ওর, তবে বিরিয়ানির মতো অতটা না। কই বিরিয়ানি আর কই খিচুড়ি। যেদিন ঐ মহিলা বিষ খেয়ে মারা গেছিলো সেদিন থেকেই মনের মধ্যে বিরিয়ানি খাওয়ার সুপ্ত একটা আশা ছিলো রাজনের। খিচুড়ি দেখে তার হয়েছিলো আশাভঙ্গ।

রাস্তা দিয়ে হেটে যেতে যেতেই বিরিয়ানির প্রায় তিনভাগের দুইভাগ শেষ করে ফেলেছে রাজন। আর অল্প কিছু অবশিষ্ট পড়ে আছে প্যাকেটের এক কোণে। আবার কবে বিরিয়ানি খেতে পাবে ও কে জানে! নাহ, খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে পারবেনা রাজন। কিছু টাকার যোগাড় করলে কেমন হয়? যাই হোক, কিছু একটা করতে হবে অন্তত। আহ বিরিয়ানি! আলতাফ চাচার ছোট ছেলে রাজু বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। সেটা দেখেই আরো বিরিয়ানি খাওয়ার আইডিয়া মাথায় আসলো ওর। হাত ইশারায় ছেলেটাকে ডাক দিলো রাজন।

একসপ্তাহ পর মসজিদের সামনে বিরিয়ানির প্যাকেট হাতে রাজন দাঁড়িয়ে আছে। গরম গরম বিরিয়ানির সাথে কয়েক পিস খাসির মাংস। প্যাকেট থেকে ধোঁয়ার সাথে ঘ্রাণ বেরোচ্ছে। আহ! বুকভরে সুঘ্রাণ টেনে নিলো ও। মসজিদ থেকে লাইন দিয়ে প্যাকেট নিয়ে মানুষ বের হচ্ছে। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আলতাফ চাচা বিষণ্ণ মুখে সবার হাতে বিরিয়ানির প্যাকেট তুলে দিচ্ছেন। আহারে! মানুষটা একদমই ভেঙে পড়েছে। রাজু ছিলো তার শেষ বয়সের ছেলে। বড়ই আদরের সন্তান। আহারে!

এই নিয়ে গ্রামে এটা দ্বিতীয় খুন হলো। এক লোকমা বিরিয়ানি মুখে তুলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলো রাজন। খেতে বেশ স্বাদ হয়েছে। আশেপাশে তাকালো। অনেকগুলো ছোট ছোট বাচ্চা দেখা যাচ্ছে। একটুকরো মাংস মুখে দিলো। সামনের জুম্মাবারে আরেক প্যাকেট পেলে মন্দ হতো না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত