আহাদ সাহেবের সাথে আমার পরিচয় রিকশায়। আমি রিকশার প্যাসেঞ্জার সিটে, আর তিনি চালাচ্ছেন। নীলক্ষেত থেকে উঠেছি, ক্যাম্পাসে যাবো। রিকশায় উঠলে রিকশাচালকদের সাথে কথা বলার পুরনো অভ্যাস আমার।
–নাম কি আপনার?
–আব্দুল আহাদ।
–আহাদ সাহেব, আপনি যে ২০ টাকার ভাড়া ৪০ টাকা চাইলেন, কাজটা কি ঠিক করলেন?
রিকশা চালাতে চালাতে পেছন ফিরে আহাদ সাহেব একবার অবাক চোখে তাকালেন আমার দিকে। সম্ভবত এই প্রথম কেউ তাকে সাহেব ডাকলো।
–শুরুতে বেশী চাওন লাগে। আমি ২০ টাকা চাইলে আমনে বলতেন ১০ টাকায় যাইবেন?
–অন্যরা হয়তো বলতো কিন্তু আমি বলতাম না। আপনি ৪০ টাকা থেকে যে ২০ টাকায় নামলেন, এটা কি ঠিক হলো? আপনি হবেন এক কথার মানুষ। ২০ টাকা বলবেন, ২০ টাকাই। কথার নড়চড় নাই….
আমার মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই ধাক্কাটা লাগলো। হাকিম চত্বরের কাছে চৌরাস্তায় ডান সাইড থেকে হঠাৎ করে আসা একটা পিকআপ ধাক্কা দিলো ঠিক রিকশার সামনের চাকা বরাবর। আমি ছিটকে পড়লাম রাস্তায়। ব্যাথায় অন্ধকার দেখলাম কিছুক্ষণ। চোখ খুলে দেখি আহাদ সাহেব আরেকটু দূরে পড়ে আছেন। মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে রাস্তা লাল হয়ে আছে। চল্লিশের মতো বয়স, মুখটা তখনো হাসি হাসি।
আমার কয়েক জায়গায় কেটে গেলেও সিরিয়াস কোন ব্যাথা পাইনি। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালাম। চারদিকে ভীড় জমে গেছে। রাস্তার দুইজনের সহায়তায় আহাদ সাহেবকে নিয়ে গেলাম ঢাকা মেডিকেলে। কাঁটাছেড়ার জন্য সামান্য ব্যান্ডেজ আর ব্যাথার ওষুধ দিয়ে আমাকে ছেড়ে দিলো। কিন্তু আহাদ সাহেবের অবস্থা গুরুতর। দুই ব্যাগ রক্ত লাগবে। ব্লাড গ্রুপ মিলে যাওয়ায় এক ব্যাগ আমি দিলাম, আরেক ব্যাগ জোগাড় করলাম।
আহাদ সাহেবের মোটামুটি সুস্থ হতে আট দিন লাগলো। প্রথম দুইদিন আমিই ছিলাম পাশে, তৃতীয় দিনে উনার স্ত্রী আর আট বছরের কন্যার খোঁজ পাওয়া গেলো। এর মাঝে একটা ইনকোর্স পরীক্ষা, দুইটা ক্লাস মিস হয়ে গেলো। তারচেয়ে বড় কথা, আহাদ সাহেবের চিকিৎসার খরচ সাড়ে সতেরো হাজার টাকা জোগাড় করতে নাভিশ্বাস উঠে গেলো আমার। হলে থাকি, টিউশনি করি। সাড়ে সতেরোশো টাকাই অনেক টাকা, আর এখানে সাড়ে সতেরো হাজার। আহাদ সাহেবের স্ত্রী হাতের দুইটা চুড়ি বিক্রি করে দশ হাজার টাকা আনলেন, আমি ধারদেনা করে পাঁচহাজার আনলাম। বাকি আড়াইহাজার হসপিটাল কর্তৃপক্ষ মাফ করে দিলেন।
— আপনে কি কামডা ঠিক করলেন?
— কি করছি?
— আপনে অন্য রিকশায় উঠছেন ক্যান আজকে দুপুরে?
— তাড়া ছিল একটু, আপনাকে ফোন দেয়ার সময় ছিল না।
— আমি আহাদ বাঁইচা থাকতে আপনের ভাড়া দিয়া অন্য রিকশায় ওঠা বন্ধ। স্টপ। ফিনিশ। কল দিবেন, আমি উইড়া আসমু। দরকার হইলে প্যাসেঞ্জার মাঝপথে নামাই দিয়া চইলা আসমু।
আমি হাসলাম। গত তিন বছর ধরে আহাদ সাহেব আমাকে নিয়ে রিকশা চালায়। সকালে হলের সামনে এসে দাঁড়ায়, আমি ক্লাসে আসি। তারপর ক্ষ্যাপ মারতে যায়। বন্ধুরা দেখে হাসে, কেউ কেউ টিপ্পনি মারে। আমার ক্লাস রুটিন উনার মুখস্ত। ক্লাস শেষ হলে বের হয়ে দেখি রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। গত তিন বছরে একদিনও ব্যতিক্রম হয়নি। জরুরী কাজে কোথাও যেতে হলে উনাকে ফোন দিতে হয়। কিছুক্ষণের মাঝেই এসে হাজির। ক্ষ্যাপ নিয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে যান না, যাতে ফোন দিলে সবসময় পাই। অন্য কোন রিকশায় উঠলে রাগ করেন, শিশুসুলভ অভিমান। যেমন আজকে। আমি অনেক মানা করেছি, কোন কিছুতেই তাকে মানানো যায় না। এই ব্যাপারে প্রচন্ড একগুঁয়ে, একরোখা। কখনোই ভাড়া নেয় না, কোনো কিছুতেই নেওয়ানো যায় না।
বিকালে টিউশনিতে যাই। রাতে ফেরার পথে আমরা রিকশায় ঢাকা শহর ঘুরি। চা খাই। আড্ডা দেই। সত্যি বলতে তিন বছরে আহাদ সাহেব আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়ে গেছেন। মন খুলে গল্প করি উনার সাথে। তিন বছরে আহাদ সাহেবের আর্থিক অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। গ্রামে জমিজমার বিবাদের জন্য সর্বস্ব হারিয়ে ঢাকায় এসে রিকশা চালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিছুদিন আগে বিবাদ মিটেছে আমার এক পুলিস আত্মীয়র সহায়তায়। কিছু জমি বিক্রি করে পুরান ঢাকায় তেহারির দোকান দিয়েছেন, তার ছোটভাই চালায়। মাঝে মাঝে বলি,
— আহাদ সাহেব, আর কতদিন রিকশা চালাবেন? টাকাপয়সা তো কামাচ্ছেন, এবার একটু আরাম করেন।
— যতদিন বাঁইচা থাকি, রিকশা চালামু। আপনের রক্ত যতদিন আমার শইলে আছে, আপনের জন্য রিকশা চালামু।
–মানুষের শরীরে রক্ত চার মাস বাঁচে। এরপর নতুন রক্ত তৈরী হয়। আমার রক্ত যা ছিলো, ফিনিস হয়ে গেছে এতোদিনে।
— আপনেরে কইছে। দুই পাতা পইড়া বেশী জাইনা গেছেন? রক্ত আজীবন থাকে শইলে। আমি বুঝাতে যাই, তর্ক শুরু হয়।
রাত বাড়ে। আহাদ সাহেবের সাথে ঢাকা শহর ঘুরছি আমি। আমি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা শেখাই, গল্প করি। আহাদ সাহেব মনোযোগী শ্রোতার মতো শোনে। ডিপার্টমেন্টের গল্প, বন্ধুদের গল্প, বান্ধবীদের গল্প, স্যারদের গল্প, টিউশনির গল্প। মাঝে মাঝে কঠিন কঠিন পড়ালেখা আর বিজ্ঞানেরও গল্প। গাউসের ছোটবেলার গল্প, এডিসন কিভাবে এডিসন হলো, আর্কিমিডিসের ইউরেকা, লাইবনিজের ক্যালকুলাস, ফার্মার লাস্ট থিওরেমের গল্প। আহাদ সাহেব কিছু বুঝে, কিছু বুঝে না। মাঝে মাঝে প্রশ্নও করে,
— এই যে মনে করেন আপনে রিকশায় বইসা আছেন। এখন আপনে পা দিয়া যতই ঠেলেন, রিকশা কিন্তু এক পাও সামনে যাইবো না। এইডা ক্যামনে হয়? আমি তখন নিউটনের তৃতীয় সুত্র বুঝাই। আহাদ সাহেব উপহাসের হাসি হাসে।
— আমি মাটিতে ঠেলা দিলে মাটিও আমারে ঠেলা দেয়? এইসব উল্টাপাল্টা ভুলভাল পড়াইয়া ভার্সিটি আমনেগো মাথাটা নষ্ট করতেছে।
আমরা একটা টংয়ে দাঁড়াই, চা খাই। এই শহরের বেশীরভাগ চায়ের দোকানদার আমাদের চিনে। রাতে এক পাগলা কিসিমের এক ভার্সিটির ছেলে আর এক রিকশাওয়ালা ঘুরে বেড়ায়। আরেকটু রাত হলে আহাদ সাহেবের ঘরে যাই, উনার মেয়েকে পড়াই। উনার মেয়ের বয়স এখন এগারো, আমাকে দেখলে বাবার মতোই অভিমান করে। “চাচ্চু, এতো দেরী করে আসো কেনো?”
— আপনেরে একটা কথা বলবো। শহীদ মিনারের সামনে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন আহাদ সাহেব।
— কি কথা?
— আমার একটা শখ, আপনে যখন বিয়া করবেন, কোন পেরাইভেট ভাড়া করবেন না। আমার রিকশাতে যাইবেন, আমার রিকশাতে বৌ নিয়া আসবেন। আমি টাকা জমাইছি, বিয়ার দিন নতুন রিকশা কিনবো। আপনাদের দুইজনরে নিয়া রিকশা চালাবো।
— বিয়ের দিন রিকশায়? বৌ তো কিপটা বলে বিয়ের আগেই তালাক দিয়ে দিবে।
— দিবো না। আপনার বৌ আপনার মতোই ভালো হইবো। উনারে আর আপনারে নিয়া রিকশায় বের হবো। আপনারা পিরিতের আলাপ করবেন, আমি কানে হেডফুন দিয়া রাখবো। আমি হাসি চাপতে চাপতে বললাম,
— আহাদ সাহেব, মনে করেন পড়ালেখা শেষে আমার বড় চাকরী হলো। অফিস থেকে তো গাড়ি দিবে। তখন তো গাড়িতে চড়তে হবে। তখন কি করবেন? আহাদ সাহেবের মুখের হাসি চুপসে গেলো। চুপ করে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। স্পষ্ট দেখতে পেলাম, চোখের কোণে হালকা একটু জল চিকচিক করছে। আমি বিব্রত হয়ে গেলাম। কথাটা বলাই উচিৎ হয়নি। অনেকক্ষণ চুপ থেকে আহাদ সাহেব মৃদু স্বরে বললেন,
-তাইলে আর কি করার, ডেরাইভিংটা শিখা লাগবো। এই মাসেই শুরু কইরা দেই, কি কন? এক ওস্তাদের লগে আমার চিনা-পরিচয় আছে। বাস চালানি শিখলে পেরাইভেটও পারমু, ঠিক কি না? আমি এবার হতম্ভব হয়ে যাই। এটাকে কি বলা যায়? ভালোবাসা? ভ্যালেন্টাইনদের যুগে, রিকশাওয়ালাদের চড় মারার যুগে এই ভালোবাসার স্থান কোথায়?